গপ্পো তক্ক যুক্তি
কেন আপনি সবকিছু দেখাবেন না : ল্যারি ক্লার্ক
পুরো নাম লরেন্স ডোনাল্ড ক্লার্ক। ১৯৪৩ সালের ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা রাজ্যের তুলসায় জন্ম তাঁর। যুক্তরাষ্ট্রের সেরা স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে স্থান করে নেন নিজের প্রথম ছবি ‘কিডস’ (১৯৯৫)-এর মাধ্যমে। এ ছবি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। নন্দিত ও নিন্দিত এই ছবি কি কেবল ল্যারির বেপরোয়া চলচ্চিত্র মানসের বহিঃপ্রকাশ, নাকি অবক্ষয়ের ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার সাহসী প্রয়াস—এ নিয়ে রয়েছে বিস্তর বাহাস। এ বিষয়ে ‘দ্য টকস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্পষ্টই নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন ল্যারি। ‘কিডস’ ছাড়াও ল্যারির ‘অ্যানাদার ডে ইন প্যারাডাইস’ (১৯৯৮), ‘বুলি’ (২০০১), ‘কেন পার্ক’ (২০০২), ‘ওয়াসআপ রকার্স’ (২০০৫) ছবিগুলো বিখ্যাত।
মিস্টার ক্লার্ক, আপনি কি এখনো স্কেটবোর্ড চালান?
না, ওটার থেকে অবসর নিয়েছি। যে পরিমাণে ব্যথা পেয়েছি আর আহত হয়েছি যে, তাতে সেরে উঠতে আমার সারা জীবন লেগে যেতে পারে। তবে সেদিন কিছু বাচ্চার সঙ্গে মিনিট পাঁচেক স্কেটিং করেছিলাম। একটা চান্স নিয়েছিলাম আর কী বলতে পারেন।
যাদের সঙ্গে স্কেটিং করছিলেন, ওদের ছবি তোলা আপনার জন্য কতটা কঠিন ছিল? আপনার কি ওদের বোঝাতে হয়েছিল যে আপনি কে?
আসলে ‘কিডস’-এর ব্যাপারে সবাই জানে। কাজেই সে পরিচিতির বিষয়টা তো একরকম কাজ করেই, মজার ব্যাপার। একদিন আমি একটা স্কেটিং পার্কে, হঠাৎ বছর পনেরোর মতো বয়সের একটা ছেলে আমার কাছে এলো। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি স্কেট করো?’ আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি করতাম বটে, তবে এখানে এসেছি অন্য কাজে, এই ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে। আমি ওদের নিয়ে একটা ছবি বানাচ্ছি, আমি একজন ফিল্মমেকার। সে বলল, ‘তাই নাকি?’ আমি বললাম, আমি এর আগে ‘কিডস’ নামের একটা ছবি বানিয়েছিলাম। তুমি কি এর নাম শুনেছ? তখন সে বলল, ‘সবাই এর নাম শুনেছে!’
ছোটদের সংস্কৃতি বা জীবনযাপন নিয়ে আপনি ঠিক কী কারণে এত আগ্রহী? কারণ তারা বর্তমানকে ঘিরে জীবন কাটায় বলে?
আমার আসলে মনে হয়, এ ব্যাপারটা নিয়ে আরো কিছু করার আছে। আমি নিজেই টিনএজ বয়সে কাজ শুরু করেছিলাম। আমি প্রায় বছর দশেক ধরে আমার বন্ধু-বান্ধবদের ছবি তুলেছি আর ওতেই ‘তুলসা’ বইটা হয়েছে। এ বইটা পরে পুরোই ভিজ্যুয়াল এনথ্রোপলজির পর্যায়ে চলে গেছে। বিশের কোঠায় বয়স আসার আগে আমরা সবাই টিনএজার। সেখান থেকে সবকিছু বদলে যায় আর আমরাও বদলে যাই। আমার মনে হয়, কীভাবে আমরা বড় হয়ে উঠি বা বেড়ে উঠি—এ নিয়ে তখন থেকেই আসলে আমার এমন কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। ভিন্ন এলাকা, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বেড়ে ওঠা।
কেন?
ওই সময়টা জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি আমি। ওই সময়ে যা ঘটে, সেটাই ঠিক করে দেয় যে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় আমরা কেমন হতে যাচ্ছি বা কী করতে যাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করা হয়, আমাদের সঙ্গে যেসব ঘটনা ঘটে তা অবশ্যই নির্ধারণ করে দেয় যে, পরিণত বয়সে আমরা কেমন হয়ে উঠতে যাচ্ছি। এটা খুবই, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। আমার কাজ আমি অনেক দিন ধরে করে গেছি, অনেক মনোযোগ দিয়ে। মানুষেরও কাজটা ভালো লেগেছে। আর কী করার আছে বলুন!
আপনার কাজকর্মের দিকে তাকালে বোঝা যায়, প্রচুর পাগলাটে সময় কেটেছে আপনার! একটু ধীরস্থির হয়ে ওঠাটা আপনার জন্য কি সহজ ছিল? কিংবা এই ‘ইয়ুথ কালচার’কে তুলে ধরতে হলে আপনি কি আসলেই শান্ত হতে পারবেন?
বটে, আমার মনে হয় যে ধীরস্থির হওয়ার একটু দরকার তো আছেই! আমি তো আসলে আমার কাজ ঠিকমতো করতে চাইছি। আমি নিজেই নিজের যত্ন নিই, যাতে আমি টিকে থাকতে পারি। একসময় নিজের যত্ন নিতাম না, কিন্তু এখন নিই।
আপনার কি কখনো এমন ভয় হয়েছে যে আপনি টিনএজার ছেলেমেয়ের যেসব কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন, আপনার সন্তানরাও এসব কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে?
অভিভাবক হিসেবে সব সময়ই আপনি উদ্বিগ্ন থাকবেন, সব সময় সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির চিন্তা আপনার মাথায় ঘুরবে, সব সময়েই এসব আপনাকে ঘিরে থাকবে। মা-বাবার জীবনে এটা তো অবিচ্ছেদ্য। আমার ভাগ্য ভালো, আমার ছেলেমেয়েরা বেশ ভালো।
আপনার কাজ কখনো কখনো ডিস্টার্বিং হয়। আপনার কি মনে হয় যে শিল্পের কোনো সীমারেখা থাকা উচিত?
কিছু বিষয় তো রয়েছে, যা আপনি করতে পারেন না। আপনি কাউকে মেরে ফেলতে পারেন না, কোনো শিশুকে আঘাত করতে পারেন না। অবশ্যই এ বিষয়ে কিছু সীমারেখা আছে।
সীমারেখা তো আছেই...
কিন্তু আমার কথা হলো, হিউম্যান এক্সপেরিয়েন্সের যেকোনো অংশই হিউম্যান এক্সপেরিয়েন্স, আর আমরা সেটা ফুটিয়ে তুলতে পারব না কেন? আমি এমন একটা সময়ের মানুষ, যখন আইজেনহাওয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, পঞ্চাশের দশকের কথা। তার পর আমি যখন কিশোর, সবকিছু ধামাচাপা পড়ে গেল। ড্রাগস নিয়ে, শিশুদের নিপীড়ন নিয়ে সেসব কথা কেউ আর বললই না। আমেরিকায় এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল না, এমন একটা ভাব! কিন্তু আমি দেখেছি, কালশিটে পড়া চোখ নিয়ে বাচ্চারা স্কুলে আসছে, বাপ-মায়ের হাতে মার খেয়ে। এমন শিশুদেরও চিনতাম, যাদের অভিভাবক ছিল ড্রাগস আর অ্যালকোহলে আসক্ত।
শিশু নিপীড়ন নিয়ে কী বলবেন?
জুনিয়র হাই স্কুলে আমার সঙ্গে একটা মেয়ে পড়ত। ওর পাঁচ ভাই ছিল, প্রত্যেকেই ওকে নিয়মিত ধর্ষণ করত, এমনকি ওর বাবাও সম্ভবত! এটা সবাই জানত, কিন্তু কেউ এসব নিয়ে কথা বলত না। এ রকম কিছু আপনি কখনোই শুনতে পাবেন না। তাই আমি যখন কাজ শুরু করলাম, তখন ভাবলাম, ‘কেন আপনি সবকিছু দেখাবেন না?’ তখন দারুণ সব ফটোগ্রাফার ছিল, দারুণ সব কাজ করত ওরা। কিন্তু চাইলেই সব করা যেত না—কিছু জিনিস এমনই ছিল যা আপনি চাইলেও দেখতে পারবেন না।
আর আপনার কি মনে হলো যে আপনার বিষয়টি দেখানো দরকার সবাইকে?
আমি ভাবতে লাগলাম, ‘কেন আপনি সবকিছু দেখতে পারবেন না?’ মানুষজন যদি এই ছবিগুলো বানাত, তাহলে আমার এসব বানাতে হতো না। আমার সব সময়ই এমন মনে হয়েছে। অন্য কেউই যদি এই কাজগুলো করত, তাহলে আমার এসব কাজ করতে হতো না। যা হচ্ছে, যা কিছু ঘটছে, আমি যা দেখছি—এগুলোই অনেক মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা এ সময়ে মানুষ হিসেবে কেমন, তা দেখানোর এটাই উপায়।
ইন্টারনেটের যুগে এখন সবকিছুই তো আমূল পাল্টে গেছে। যে কেউ এখন যেকোনো কিছুতে সহজেই অ্যাকসেস পায়, সহজে দেখতে পারে।
শিশুরা সবকিছুই দ্রুত দেখে ফেলে। আমার যখন সন্তান হলো আর আমি দেখলাম যে আমার মেয়ে একদম ছোট বয়সে কী দেখছে, তখন বুঝলাম যে শিশুত্ব কিংবা শিশুত্ব বলতে আমি যেটা বুঝি, জিনিসটা খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়! কিন্তু যা-ই হোক, শিশুরা ঠিকই আছে। এই দুনিয়াটা তাদের, তারাই এটার সঙ্গে বোঝাপড়া করে। এটা যেমন হওয়ার তেমনই, অন্য কোনো পথ তাদের জানা নেই। আমি যখন শিশু ছিলাম, আমাকে কেউই কিছু বলতে আসেনি। কিন্তু এখন শিশুরা সবকিছু জানে। তাদের কাছে সব বিষয়েই তথ্য আছে এবং তারা যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে। এখন তারা বিষয়টা করবে কি করবে না, সেটা তাদের বিষয়।