গল্প পড়ার গল্প
সাহিত্যে দাগ রেখে গেছেন শহীদুল জহির
শহীদুল জহিরের নাম প্রথম আমাকে বলেছিলেন ঢাকায় কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আমেদ, মঞ্জু সরকারেরা। ২০০০ সালের কথা। ঢাকার বই বাজারে গিয়ে শহীদুল জহিরের একটি বই পাই— ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’— একটি ক্ষুদ্র উপন্যাস। ঢাকা শহরে মিলিটারি নামল যে রাতে, সেই ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের রাত ছিল সেই অসামান্য উপন্যাসিকার বিষয়। বাস্তবতা আর অতিবাস্তবতার সীমারেখায় যাতায়াত তাঁর। এমন এক বিভ্রম আছে তাঁর লেখায় যে পাঠের পর আবৃত হয়ে যেতে হয়। তখন তাঁর আর কোনো বই পাইনি। অনেক দিন পর, ২০১০-এর গ্রীষ্মে আমার বাংলাদেশের বন্ধু মাসুদ করিম আমার জন্য উপহার নিয়ে আসেন শহীদুল জহিরের একটি গল্প সংকলন ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’। শহিদুল জহির তখন প্রয়াত। খুব কম বয়সে তাঁর প্রয়াণ ঘটেছে। তিনি একা থাকতেন শুনেছি। কোনো সাহিত্যের আড্ডায় তাঁকে দেখা যেত না।
‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ পাঠের পর আমি এই লেখকের অনুরাগী হয়ে উঠি। ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্পে’র সাতটি গল্প আমাকে বিচলিত করে তুলেছিল। এমন গল্প কমই পড়া হয়। শহীদুল জহির তাঁর সামান্য কটি গল্প নিয়ে অখণ্ড বাংলার কথাসাহিত্যে দাগ রেখে গেছেন। তাঁর লেখার স্টাইল, তাঁর আখ্যান নির্মাণ আমাকে ভাবিয়েছে অনেকবার। যেমন ভাবান বাসুদেব দাশগুপ্ত। সাহিত্যের ইতিহাস আঙ্গিকের ইতিহাসও। সেই ইতিহাসে শহীদুল জহির জায়গা পাবেন। আমি ‘আমাদের বকুল’ গল্পটির কথা শোনাই। সেই গল্প আকালু শ্যাকের যেমন, তেমনি তার বিবি ফতিমার। বিবি ফতিমার যমজ দুই সন্তানের একটি, সেই বকুলের গল্পও। আকালুর বউ এক ভোরে উধাও। সে ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। লোকের জমিনে কামলা দেয়। ফতিমাকে যখন বিয়ে করে আনে, সঙ্গে একটি গাই গরু এনেছিল। ফতিমা যৌবনবতী। খাটতে পারে খুব। ক্ষেতের কাজের গাঁয়ের চাষা, কামলারা ফতিমার কথা জিজ্ঞেস করে আকালুকে।
আকালু ক’দিন খুঁজে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ফতিমা গর্ভবতী হয়েছিল বিয়ের অনেক দিন পরে। যমজ সন্তান দিয়েছিল আকালুকে। একটি পুত্র, একটি কন্যা। আর সে সময়েই তার গাই গরুটিও পাল খেয়ে এসেছিল। সে দিয়েছিল একটি এঁড়ে ও একটি বকনা বাছুর। গল্পটি খুব সাজানো। পড়তে পড়তে ধরা যায় এটি একটি ছক। গাই গরুটি তার দুই বাছুর নিয়ে এক রাতে উধাও হয়ে যায়। তারপর যায় ফতিমা। আন্দাজ করাই যায় গরুটি চুরি হয়েছে নিরুপায় আকালু শ্যাকের জিম্মা থেকে। এক নিরুপায় মানুষের গল্প শুনিয়েছেন শহিদুল জহির তাঁর অনন্য আঙ্গিকে। দুটি ছেলে মেয়ে রইল পড়ে, ফতিমা কোথায় গেল জানতেই পারল না সে। কিন্তু এইই তো কপাল, ভবিতব্য। সে হাল ছেড়ে দিল। বকুল আর তার ভাই আমির হোসেনকে তাদের মা ফতিমা আরবি পড়াতে মাদ্রাসার তালেবুল এলেম রফিকুল ইসলামের কাছে পাঠিয়েছিল। রফিকুল চলে যাওয়ার পর জুম্মা মসজিদের ইমাম বুড়ো মোহসিন আলি মৌলভির কাছে যায় ভাইবোন।
সেই বুড়োই দুই বালক-বালিকার কাছে তাদের মা ফতিমাকে ফিরিয়ে দেয়। কীভাবে? না, ভিটের পিছনে বিচিকলা গাছ পুঁতে। আসলে শহীদুল জহির ছকবেঁধে যে গল্প বলেন, তা তাঁর লেখার গুণে হয়ে ওঠে অসামান্য। সেই বৃক্ষের ভেতরে মা, অনাথ প্রায় দুই ভাইবোন বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে তাই-ই সত্য। আকালু আবার বিয়ে করেছিল, আবার একটি কাজলা গাই ও বউ নিয়ে গাঁয়ে ফিরেছিল। আকালুর মেয়ে বকুল বড় হয়ে উঠছিল। পূববঙ্গ, নিরুপায় দরিদ্র মুসলমান ক্ষেতমজুর, কী আশ্চর্য কলমে গল্পটি বলেছেন শহীদুল জহির। অসামান্য তাঁর গল্পের সংলাপ। কথার ভেতরেই ডুবে যেতে হয়। বকুল ঋতুমতী হলে মায়ের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়। মা মানে সেই কদলীর ঝাড়। আসল গাছটিই আর নেই। বকুলকে লাল পিঁপড়ে খায়। গল্প হয় স্বতঃৎসারিত।
শহীদুল জহির যেন তেমন লিখতেন না। কিন্তু গল্প কীভাবে বলেছেন, তা অনুসরণ করলে মনে হয় এ গল্প আগে বাঁধা যায় না সম্পূর্ণ। তাঁর আর এক গল্প ‘কোথায় পাব তারে’ ঢাকা মহানগরীর এক অন্ধ গলি, ভূতের গলির বেকার যুবক আবদুল করিমের কাহিনী। সে কদিন ধরেই বলছে মৈমনসিং যাবে। যাবে কিন্তু যায় না। সন্ধেয় ঠোঙায় করে ডালপুরী নিয়ে নিজের বাসায় ফেরার সময় আজিজ ব্যাপারি প্রায়ই তাকে দাওয়াত দেয়। ডালপুরীর ভিতরে ডাইল আর নাই, আলু বেশি, আবদুল করিম প্রস্তাব দেয়, সে মৈমনসিং থেকে ডাইল আনবে আজিজ ব্যাপারির জন্য। সে কারবার করতে পারবে। এমনি আর একজনকে সে বলে সে তার জন্য মৈমনসিং থেকে আলু এনে দেবে। আবদুল করিম ঢাকার বাইরে কোথাও কোনোদিন যায়নি। তার বাবা তার উপরে কোনো ভরসাই করে না, সে হঠাৎ মৈমনসিং যাবে কেন? না, দাওয়াত আছে। তাকে কোনো এক শেপালি বেগম তার বাড়ি যেতে বলেছে। আহা, সত্যি? আবদুল করিম কি প্রেমে পড়েছে? শেপালিরে সে পেল কোথায়? না, মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে। সে অসুস্থ শেপালিরে জল এনে দিয়েছিল, তা মনে পড়ে। শেপালি তাকে দাওয়াত করেছে। একটি কাগজে তার ঠিকানা লিখে দিয়ে গেছে আবদুল করিমকে। তা এমনি, মোছাঃ শেপালি বেগম। ফুলবাইড়া। মৈমনসিং। পথ নির্দেশে ছিল, ঢাকা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড।
মৈমনসিং শহর। গাঙ্গিনার পাড়। গাঙ্গিনার পাড়—আকুয়া হয়া ফুলবাইড়া বাজার...। সে এক আশ্চর্য ঠিকানা। সেই ঠিকানা আরো দূর বিস্তৃত। থানার সামনে গিয়ে উল্টোদিকে হাঁটলে বড় এড়াইচ গাছের সামনে টিএনইউ অফিস, বাম দিকে রাস্তা, নাক বরাবর হাঁটা, ধানক্ষেত, কাঁটা গাছ, লাল মাটি, বামে মোচড় খাওয়া নদী, আখাইলা নদী, নদী পেরিয়ে ব্রিজ পেছনে রেখে দাঁড়ালে ছায়া যেদিকে পড়ে তার উল্টোদিকে...। কী সরল কী জটিল আর মায়াবী এক পথের কথা লিখেছেন লেখক সম্পূর্ণ উপভাষায় লেখা এই গল্পে, তার কোনো তুলনা হয় না।
আমার শুধু মনে পড়ে যায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথা। সেই তেলেনাপোতা আবিষ্কার, হয়তো... ইত্যাদি সব গল্পের কথা। প্রেমেন্দ্র মিত্র পড়েছি অল্প বয়সে। সেই বিস্ময় আবার ফিরে এল যেন ‘কোথায় পাব তারে’ গল্পটি পড়তে পড়তে। এই গল্প সেই গল্প নয়। কিন্তু এই অসামান্য কল্পনা আমি প্রেমেন্দ্র মিত্রর গল্পে পেয়েছিলাম তো। সেই যে তেলেনাপোতা যাত্রা, না এই যাত্রা আরো জটিল আরো সরল, কিন্তু আমাকে সেই প্রাচীন হয়ে আসা মুগ্ধতা দিয়েছে। আবদুল করিমের সঙ্গে জুতে দেওয়া হয়েছিল আজিজ ব্যাপারির ছেলে দুলাল মিঞাকে। তারা মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ফুলবাইড়ার ডাইরেক্ট বাস পেয়েও যায় না। যেমন লিখে দিয়ে গেছে শেপালি বেগম, তেমনি যাবে।
মৈমনসিং, গাঙ্গিনার পাড়, সেখান থেকে বাসে আকুয়া হয়ে ফুলবাইড়া। তারপর পথ নির্দেশ নিয়ে শেপালি বেগমের উদ্দেশে রওনা হওয়া। আর শেষ অবধি অনেকটা গিয়ে ফিরে আসা। আকাশে মেঘ থেকে ছায়া না পড়লে, ব্রিজ পার হয়ে জুতো খুলে যেদিকে নরম মাটি, সেই স্পর্শ পরখ করে সেই পথে হাঁটার কথা ছিল। জুতোর ফিতে আটকে যায় গেরোয়। জুতো না খুলতে পেরে রণে ভঙ্গ দেয় আবদুল করিম। আসলে শহীদুল জহির এমন এক মহাযাত্রার কথা লিখেছেন ভূতের গলির আদি বাসিন্দা আবদুল করিমের তাই নিয়ে মাথা ঘামিয়েই সুখ সেখানকার মানুষের। তাদের জীবন অতি খিন্ন, তাদের জীবনে কোনো বৈচিত্র্য নেই। বৈচিত্র্য শুধু আবদুল করিমের জীবনে, যা সে নিজেই আয়ত্ত করেছিল। এই গল্প আমি ভুলব না। বাংলাদেশের গল্পে মাটির মানুষের মুখের ভাষা বড় জায়গা করে নিয়েছে। শহীদুল জহিরের গল্প পড়লে তা ধরা যায়।