গল্প পড়ার গল্প
স্বতন্ত্র ধারার লেখক অমলেন্দু চক্রবর্তী
লিখতে লিখতে লেখা বন্ধ করে অমলেন্দু চক্রবর্তী আবার ফিরে এসেছিলেন তাঁর অবিরত চেনামুখ গল্প সংকলন নিয়ে আশির দশকের প্রথম দিকে। আমার ভুলও হতে পারে। তবে আমি অনেক পরে চিনেছি তাঁকে। আর অবিরত চেনা মুখ থেকেই চেনা। স্নেহময় এই লেখক আমাদের বেড়ে ওঠার সময় অনেকভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। অমলেন্দু চক্রবর্তী স্বতন্ত্র ধারার লেখক। তাঁর গল্প নিয়ে দুটি অসামান্য ছবি করেছিলেন মৃণাল সেন : ‘একদিন প্রতিদিন’ ও ‘আকালের সন্ধানে’। বছর কয় আগে তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ আমাকে শূন্যতা দিয়েছে সত্য। লেখার গুণাগুণ বিচারে তিনি ছিলেন অকপট। লিখতে বসে মনে পড়ে যাচ্ছে, রোহিতাশ্বের নামে, কিংবদন্তী, গৃহে গ্রহান্তরে... কত গল্পের কথা।
গোষ্টবিহারির জীবনযাপন, রাধিকা সুন্দরী আমার প্রিয় উপন্যাস। সাধারণ, অতি সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ, ছিন্নমূল মানুষ ছিল তাঁর গল্প আর উপন্যাসের মানুষ। সেই যে মেয়েটি রাতে বাড়ি ফেরেনি, অবিরত চেনামুখ গল্পের সেই অদ্ভুত সংকটের কথা ভুলতে পারি না এখনো। এসব গত শতাব্দীর ছয়-সাতের দশকের গল্প। আমি অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘ইছামতী বহমান’ গল্পটির কথায় আসি। এই গল্প অনেক দিন আগে যখন পড়েছিলাম, গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। এতকাল বাদে পড়তে গিয়ে চোখ ভিজে যায়। আসলে গল্প কখন আমার হৃদয়তন্ত্রীতে টং করবে, আমি জানব কী করে? শেষ অবধি মানুষ তো তার নিজের গল্পই অন্যের ভেতর দিয়ে শুনতে চায়। ইছামতী বহমান এক শিকড় সন্ধানের গল্প। সেই শিকড় আমার-আপনারও। একটি বছর একুশের মেয়ে মৃন্ময়ী তার মা আর বড়দা সেই সক্কালে বেরিয়েছে সীমান্তের উদ্দেশে। এই গল্প ১৯৬৮-এর। তখন বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। ওপারে পাকিস্তান। ১৯৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়ে গেছে। সীমান্তে দারুণ প্রহরা।
ইছামতীর ওপারে খুলনা জেলার কালীগঞ্জ থানা, এপারে হাসনাবাদ, তারপর নানা দ্বীপ, সাতজেলিয়া, ছোট মোল্লাখালি। সমস্ত দিন গেছে দালালের সঙ্গে উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে। পড়তে পড়তে টের পাওয়া যায় তারা দালালের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এক জেলেদের গ্রামে পৌঁছেছে অনেক রাতে। ভাদ্র মাস। সমস্ত দিন টিপটিপ বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। কাদা আর জল ভেঙে তাদের নিয়ে এলো দালাল এক জেলেবাড়িতে। মৃন্ময়ী সমস্ত দিন ধরে ভেঙেছে শুধু ভেঙেছে। তারা ওপারের মানুষ। পার্টিশনের পর এপারে এসেছিল দেশ ছেড়ে ।
মৃন্ময়ী এত দিন বাদে, এই একুশ বছর বয়সে জেনেছে তার মা-বাবা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল জল কাদার ভেতরে সেই গোয়ালন্দ জাহাজঘাটায়। তখন অগণিত মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় আসছে। ওখান থেকে ট্রেন ধরবে। উদ্ভ্রান্ত মানুষের পায়ের নিচে পিষ্ট হতে যাচ্ছিল সেই বছর দেড়ের শিশু। কোনো হতভাগী মায়ের কোল থেকে পড়া হৃৎপিণ্ড। তখন জলকাদা থেকে তুলে সেই শিশুকে এই মায়ের কোলে দিয়েছিলেন মৃন্ময়ীর বাবা। তার পর থেকে তার শিকড়ের সন্ধান করে যাচ্ছিল এই পরিবার মৃন্ময়ীর অজান্তে। তার ঊরুর নিচে আছে এক জন্ম জড়ুল। কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান, সে মাটির মতো। মৃত্তিকা। সে যেন জনক রাজার কুড়িয়ে পাওয়া সীতা। তাকে জীবন দিয়েছে এই পরিবার। আচমকা পাওয়া গেছে মৃন্ময়ীর শিকড়ের সন্ধান। মৃন্ময়ী চায় না সেই শিকড়ের মুখোমুখি হতে।
এই পরিবারকে, এই মা, দাদাদের, বাবাকে সে নিজের বলেই জানত এতকাল। সেই ভাদ্র মাসের রাতে, ওপারের কালীগঞ্জ থেকে তারা আসবে তাকে দেখতে। কালীগঞ্জে এসে অপেক্ষা করছে তারা। পাঠক, আপনি সেই অনন্ত অপেক্ষার মুহূর্তগুলোর কথা ভাবুন। সেই কাঁচা মাছের গন্ধে ভরপুর জেলেদের কুটির। তাদের মেয়ে-বউ-সন্তান। অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসছে অপরিসীম দারিদ্র্য। অমলেন্দু চক্রবর্তী খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দেন না। বাদ দেননি মৃন্ময়ীর মনের ভেতরে ওঠা অজানা আশঙ্কার বিবরণ। পড়তে পড়তে দম বন্ধ হয়ে আসে। ফেলে আসা শিকড়, হারিয়ে যাওয়া শিকড়ের মুখোমুখি হতে কী থিরথিরানি। পড়তে পড়তে আমাদের পিতৃপুরুষের ফেলে আসা সেই গ্রামের কথা মনে পড়ে। সেই যেখানে আমার প্রপিতামহ ও পূর্বপুরুষ বাস করতেন বহু জন্ম ধরে। মৃন্ময়ীর সন্ধানে তারা আসবে দালালের হাত ধরে ওপার থেকে। গল্পটি রূপক। তিনি এক কল্প কাহিনী রচনা করতে বসেননি। তাই কী করে যোগাযোগ হলো, তার কোনো বিবরণ দেননি লেখ্ক। অপ্রয়োজনীয়ও হতো তা।
মৃন্ময়ী আর তার মা অন্ধকারে অপেক্ষা করে তাদের জন্য। তার দাদা অন্য কোথাও সেই দালালের সঙ্গে। অবশেষে তারা আসে। মৃন্ময়ী কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার এই মা বলেন, ‘কাঁদিস নে কাঁদিস নে মা, আমি তো সঙ্গে আছি, ভয় কী মা তোর?’ কারা এলো? দালাল সেই অদ্ভুত মানুষটি, তারপর আশ্রয়দাতা জেলে বুড়ো, তারপর এক প্রৌঢ়া নারী। শাদা সেমিজের ওপর লাল রেলপাড় সাদা শাড়ি। রোগা, বিমর্ষ। টিকোল নাক, ভাঙা চোয়াল, কপালে দগদগে সিঁদুর। পেছনে এক বৃদ্ধ। হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, সস্তার কাপড়ের পাঞ্জাবি, কালো মতো, রুগ্ণ। তারা যেন বহুদিন বিমর্ষ হয়ে বাঁচায় অতি ক্লান্ত।
মৃন্ময়ীর মা মৃন্ময়ীর গা থেকে হাত তুলে সরে দাঁড়ালেন। অনন্ত এক স্তব্ধতা সেখানে যেন জন্মাল। বহমান ইছামতীও বুঝি থেমে গেছে। কোনো প্রমাণ চাই না। জড়ুল চিহ্ন নয়, রক্ত পরীক্ষা নয়, কার সমুখে দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়ী? মৃন্ময়ীকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে কী কান্না! সময় যেন মুছে গেল, সে দাঁড়িয়ে আছে এক স্নিগ্ধ জলপ্রপাতের নিচে। বৃদ্ধ সন্ত্রস্ত হয়ে এগিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে নিশ্চুপ। কাঁপতে কাঁপতে হাত রাখলেন মৃন্ময়ীর মাথায়। ছুঁতেও যেন সংকোচ। একটি পুরুষ মানুষ তো। স্পর্শে মৃন্ময়ীর সমস্ত দেহে এক স্নিগ্ধতার ঢল। নারীটি কেঁদে উঠলেন মেয়ের পায়ের কাছে পড়ে। তাঁকে টেনে তুললেন বৃদ্ধ। মৃন্ময়ী তার একুশ বছরের আশ্রয় মায়ের কাছে ছিটকে যায় কাঁদতে কাঁদতে। তার একুশ বছরের বিশ্বাসে ভাঙন ধরেছে যে। মা বললেন, ‘প্রণাম কর, প্রণাম কর মিনু।’ সে তখন শুনতে পাচ্ছে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর, নাম ছিল পারুল, পারুলরানি মালাকার, পিতার নাম শম্ভুনাথ মালাকার, সাকিন শুভড্ডা, কেরানীগঞ্জ থানা, ঢাকা সদর, আলিমন গোত্র রাঢ়ী শ্রেণি...।
তারা দেশ ছেড়ে এপারে আসছিল। গোয়ালন্দ ঘাটে মেয়েটা হারালে কাঁদতে কাঁদতে আবার ফিরে গিয়েছিল নিজের ভিটেয়। তারা মেয়েকে দেখে, ছুঁয়ে আবার ফিরে গেল দালালের সঙ্গে। ইছামতী পার হয়ে গেল। এমন আশ্চর্য গল্প আমাদের ভাষায় লেখা হয়েছে। শিকড় চেনাতে নিয়ে এসেছিল তাকে তার পালক মা, দাদা। আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।