মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে পাকিস্তানি দালাল
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তি এবং পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অনুচর ও সহযোগী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল। তাদের রাজাকার, আলবদর, আল শামস নামে অভিহিত করা হয়। তারাই আমাদের উদ্দিষ্ট পাকিস্তানি দালাল।
এ দেশের অনেক কথাসাহিত্যিকই মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে পাকিস্তানি দালাল চরিত্রের রূপায়ণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাসেই পাকিস্তানি দালাল চরিত্রের অনিবার্য আবির্ভাব লক্ষ করা যায়। আনোয়ার পাশার 'রাইফেল রোটি আওরাত' উপন্যাসটির রচনাকাল ৭১ সালের মার্চ থেকে এপ্রিল মাস। এটিই মুক্তযুদ্ধভিত্তিক প্রথম উপন্যাস। ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসে আমাদের দেশের তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবীর জাতীয় চরিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন মালেক ও খালেক সাহেব চরিত্র দু'টির মধ্য দিয়ে; যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালি ও তোষামদের মাধ্যমে নিজেদের আখের গুছিয়েছে ও শাসকগোষ্ঠীর অনুগ্রহভাজন হওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রধান চরিত্র সুদীপ্ত শাহীনের ভাষায়, পাকিস্তানে এখন দালালির জয়জয়কার প্রচন্ড নির্লজ্জ দালালি তোষামদ আর উৎকোচ।
'দুই সৈনিক' শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় উপন্যাস। উপন্যাসটির মূল উপজীব্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি গ্রামে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক বাঙালি নারী ধর্ষণ, পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতনের চিত্রাঙ্কন। পাশাপাশি এ অনুষঙ্গে উঠে এসেছে, গ্রামীণ পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এদেশীয় দালাল ও ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা ও অবস্থান। 'জলাংগী' চাচাতবোন প্রেমিকা হাজেরার খোঁজখবর নিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জামিরালি একদিন ধরা পড়ে পার্শ্ববর্তী কাজীর চর গ্রামের কয়েকজন রাজাকারের হাতে। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে রাজাকাররা তার প্রকৃত পরিচয় না পেলেও তার কাছ থেকে খুঁজে পাওয়া একটি চিরকুটে হাজেরার নাম লেখা দেখতে পায়। রাজাকাররা এক পর্যায়ে জামিরালিকে তুলে দেয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের মেজর হাশেমের কাছে। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মেজর হাশেমের অত্যাচার ও নির্যাতনের কুখ্যাতি অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্যাম্পে আগে থেকেই বন্দি হয়েছিল তার প্রেমিকা হাজেরা। আরো অনেক মেয়েদের মতো তাকেও এখানে বন্দি করা হয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের রিরংসা চরিতার্থ করার জন্য। পাকিস্তানি মেজর গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মোসাহেব আলীর মাধ্যমে কয়েকজন গ্রামবাসীর সামনে জামিরালি ও হাজেরার ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে বিচারের সম্মুখীন করে। বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে মেজর হাশেম তাদের পাথর বেঁধে মেঘনা নদীতে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু উপস্থিত জনতা এই রায় ও তার বাস্তবায়ন কোনোটিতেই আগ্রহ দেখায় না।
কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের 'ফেরারি সূর্য' সত্তরের এর দশকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। উপন্যাসটি মূলত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজধানী ঢাকা নগরীর নয় মাসের অবরুদ্ধ জীবনচিত্র। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা শহরে অবস্থিত একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাপনের কাহিনী বর্ণনার মধ্যে দিয়ে লেখক সমগ্র ঢাকা শহরের বাস্তব জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতা, বিহারীদের লুটপাট, অত্যাচার, রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পার্শ্ববর্তীদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমপৃক্ততা ও বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকাসহ নানা আনুষঙ্গিক বিষয় উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। সেলিনা হোসেনের 'হাঙর নদী গ্রেনেড' উপন্যাসে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় মাস পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের পাশাপাশি কিছু সংখ্যক সুযোগ সন্ধানী এদেশীয় দালাল ও পশ্চিমি সৈন্যদের সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট শান্তি কমিটি রাজাকার বাহিনী ও আলবদর বাহিনীর অত্যাচারের মাত্রা, হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত লালসা চরিতার্থ করাও একইসঙ্গে তাদের পাকিস্তানি সৈন্যদের খুশি করার দিকটিও সার্থক ভাবে উন্মোচিত হয়েছে নীতা বৈরাগিনীর কাহিনীর মধ্যে।
সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের রচয়িতা হিসেবে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে রয়েছেন। আশির দশকে যতগুলি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে সৈয়দ হক তাদের অন্যতম। তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলো হচ্ছে- নীলদংশন, নিষিদ্ধলোবান, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, অন্তর্গত, মৃগয়ায় কালক্ষেপ, ত্রাহি। তবে কাব্যনাট্য 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' যেভাবে একজন রাজাকার চরিত্র রূপায়ণে সার্থক তেমন আর দেখা যায় না।
'অন্ধকথামালা' রশীদ হায়দারের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দ্বিতীয় উপন্যাস। 'অন্ধ কথামালা' উপন্যাসের কাহিনীতে দেখতে পাই মুক্তিযোদ্ধা বেলাল হোসেনকে (বেলু) গ্রামের শান্তি বাহিনীর লোকজন চোখ হাত পা বেঁধে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ তারা পাঁচ বন্ধু নওশের, গনি, কাসেম ও মোকসেদ মিলে পরিকল্পনা করেছিল হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর গ্রামে প্রবেশের একমাত্র সেতু বুড়িদ'র সাঁকোটি উড়িয়ে দেবে। পাবনা শহর পতনের পর মিলিটারিরা যেকোনো সময় গ্রামে প্রবেশ করতে পারবে; কিন্তু তাদের এই গোপন পরিকল্পনাটি কিভাবে ফাঁস হলো বেল্টু বুঝতে পারে না। চোখ-হাত-পা বাঁধা বেল্টু শত্রু সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না । কিন্তু এক সময় তার বন্ধু মোকসেদ কথা বলে উঠে নিজেই পরিষ্কার করে দেয় তার বিশ্বাস ঘাতকতার বিষয়টি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তারই বন্ধু মোকসেদ। মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে ওরা বেল্টুকে তুলে দেয় গ্রামের শান্তি বাহিনীর সেক্রেটারি হান্নানের কাছে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে বেলাল আহমেদের স্মৃতিতে উঠে আসে তার পূর্ববর্তী জীবনের কথা শৈশব ও কৈশরের স্মৃতি, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।
'নষ্ট জোছনা এ কোন অরণ্য' উপন্যাসটি মূলত দুটি আলাদা কাহিনীর সমন্বয়ে রচিত হলেও প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ। নষ্ট জোছনায় অঙ্কিত হয়েছে যুদ্ধোত্তর কালের মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন হতাশা, অপ্রাপ্তি ও তার বেদনা, বিপথগামিতা এবং আর্থসামাজিক অবক্ষয়। উপন্যাসটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের তৎকালীন সময় ও সমাজের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয় দুটো। একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা ও অপ্রাপ্তিজনিত কারণে তাদের নানাবিধ চারিত্রিক স্খলন এবং তৎপরিবর্তে সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়নের প্রবণতা; অন্যদিকে স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থান ও তাদের সুসংহত সামাজিক অবস্থান।
গল্পকার ও ঔপন্যাসিক মিরজা আব্দুল হাই এর 'তোমার পতাকা' উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ স্থান পেলে
গ্রামে শান্তি কমিটি গঠিত হওয়ার কথা আছে। যথারীতি কমিটির চেয়্যারম্যান নিযুক্ত হয় আইনুদ্দিন এবং তার ছেলে উঠতি ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অন্যতম সহযোগীতে পরিণত। এক সময় তারা আরোগ্য কুটিরেও হানা দেয়। ডাক্তার সুবলের অনুপস্থিতিতে নার্স লিলি বিশ্বাসকে সর্তক করে দেওয়া হয় যাতে কোন মুক্তি বাহিনীর সদস্য এখানে চিকিৎসা না পায়।
ইমদাদুল হক মিলন বেশ কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের রচয়িতা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কালোঘোড়া, ঘেরাও, মহাযুদ্ধ, রাজাকারতন্ত্র, বালকের অভিমান ইত্যাদি। এসব রচনাতে লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ অভিজ্ঞানের পাশাপাশি, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর সময়কালের অস্থিরসময় এবং সমাজচিত্র যেমন ধরা পড়েছে তেমনিভাবে লেখক তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী ব্যক্তি মানুষের (অনেকাংশে তারুণ্যের) সংকট ও হতাশার নানামুখী চিত্র। 'কালোঘোড়া' উপন্যাসে চেয়ারম্যান সিরাজ ও শান্তিবাহিনীর লোকেরা গ্রামের যুবক মুক্তিযোদ্ধা খোকা, কাদের, মনা ও আলমদের আশ্রয় দেবার অপরাধে রতনলালের কর্মচারী নয়নাকে ধরে এনে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে।
নব্বইয়ের দশকে রচিত মু্ক্তি যুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রচয়িতার মধ্যে কথাশিল্পী মঈনুল আহসান সাবের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে- পাথর সময়, সতের বছর পর, কবেজলেঠেল, ফিরে আসা প্রভৃতি। তার উপন্যাসে দালাল 'বিডি' ও 'সে' গুরুত্বপূর্ণ। যারা ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি আর্মিদের লালসা নিবৃত্তের জন্য বাঙালি নারী যোগান দিত, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী, স্বাধীন বাংলাদেশের পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামোয় তারা আজ জাঁকিয়ে বসেছে। রাজধানী ঢাকা শহরের মতো গ্রামেও অনুরূপ চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়- 'আখন্দ ' '৭১ সালে পাকিস্তানীদের দালালি করেছে। শান্তি কমিটির মেম্বার ছিল। অবশ্য '৭২-এর শেষ থেকেই সে জোর গলায় বলতে আরম্ভ করেছে _ ঠিকই করেছে সে। সে না থাকলে পাকিস্তানিরা ধ্বংস করে দিত এ গ্রাম। সে যা করেছে তা গ্রাম আর গ্রামবাসীকে বাঁচানোর জন্যই করেছে। এমন কথাই শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। সুতরাং '৭১-এর রফিক আখন্দ চেয়ারম্যান, দু'তিন বছরের মধ্যে আবার সেই চেয়ারম্যান।' স্বাধীনতাবিরোধীরা কীভাবে ভোল পাল্টিয়ে যুদ্ধশেষে কিছু অসৎ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের সহায়তায় আবারও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পক্ষান্তরে হারেস মাস্টারের মতো মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে স্বাধীনতার পর অবহেলিত ও এসব অপশক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিল তার অনন্য উদাহরণ 'কবেজ লেঠেল' উপন্যাস।
একাত্তর সালে ক্ষমতাসীন শাসক ও মিলিটারি স্পষ্ট তাদের এদেশীয় দোসররা, বিশেষ করে ধর্মীয় দলগুলো, কনভেনশন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ মদদে সৃষ্ট রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর চালিয়েছিল অত্যাচার, লুটতরাজ ও তাদের সর্বস্ব অপহরণসহ নানা অপকর্ম। হুমায়ূন আহমেদের 'অনিল বাগচীর একদিন' মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন এ ধরনের সময়ের প্রতিবিম্ব। নব্বইয়ের দশকে যতগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রচিত হয়েছে তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় রচনা ঔপন্যাসিক শহীদুল জহিরের 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'। উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার অনন্য নিদর্শন। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় দেড় দশক পর লেখক উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আব্দুল মজিদের স্মৃতিচারণার অন্তরালে তুলে ধরেছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হত্যা, নির্যাতন, নৃশংসতার এবং সামপ্রদায়িকতার ভয়াবহ চিত্র।
কবি ও কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিকের 'একাত্তরের হৃদয়ভস্ম' নব্বইয়ের দশকের একটি উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস এবং বাংলাদেশের উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। উপন্যাসে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপন্ন অস্তিত্বের কোণঠাসা রূপ বর্ণনার পাশাপাশি ১৯৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক গতিধারা, সামরিক শাসনসৃষ্ট অপরাজনীতির কারণে স্বাধীনতাবিরোধীদের সামাজিক প্রতিপত্তি ও উত্থান, সমকালীন বামরাজনীতির গতি প্রকৃতিসহ জাতীয় জীবনের যাবতীয় বিষয়ের একটি বস্তুনিষ্ঠ ও সামগ্রিকচিত্র তুলে ধরেছেন লেখক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইদ্রিস ইজেদ্দার ছিল সবচেয়ে বড় রাজাকার ও পাকিস্তানিদের সহযোগী দোসর। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ও তার এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি। পাকিস্তানি দালালের নির্মম আচরণের অসাধারণ চিত্রন রয়েছে উপন্যাসটিতে।
'ছায়াশরীর' মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাসে সালাম সালেহ উদদীন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কাহিনীতে ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। হাতনী গ্রামের সিরাজ কাজী একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে ফিরে এসে গ্রামের বিচিত্র পরিবর্তনের সম্মুখীন হয় সে। পাকিস্তানের দালাল লালু চেয়ারম্যানের দাপট দেখে সে আশ্চর্য বনে যায়। উপন্যাসের কাহিনী মোটামুটি আরিফ কাজী ও নোয়াই শিকদারের পরিবারকে ঘিরে অর্ধেকের বেশি আবর্তিত হয়ে এসে শেষের দিকে জড়িয়ে গেছে আবুল মওলানা ও তার ছেলে লালু মিয়ার পরে লালু চেয়ারম্যানের ঘটনার সঙ্গে। আবুল মওলানা ও তার ছেলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর সহযোগী ছিল এবং ছিল পাকবাহিনীর সকল দুষ্কর্মের সঙ্গী। যুদ্ধ আরম্ভ হবার তিন মাস পর পাক আর্মি হাতনী গ্রামে আসে এবং হরিপদ ডাক্তারসহ বহু লোককে খুন করে। হাটবাজার তছনছ করে দেয়। নিহতের মধ্যে সিরাজ কাজীর ছোট ভাইও থাকে। ধরে নিয়ে যায় প্রতিবাদী ও সদ্য পুত্র হারা আরিফ কাজীকে যে আর ফিরে আসে না। আবুল মওলানা আর্মির লোকদের আপ্যায়ন করতে থাকে এবং তার ছেলে লালু আর্মির ক্যাম্পে মেয়ে সরবরাহ করার দায়িত্ব নেয়। তুলে দেওয়া এসব হতভাগিনীর মধ্যে সিরাজ কাজীর বড় ভাইয়ের মেয়েও থাকে। দেশের এই করুণ দশা দেখতে পেয়ে সিরাজ কাজী গ্রামের ছেলেদের উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধে যায় দেশকে হানাদারমুক্ত করার সঙ্কল্প নিয়ে। যুদ্ধ শেষে দ্রুত দৃশ্যপট বদলে যায়। সরকার কর্তৃক দালালদের ক্ষমা ঘোষণায় আবুল মাওলানা জেল থেকে ফিরে আসে। তার ছেলে লালু অসদুপায়ে পয়সা করে বড়লোক হয়ে যায় এবং পয়সার জোরে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর সিরাজ কাজীকে মানুষ যোদ্ধা হিসেবে সংবর্ধনা দিয়েছিল। কিন্তু লালু ও তার সঙ্গীদের দাপটে মানুষ অচিরে সিরাজ কাজীর যোদ্ধা হিসেবে অবদানের কথা ভুলে যায়। তবে দালালের শাস্তি বিধানের জন্য কথাসাহিত্যিক সালাম সালেহ উদদীন কৌশল অবলম্বন করেন। প্রবল পরাক্রান্ত লালু চেয়ারম্যানকে স্বগৃহে জবাই করে হত্যা করান তিনি। এতে শিল্প কুশলতার বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি একটুও।
মোস্তফা কামালের 'জনক জননীর গল্প' উপন্যাসটি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের নতুন আখ্যান। উপন্যাস শেষে রাজাকার সলিমুল্লাহ চৌধুরী নিহত হয়েছে; তবে তার সমাধি হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। রাজাকার সলিমুল্লাহ চৌধুরীর কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পর্বের সুখের জীবন ও সমাজে তার প্রতিষ্ঠার চিত্র লক্ষ্য করা যায়। যুদ্ধের সময় রাজাকার সলিমুল্লাহ এক পর্যায়ে তার মার অনুরোধে বরিশালে শ্বশুরালয়ে গমন করলে রংপুরে তার গৃহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে সে প্রচার করে বরিশালে যুদ্ধে গমন করায় তার ঘরবাড়ি রাজাকাররা পুড়িয়ে দিয়েছে। সে তার ভৃত্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সনদও সংগ্রহ করে। জিন্নাহ টুপি যার প্রিয় পরিধেয় সেই ব্যক্তি ধীরে ধীরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিরাপদ জীবন খুঁজে পায়। তবে শেষ রক্ষা যে করতে পারে নি সে ঘটনাও আমরা জেনেছি উপন্যাসটি পাঠ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় হরিচরণ মাস্টারের স্ত্রী কমলা রাণীকে ভাগিয়ে এনে বিবাহ করার মধ্যে সলিমুল্লাহ অপরাধ খুঁজে পায়নি। কিন্তু অনেক দিন পরে ১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনার সরকার গঠনের পূর্বে তার ভেতর ভয় প্রবেশ করে। নিজগৃহে সবাই ঘুমিয়ে থাকলেও সে বিনিদ্র রাত্রি অতিবাহিত করে, অনুশোচনা জাগে তার অন্তরে। তবে তা প্রকাশের আগেই হরিচরণ এক রাতে তাকে হত্যা করে। দেশের সঙ্গে বেঈমানির শাস্তি প্রাপ্তি ঘটে। অন্যদিকে রাজাকার পিতার সন্তান করবী পাগল হয়ে যায়। শেষে আত্মহত্যা করে। সুইসাইড নোটে লিখে রাখে, 'যেই বাবা দেশের সঙ্গে বেঈমানি করেছিলেন, বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন; সেই বাবার সন্তান হয়ে আমি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চাই না। তাই আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলাম। আমার এই আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়।' করবী বর্তমান প্রজন্মের প্রতীক; যারা দেশের মুক্তিসংগ্রামের সঠিক ইতিহাস জেনেছে। আর তাদের বোধে সেই ইতিহাসচেতনা সবসময় জাগ্রত। এজন্য তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। না পারলে নিজের জীবন বিনষ্ট করে। পাকিস্তানি দালালদের নিজ সন্তানের কাছেও ঠাঁই নেই।
মূলত '৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের কঠিন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের উপন্যাস ও ঔপন্যাসিকদের চেতনা ও মনোভূমিতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল, তাদের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছিল সে সমস্তের পরিচয় পাওয়া যায় উপন্যাসে পাকিস্তানি দালাল চরিত্র উপস্থাপনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষ সকল মানুষ সেদিন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আর মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিল গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব মধ্যবিত্তের হাতে থাকলেও, মধ্যবিত্তের তুলনায় মুক্তিযুদ্ধ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই ছিল সর্বাধিক। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি সহযোগী এ দেশীয় দালালরা ছিল সুযোগ সন্ধানী, গ্রাম্য মাতব্বর ও পুঁজিপতি শ্রেণির অপরাধী। তাদের স্বরূপ উন্মোচনে মুক্তিযুদ্ধের ঔপন্যাসিকরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।