শিশুদের চলচ্চিত্রে শিশুরা কোথায়?
একটা সময় রুপালি পর্দায় শিশুরা তাদেরই মতো দুষ্টু-সাহসী শিশুদের দেখে মজা পেত। কিন্তু এখনকার নির্মাতারা শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন শিশু চরিত্র বাদ দিয়েই। এমনকি কার্টুন-অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও। কেন এমনটা হচ্ছে, তা তথ্যসহ উপস্থাপন করেছেন কলিন হরগ্যান, নিজের ব্লগে। আর ব্লগের বরাত দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিশ্লেষণটি ছাপিয়েছে দ্য গার্ডিয়ানের অনলাইন সংস্করণ।
বিশালাকৃতির এক মিনিয়ন-বেলুন আটকে দিয়েছিল আয়ারল্যান্ডের মহাসড়কের যান চলাচল। সেটা কিন্তু একা একা ওই সড়কে যায়নি। প্রচারণার জন্য খরচের কথাটা ভাবুন একবার! শিশুদের চলচ্চিত্র বা যেসব চলচ্চিত্র শিশু-কিশোরদের লক্ষ্য করে নির্মিত হয়েছে, সেগুলো কখনোই এত বড় আকারে, প্রচুর অর্থ লগ্নি করে বানানো হয়নি। তারপরও অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রগুলো ভালোই দাপট দেখাচ্ছে বক্স অফিসে। ইউনিভার্সাল ও প্যারেন্টাল গাইডেন্স তকমা লাগানো সর্বকালের শীর্ষ ২০টি চলচ্চিত্রের দশটিই কিন্তু অ্যানিমেটেড ঘরানার। শীর্ষ দলের মধ্যে অ্যানিমেশন নিয়েছে ছয়টি স্থান। বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট (১৯৯৪) ছাড়া সব চলচ্চিত্রই প্রকাশ পেয়েছে এই শতাব্দী শুরুর পর।
সব ধরনের প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ, ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব ইত্যাদির বাইরে শিশুদের নিয়ে আধুনিক চলচ্চিত্রের অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সেই চলচ্চিত্রগুলোতে খোদ শিশুদের উপস্থিতি খুবই কম। ১৯৮০ সাল থেকে শিশুদের জন্য যত চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো দেখলে আমরা এই সত্যই দেখতে পাব।
টেলিভিশনের জন্য নির্মিত, সরাসরি ডিভিডি আকারে প্রকাশিত ও অল্প কিছু বিদেশি চলচ্চিত্র বাদ দিয়ে আমরা পেয়েছি ৭৪৫টি চলচ্চিত্রের তালিকা। এটা নিশ্চিত যে শিশুদের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা বেড়েছে। তালিকা অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৮০-এর দশকে নির্মিত হয়েছে ১০৬টি চলচ্চিত্র। ১৯৯০-এর দশকে ২২৪টি। নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে সংখ্যাটা আরো বেড়েছে- ২৬১। আর ২০১৫ সাল শেষ হতে হতে সংখ্যাটা ৩০০ ছাড়িয়ে যাবে। গত পাঁচ বছরে নির্মিত হয়েছে ১৫৪টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র।
কিন্তু এত এত চলচ্চিত্রের মধ্যে শিশুরা কোথায়? প্রতি দশকে শিশুদের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা বেড়ে চললেও একই ঘটনা যে চলচ্চিত্রে শিশুর উপস্থিতির ক্ষেত্রে ঘটেছে তা বলা যায় না। শিশুদের খুব বেশি দেখা যায়নি চলচ্চিত্রের মূল কোনো চরিত্রে। বা যেখানে শিশুরাই চলচ্চিত্রের ধারা বর্ণনা করছে। সাল ধরে ধরে জিনিসটা এভাবে হয়েছে:
চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র থেকে শিশুর হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে, শিশুদের নিয়ে লাইভ-অ্যাকশন চলচ্চিত্রের সংখ্যা কমে যাওয়া। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝিতে (হয়তো এটাই শিশু চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি সময়, যখন শিশুদের লাইভ-অ্যাকশন চলচ্চিত্র অনেক বেশি পরিমাণে বানানো হতো, তখন সেখানে শিশুদেরই প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখা যেত।
পরে লাইভ-অ্যাকশন শিশু চলচ্চিত্রে শিশুদেরকেই মূল চরিত্র হিসেবে দেখতে না পাওয়ার বিষয়টি আরো সংশয়পূর্ণ হয়ে উঠে আরো দুটি জিনিস বিবেচনা করলে। লাইভ-অ্যাকশন চলচ্চিত্র বানাতে খরচ কম হয় (টয় স্টোরি ৩ বানাতে খরচ হয়েছে ২০০মিলিয়ন ডলার। যেখানে হোম অ্যালোন বানাতে লেগেছে মাত্র ১৮ মিলিয়ন ডলার)। আর শিশু অভিনেতারা শুধু সর্বত্রই আছে এমন না, বরং তারা আগের চেয়ে আরো ভালো করছে।
কিন্তু এটা দিয়ে কী বোঝা যায়? শিশুরা চলচ্চিত্রে একটা সত্যিকারের শিশুকে দেখছে নাকি অ্যানিমেশন চরিত্র; তা কি কোনো পার্থক্য গড়ে দেয়? চলচ্চিত্রের পর্দায় শিশুরা অন্য শিশুদের কতখানি দেখতে চায়? চলচ্চিত্রের বার্তা বা নৈতিকতার শিক্ষা কি দুই আঙ্গিকেই নেওয়া যায়?
এই প্রশ্নগুলো নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু এটা ভেবে আমাদের মনে তো প্রশ্ন আসতেই পারে যে, চলচ্চিত্রের পর্দায় অ্যানিমেশন চরিত্র দেখতে দেখতে শিশুরা কি অন্য কোনো বাস্তব শিশুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়বে?
১৯৮৫ সালের চলচ্চিত্র ‘দ্য গুনিজ’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলো কমে যাচ্ছে কেন, এমন আলোচনা করতে গিয়ে একজন লিখেছেন, ‘গুনিজের মতো চলচ্চিত্র... এখন আর সম্ভব না। কারণ এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য শিশুদের জগতে অনুসন্ধান চালাতে হয়। যা বড়দের দুনিয়া থেকে অনেকটাই আলাদা। আর শিশুদের সে রকম জগতের এখন আর অস্তিত্বই নাই।’ তারা উপসংহারে এসেছিলেন যে, গুনিজের মতো চলচ্চিত্র শুধু স্বাধীনতাকেই উৎসাহিত করে না বরং স্বাধীন চিন্তাভাবনারও বিকাশ ঘটায়।
কিন্তু এখনকার সময়ে শিশুদের জগতে অনুসন্ধান চালানোর ব্যাপার খুব বেশি ঘটে না। শিশুদের এমন একটা জগৎ আছে, যেটা বড়দের থেকে আলাদা। আর সেই জগৎ উপলব্ধি করার জায়গাও আছে। পার্থক্যটা হচ্ছে এই যে, আমরা সেই পার্থক্যটা এখন খুঁজতে যাই ফোন বা ট্যাব দিয়ে। যে কল্পিত জায়গায় কল্পনার কোনো স্থান আদৌ নেই। চলচ্চিত্র যেখানে একসময় শিশুদের চিন্তাভাবনার জগতে ঢুকতে চাইত, এখন সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে অবাস্তব কম্পিউটার স্টিমুলেশন। যেখানে শিশুদের উপস্থিতি খুব কমই দেখা যায়।
এখন সান্ত্বনা এটাই যে, এসব চলচ্চিত্র বানিয়ে তাদের বিপণন বিভাগ অন্তত বড় বড় বেলুন বিক্রি করতে পারছে!
কলিন হরগানের পুরো ব্লগটি পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে