পর্ব ২
দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস

খোয়াবগা
তিনি ছিলেন পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। জন্মেছিলেন জানুয়ারির এক শীতল রাতে, কুপির আলোয় (বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল), শাহজাহানবাদে, দিল্লির দেয়াল ঘেরা শহরটিতে। আহলাম বাজি, যেই ধাত্রী ওনাকে প্রসব করাল আর দুটো শাল দিয়ে জড়িয়ে ওনার মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘ছেলে হয়েছে।’ তখনকার পরিস্থিতির বিবেচনায়, তাঁর ভুলটি বোধগম্য।
সন্তানধারণের প্রথম মাসের মধ্যেই জাহানারা বেগম এবং তাঁর স্বামী ঠিক করেছিলেন যে, যদি তাঁদের বাচ্চাটি পুত্র হয়, তবে তার নাম রাখবেন তাঁরা আফতাব। তাঁদের প্রথম তিনটি সন্তান ছিল কন্যা। ছয় বছর যাবত তাঁরা তাঁদের আফতাবের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি জন্মালেন যেই রাতে, সেটি ছিল জাহানারা বেগমের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের।
পরদিন সকালে, যখন সূর্য উঠেছে আর চমৎকার উষ্ণ হয়েছে ঘরটা, তিনি ছোট্ট আফতাবের গায়ে জড়ানো কাপড়গুলো খুললেন। তিনি পর্যবেক্ষণ করলেন তার ক্ষুদ্র শরীরটা—চোখ নাক মাথা গলা বগল হাত পায়ের আঙুল— ধীর তৃপ্ত উল্লাসে। তখনই তিনি আবিষ্কারটি করলেন। তার পুরুষাঙ্গটির নিচে লুকিয়ে আছে, ছোট, অগঠিত, কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে একটি নারী-অঙ্গ।
কোনো মায়ের পক্ষে কি সম্ভব নিজের বাচ্চার ভয়ে দিশেহারা হওয়া? জাহানারা বেগম হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়াটি ছিল, এ রকম একটি অনুভূতি যে তার হৃদযন্ত্রটি থেমে গেছে এবং তার হাড়গুলো ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। তাঁর দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটি ছিল, তিনি কোনো ভুল করেননি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকবার দেখা। তাঁর তৃতীয় প্রতিক্রিয়া ছিল, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তা থেকে দ্রুত পিছিয়ে আসা। এই সময় তার দেহাভ্যন্তরে একটা গোলযোগ ঘটে গেল এবং মলের একটি ক্ষীণধারা তার পা বেয়ে গড়িয়ে নামতে লাগল। তাঁর চতুর্থ প্রতিক্রিয়াটি ছিল, নিজেকে এবং নিজের সন্তানটিকে মেরে ফেলার ব্যাপারে মনস্থ করা। তাঁর পঞ্চম প্রতিক্রিয়াটি ছিল, যে তিনি তাঁর বাচ্চাটিকে তুলে নিলেন এবং নিজের কাছে আঁকড়ে ধরলেন। আর সেই অবস্থায় তিনি তাঁর চেনা বিশ্ব এবং যেসব বিশ্বের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তিনি জানতেন না কোনোদিন, তাঁদের মাঝখানের একটা ফাটল দিয়ে নিচে পড়ে যেতে লাগলেন। সেখানে, সেই অতল গহ্বরটিতে, আঁধারের মাঝে ঘুরতে ঘুরতে, এত দিন পর্যন্ত যা কিছুর ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন তিনি, প্রত্যেকটা জিনিস, সবচেয়ে ক্ষুদ্র থেকে নিয়ে সবচেয়ে বড় পর্যন্ত, তাঁর কাছে অর্থবহ হওয়া বন্ধ করে দিল। উর্দুতে, তাঁর জানা একমাত্র ভাষাটিতে, সব জিনিসের, শুধু জিনিসের নয় বরং সকল জিনিসের—এমনকি কার্পেট, কাপড়, বই, কলম, বাদ্যযন্ত্র—সকল কিছুরই একটা লিঙ্গ আছে। সবকিছুই ছিল হয় পুরুষ অথবা নারী, ছেলে অথবা মেয়ে। শুধু তাঁর বাচ্চাটি ছাড়া। হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি জানতেন যে তাঁর বাচ্চার মতদের জন্য একটা শব্দ আছে—হিজরা।
শব্দ আসলে দুটো, হিজরা এবং কিন্নার। কিন্তু দুটো শব্দ মিলে তো একটা ভাষা হয় না।
এটা কি সম্ভব ভাষার বাইরে বসবাস করা? স্বভাবতই এই প্রশ্নটি জাহানারার কাছে নিজেকে সম্ভাষিত করল না একটিমাত্র শব্দের মাধ্যমে, বা একটি প্রাঞ্জল বাক্যের দ্বারা। সে নিজেকে তার কাছে সম্ভাষিত করল একটি আওয়াজহীন, আদিম হাহাকার হিসেবে।
তাঁর ষষ্ঠ প্রতিক্রিয়াটি ছিল, নিজের শরীর পরিষ্কার করা এবং এ মুহূর্তে কাউকে কিছু না জানানোর সংকল্প করা। এমনকি তাঁর স্বামীকেও না। তাঁর সপ্তম প্রতিক্রিয়া ছিল, শুয়ে পড়া আফতাবের পাশে এবং বিশ্রাম নেওয়া। যেমনটা করেছিলেন খ্রিস্টানদের ঈশ্বর। যখন তিনি স্বর্গ এবং পৃথিবী নির্মাণ সমাপ্ত করলেন। পার্থক্য হলো যে ঈশ্বরের ক্ষেত্রে তিনি বিশ্রাম করেছিলেন নিজের সৃষ্ট জগৎটিকে একটি অর্থ প্রদানের পর। যেখানে জাহানারা বেগম বিশ্রাম করছিলেন তাঁর সৃষ্টটি তাঁর জগতের অর্থকে তছনছ করে দেওয়ার পর।
যত যাই হোক, ওটা কোনো আসল যোনি না, তিনি নিজেকে বোঝালেন। ওটার পথগুলো খোলা নয় (তিনি পরীক্ষা করেছেন)। ওটা একটা উপাঙ্গ মাত্র, বাচ্চা-কাচ্চাদের থাকে এসব। হয়তো বা এটা বন্ধ হয়ে যাবে, বা সেরে যাবে, বা চলে যাবে কোনো একভাবে। তিনি তাঁর পরিচিত সবকটা দর্গায় মানত করবেন আর সর্বশক্তিমানকে বলবেন, তাকে রহমত করার জন্য। সর্বশক্তিমান নিশ্চয়ই করবেন। জাহানারা জানেন, তিনি করবেন। আর হয়তো বা তিনি করেছিলেনও। যেভাবে করেছিলেন সেটা হয়তো জাহানারা বুঝতে পারেননি পুরোপুরি।
প্রথম যেদিন শরীরে জোর পেলেন জাহানারা বেগম, শিশু আফতাবকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন হজরত শারমাদ শহীদের দরগায়। দরগাটি তার বাড়ি থেকে একটা সরল ১০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে। হজরত শারমাদ শহীদের কাহিনীটি জাহানারা তখনো জানতেন না। তাঁর কোনো ধারণাও ছিল না কিসে তাঁর পদযাত্রাটিকে হুজুরের দরগার দিকেই ধাবিত করল। হয়তো বা হুজুর তাঁকে নিজের কাছে ডেকে নিয়েছেন। অথবা সেখানে তাঁবু করে বসবাসরত অদ্ভুত মানুষগুলো তাঁকে আকর্ষণ করেছিল কোনো একভাবে। মীনা বাজার যাওয়ার পথে এই মানুষগুলোকে তিনি প্রায়ই দেখতেন। তাঁর আগের জীবনে জাহানারা এই ধরনের লোকদের প্রতি কৃপাপরবশেও তাকানোর দরকার মনে করেননি, যদি না তাঁরা রাস্তাঘাটে তাঁর সামনে পড়ে গেছে। হঠাৎ করে তাঁদেরকেই মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
হজরত শারমাদ শহীদের দরগায় আগমনকারীদের সকলে হুজুরের গল্পটি জানত না। কেউ কিছু অংশ জানত, কেউ কিছুই জানত না, এবং কেউ তাদের নিজস্ব সংস্করণ বানিয়ে নিত। অধিকাংশ লোকে জানত যে শারমাদ ছিলেন একজন ইহুদি আর্মেনীয় বণিক, যিনি নিজের জীবনের প্রেমিকটিকে অনুসরণ করতে করতে পারশিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে দিল্লি চলে এসেছিলেন। কম লোকই জানত যে তার জীবনের প্রেমিকটি ছিল অভয় চাঁদ, একজন কমবয়সী হিন্দু বালক, যার সাথে তার দেখা হয়েছিল সিন্ধুতে। বেশির ভাগ লোক জানত যে তিনি ইহুদিবাদ ত্যাগ করে ইসলামকে গ্রহণ করেছিলেন। কম লোকই জানত যে আধ্যাত্মিক সাধনার একটি পর্যায়ে গতানুগতিক ইসলাম থেকেও তার মন উঠে যায়। অধিকাংশ লোক জানত শারমাদ হুজুর জীবনযাপন করতেন শাহজাহানবাদের রাস্তাঘাটে একজন নগ্নফকির হিসেবে। পরে একদিন তাঁকে জনসমক্ষে হত্যা করা হয়। কম লোকেই জানত তাকে হত্যার কারণটি জনসমক্ষে নগ্ন থাকার অপরাধ নয় বরঞ্চ তার অপরাধের কারণটি ছিল স্বধর্ম ত্যাগ। আওরঙ্গজেব, তৎকালীন সম্রাট, তাকে নিজের দরবারে ডেকে পাঠাল এবং তাকে বলল প্রমাণ করতে যে তিনি একজন প্রকৃত মুসলিম। তিনি তাকে পাঠ করতে বললেন কালিমা : লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুহ— আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মাদ (স.) তার বার্তাবহণকারী।
লাল দুর্গের রাজদরবারে কাজী আর মাওলানাদের একটি জুরির সামনে শরমাদ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আকাশে মেঘেদের ভেসে বেড়ানো বন্ধ হয়ে গেল, উড়ন্ত পাখিরা মাঝপথে স্থির হয়ে গেল, দুর্গের ভেতরের বাতাস ক্রমশঃ ঘন আর দুর্ভেদ্য হয়ে উঠল যখন তিনি কালিমা পাঠ শুরু করলেন। কিন্তু তিনি শুরু করতে না করতেই থেমে গেলেন। তিনি বললেন শুধু প্রথম অংশটুকু : লা ইলাহা। কোনো ঈশ্বর নেই। এর বেশি আর অগ্রসর হওয়া তার হবে না, হুজুর দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন, যতক্ষণ না তিনি তার আধ্যাত্মিক সাধনা সমাপ্ত করছেন এবং ঈশ্বরকে গ্রহণ করতে পারছেন নিজের সমস্ত হৃদয় দিয়ে। তার আগপর্যন্ত, তিনি বললেন, কালিমা পাঠ করা হবে শুধুই প্রার্থনা নিয়ে তামাশা করা। কাজীদের সমর্থনক্রমে, আওরঙ্গজেব শারমাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন।
এর থেকে যদি এমনটা ধরে নেওয়া হয় যে, এই গল্পটি না জেনেই যাঁরা তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হজরত শারমাদ শহীদের কাছে গিয়েছেন, তাঁরা সেটা করেছেন অজ্ঞতাবশত, ইতিহাস আর সত্যের ব্যাপারে খুব বেশি সচেতন না হয়ে, তাহলে ভুল হবে। কারণ দরগার ভেতরে, শরমাদের স্বাধীন আত্মাটি, প্রবল, অনুভবযোগ্য এবং যেকোনো ঐতিহাসিক তথ্যাবলির স্তূপের থেকে অনেক বেশি সত্য হয়ে দেখা দিত তাঁদের সামনে, যাঁরা তাঁর দোয়াকামী। এটা উদযাপন করত (কিন্তু কখনো উপদেশ দিত না) ধর্মীয় দীক্ষাদানের বদলে আধ্যাত্মিকতার শুদ্ধ শক্তিকে, বিত্ত আর জিদের তুলনায় সারল্যকে, এমনকি নিঃশেষিত হওয়ার সম্মুখ সম্ভাবনার সামনে পরমানন্দদায়ক প্রেমকে। শারমাদের আত্মা ওনার কাছে আগতদের অনুমতি দিত তার গল্পটিকে নেওয়ার এবং তাদের সেটাকে যা হওয়া প্রয়োজন তাই বানিয়ে নেয়ার।
যখন জাহানারা বেগম দরগায় একটি পরিচিত মুখ হয়ে গেল, তখন সে গল্পটি শুনল (এবং তারপর প্রচার করে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিল) যে কীভাবে শারমাদের শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল জামা মসজিদের সিঁড়িতে এক বিশাল জনতার সম্মুখে যারা তাকে ভালোবাসত এবং সেদিন সমবেত হয়েছিল তাকে বিদায় জানাতে। যে কীভাবে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরেও হুজুরের মস্তকটি আবৃত্তি করে যাচ্ছিল তার প্রেমের কবিতাগুলো, এবং কীভাবে তিনি তার বাক্যরত মাথাটিকে তুলে নিলেন, যে রকম স্বাভাবিকভাবে আজকের দিনের একজন মোটরসাইকেল চালককে দেখা যায় তার হেলমেটটিকে তুলে নিতে, আর হেঁটে উঠলেন জামা মসজিদের সিঁড়ি ধরে এবং তারপর, ওই একই রকম সাবলীলভাবে, সরাসরি স্বর্গে চলে গেলেন। সেই কারণেই, জাহানারা বেগম বলত (শুনতে ইচ্ছুক যে কাউকে), হজরত শারমাদের ক্ষুদ্র দরগায় (যেটা পর্বতের গায়ে সেঁটে থাকা শামুকের মতো আটকে ছিল জামা মসজিদের পূর্বদিকের সিঁড়ির ধাপগুলোতে, সেই একই জায়গা যেখানে তার রক্ত গড়িয়ে পড়ে একটা ছোটখাটো পুকুরের মতো তৈরি করেছিল), মেঝেটি লাল, দেয়ালগুলো লাল এবং ছাদটি লাল। তিনশ বছরের উপর চলে গেছে, তিনি বলতেন, কিন্তু হজরত শারমাদের রক্ত ধুয়ে ফেলা যায়নি। যে রঙেই তারা রং করুক না কেন তার দরগাটিকে, জাহানারা বেগম জোর দিয়ে বলতেন, সময়ের সাথে সাথে এটা নিজে থেকেই লাল হয়ে যায়।
প্রথমবারের মতো যখন জাহানারা পার হলেন সেই জনতার ভিড়টি—আতর আর তাবিজের দোকানদাররা, দরগায় আগতদের জুতার জিম্মাদাররা, খোঁড়া-আতুররা, ভিখারিরা, ঘরহারারা, ঈদে কোরাবানির জন্য মোটা করা হচ্ছিল যেই ছাগলগুলাকে, আর নীরব, বয়স্ক খোঁজাদের যেই জটলাটি সংসার পেতেছিল দরগার বাইরে একটি তার্পোলিনের নিচে—এবং ক্ষুদ্র লালরঙের কক্ষটিতে প্রবেশ করলেন, জাহানারা বেগম শান্ত হয়ে গেলেন। রাস্তার শব্দগুলো ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল আর মনে হলো খুব দূর থেকে আসছে। তিনি এক কোনায় বসলেন কোলে তার ঘুমন্ত সন্তানটিকে নিয়ে, দেখতে লাগলেন লোকজনদের, মুসলিম এবং সেই সাথে হিন্দুরা, একজন দুজন করে আসে, আর সমাধিটির চারপাশের গ্রিলে লাল সুতা, লাল চুড়ি আর কাগজের টুকরা বেঁধে দেয়, সকাতরে প্রার্থনা করছে শারমাদ যেন তাদের আশীর্বাদ করেন। একমাত্র যখন জাহানারা বেগম খেয়াল করলেন ঘষাকাচের মতো অস্বচ্ছ শরীরের এক বৃদ্ধ লোককে, যিনি তার কাগজের মতো চামড়া আর আলো দিয়ে বোনা সুতার মতো দাঁড়ি নিয়ে এক কোনায় বসে আছেন, দোলা খাচ্ছেন সামনে পিছে, নীরবে কেঁদে চলেছেন যেন তার হৃদয় ভেঙে গেছে, তখন জাহানারা নিজের অশ্রুধারাকে বইতে দিলেন। এই আমার ছেলে, আফতাব, তিনি ফিসফিস করে বললেন হজরত শারমাদকে। আমি তাকে এখানে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। তার দিকে খেয়াল রাখবেন। আর আমাকে শেখান কীভাবে তাকে ভালোবাসব।
হজরত শারমাদ তেমনটাই করেছিলেন।
(চলবে)
(সালেহ মোহাম্মদ অনূদিত বইটি প্রকাশ করবে ‘চারদিক’)