জুননু রাইনের একগুচ্ছ কবিতা
ব্যর্থতাগুলোর গভীর সফলতা
১.
আমার ব্যর্থতাগুলো গভীরভাবে সফল। আতঙ্কের চাষাবাদে ভরপুর। জাগিয়ে তুলতে পেরেছে নদীর বুকভরা বালুর হাহাকার। খেলার মাঠ থেকে শিশুদের তাড়িয়েছে মহানন্দে। মায়া হরিণকে উলঙ্গ করছে বীভৎস নির্মমতায়।
আমার ব্যর্থতাকে করপোরেট রোবট ভাঁজ করে রাখে অদৃশ্য সিন্দুকে। যে সিন্দুকের তালা দেখা যায় না। চাবি হয় না। আমি আমার ব্যর্থতাকে আহত করতে পারি না। আমি শুধু একটি নদীকে ভালোবাসি। যে বহমান প্রতিটি সবুজ ঢেউ এর পলকে। যে নদীটিকে মানুষ মুহূর্তের মধ্যেই লুকিয়ে ফেলে তার প্রতারণার নিজস্ব পালকে।
আমার ব্যর্থতাগুলো এক একটি উদ্ভট রং প্রসব করে। আমি নিতে চাই না। ফেলানী, তনু, সাত খুন, বিশ্বজিৎ, সাগর-রুনী, হযরত আলী, আয়েশা, হলি আর্টিজানকেও আমি মানি না। অথচ আমি এড়াতে পারছি কি না, তা নিয়েই আমার ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ!
আমার ব্যর্থতাগুলো সীমানায় আতঙ্ক এঁকে দেয়। এবং সেটা শুধু সে আমাকেই দেখায়। আমাকে কাঁটাতারের সত্যতা শেখায়। আমি কোনোভাবেই দায়ী নই বনে আগুন দেওয়ার জন্য এবং মৃত্যুর বীজ রোপণের জন্য। অথচ আমার ব্যর্থতা আমাকে সফলতার মতো মৃত্যুর গতিতে ছুড়ে ফেলছে। আমি বুঝে ওঠার আগেই প্রতিযোগিতা আমার আকাশকে পাখিহীন করছে। আমার সারল্যের বৃষ্টি শরণার্থীর ভয়ার্ত চোখে ঝরিয়েছ।
আমি বিশ্বাসকে ভয় পাই শেকলের চেয়েও বেশি। অথচ মানুষকে দখলে নিয়েছে বিশ্বাস। আমি সন্ত্রাসে বিশ্বাসী নই। যেমনটি নই ক্রসফায়ারেও। আমি কোনো মানুষ দেখি না, যাদের হাতে-চোখে রক্ত নেই। অথচ আমি হাসির মতো জীবন ভালোবাসি। অশ্রুর মতো জীবনের অর্থ।
২.
সবগুলো ব্যর্থতা জমা হোক, আপত্তিহীন পুরোনো খুচরো পয়সায় কথা বলুক। আমরা দেখতে পাব কাচে ঢাকা চোরাবালির ইতিহাস। ডায়রিয়া রোগীর মতো সুন্দরবন, ফেলে আসা কিশোরবেলার স্মৃতির হাহাকারে ডোবা শুকনো নদী।
এক একটি মাছ খুব সাবধানে লাফিয়ে উঠবে অ্যাকুরিয়ামে। অ্যাকুরিয়াম আমাদের না, আমরাও অ্যাকুরিয়ামের নই; এ কথা কে বিশ্বাস করাবে সন্তানদের!
সেদিনও সূর্য উঠবে মন্ত্রী বাহাদুরের প্রবল প্রতাপে, যদিও তিনি থাকবেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরাজিত ঘরে। বাংলার হাঁসগুলো সংখ্যালঘু হবে, গরুগুলো আদিবাসী। তাদের চোখে রক্ষিত হবে ভালোবাসার নদী জল আর স্নেহের চর।
আমরা তাদের মরে যেতে দেখব...
দেখতে দেখতে মরে গিয়েও জানব না, আমরা, আমরা মরে যাচ্ছি।
সাভার ট্র্যাজেডি ২৪/৪/১৩
কালরাতে আমি কী স্বপ্নে দেখব! এই কথা ভেবে ভেবে ভুলতে চেষ্টা করছি টিভি সাংবাদিকের করা প্রশ্ন, প্রশ্নের উত্তর আর উত্তর দেওয়া মৃত্যুর অদৃশ্য আঁচড়ে জড়িয়ে রাখা পোশাকশ্রমিককে।
‘আমাকে বাঁচান, যে হাতটা চাপা পড়ে আছে সেই হাতটা কেটে ফেলে হলেও আমাকে বাঁচান।’ টিভি সাংবাদিকের হয়ে আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়েছিল ওই শ্রমিককে, আপনার এত তাড়া কিসের? আপনি একহাত নিয়ে হলেও আবার কালকে সকাল ৭টার মধ্যে কারখানায় যেতে না পারলে মাইনে কাটা যাবে?
আমি দেখতে পাচ্ছি সে তার পিঠ দিয়ে ঠেলে রেখেছে নয়তলার নয়টি ছাদ, নিজেকে থেঁতলে যেতে দেবে না, তার শরীরের ঘাম পৃথিবীর তিন ভাগ পানির সমান, সে সাঁতরাবে শ্রমের প্রার্থনায় অর্জিত নোনা সমুদ্রে। জীবনকে পৌঁছে দিতে তার প্রকৃত অর্থে...।
সাংবাদিক আপনি তখন অর্ধপুরুষের ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার পাশে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছেন?’
আমি পূর্ণাঙ্গ কাপুরুষের মতো কেঁদে ফেললাম, ওই পোশাকশ্রমিক যখন তেজদীপ্ত হয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে জানালেন, ‘আমার দুপাশে অনেকগুলো লাশ থেতলে আছে, আরেকটু দূরে কয়েকজন চাপা পরে আছে,
তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছে...
... আমার হাতটা কেটে হলেও আমাকে বের করুন’।
সাংবাদিক আমি তো ওই শ্রমিকের জীবনের মূল্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করিনি, আমি তো তাঁকে এখানে আনিনি যে, ১০০ টাকায় জীবনের ঝুঁকি না নিলে তাঁকে না খেয়ে মরতে হবে!
তবে কেনো আমার বুকে ৯ তালা না, ৯০০ তালার চেয়েও বেশি ওজনের একটি কালো পাহাড় চেপে আছে?
কেন শ্রমিকটির সঙ্গে কথা বলতে আপনার কণ্ঠস্বর ভিজে আসছিল?
না হয় বুঝলাম, একটা হাত কেটে ফেলে হলেও ওই শ্রমিকের বেরিয়ে আশার তাড়া আছে, আগামী কাল সকাল ৭টার মধ্যে গার্মেন্টসে যেতে না পারলে তার মাইনে কাটা যাবে বলে।
কাকতাড়ুয়া
একা থাকার জন্য সে ছেড়েছিল রক্ত-মাংসের জীবনের স্বাদ
কত রাত্রি তার ওপর বয়ে যায় ভয়াল অন্ধকার
তার পরেও সে ফসলের স্বপ্নে ভরিয়ে দেয় কৃষকের অন্তর।
একা থাকতে থাকতে দেখে ফেলল কোনো এক রাতে—
দাঁড়িয়ে আছে সে একারই সাথে।
বিশ্বজিৎ
আমার জানালার পাশে একটি রঙিন মৃত্যু হাসে
প্রলম্বিত রাতের অন্ধকারে হেলান দিয়ে
ঠোঁটে সিগারেট হাতে হুইস্কির পেয়ালা নিয়ে
আমার জানালার পাশে
... একটি অমর মৃত্যু হাসে।
বৃষ্টি
একদিন বৃষ্টি হবে
ব্যথিতের রক্তক্ষরণের
গুঁড়ো গুঁড়ো দারিদ্র্যের শব্দে
সূর্যের লাল চোখরাঙানি ঝরিয়ে
শতাব্দী থেকে শতাব্দী দীর্ঘ আর্তনাদে
...একদিন বৃষ্টি হবে।