সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

জুলেখায় তো কান্দতে কান্দতে, হিক্কা তোলতে তোলতে, পাঁচ বচ্ছর আগের সগল কতা ভাইঙ্গা-চুইরা কইয়া যাইতাছে; সেয় নি একবার খেয়াল করতাছে যে, তার অই সগল কতা তার লগে বহা ময়-মুরুব্বিগিলির অন্তরে কোন দাগা দিতাছে! কোন দাগার দাগা দিয়া একেক জোন মুরুব্বিরে ফানা ফানা কইরা ফালাইতাছে অর কতাগিলি—জুলেখায় বোজতাছে?
না! জুলেখার সেইদিগে কোনো হুঁশ নাই! কোনো বিষয়েরই তার কোনো হুঁশ নাই। আশপাশের কোনো কিছু নিয়াই য্যান অর আর কোনো গর্জ নাই! কোনো কিছুরই কোনো হিসাব-কিতাব রাখোনের য্যান অর আর ঠেকা নাই!
অর মোখের দিগে চাইয়া অন্য সগলতের মোনে হইতাছে যে, নিজের ভিতরের কতাটি কইয়া সারোনের ঠেকাখানই খালি আছে অর! এই একটা ঠেকাই! আর কিছু নাই।
সেই কারোণেই য্যান জুলেখায় পাঁচ বচ্ছর আগেকার কোনো একটা কথারেও এড়ানি দিয়া যাইতাছে না। যা যা ঘটছিলো, তার সগলই যেমুন জুলেখায় বিশদ কইরা কইতাছে, তেমুন সেই সব ঘটনার কালে তার নিজের পরানের ভিতরে যেমুন যেমুন কাঁপাকাঁপি, লড়া-চড়ি উঠছিলো—তাও খুইল্লা-মেইল্লা কইতাছে!
কোনো একটা কথারেই উয়ে একটা রত্তি গোপন করতাছে না! কিচ্ছু ঢাকা রাখতাছে না উয়ে! য্যান উয়ে নিজের কাছেই নিজে কিরা-কসম কাইট্টা লইছে যে, লাজ-শরমের ধার ধারোনের দিগে আর যাইবো না সেয়! অখন অর কপালে বাঁচোন-মরোন যাই থাকুক; সগল ভেদের কতা আউজকা ভাইঙ্গা ফালাইবোই! কিচ্ছু লুকাছাপি রাখবো না! একটা কিচ্ছু না!
এমুন কিয়ের হুতাশ অর! কিয়ের এতো জ্বালা! এমুন ক্যান করতাছে জুলেখায়!
আবার দেখো, ভেদের কতা কইতে কইতে জুলেখায় তার চউখও বলতে খোলা রাখতে পারতাছে না। সেয় কতখোন তার চউখ, কোনোমতে, এই অল্প এট্টু, খোলা রাখতে পারতাছে। আবার আপনার তেনেই অর চউখ বুইজ্জা যাইতাছে গা।
চউখ বোজা থাকা নিয়া মুরুব্বিগো কোনো কতা নাইক্কা! বিমারি শইলই তো ছেড়িটার! কতা কইতে গিয়া কাহিল হইয়া চউখ বুইজ্জা থুইতেই পারে উয়ে!
কিন্তু ফ্যাসাদ বান্ধতাছে তো অন্য বিষয় নিয়া! জুলেখায় যেট্টুক সময় চউখ খোলা রাখতে পারতাছে, সেই সময়টুক দেহো কেমুন আচুইক্কা ব্যাভার করতাছে!
সেয় তহন করতাছে কী—হয় কতখোন মাটির দিগে চউখ নামাইয়া আপনা মোনে কতা কইয়া যাইতাছে; নাইলে কতখোন দূরের আসমানের দিগে চাইয়া থাইক্কা থাইক্কা কতা কইতে থাকতাছে! মুরুব্বি একজোনের দিগে চাওনের কতাও মাথায় আহে না অর! এইটা কেমুন কাম! কেমুন ব্যাভার অর!
এই যে তারে ঘিরা নানামতে, তার কয়জন মুরুব্বি যে বহা দিয়া আছে—তাগো কতা য্যান আর তার খেয়ালে নাই! দিন-দুনিয়ার কোনো কিছুরেই য্যান আর তার খেয়ালে নাই। এমুনকি দেহো অর নিজেরেও য্যান অর নিজের খেয়ালে নাই! থাকার মিদে খালি খেয়ালে আছে অর অই গুপ্তি কথা কয়টা!
বিষয়খান কেমুন গোলমাইল্লা গোলমাইল্লা লাগে য্যান ইমাম হুজুরের কাছে! এমুন বেধোন্ধা দেহায় ক্যান জুলেখারে!
এই যে ছেড়ির মুরুব্বি কয়জোনে যে অর কথাটি শোনতাছে, অর কতাটি শুইন্না তাগো অন্তর যে পলকে পলকে ছিঁড়া তেনা-তেনা হইয়া যাইতাছে—ছেড়িয়ে তার হিসাব রাখতাছে কোনো? রাখতাছে না!
ইমাম হুজুরে তো মইধ্যের উঠানের আমগাছের ছেমায় জলচৌকির উপরে বহা আছে এক্কেবারে পইল্লার তেনে। সেয় বহা আছে জুলেখার বাও দিগে। জুলেখার মায় আছে জুলেখার ডাইনে বহা। মায়ে-ঝিয়ে তারা কোনোজোনেই পাটিতে বহা না! গাছের ছেমায় তো মংলার মায় পাটি পাইত্তা থুইছে কুনসোম! অহন, কেউ হেইটায় না বইলে মংলার মায় কী করবো! জুলেখার মায় জুলেখার মতোনই উঠানের মাটিতে লেট দিয়া বহা।
মংলার মায় বইছে তার নিজ ভাও মতোন। পাতলা পিঁড়িখান পাইত্তা সেয় বইছে এইনকার মানি মানুষগো নজরের আউলিতে। বইছে হগলেতের পিছে। বুঝ কইরাই বইছে সেয়।
জুলেখারে নিয়া কতা-বারতি চলোনের কালে কোনো কিছু আনুন্তি-নেউন্তির দরকার পড়লে সেয় আলগোচ্ছে উইট্টা যাইতে পারবো গা; আবার দরকার শেষে চুপ্পে আইয়া নিজের জাগায় বইতেও পারবো সোন্দর মতে। লড়াচড়ির কোনো আওয়াজ তুইল্লা সেয় কেউইরে ঝামেলা করোনের কোনো রাস্তা রাখে নাই!
আবার দেখো, তার সাধ্যি মতোন দরকারি কামটি না কইরাই সেয় আইয়া পিঁড়ি পাইত্তা বয় নাই! কেউ তারে হুকুম করে নাই, কিন্তুক জুলেখার কতা হোনতে বহোনের আগে সেয় ছুত-ছাত পাওয়ে ঠিকই ইসুফ মিয়াগো বাইত গেছে—অর মায়েরে দরকারি খবরটা দিতে!
আওয়া-না আওয়া ইসুফ মিয়ার মায়ের ইচ্ছা, কিন্তু এমুন গুরুতর কথা চলাচলির কালে তার কানে খবরটা তো পৌঁছনি দেওন লাগে! সেইটা করতে মংলার মায় কইলাম এট্টুও ভুল করে নাই!
যেয় কি না আন্ধার দুক্ষের দিনে, আবাগী জুলেখার মা বিধবারে, অমুন দুই ডেনা দিয়া আগলাইয়া রাখছে; তারে আউজকার খবরখান না দেওয়া যায় কোন প্রকারে! না দিলে বেইমানি করা হয় কি না! হয়।
সেই ভাবনা ভাইব্বাই মংলার মায় এক লৌড়ে গিয়া ইসুফ মিয়ার মায়রেও খামাখা কইরা আইতে কইয়া আইছে।
এমুন জলদি আওনের ডাক পাইয়া ইসুফ মিয়ার মায়ও আইতে দেরি করে নাই। সেয়ও লগে লগেই আইয়াই বইছে জুলেখার মাওয়ের পাশে। এই ত্তো! এই কয়জোন মাইনষে হোনলেই ত্তো চলবো দুক্ষিণী জুলেখার কথা! আর কেউইরে লাগবো না।
কিন্তু তার বাদেও ক্যামনে জানি আরেকটা কেমুন আচানক কারবার হইয়া যাইতে দেখে মুরুব্বি কয়জোনে! তারা কেউই চিন্তাও করতে পারে নাই, এমুন এক তাজ্জুবের ঘটনা ঘটে! বড়োই আচানক এক বেপার!
ইসুফ মিয়ার মায় খালি আইয়া জুলেখাগো উঠানে বইছে; এমুন সোমে সগলতে দেখে যে, অতি ধীর পাওয়ে ইসুফ মিয়ায়ও আইয়া খাড়াইছে জুলেখাগো পচ্চিম ভিটির শেষ মুড়ায়! আইছে সেয় অতি চুপে! তার আসোনের সোম তার পাওয়ের আওয়াজ এট্টুও ওঠে নাই!
একটা বিলাই হাঁটোনের আওয়াজের মতোন আওয়াজও উঠতে দেয় নাই ইসুফ মিয়ায়।
যেমুন নিজের মতে আহে সেয়, তেমুন আইয়া সেয় করে কী—কেউইর খাতিরদারির লেইগা এট্টুও বার না চাইয়া-আপনার তেনেই বইয়াও পড়ে পচ্চিম মুড়ার কাঠোল গাছটার গোড়ায়! অতি চুপেচাপে।
কে আইতাছে কে বইতাছে সেই দিগে জুলেখার তো কোনো নজর নাই! সেয় বইয়া আছে সগলতের লগে; কিন্তু জুলেখার ভাবে তো সগলতেই পষ্ট বোজতাছে যে, অই মাইয়ায় সগলতের লগে নাই! থাইক্কাও নাই সেয়!
সেয় ইসুফ মিয়ার আনা-যানা নজরে নিবো কী, নিজের কান্দন কাইন্দাই ত্তো কূল পায় না! আর, অর যে নিজের মায়রে ছাড়া আর কেউইর কথা খেয়ালে আছে, অর ভাব-গতিক তো সেইটা কয় না!
কো! জুলেখায় তো দেহি অর বাপের কতা একবারও জিগায় নাই! বাপে আছে-না মরছে, সে বিষয়ে একটা কতাও তো জিগাইয় নাই উয়ে, এই তরি! একবারও না! মংলার মায় তো একবারও হোনলো না যে, জুলেখায় অর বাপের কোনো ডাক-খোঁজ করছে! সেই বেবোধা অইয়া যাওয়া মাইয়ায় নি খেয়াল করবো ইসুফ মিয়ার আউন্তির! এট্টুও করে নাই।
তয় জুলেখায় নজর করুক আর না করুক; মুরুব্বিরা কিন্তুক ইসুফ মিয়ারে এমুন আঁতকার মিদে আইতে দেইখ্যা পুরা বাক্যিহারা হইয়া যায়! ইসুফ মিয়ায় অখন এইনে আইলো কী মোনে কইরা! এই কয়দিন তো অর চলা-চলতি দেইখ্যা কেউইরই বিশ্বাস হয় নাই যে, জুলেখারে আর অর স্মরণে আছে!
ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায় জুলেখারে পাউন্তির পরে সেয় খালি একবার হাছা-মিছা কোনোরকমে আইয়া, খাড়ার উপরে জুলেখারে এক নজর দেইখ্যা গেছে গা। একবার খালি দেইখ্যা গেছে। তার বাদে আর আহে নাই। ইসুফ মিয়ার মায় তো এই বাড়িতে আনা-যানার উপরেই আছিলো। নিজের মায়রেও ইসুফ মিয়ায় জুলেখা বিষয়ে নেক-বদ কিচ্ছু জিগায় নাই! একটা বারও না।
কিচ্ছু জিগায় নাই, আবার অই একবারের বেশি একটা পাড়াও দেয় নাই সেয় এই ভিটিতে!
অখন ইসুফ মিয়ায় তাইলে কী কারণে আইলো! তারে তো আইতে সংবাদ দেয় নাই ইমাম হুজুরে! জুলেখার মায়ও তো খবর পাঠায় নাইক্কা কোনো!
ইসুফ মিয়ায় যে এমনে তার মায়ের পিছে পিছে আইয়া হাজির হইতে পারে, সে বিষয়খান, এমুনকি ইসুফ মিয়ার মায়ও তো চিন্তা করতে পারে নাই! কোন ফাঁকে তার পাগলা পুতে মংলার মায়ের কথারে খেয়াল করছে, ক্যামনে তার বাদে কী মোনে কইরা উয়ে জুলেখাগো বাইতও আইয়া খাড়া হইয়া গেছে, সেই বিষয়খান মায়ে যেমুন ধরতে পারতাছে না! অন্য সগলেও তেমুন আন্দাজ করতে পারতাছে না!
উয়ে যে কিয়ের লেইগা কী করে, কে ধরতে পারে! অর মোনের ভেদ ফেরেশতারা নি ধরতে পারবো! মাইনষে তো দূর!
তয় আইছে ভালোই হইছে! ইমাম হুজুরে চিন্তা কইরা দেখে যে, এক হিসাবে এইটাই সঠিক কাম হইছে! সগল ভালা-মন্দের অংশী খালি ইমাম হুজুরে থাকলেই কী চলে নি! আরেকজোন সাব্যস্ত পুরুষপোলারও তো এই বিত্তান্তের ভাগীদার থাকোনের কাম! তাইলে ঠেকা-বেঠেকায় বুঝ-বিবেচনা করোনের সোমে খালি একলা ইমাম হুজুরের উপরে চাপখান থাকে না!
আরো কতা আছে! এই বাড়ির আপদ-বালাই-মুসিবতের দিনে সগল কিছুরে সামলানি দেওনের যেই কঠিন কামটা ইসুফ মিয়ায় তার মায়ের লগে লগে কইরা গেছে, সেই হিসাবে সেয়ও ত্তো অখন এই বাড়ির এক মুরুব্বি! এই ভিটির এই নয়া বিপদের কতা হোনোনের বড়ো হকদার সেয়ও! তারে আওনের সংবাদ না পাঠানই ত্তো মস্তো ভুল কাম হইছে জুলেখার মায়ের!
নিজের তেনে আইয়া না ইসুফ মিয়ার জুলেখার মায়রে শরমের তেনে বাঁচাইয়া দিছে!
ভিতরে ভিতরে এমুন শত জাতের বিষয়ের ঘোটাঘুটি লইয়া মুরুব্বিরা জুলেখার কতা হোনোন শুরু করে।
কিন্তুক, সেই কাহিনী এট্টু হুইন্নাই ত্তো কেউইর কইলজায় পানি থাকে না! হায় হায় হায়! এইটা জুলেখায় কী কয়! এইটা কী কয়!
এই ঘটোনার মিদে ইসুফ মিয়ায় আহে ক্যামনে! ইসুফ মিয়ার কথা ওঠে ক্যান এইনে!
হায় হায় হায়! জুলেখায় এটি কী কয়! ইসুফ মিয়ার মায়ের মাথা গুরগুরাইয়া ঘুরতে থাকে! হায় হায়! এতোকাল বাদে আউজকা এইটা কোন ইজ্জত-খোয়াইন্না কথা হোনতাছে ইসুফ মিয়ার মায়!
পোলায় তাইলে তার বাপ-মায়রে ভাঁড়াইছে! জুলেখারে তাইলে ভাগাইয়া নিছিলো উয়েই! আর, হেই কথা উয়ে বাড়িরে জানায় নাইক্কা এতোদিন! করছে কী! পোলায় এইটা করছে কী!
আরে ছেড়িরে তুই ভাগাইয়া নিছিলি, নিছিলি! তারে বাইত না আনতে মাথার কিরা দিছিলো কেটায়! খাওয়াইতে পারলে বেটা মাইনষে চাইরটা বিয়া করবো! দোষ তো নাইক্কা কোনো! কিন্তুক হেইটা নয়া কইরা নি উয়ে ছেড়িরে লইয়া মউজ কইরা—শেষ কাটালে মাইয়াটারে রাস্তায় ফালাইয়া থুইয়া আইছে!
খোদা পরোয়ারদিগার! অহন তো এই কথা দশ লোকে গাইবো! দশ গেরামে জানাজানি অইবো পুতের কুকীর্তির কথা! ইয়া মাবুদ! অর বাপের তো নাক কাটা যাইবো! আল্লা! সেয় লোকেরে মোখ দেখাইবো ক্যামনে! আল্লা! এই পুতেরে পেটে ধইরা এই কলঙ্ক কপালে আছিলো মায়ের!
জুলেখার কতা হোনতে হোনতে মোনে মোনে নিজের কপালে নিজেই পিছার বাড়ি দিতে থাকে ইসুফ মিয়ার মায়! পিছার বাড়ি দিতে থাকে, আর চিপচিপাইয়া বিলাপ পাড়তে থাকে সেয়।
ইসুফ মিয়ার মায়ের লড়াচড়ি দেইখ্যাই ইমাম হুজুরে ধইরা ফালায় যে, বেপার তো গুরুতর! অখন যুদি এই মাতারি ডাক-চিইক্কুর লাগাইয়া দেয়, তাইলে তো জুলেখার সগল বিত্তান্ত খোলাসা কইরা জানোনের পোথখান বন হইয়া যাইবো! কথার মিদে যতো বাগড়া পড়বো, ততো না আসোল বিষয়টা পরিষ্কার হওনের রাস্তায় আটকানি পড়বো! সেইটা তো হইতে দেওন যাইবো না!
এই ভাবনায় উতলা হইয়া ইমাম হুজুরে হাবে-ভাবে ইসুফ মিয়ার মায়রে ঠান্ডা থাকতে মিন্নতি করতে থাকে। কউক না জুলেখায়—অর কতা! আগে তো সগলতে হুনুক সব কতা! হাছা-মিছা পরে যাচাই করোন তো যাইবোনেই! কথা তো পচে না!
ইসুফ মিয়ার মায়রে কোনোমতে এট্টু ঠান্ডা করলে কী! হুজুরে দেখে যে; অদিগে জুলেখার মায়ে না কোরোধে, লাজে ফাইট্টা যাইতাছে!
করছে কী! তার মাইয়ায় এইটা করছে কী! অই ছেড়ায় অইলো বড়ো-মাইনষের পুত। অর ফুঁসলানির তলে নি গিয়া পড়ছে তার বেকুব মাইয়ায়! হায় হায়!
কো! ভাগাইয়া যে নিলো সেয় গরিবের মাইয়াটারে, নিয়া দি তারে বিয়াইস্তা বউয়ের জায়গাখান দিলো না!
নিয়া দি মউজ কইরা, ছোবড়া বানাইয়া ফালাইয়া থুইয়া, সোন্দর আরেক বড়োঘরের মাইয়ারে লইয়া সংসার করতাছে! হায় হায় হায় রে! কতো বড়ো সীমারের সীমার ইসুফ মিয়ার মায়ের এই হারামজাদা পুতে! নিলি যে তুই পরের মাইয়াটারে, ঘরের বাইর কইরা যে নিলি তারে, হেরে ক্যামনে তুই রাস্তায় ফালাইয়া দিয়া, নিজে ঘরে আইয়া বইলি!
অরে পয়মালের ঘরের পয়মাল! খোদার বিছার আছে রে! খোদার বিছার আছে! নাইলে তুই এমনে এমনেই এমুন কুছবি, কুসাইধ্যা হস নাই! বিনা কারণে তর বউ এমুন সুতিকা রুগী হইয়া বিছনায় পইড়া রয় নাই! করলি না বড়োলোকের মাইয়ারে নিয়া ঘর-সংসার? করলি না? দিছে আল্লায় এই পাঁচ বচ্ছরের মিদে কোনো পোলাপান তোরে? দেয় নাই!
বিনা দোষে দুষী করছস না তুই আমার না বুঝ মাইয়াটারে! তর বিছার খোদাতাল্লায় করতে বাকি রাখবো না রে আঁটকুড়া!
গলা ছাইড়া দিয়া ইসুফ মিয়ারে ঝাড়তে বাঞ্ছা হইতে থাকে জুলেখার মায়ের। না না না! এতো বড়ো অনায্যি কামেরে এমনে মোখ বুইজ্জা সওনের খ্যামতা জুলেখার মায়রে দেয় নাই খোদায়! সেয় আউজকা অখন অই কুত্তার ছাওয়ের চউদ্দ গুষ্টিরে পিছা না মাইরা চুপেচাপে বইয়া থাকবো না! আলা যা থাকে কপালে! হুজুরে আলা যতোই না ক্যান ঠান্ডা থাকতে তারে খোসামোদ করুক! জুলেখার মায় ঠান্ডা থাকব কোন পরানে!
এই চেত যেমুন ভিতরে ওঠে জুলেখার মায়ের, লগে লগে এক গহিন ঘিনও পাঁক দিয়া ওঠতে থাকে তার ভিতরে! করছে কী দ্যাখছো ছিনাল মাইয়ায়! করছে কী ঢেমনীর ঘরের ঢেমনীয়ে!
তুই যে অই ফুঁসলানির তলে পড়লি, অহন তোর উপায়টা হইবো কী! আ লো কলঙ্কী! তোরে তো দশলোকের মোখে রেহাই দিবো না! হগলতে তরে কুকতা দিয়া দিয়া ফাঁইড়া ফালাইবো লো!
তোরে আমি ঘরে ঠাই দিমু ক্যামনে! ক্যামনে আমি এই দাগি, কলঙ্কীরে নিয়া সমাজে মোখ দেহামু!
নিজের ভিতরে এই কোরোধের গরজানি সগল পাইতে পাইতে আঁতকা একবার জুলেখার মায়ের স্মরণে আহে যে, জুলেখায় না কইছিলো শরিয়ত মাইন্না অরে বিয়া করছে অর খসমে! সেইটা কী তাইলে মিছা কইছে জুলেখায়? নাকি হাছা? ও আল্লা!
আইচ্ছা! জুলেখার কতা তো অহনও শেষ হইয়া যায় নাই! আধা-কতা হুইন্নাই যুদি জুলেখার মায়ে এমুন মাতা-খরাপী দেহাইতে থাকে, তাইলে তো বিষয়টার কোনো সঠিক সুরাহা করোনের উপায় থাকে না!
জুলেখার মায়ের কষ্ট এইনের কে না বোজতাছে! সগলতেই বোজতাছে! এইনের মুরুব্বিরা সগলতে হক্কের পক্ষে থাকা মানুষ! বাপের বিরুদ্ধের হক কথা, তারা বাপের কোলে বইয়া হইলেও কইতে পারে!
ইসুফ মিয়ায় যুদি এই কুকাম কইরা থাকে, তার নায্যি বিছার করতে কী ইসুফ মিয়ার বাপে মায়ে নি পিছপাও হইবো! আর, হুজুরেই নি হক-কথা নয়া কইয়া খাম্বা হইয়া বইয়া থাকবো! এইটা বোঝে না জুলেখার মায়? খামাখা দাপাইলে হইবো? মাইয়াটায় কতাগিলি শেষ করুক!
ভিতরের জ্বালা ভিতরে থুইয়া নিজের মোখেরে বন করে জুলেখার মায়!
আইচ্ছা! দেখবো সেয়! তার মাইয়ার এত্তা বড়ো সর্বনাশের কী বিছার করে হেরা! নাইলে এই রাঁড়ি মায়ে জানে কী করবো সেয়! ঘরের রামদাওখান দিয়া এক পোছে মাইয়ার কল্লাটা ফালাইয়া নিজেরটাও নামাইবো সেয়। কোনোদিগে ফিরা চাইবো না! হক-বিছারের ভার সেয় দিয়া থুইবো খোদার দরবারে। মাইনষের বিছার লাগদো না তার। কিছুই লাগবো না।
মাতারিগিলিরে তো নানান ভাও দিয়া ঠান্ডা কইরা থোয় ইমাম হুজুরে, কিন্তু সেয় নিজেরে থির করে কোন উপায়ে! ঘটনার আধাখান হুইন্নাই ত্তো এদিকে জানে আর পানি নাইক্কা তার! আল্লায় আর কী দেহানীর বাকি রাখছে তার লেইগা! ইসুফ মিয়ায় নি এই কাম করছে!
দুনিয়ায় তাইলে আর কারে বিশ্বাস করোন যাইবো! কারে!
কিন্তুক, এই কথা হুজুরে বিশ্বাস করেই বা ক্যামনে! জুলেখায় হারানী যাওনের পরে অর লেইগা ইসুফ মিয়ার পেরেশানি তো নিজের চক্ষে দেখছে হুজুরে!
সেই কষ্ট সেই কান্দন তো মিছা বইল্লা মোনে হয় নাইক্কা হুজুরের!
এই যে জুলেখার লেইগা অন্তর পোড়াইয়া পোড়াইয়া নিজেরে অখন এমুন ধজভঙ্গের বিমারীর লাহান কইরা ফালাইছে ছেড়ায়, সেইটা কী তাইলে জুলেখারে না- পাওনের কষ্টে না?
সেইটা তাইলে হইছে কোন কারোনে?
সেইটা তাইলে ঘটছে জুলেখারে নষ্ট কইরা রাস্তায় ফালাইয়া থুইয়া আহোনের পাপের কারোনে?
তয় একটা গুরুতর কথাও ওঠতাছে হুজুরের অন্তরে।
কথাটা হইলো, জুলেখারে ভাগাইয়া নেওনের অই সর্বনাইশ্যা, নিদয়া কামটা ইসুফ মিয়ায় কুনসোম করলো! দোপোরে হারাইছে জুলেখায়। হারানীর পরে তারে খোঁজ করার সগলটা খোন ধইরাই তো ইসুফ মিয়ায় সগলতের লগে, সগলতের সামোনে! এক দণ্ডও তো সেয় কোনো প্রকার আউইলে যায় নাই। বাড়িছাড়া হয় নাই। কোনো প্রকার লুকি-ছাপি কারবার করতে তারে দেহা যায় নাই!
তাইলে বিষয়খান কী! হুজুরে কী তাইলে নিজেরে ভালারকমে অখনও চিনে নাই? তার যে নিজেরে নিয়া কঠিন বিশ্বাস আছিলো যে, সেয় লোক-চরিত পষ্ট কইরাই চিনে! লোক চিনোনে তার কোনো ভুল অয় না! এই বিশ্বাস ত তাইলে মস্ত ভুল! বিরাট ভুল!
কিন্তুক না! জুলেখার সগল কতা হোনা শেষ না কইরা সেয় কিছুমাত্র লাফাইবো না! দেওভোগ গেরামের লোকে তারে মুরুব্বি বইল্লা মাইন্না আইতাছে আউজকা কতো বচ্ছর! মাথা তারে ঠাণ্ডা রাখোন লাগবোই।
তারে নিয়া জুলেখার এতাটি কথার—সবই ত্তো ইসুফ মিয়ার কানে গেছে! কো! উয়ে দেহি রাগ-তাপ কিছুই দেহায় না! একটা কতারও দেহি ফিরা জব দেয় না! ইয়া রাখমানুর রহিম! বড়ো মাইনষের ঘরে তাইলে এমুন আমাইনষের ছাওও জনম নেয়! আফসোসে খানেখান হইয়া যাইতে থাকে মংলার মায়! হায়রে কপাল! অখন কপাল-পোড়া মাইয়াটার দিন ক্যামনে যাইবো!
কাঁঠোল গাছের ছেমায় বওয়া ছেড়াটায়, ঠাটার মরার মতোন পইড়া থাকা ছেড়াটায় বোবা হইয়া জুলেখার কথা হুইন্না যায় যায়; একটা টুঁ আওয়াজ তরি করে না! একটা বারের লেইগা জুলেখার মোখের তেনে নিজের চউখও সরায় নয়া ছেড়াটায়। অর কী লাজ-ঘিন কিছুই হয় না!
ছেড়াটায় বোবা মোখে জুলেখার বিত্তান্ত হোনতে হোনতে আঁতকা করে কী বেদম এক চিক্কুর দেওয়া শুরু করে।
করে কী করে কী ছেড়ায়!
ছেড়ায় দেহো চিক্কুর দিতে দিতে কোন কথা কয়!
সেয় কয়, ‘জুলি! ভালা হইছে! খোব ভালা হইছে রে! তর মিয়াভাইয়ে জিন্দিগীতে যা করোনের হিম্মত পায় নাই, তুই যে সেই হিম্মতের গপ বানাইয়া আমারে ইজ্জত দিতাছস—আমার কইলজা ভইরা যাইতাছে জুলি! আমি তো পারি নাইক্কা, এটি করতে! কিছুই পারি নাইক্কা! তর লেইগা জুলি! ক ক!
জিন্দিগীতে পারি নাই তো তরে ঘরে নেওনের রাস্তা বান্ধতে! আমার মুরুদ অয় নাই! মুরুদ অয় নাই! অহন তর পরস্তাবে আমার হিম্মতের কতা হুইন্না যুদি নিজেরে নিজে এট্টু ইজ্জত দিতে পারি আমি জুলি! ক তুই ক!
“আমার কতা তো অহনও শেষ হয় নাই!” জুলেখায় হু হু গলায় জব দেয়।
(চলবে)