পিতার প্রতি পুত্র
জহির রায়হানের পঁচিশ পাতায়
জহির রায়হান। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির পরিচালক। লিখেছেন ‘হাজার বছর ধরে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’র মতো উপন্যাস। পরিচালক ও লেখক হিসেবে সব জায়গাতেই তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়। আজ ১৯ আগস্ট শহীদ জহির রায়হানের ৮০তম জন্মদিন। ১৯৩৫ সালের এই দিনে ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ সমর্থক ও সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের অত্যাচার, গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে নির্মাণ করেছেন প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘বার্থ অব এ নেশন’। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশেই খোদ রাজধানীর বুকে প্রাণ দিতে হয়েছিল শহীদ এই নির্মাতাকে। লাশ উদ্ধার করা যায়নি। অনেক দিন ধরে ছিলেন ‘নিখোঁজ’।
বড় ভাই সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। ভাইয়ের কাছ থেকেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দীক্ষা অর্জন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার আরো অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শহীদুল্লাহ কায়সারকে। বড় ভাইয়ের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন জহির রায়হান। ফিরে আসতে পারেননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময়টি আমাদের জাতীয় জীবনে যেমন প্রভাব ফেলেছিল, তেমনি প্রভাব ফেলেছিল কিছু মানুষের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে। শহীদ জহির রায়হানের পরিবারটিও তেমন। জহির রায়হানের প্রথম স্ত্রী ছিলেন তাঁর প্রথম ছবি ‘কখনো আসেনি’র নায়িকা সুমিতা দেবী। জহির-সুমিতার দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান।
জহির রায়হানের দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের নায়িকা সুচন্দা। প্রথম সন্তান হিসেবে বিপুল রায়হান বাবার স্নেহ-আদর সম্পূর্ণভাবে পেলেও বঞ্চিত হয়েছিলেন ছোট ছেলে অনল রায়হান, যাঁর ডাকনাম পার্থ। বাবা-মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধ—সব মিলিয়ে বাবার কোনো দৈহিক অবয়বও মনের ভেতরে ছিল না অনল রায়হানের।
জহির রায়হান বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৭ বছর। আর তাঁর ছেলে অনল রায়হানের বয়স এখন ৪৬। বাবা ও ছেলের মধ্যে এই যে যোগাযোগের ঘাটতি, তা ফিরে এসেছে ৫০ বছর পর পাওয়া জহির রায়হানের ২৫ পাতার দীর্ঘ এক চিঠির মাধ্যমে। যেন চিঠি নয়, পার্থর কাছে ফিরে এসেছেন স্বয়ং বাবা জহির রায়হান।
জহির রায়হানের দুই বিয়ের মতো ছেলে পার্থরও দুই বিয়ে। প্রথম স্ত্রী ভেনাসের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় স্ত্রী জ্যোতির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তবে সে দাম্পত্য জীবন দীর্ঘ হয়নি। ২০১৪ সালে বিচ্ছেদ ঘটে পার্থ ও জ্যোতির। সে সময়ে একা হয়ে পড়েছিলেন পার্থ। নিজেকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য লিখেছেন দিনলিপি। আর এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন মোহাম্মদপুরের ভাড়া বাসা ছাড়ার সময় উদ্ধার করেন মা সুমিতা দেবীর কাছে লেখা বাবা জহির রায়হানের ২৫ পাতার এক দীর্ঘ চিঠি। তখন তাঁরা দুজন আলাদা থাকছেন। সুমিতা দেবী চেষ্টা করেছিলেন, জহির রায়হানকে আটকে রাখতে; কিন্তু পারেননি।
বিচ্ছেদের সেই মুহূর্ত আর পার্থর এই মুহূর্ত যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। একা হোটেল রুমে বসে বাবার সেই চিঠি পড়েছেন পার্থ আর যেন বাবাকেই ফিরে পেয়েছেন তিনি এতগুলো বছর পর।
সেসব কথাই তিনি লিখেছেন ‘হঠাৎ বাবার পঁচিশ পাতায়’ বইটিতে। সঙ্গে রয়েছে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যা ব্যক্তি জহির রায়হানকে বুঝতে, চিনতে সাহায্য করবে। বইটির ভূমিকা লিখেছেন জহির রায়হানের চাচাতো ভাই এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। পার্থর ডায়েরিটি মূলত ২০১৪ সালে লেখা, চিঠিটি পাওয়ার পরে।
সে সঙ্গে রয়েছে ১৯৯৯ সালে কিছু দিনলিপি, যখন অনল রায়হান পার্থ কাজ করতেন সাপ্তাহিক ২০০০-এর প্রতিবেদক হিসেবে। ১৯৯৯-এর জুলাইয়ে মিরপুরের পল্লবীর নূরী মসজিদ এলাকায় আবিষ্কৃত হয়েছিল একটি গণকবর। ধারণা করা হয়, জহির রায়হানসহ ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি যাঁরা বিহারি ও পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশে নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের সেখানে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। সাপ্তাহিক ২০০০-এর পক্ষ থেকে অ্যাসাইনমেন্টটি কাভার করেছিলেন শহীদ জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান।
বইটিতে রয়েছে সুমিতা দেবীকে লেখা জহির রায়হানের সেই ২৫ পাতার পুরো চিঠিটা। বইটি সম্পর্কে লেখক অনল রায়হান লিখেছেন—
আমি বললাম উপন্যাস।
অন্যদিন পত্রিকা ছাপলো স্মৃতিউপাখ্যান।
আমি বললাম উপন্যাস।
প্রকাশক দেখলেন জহির রায়হানের চিঠি।
আমি বললাম উপন্যাস।
আমার স্ত্রী বললেন সত্যবয়ান।
আমি বললাম উপন্যাস।
পাঠক ভাবুক যেমন ভাবুক।
২০১৫ সালের একুশে বইমেলায় অনুপম প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে বইটি। জহির রায়হান সম্পর্কে আরো নিবিড়ভাবে জানার জন্য এই বই অবশ্যপাঠ্য।