এনরিকে আন্দেরসন ইমবের্তের একগুচ্ছ অনুগল্প

[এনরিকে আন্দেরসন ইমবের্ত আর্হেন্তিনীয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও সাহিত্য সমালোচক। শিক্ষকতা করেছেন তুকমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৫ সাল থেকে অবসর গ্রহণ অবধি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হিস্পানি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আন্দেরসন ইমবের্তের অনুগল্প খুবই জনপ্রিয়। গল্পগুলোতে তিনি ফ্যান্টাসির সঙ্গে মিশিয়ে দেন জাদুবাস্তবতা আর দার্শনিকের প্রজ্ঞা। তাঁর বইগুলোর মধ্যে আছে : জাগরণ (১৯৩৪), চেশায়ারের বিড়াল (১৯৬৫), প্রতিগল্প : নিরীক্ষাধর্মী গল্প সংকলন (১৯৭১), রাজকীয় বার্তা (১৯৭৬), বিজয় (১৯৭৭), বিশ্বের প্রথম গল্পগুলো (১৯৭৮)।
নিচের কয়েকটি গল্প অনুবাদ করেছেন রায়হান রাইন।]
একশৃঙ্গি ঘোড়া
মেয়েটিকে সে আক্রমণ করল। তার দুটি শিং। দেহ সে রকম না হলেও আক্রমণটি ছিল ঠিক ষাঁড়ের মতো।
‘আমি তোমাকে চিনি,’ মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল। ‘তুমি কি ভেবেছ আমি এতটাই বোকা যে খপ করে তোমার শিং ধরে ফেলব? তোমার একটা শিং অলীক। তুমি একটা রূপক।’
তারপর একশৃঙ্গি ঘোড়া, তাকে চিনে ফেলেছে দেখে, হাঁটু গেড়ে বসল মেয়েটির সামনে।
সর্পিল
বাড়ি পৌঁছালাম কাকভোরে। জেগে থাকতে গিয়ে ঘুমের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছিলাম। যখন বাড়িতে ঢুকছি, সবকিছু তখনো আঁধারে মোড়া। কারো ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমি পা টিপে টিপে সর্পিল সিঁড়িটা পর্যন্ত গেলাম যেটি আমার ঘরের দিকে গেছে। সেখানে পা ফেলতে না ফেলতেই আমার সন্দেহ হলো, এটা কি আসলেই আমার বাড়ি, নাকি বাড়িটা স্রেফ আমার বাড়ির মতো দেখতে। যখন সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম, আমার আশঙ্কা হলো বিছানায় আমার মতো দেখতে কাউকে ঘুমাতে দেখব, এবং সে হয়তো স্বপ্ন দেখছে, সে এই সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। শেষ পাক ঘুরে, আমি ঘরে ঢুকলাম, এবং নিমেষহীন চোখে তাকে দেখলাম—কিংবা আমাকে দেখলাম—চাঁদের উজ্জ্বল আলোয়, বিছানার পাশে বসে। আমরা সেখানে একমুহূর্ত দাঁড়ালাম। তাকালাম পরস্পরের দিকে। দুজনেই মৃদু হাসলাম। আমি অনুভব করলাম তার হাসি আমার হাসির মতো। যখন কেউ আয়নার দিকে দেখে, দুজনের একজন হয় মিথ্যা। ‘কে কাকে স্বপ্ন দেখছে?’ আমাদের একজন অবাক হলো, কিংবা হয়তো একসঙ্গে আমরা দুজনেই। তারপর আমরা শব্দ পেলাম সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে কেউ। আমরা দ্রুত পরস্পরের ভেতরে মিশে গেলাম, শুয়ে পড়লাম বিছানায় এবং স্বপ্ন দেখতে থাকলাম—আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছি আবার।
নিয়তি
পাহারাদার দেবদূত ঘাড়ের পেছন থেকে ফিসফিস করে ফাবিয়ানকে বলল, ‘সাবধান, ফাবিয়ান! এটা লিখিত আছে যে, তোমার মৃত্যু হবে যদি সানহোলোতিনো কথাটা উচ্চারণ করো।’
‘সানহোলোতিনো?’ ফাবিয়ান হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
এবং নিহত হলো।
মাথাঝিম
জেরোনিমো ও থিওডর নামের দুজন সন্ন্যাসী মঠের খাবারঘরে বসে কথা বলছিলেন। তখন তারা এক বিস্ময়কর পাখিকে উড়ে যেতে দেখলেন। দুজনেই লাফিয়ে উঠলেন, তাতে টেবিল থেকে পানির জগ উল্টে পড়ল। তারা দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন উঠানে যেখানে ঝর্ণার পাশে বসে পাখিটি গান গাইছিল।
জেরোনিমো মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাখিটির গান শুনছিলেন, যেন তিনি দেখছেন তিনশ বছরের ইতিহাস, মহান চার্লসের রাজ্যাভিষেক থেকে বইজিওনের গডফ্রের ক্রুসেডের সময় জেরুজালেমের পতন পর্যন্ত। এবং কেবল বাস্তব ইতিহাসই নয়, যা যা ঘটতে পারত এমন সব সমান্তরাল ইতিহাসও, যেমন সম্ভাব্য সেই ইতিহাস যা ঘটতে পারতো যদি পোপ মহান চার্লসকে অভিষিক্ত করতে অস্বীকার করতেন। এরই মধ্যে পাখিটি নীরব হলো, জেরোনিমো নিজেকে একা দেখতে পেলেন, তার সঙ্গী থিওডরের কোনো চিহ্নই তিনি খুঁজে পেলেন না। জেরোনিমো ফিরে গেলেন মঠের খাবার ঘরে। পড়ে যাওয়া জগটি তুললেন, তখনো জল গড়িয়ে পড়ছিল, শেষ ফোটাটি নিঃশেষ হওয়া অব্দি। তারপর, একই টেবিলে বসে তিনি লিখলেন দিব্য চোখে দেখা তার অভিজ্ঞতার উপাখ্যান।
অন্য সন্ন্যাসী, থিওডর বিস্ময়কর পাখিটির কূজন শুনে ভাবাবিষ্ট হয়ে চোখের পলক ফেললেন, যেন এক বিদ্যুচ্চমক তার চোখ ঝলসে দিয়েছে। কেবল একটি পলক, ইতোমধ্যে পাখিটি চুপ করেছে, থিওডর দেখলেন তিনি একা। জেরোনিমোর কোনো চিহ্ন কোথাও নেই। মঠটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। হেসদনের চিত্রকর জাকমার্ত থিওডরকে এক বিধ্বস্ত চিত্রশালার ভেতর হাঁটাহাঁটি করতে দেখলেন। চুপচাপ এবং উদাসীন। চিত্রকর তাকে ডেকে নিলেন এবং চতুর্থ চার্লসের কাছে প্রতিশ্রুত একটি চিত্রের জন্য তাকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করলেন : ছবিটি ছিল এক সন্ন্যাসীর, যিনি এক মঠ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছিলেন, এবং সময়ের ভেতর দিয়ে উড়ে গিয়েছিলেন তিনশ বছর পেছনে; জেরোনিমো নামের এক কাহিনীকার লিখে গিয়েছিলেন এ রকমই এক উপাখ্যান।
আত্মাভিমান
নেস্তর প্রায় সব ধরনের পাপ করেছে। কাজেই সে যখন মারা গেল, তাকে এ রকম শাস্তি দেওয়া হলো : সে অতীতের দিকে যেতে শুরু করল আর যখন সে পেছন দিকে যাচ্ছে, অনুভব করতে থাকল সেইসব যন্ত্রণা যা সে অন্যদের দিয়েছিল। সে অনুভব করল বিশ্বাসঘাতকতা, লাঞ্ছনা, অপবাদজনিত অসহায়ত্ব, লুণ্ঠিত হওয়ার হতাশা আর পিঠে ছুরিবিদ্ধ হবার যন্ত্রণা। তারপর, তারা তাকে বিচারালয়ে নিয়ে গেল। যাহোক, সেখানে আরেকটা নতুন পাপ করল সে। এ পাপ আত্মাভিমানের। কারণ সে অন্যদের যে যন্ত্রণা দিয়েছিল, নিজের দেহে তা অনুভব করে, অকল্যাণ ঘটাবার তার এই অসাধারণ ক্ষমতার প্রশংসা না করে পারল না।
প্লেটোর গুহা
প্লেটোর গুহা-রূপকটিকে (গণরাজ্য, ৭) আরেকভাবে প্রকাশ করা যায়।
বন্দি লোকগুলো আগুনের দিকে পেছন ফিরে বাস করছে ভূগর্ভস্থ ঘরে। সামনের দেয়ালে যে ছায়াগুলোকে তারা নড়াচড়া করতে দেখছে সেসবকেই তারা বাস্তব হিসেবে বিশ্বাস করছে। যখন তারা ছায়াগুলোকে নিয়ে কথা বলছে, সেসবের কী নাম বা কী তাৎপর্য, তা নিয়ে তারা একমত হতে পারে না। তারপর হঠাৎ একদিন শিকল খুলে গুহাবাসীকে মুক্ত করে দেওয়া হলো। তারা উঠে পেছন ফিরল, দেখতে পেল আগুন; তারা বেরিয়ে এলো গুহার বাইরে, সূর্যের আলোয়। কিছুকাল পর, তাদের আবারও বন্দি করা হলো এবং আগের মতো একই অবস্থানে রাখা হলো। যে ছায়াগুলোকে তারা অবাস্তব বলে জানল, সেসবের প্রতি অবজ্ঞা নিয়ে তারা এইমাত্র দেখা চমৎকার বাস্তব নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। কিন্তু আলোর ভেতর যা দেখেছে তা নিয়ে একমত হতে আবারও তারা ব্যর্থ হলো।
জোছনা
বোকা ছেলে যাকব মাঝে মাঝে ছাদে ওঠে যাতে সে পড়শিদের গতিবিধির ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে পারে।
সেই রাতে ফার্মাসিস্ট আর তার বউ উঠানে বসে কোমল পানীয় আর কেক খাচ্ছিল, তখন তারা ছাদ থেকে আসা ছেলেটির পায়ের আওয়াজ শুনল।
‘শশশ!’ ফার্মাসিস্ট ফিসফিস করে তার বউকে বলল, ‘ওই যে ছেলেটা আবার এসেছে। তাকিও না। নিশ্চয়ই আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে। এইবার, তাকে একটা শিক্ষা দেবো আমি। যা বলি শোনো, যেন কিছুই ঘটেনি এভাবে...।’
তারপর গলার স্বর উঁচু করে ফার্মাসিস্ট বলল, ‘কী যে সুস্বাদু এই কেক! খাওয়া শেষ হলে তুমি কিন্তু সাবধানে রাখবে, যেন কেউ চুরি করতে না পারে।’
‘চুরি কী করে করবে? রাস্তার দিকের গেট বন্ধ, জানালা-দরজা সব লাগানো...।’
‘বেশ...ছাদ থেকে তো আসবে পারে কেউ।’
‘অসম্ভব। কোনো সিঁড়ি নেই। তাছাড়া মসৃণ দেয়াল বেয়ে তো কেউ নামতে পারবে না।’
‘তা বটে, একটা গুপ্ত কথা বলি, এ রকম কোনো রাতে, কেউ যদি কেবল ‘আবরাকাডাবরা’ তিনবার বলে আর মাথা নিচের দিকে রেখে ঝাঁপ দেয়, জোছনার ভেতর দিয়ে সবটা পথ সে নেমে আসতে পারবে, আর কেকটা নিতে পারবে। তারপর মহানন্দে চন্দ্র রশ্মি ধরে উড়ে যেতে পারবে। চলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে, ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ি।’
তারা টেবিলের ওপর কেক রেখে ঘরে গেল, আর ছেলেটা কী করে সেটা দেখতে শোবার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল। তারা দেখতে পেল, তিনবার “আবরাকাডাবরা” বলে বোকার হদ্দ ছেলেটা মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝাপ দিলো ছাদ থেকে, যেন একটা সোনালি শ্লেজগাড়ি চালাচ্ছে এমনভাবে সে নেমে এলো জোছনার ভেতর দিয়ে, হাতে নিলো কেক, আর স্যামন মাছের আনন্দ নিয়ে উড়ে গেল আবার, অদৃশ্য হয়ে গেল ছাদের চিমনিগুলোর মাঝখান দিয়ে।