বাংলাদেশের বহুমাত্রিক শিল্পকলা : চিত্রকলার অনন্য মূল্যায়ন
নাজমা আক্তার আমাদের দেশের বিশিষ্ট ও জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী। এরই মধ্যে তিনি তাঁর নিজের আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন। একক প্রদর্শনী করেছেন ঢাকা, কলকাতা, আগরতলা, পেনাং, বার্লিন ও লন্ডনে। বুলগেরিয়ায় মিনিপ্রিন্ট এক্সপোর ২০১২ জুরি সদস্য ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের চারুশিল্পী সংসদের সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের শিল্পীদের সংগঠন কিরাতের যুগ্ম সম্পাদক।
২০১৬ সালে তিনি বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় লেসেদ্রা আর্ট গ্যালারির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সপ্তম লেসেদ্রা আন্তর্জাতিক পেইন্টিং ও মিশ্র-মাধ্যম প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মের অধিকারী হন। ২০১৭ সালে চিত্রশিল্পী নাজমা আক্তার ‘কবি আবদুল হাই মাশরেকী’ স্বর্ণপদক লাভ করেন। খ্যাতনামা এই চিত্রশিল্পী বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় শিল্পকলা এবং শিল্পীদের নিয়ে মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছেন অনেক দিন ধরে। এ দেশের চিত্রকলার বিকাশে তাঁর এই লেখনীর প্রয়াস অভিনন্দিত হয়েছে জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের দ্বারা।
২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের বহুমাত্রিক শিল্পকলা’ নাজমা আক্তারের সেই গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর সংকলন। ৩০টি প্রবন্ধের মলাটবন্দি এই গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখেছেন কলকাতার চিত্র-সমালোচক মৃণাল ঘোষ। তাঁর মতে, ‘একজন শিল্পী যখন শিল্প-আলোচনা করেন, তখন অনেক সময় শিল্প সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত বোধ ও রুচি তাঁর রচনাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু নাজমার ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। তিনি মুক্তদৃষ্টিতে শিল্পের গুণাগুণ বিচার করেছেন, বাংলাদেশের শিল্পের বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে শিল্পীর অবদানের মূল্যায়নে প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁর কাছে এই লেখা তাঁর শেখারই একটা প্রক্রিয়া। সে জন্য তিনি শ্রদ্ধা নিয়ে দেখেছেন এবং বিনীতভাবে মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভাষা সংযত ও সাবলীল। কোথাও অহমিকার প্রকাশ নেই। এটাই তাঁর লেখার অনিবার্য শর্ত।’
মৃণাল ঘোষ নাজমা আক্তার সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত রুচি, রাজনৈতিক দর্শন, ভালো লাগা না লাগা চিত্র-সমালোচনায় প্রকট নয়। তিনি নিরপেক্ষভাবে ও সুষ্ঠু বিচার করতে সক্ষম। মূল্যায়নের জন্য খোলা মন নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। বিমূর্ত রীতির প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকলেও গোঁড়া নন। তিনি নিজে সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী দেখেছেন এবং চিত্রকলা-সংক্রান্ত সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন কিংবা বিভিন্ন শিল্পীর ওপর প্রকাশিত বইয়ের সমালোচনা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছেন। এ জন্য তাঁর গ্রন্থে আমরা দর্শকদের নান্দনিক ও শিল্পবোধকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করার জন্য চিত্রকর্ম বিচারের সুচিন্তিত মতামত পেয়েছি। উপরন্তু সমসাময়িক শিল্পকলার মতবাদগুলোর কোনো একটি তাঁকে অন্ধ করে তোলেনি।
আলোচ্য গ্রন্থে বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রায় সব শিল্পীর চিত্রকলার ওপর আলোচনা ও মূল্যায়ন উপস্থাপিত হয়েছে। এস এম সুলতান থেকে শুরু করে এ্যানি ইসলাম আর আধুনিক চিত্রকলার পথিকৃৎ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শহীদ কবীর সকলকেই নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করেছেন নাজমা আক্তার। তাঁর ‘বাংলাদেশের বহুমাত্রিক শিল্পকলা’ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এ দেশের নারী শিল্পীদের শিল্পকর্মের মূল্যায়ন। দেশ-বিদেশের প্রদর্শনীতে নারী শিল্পীদের কাজের স্বীকৃতির প্রশংসা করে তাঁদের চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, ধাতব শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন। আর আলো, রেখা ও রং দ্বারা সৃষ্ট শিল্পকর্মের শিল্পীরা কীভাবে তাঁদের ভুবন তৈরি করে দর্শককে মুগ্ধ করেন, তারও অনুপুঙ্খ আলোচনা আছে বিভিন্ন প্রবন্ধে।
২০১৮ সালে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী প্রিয়ভাষিণী সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘ভাস্কর পিলু পোচখানাওয়ালা এবং দাবিয়েল ওয়ালার মতো শিল্পকলার প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই আধুনিক ভাস্কর্যের প্রাণকেন্দ্র স্পর্শ করতে পেরেছেন প্রিয়ভাষিণী।’(পৃ.-২৯) প্রিয়ভাষিণীর শিল্পসামগ্রীতে দেখা যায়, তিনি অনুভবের সাহায্যে ভাবাবেগ ও বাস্তবতার শিল্পরূপ সৃষ্টি করেছেন। এই নান্দনিক শিল্পজগৎ ইন্দ্রিয়ভিত্তিক, সেইসঙ্গে কল্পনারও। নাজমা আক্তার অনেক দিন ধরে বিমূর্ত চিত্রকলার চর্চা করছেন। চিত্র-সমালোচনায় তাঁর সেই বিশেষ প্রবণতার স্বাক্ষর রয়েছে একাধিক প্রবন্ধে। অন্যদিকে তিনি একজন নারী শিল্পী। ফলে নারীদের শিল্পকর্ম নিয়ে তাঁর উৎসাহ এ গ্রন্থে লক্ষ করা যায়। একাধিক প্রদর্শনীর মূল্যায়নভিত্তিক রচনাগুলো সেই সাক্ষ্য বহন করে।
অন্যদিকে ‘বাংলাদেশের বহুমাত্রিক শিল্পকলা’ গ্রন্থের মূল্যায়নগুলো পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই, শিল্পী তার শিল্পসৃষ্টির মাধ্যমে, যা প্রকাশ করতে চেয়েছেন তা সার্থক কিনা এবং দর্শকের মানসচৈতন্যে অভিঘাত সৃষ্টি করছে কিনা বা আকর্ষণীয় রূপে তুলে ধরতে পেরেছেন কিনা, তার সব দিকেই নাজমা আক্তারের অভিনিবেশ ছিল। কারণ আমরা জানি, শিল্পের জগৎ ব্যঞ্জনাময় রূপান্তরিত সৃজনের জগৎ; তার ভেতর থাকে বিষয়বস্তু ও রূপের সামঞ্জস্যের সম্মিলন। একজন চিত্র-সমালোচক শিল্পী ও শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করার সময় মনোযোগ সহকারে লক্ষ করেন, কীভাবে সেই শিল্পময় সমগ্র উপাদান সংগতিসহ রসোত্তীর্ণ, নাকি তা ব্যর্থ। অর্থাৎ শিল্পী বিষয়বস্তু বেছে নিয়ে তাকে রস ও রূপের সমন্বয়ে রূপময় করে যে কাঙ্ক্ষিত শিল্পকলা কল্পনা ও প্রযত্ন সহকারে আবেগময় কৌশলে সৃষ্টি করেছেন, তা চিত্র-সমালোচক দর্শকের সামনে তুলে ধরেন। চিত্র-সমালোচক অনেকটা শিক্ষাদানের মতো কাজ করেন। শিল্পী মুর্তজা বশীরের মতে, ‘আলোচনার ভেতর দিয়ে মূল্যায়ন করে তুলে ধরা কোন শিল্পকর্মটি শিল্পবিধির গুণগতমানে ভালো বা কোনটি মন্দ। শিল্পীর উপস্থাপিত শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্য বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করে কোনটি আসল বা নকল বা কোন শিল্পস্বরূপ নতুনত্বের বার্তা বয়ে এনেছে, রসোত্তীর্ণ হয়েছে না ব্যর্থ, তার গুণাবলি ব্যাখ্যা করা। এভাবেই আমাদের কাছে শিল্পকর্মকে শিল্প-সমঝদার রস আবিষ্কার করতে সহায়তা করে, নিপুণতা নির্ণয় করেন।’ নাজমা আক্তারের গ্রন্থটি পাঠ করলে চিত্র-সমালোচকের জন্য প্রযোজ্য এই বৈশিষ্ট্যসমূহই আমরা লক্ষ করি। তাঁর গ্রন্থে যেমন আছে শিল্পীর মূল্যায়ন, তেমনি তাঁদের শিল্পকর্মের গুণগত মান নির্ণয় করার প্রয়াস। অন্যদিকে সেই সমালোচনার ভেতর দিয়ে শিল্পীর চিত্রনৈপুণ্য সম্পর্কে শিল্পরসিকদের প্রভাবিত করার প্রচেষ্টাও লক্ষণীয়।
একজন সত্যিকারের সমালোচকের যেসব গুণ থাকা দরকার, তা নাজমা আক্তারের আছে। তাঁর কেবল বিষয়গত জ্ঞান নয়; বরং তার চেয়েও বেশি চিত্রশিল্পের ধারাবাহিকতার সঙ্গে তাঁর আছে সুগভীর সংযোগ। তিনি শিল্পকলা সম্পর্কে একজন সমঝদারি ব্যক্তি। আর প্রচুর পরিমাণে শিল্পকর্ম দেখার অভিজ্ঞতাও তাঁর রয়েছে। তিনি শিল্পীদের প্রত্যক্ষভাবে জানেন, চেনেন এবং নিজের বোধ-বুদ্ধি ও পঠন-পাঠন দিয়ে এ দেশের শিল্পীর সৃষ্টি-চেতনাও বুঝতে পারেন।
মূলত চিত্রশিল্পী নাজমা আক্তার শিল্পকলার ইতিহাস, সমসাময়িক শিল্পকলার গতিবিধি ও বাংলার ঐতিহ্য সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল। আর নিজে চিত্রশিল্পী হওয়ায় শিল্পকলা নির্মাণের করণ-কৌশল ও শিল্পীর নৈপুণ্য বিচার করার জন্য দক্ষতা অর্জন করেছেন তিনি সহজেই। এ জন্য তাঁর গ্রন্থে দেখা যায়, শিল্প-সমালোচকের সমালোচনার তত্ত্বগত কিছু উক্তি নয়, বরং শিল্পকর্ম ও রচনাশৈলী সম্পর্কে সমঝদার একজন বোদ্ধার জ্ঞানগর্ভ বিচার ‘বাংলাদেশের বহুমাত্রিক শিল্পকলা’ গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহে উপস্থাপিত। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।
বাংলাদেশের বহুমাত্রিক শিল্পকলা, নাজমা আক্তার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ২০১৬, প্রচ্ছদ : কিউরিয়াস ঢাকা, মূল্য : ৩০০ টাকা।