নন্দিনী : প্রেম ও প্রতিবাদের কবিতা
মিল্টন বিশ্বাসের প্রবন্ধ প্রতিভার আড়ালে লুকিয়েছিল তাঁর কবি প্রতিভা। হঠাৎ তার উপস্থিতি জানান দিল ‘নন্দিনী’(২০১৮) কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। ‘নন্দিনী’র প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে উপস্থাপিত হয়েছে প্রতিবাদও। প্রেম এবং প্রতিবাদ কবির কবিতায় একাকার। মানবতাকে তিনি উচ্চে তুলে ধরেছেন সাম্প্রদায়িকতাকে পাশ কাটিয়ে। সেখানে প্রেরণা হয়ে এসেছেন কবির মানসপ্রিয়া ‘নন্দিনী’।
অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাসের কবিতার নির্যাস তাই মানবতাবাদ। রোহিঙ্গারা সম্প্রতি আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মানবেতর জীবনযাপন একজন কলামিস্ট কবিকে আন্দোলিত করে। তিনি প্রিয়ার নিকট প্রতিশ্রুতি দেন সব সময় এসব বঞ্চিত মানুষের পাশে আছেন এবং থাকবেন। এতিম অসহায় শিশুদের মাঝে তিনি সুখ খুঁজে পেয়েছেন। নন্দিনীর বিরহে দগ্ধ হৃদয় শীতল করার সরোবর খুঁজে পেয়েছেন বাস্তুহারা মানুষের বেদনায়। কবিও গৃহহীন। নন্দিনী ছেড়ে গেলে তিনি আর ঘর বাঁধেননি। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছেন পৃথিবীব্যাপী। টেকনাফ রোডে তিনি হাঁটেন আর উপলব্ধি করেন অসহায় বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের মর্মব্যথা—
‘নন্দিনী, তুমি দেখে নিও, আমি রোহিঙ্গা শিশুর সঙ্গে ঠিকই পার হব নৌকো,
দেখো তুমি, করুণামদির মাতার দেহে জন্মের আগেই যারা ক্ষত-বিক্ষত,
সেসব অভাজনের পাশে থাকব আমি চির সকাল।’
তীব্র বেদনায় দগ্ধ কবি বেদনার সাগরে আত্মাহুতি দিয়েছেন। জীবন্মৃত কবি যেখানেই যান, পিছু ছাড়ে না নন্দিনী। ময়নামতি দেখতে গিয়ে কবি সেখানেও অবচেতনে নন্দিনীর কণ্ঠস্বর শুনতে পান। নিজের বিভ্রম আবার নিজের কাছেই ধরা পড়ে ‘সন্দেহ’ অলংকারের মাধমে।
‘নন্দিনী,
পতিত ইটের ভাণ্ডারে তোমাকে পেলাম আমি
তোমার নাম ধরে কে যেন দিল ডাক, দিল কি?’
এ ভগ্ন নগরে তারাই আসে যাদের হৃদয় এমনি ভগ্ন এমনি ক্ষয়ে যাওয়া। ভগ্ন মন্দিরকে তিনি প্রিয় হারা প্রেমিকের ভগ্ন হৃদয়ের প্রতীক রূপে কল্পনা করেছেন।
‘নন্দিনী,
এ কোন নগর যার দ্বারে দাঁড়িয়ে স্বয়ং তথাগত।
এ কোন কুটির যার ছায়ায় বিদগ্ধ যুবকের আনাগোনা।’
বিধ্বস্ত শালবন বিহারে কবি নন্দিনীকেই খুঁজে পান।
‘নন্দিনী,
এ বৌদ্ধবিহারে, এ প্রাচীন শালবনে
চারিদিকে তুমি আর তুমি
আকাশে বাতাসে মেঘ মল্লারে
ফুলে ঢাকা পাখির কলতানে ।’
বিশ্বভ্রমণের ছলে কবি নন্দিনীকেই খুঁজে ফেরেন বা নন্দিনীকে খোঁজার ছলে কবি বিশ্ব ভ্রমণ করেন।
‘তবু নীল, তামাটে আর লাল দিগন্তে
ধুলো আর সমুদ্র ঘিরে
রঙছুঁয়ে, অসীম প্রান্তর পেরিয়ে
খুঁজে ফেরা তোমাকেই।’
পোর্ট ডিকসনে প্রভাত ভ্রমণ করতে গিয়ে অবচেতনে কবি নন্দিনীকেই দেখেন সেখানে।
‘পোর্ট ডিকসনের মালাক্কা আজ জানিয়েছে তোমাকে ভালোবেসে
চাঁদ ডুবা আর পাতা ঝরা সেই সৌখিন
ঢেউ রাঙা মশালে-
হারাতে হবে জীবনের সোনালি ময়ূর।’
‘নন্দিনী’ কাব্যগ্রন্থে কবি মিল্টন বিশ্বাস কবিতার প্রচলিত প্রথা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এ বইয়ের সবগুলো কবিতাই একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আবার এটি উপন্যাস বা কাহিনী কাব্য নয়, কিন্তু কাহিনীর স্বাদযুক্ত। দুটি চরিত্র এখানে প্রধান। কবি ও নন্দিনী। তাদের মধ্যে একটি উপন্যাসধর্মী ঘটনাপ্রবাহ চলে কাব্যের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্যাটার্নে। এ দিক থেকে নন্দিনী কাব্যটি বাংলা সাহিত্যে অভিনব সংযোজন। কবি মিল্টন বিশ্বাস বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে নতুন কোন মাত্রা সংযোজন করলেন কিনা জানি না। সেটা সময় বলে দেবে।
সাধারণত গীতিকবিতার বহুমাত্রিক আঙ্গিক, বৈশিষ্ট্য, দর্শন, রস প্রভৃতি থাকে। কিন্তু নন্দিনী করুণ রসের একটি ঝর্ণাধারা এক রৈখিক গতিতে তরঙ্গ তুলে বয়ে চলেছে। সমস্ত কবিতার অন্তরে বিলাপ ব্যঞ্জিত হয়েছে। আষাঢ়ের বর্ষণের মত কেঁদেছেন কবি, যা পাঠককেও সহজেই স্পর্শ করে। ৫৩টি কবিতায় একই সুর। অতি করুণ বলে অতি মধুর। শেলির শাশ্বত উক্তির প্রতিফলন যেন প্রতিটি কবিতা। Our sweetest songs are those that tells our saddest thought.
কবিতায় কবি মিল্টন বিশ্বাস ভাবকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। অলংকার এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। ভাবের সহজ মুক্তি দিয়েছেন তিনি। প্রকাশভঙ্গি সাবলীল, ভাষা অতি সাধারণ হয়েও অসাধারণ ব্যঞ্জনা পেয়েছে। গদ্য ছন্দের মধ্যে তিনি প্রাণপ্রবাহ প্রয়োগ করেছেন। শব্দবিন্যাস স্বাভাবিক। কোনো কষ্ট কল্পনা নেই শব্দ বাছাইয়ে। বাক্য গঠনেও তিনি পাণ্ডিত্য দেখাতে চাননি। মনের মধ্যে কথাগুলো যেভাবে পেয়েছেন সেভাবেই কলমে এনেছেন বলে মনে হয় । তাই কবি মিল্টন বিশ্বাসের কাব্যের শিল্প—সাফল্য এর সহজবোধ্যতা, সরলতা, সহজমুক্তি, স্পষ্টবাদিতা, সরসতা, সাবলীলতা। আবেগ তাঁর কাব্যের সরসতা, করুণ রস তাঁর কাব্যের বেগ। তিনি পরিহার করেছেন কষ্টকল্পনার সকল বৈশিষ্ট্য। অলংকারের বাড়াবাড়ি নেই, অনুপ্রাসও নেই। তিনি যে কবি সেটি তিনি সব জায়গায় লুকানোর চেষ্টা করেছেন, কেবল মেলে ধরেছেন বেদনা বিধুর হৃদয়।
কবি চিরবিরহ চরিত্র, নন্দিনী অভিমানী। কবিকে ছেড়ে চলে গেছে। ফলে বিগত দিনের প্রেমের স্মৃতি নিয়ে পল্লবিত হয়েছে কাব্য। শতশত স্মৃতি, মান-অভিমান, চাওয়া-পাওয়া, ভুল-বোঝাবুঝি, পারস্পরিক সহযোগিতা, অসহযোগিতা, প্রেম-অপ্রেমের হাজারো দৃশ্য চলচ্চিত্রের মত বয়ে চলছে কাব্যজুড়ে। এ কাব্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য কোথাও স্থূল যৌনতা নেই। কবি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন দৃশ্যগুলো। অথচ প্রচুর সুযোগ ছিল কিন্তু তিনি সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। নন্দিনীর সাথে তাঁর যাপিত জীবন নিয়ে তিনি কাদা ছোড়াছুড়ি করতে পারতেন। কিন্তু নন্দিনীর শরীর ও দোষ তিনি পাঠকের কাছে আবৃত করেই রেখেছেন। তবুও পাঠকের উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না নন্দিনীর সৌন্দর্য।
আধুনিক প্রেমের প্রধান অনুষঙ্গ মনোযোগ। নন্দিনীর প্রতি কবির যে মনোযোগ কাব্যের প্রতি চরণে চরণে মিশে আছে তাতে বিচ্ছেদের সকল দোষ তিনি নন্দিনীকেই দিচ্ছেন। নন্দিনীর উচ্চাকাক্সক্ষা, অবিবেচনা, জেদ, উপেক্ষাই বিচ্ছেদের কারণ। এত মনোযোগী কবিকে এভাবে ফেলে যাওয়া নন্দিনীর ঠিক হয়নি। এমনি এক বোধে পাঠক কবির ব্যথায় ব্যথিত হয়। কবি পূর্বে কবি ছিলেন না। নন্দিনীর ভালোবাসা তাঁকে কবি বানিয়েছে। ‘তুমি বলেছিলে কবি হও। কবিকে আমার পছন্দ।’
নন্দিনী কবিকে ফেলে গেলে কবি তাকে তিরস্কার করেননি। মৃদু ভাষায় তাকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
‘নন্দিনী ,
যত দূরেই যাও তুমি
তোমার স্বপ্ন আমাকে টানবে শুভ যুদ্ধের ময়দানে
যত দূরের পথিক হও না কেন
তোমার হাসি আমার শরীর ছুঁয়ে যাবে।’
স্যুররিয়ালিজমের স্বপ্ন কৌশল দিয়ে বোনা নন্দিনী কাব্যে কবি কল্পনাচারী। রোমান্টিকতা কবিতাগুলোকে ভারাক্রান্ত করেনি। কবি ভারতীয় অলঙ্কার যদিও এড়িয়ে গেছেন। তিনি চাইলে তা ব্যবহার করতে পারতেন। সমাসোক্তি অলংকারের শক্তিশালী একটি দৃষ্টান্ত-
‘নন্দিনী
তুমি চলে যাবার আগে নিঃশ্বাসে স্বপ্ন বুনে গেলে
লাল কবুতরের গল্প শুনিয়ে উধাও হলে।
চলে যাবার আগে যে নদী ছিল বুনো হাঁসের দখলে
ফণিমনসা তার শরীর জুড়ালে এসে।’
প্রথমেই লিখেছি, কবি মিল্টন বিশ্বাসের আবির্ভাব আকস্মিক। এখন কবিকে মূল্যায়ন করা কঠিন। তবে নতুন কোনো ঢং বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করতে পারে এমন সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছে। প্রচলিত গীতিকবিতাকে তিনি কাহিনী কাব্য এবং আঙ্গিকগতভাবে গীতিকবিতার অবয়বের একটি চারিত্র্য অবলম্বনে রচনা করেছেন। এতে রয়েছে উপন্যাসের স্বাদ। ভাবগতভাবে তিনি করুণ রসের পক্ষপাতী। তবে প্রেম, বিরহ, মানবতা প্রভৃতিকে কব্যের বিষয় করেছেন তাঁর ‘নন্দিনী’ কাব্যগ্রন্থে। তাঁর সৃষ্টি অপূর্ব। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।
বইয়ের নাম : নন্দিনী
লেখক : মিল্টন বিশ্বাস
প্রকাশনী : নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা
প্রকাশকাল : ২০১৮
প্রচ্ছদ : আলপ্তগীন তুষার
মূল্য : ১৫০ টাকা