বই আলোচনা
গল্পের মিছিলে ‘জিহ্বার মিছিল’
কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের তেরোতম গল্পগ্রন্থ ‘জিহ্বার মিছিল’। অমর একুশের বইমেলা-২০১৮-তে প্রকাশ করেছে এ দেশের অভিজাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাওলা ব্রাদার্স। গল্পেগ্রন্থের নামকরণেই রয়েছে চুম্বকীয় আকর্ষণ। ‘জিহ্বার মিছিল’ নাম অথবা শব্দদ্বয় আমাদের মনে ধারণা আনে, এক রূপকীয় তরবারি বোধ হয় গল্পে বিম্বিত হয়েছে। গল্পকার ‘জিহ্বার মিছিল’ দিয়ে বাকফুর্তি অথবা বাকস্বাধীনতা সম্পর্কিত কোনো আদর্শ রূপরেখায় এনে দিয়েছেন। কিন্তু সব গল্প একনাগাড়ে না পড়ে গেলে ভুল ভাঙা অসম্ভব। গল্পগুলো প্রতীকী নয়, বরং খুব বেশিই বাস্তবের কশাঘাতে রক্তাক্ত এবং সমাজকেন্দ্রিক। গল্পগুলো বর্তমান সমাজের চলচিত্রের বিম্বায়ণের জন্যে প্রতিটি গল্পের ভেতরের কলকজ্বা বা শেকড় অনুসন্ধান জরুরি। গল্প তো মানুষের রক্তে আর প্রাণের রঙে রঙিন হয়।
মনি হায়দারের ‘জিহ্বার মিছিল’ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘রক্ত মাখামাখি’ যখন পড়া হয়, মনে হয় গল্পের ব্যাপকতার সঙ্গে নামকরণ খানিকটা সাযুজ্যহীন। এক প্রদীপ্ত ক্লান্ত আগন্তুক যে কি না পরিমাপহীন পথ পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হয়েছে এক রাজবাড়িতে। রাজবাড়ি বহুদিন অন্ধকার ছিল, সমস্ত রাজনর্তকী ছিল নিষ্প্রভ অথবা নিষ্প্রদীপ। আগন্তুকের উপস্থিতিতে প্রধান রাজনর্তকী উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। আগন্তুকের আসাকে কেন্দ্র করে চলতে থাকে জমজমাট প্রস্তুতি। গল্পকার কোথায় পাঠকদের নিয়ে যাচ্ছেন, একেবারে শেষ শব্দ পাঠ না হওয়া পর্যন্ত ঠাহর করা কঠিন। বর্ণনার কুশল কারুকাজে ‘রক্ত মাথামাখি’-তে নাটোরের বনলতা সেন রাজনর্তকী হিসেবে আবির্ভূত হয় আর আগন্তুক জীবনানন্দ দাশ আশা করেন, বোধ হয় এইবার তিনি বনলতা সেনের কাছে দুদণ্ড শান্তি খুঁজে পাবেন। কিন্তু সমস্ত আশা নিরাশায় পরিণত হতে বাধ্য হয়, যখন কবি দেখেন, তার আরাধ্য বনলতা সেনও আইএসের মতো রক্তনাচে আগ্রাসিত। আইএসের জঙ্গিবাদের রক্তনেশা আক্রমণ করে চলেছে সকল কল্পনার সুন্দরকে ঠিক এই সময়ের মতো। ‘রক্ত মাখামাখি’ গল্পটার আখ্যান অসাধারণ। আর শব্দচয়ন, বাক্যগঠন একেবারেই আলাদা বৈশিষ্ট্য নির্মিত।
পরের নাম গল্প ‘জিহ্বার মিছিল’। সত্যিকার অর্থেই জিহ্বাদের বিদ্রোহী মিছিল। জাদুবাস্তবতার সংম্পর্শে এই গল্পটি পেয়েছে নতুন মাত্রা। আমাদের সমাজের বাকপটু রাজনীতিবিদগণ, পুলিশ কর্মকর্তারা, দোকানদার, ডাক্তার কিংবা ধর্মবেত্তারা যদি এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন জিহ্বা খুঁজে পাচ্ছেন না, তাহলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে? প্রত্যেকে নিজেদের অসত্য কথাগুলো, মিথ্যে কিংবা মুনাফেকি অনাচারগুলোর সামনে মুখোমুখি দাঁড়ায়। অন্তত গল্পকার মনি হায়দার গল্পে এইসব ঠক আত্মপ্রতারকদের রূপক অর্থে হলেও বাধ্য করেন, সত্যের মুখোমুখি হতে। সমস্ত জিহ্বারা সত্যমাঠে এসে জমায়েত হয় আর স্ব-স্ব মালিকগণের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো একে একে উত্থাপন করতে থাকে। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ান অসত্যেরা। এ গল্পটিতে মনি হায়দার জাদুবাস্তবতার অনবদ্য চিত্র এঁকেছেন পরম শিল্পময়তায়।
‘একটি অরক্ষিত গল্প’ পরিহাসময় আঘাত আমাদের সমাজের প্রতি। গল্পটি এক পাহারাদেরকে নিয়ে যে কি না পুরো রাত অতিবাহিত করে নির্দিষ্ট এলাকা পাহারার কাজে। ছোট ঘরে রাতে স্ত্রী কুলসুম থাকে। ডাকাতদের অনৈতিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অপরাধে এক সকালে কাজ থেকে ফিরে দেখে স্ত্রী ধর্ষিত হয়ে পড়ে আছে আর তাতেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে গল্পের অপ্রিয় সত্যটি। যে পাহারাদার রক্ষণ করে পুরো এলাকা, সেই পাহারাদারের ঘরই অরক্ষিত, খোলা এবং এভাবে দেখা যায় পুরো বাংলাদেশটিই অরক্ষিত, খোলা যা গল্পের শেষে আমরা দেখতে পাই। এবং আমরা শিহরিত হই। শিহরিত হতে বাধ্য করেন গল্পকার।
অন্যদিকে ‘দড়ি’ গল্পটা অতিপ্রাকৃত। গোলাম কবির নামে রংমিস্ত্রিওয়ালার সাথে দড়ির কথোপকথন শেষমেশ সংঘর্ষে রূপ নেয়। দড়ি যেটা কি না নতুন, তা আবার কথাও বলে—গোলাম কবিরের স্ত্রীকে এক প্রকার দংশন অথবা ধর্ষণ করে কালমৃত্যু ডেকে আনে যেমনটা সে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল দড়ি, কিনে আনার প্রথম মুহূর্ত থেকে। কিন্ত গোয়ার গোলাম কবির পাত্তা দেয়নি। সামান্য একটা দড়ির কী ক্ষমতা? গল্পের শেষ অংশ : সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, বিছানায় কাকলী নেই। হাই তুলে বিছানা থেকে নামে গোলাম কবির। রান্নাঘর থেকে কোনো শব্দ না পেয়ে যায় সামনের বারান্দায়। দরজা খুলতেই মুখের ওপর দেখতে পায় একজোড়া আলতা মাখানো পা। আলতার একটু ওপরে শাড়ির গোলাকার ভাঁজ। পা এবং শাড়ির ভাঁজ ধরে ধরে ওপরে তাকায় গোলাম কবির। কাকলী দড়ি গলায় দিয়ে ঝুলে আছে কড়িকাঠের সঙ্গে। আর ঝুলে থাকা দড়ির মাথাটা গলার পাশ দিয়ে নিচের দিকে ঝুলে আছে খুব নিরীহভাবে। হতবাক গোলাম কবির বসে পড়ে কাকলীর পায়ের সোজা, নিচে। কী করবে, কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না কবির। তাকায় কাকলীর গলার কাছে। দড়িটা চমৎকার আদরে আটকে রেখেছে কাকলীর মসৃণ গলাটাকে। গলা বেয়ে বেয়ে টাটকা রক্ত পড়ছে ফোটা ফোটা করে গোলাম কবিরের মাথার ওপর।
‘অস্তিত্ব’, ‘জয় বাংলা’ ও ‘ন্যাশন ৫৭০’ গল্পত্রয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি পরিবারে যখন পাকিস্তানি মিলিটারিরা এসে হানা দেয়, তখনকার সংকটটি তৈরি হয় তা ‘অস্তিত্ব’ আর ‘জয় বাংলা’ মনি হায়দার প্রবল দক্ষতায় তুলে ধরেছেন। ‘অস্তিত্ব’ গল্পে খবিরউদ্দীনের ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যায় আর তার সন্ধান পেতে মেজর দীদার অবিন্যস্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে এসে হানা দেয় বাড়িতে। শেষ পর্যন্ত খবিরউদ্দীনের চোখের সামনেই তুলে নিয়ে যায় কন্যা লায়লাকে। যেন খবিরউদ্দীন আশা করেন, পুরো ঘটনাটিই যেন একটি নাটকের মঞ্চায়ন কিন্তু শেষমেশ বাস্তবতা নিষ্ঠুর রূপেই মঞ্চায়িত হয়।
‘ন্যাশন ৫৭০’ বঙ্গবন্ধুকে প্রতীকায়তনে রেখে গল্পকার মনি হায়দার অনন্য একটি গল্প লিখেছেন। বাংলাদেশে অনেক গল্পকার বঙ্গবন্ধুকে চরিত্র করে অনেক গল্প লিখেছেন। আমার ধারণা, সব গল্পকে ছাড়িয়ে গেছে গল্প ‘ন্যাশন ৫৭০’। একটি সাবানই দেশের মানুষ ব্যবহার করে আর কেনোই বা সাবানের নাম ‘ন্যাশন ৫৭০’ উত্তর খুঁজলে গল্পে পাওয়া যায়, বাঙালি জাতি একাত্তর-পরবর্তী পঁচাত্তরে সংকটে পতিত হয় জাতির পিতা আগামেননকে নির্মম হত্যার পর। এবং নিহত জনককে সামান্য ৫৭০ সাবান দিয়ে শেষ গোসল করানো হয়। আবার যখন দেশ ফিরে আসে জনকের আদর্শের মহাসড়কে, সেই থেকে পুরো বাঙালি জাতি একটিমাত্র সাবান ব্যবহার করে আসছে। সাবানের নাম ‘ন্যাশন ৫৭০’। সেই সাবান হয়ে উঠেছে পুরো একটি জাতির স্মারক।
‘রক্তাক্ত কাঁটাতার’ গল্পের প্রশ্নটি মূলত যুদ্ধও এর ফলাফলের যৌক্তিকতা নিয়ে। জসীমউদ্দীন নামের এক প্রবীণ মানুষ তিনটি যুদ্ধ করেছে। প্রথম যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় যুদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে, ভারতের বিরুদ্ধে। তৃতীয় যুদ্ধ তেইশ বছর পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তিনটি যুদ্ধের গৌরবময় ভূমিকা পালনস্বরূপ মেডেলের মূল্যসংক্রান্ত সকল চিন্তাভাবনা ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে যখন তিনি দেখতে পান ফেলানীকে আজও সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষীর গুলিকে কাঁটাতারে ঝুলতে হয়। এবং পিতাকে কন্যার তিল তিল সেই মৃত্যু দেখতে বাধ্য করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষীরা। জসীমউদ্দীনের মনে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, এতসব যুদ্ধের ফলাফল কি ফেলানীদের কাঁটাতারে ঝুলন্ত রক্তাক্ত দেহ? গল্পের শেষে আমরা দেখতে পাই, রাজনৈতিক সত্য উচ্চারিত হয়েছে চরিত্রের মাধ্যমে গল্পকারের গল্পে ‘জগতের সকল যুদ্ধই একটা প্রবল প্রতারণা। যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে হয়তো কারো রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পায়, কিন্তু আপনার মতো সাধারণ দরিদ্র বিপন্ন মানুষের কিছুই হয় না’। গল্পের চরিত্র জসীমউদ্দীন তিনটি যুদ্ধে অর্জিত যুদ্ধের মেডেলগুলো রাস্তায় বিছিয়ে রাখেন আর চোখের জল হয়ে উঠে রক্তের ফুল। ফেলানীকে লেখা গল্পটি গোটা মাবন সভ্যতার পক্ষ থেকে যথার্ত শিল্পীত প্রতিবাদ।
‘একটা ছবির গল্প’ মধ্যবিত্ত পরিবার সংকট অথবা একজন চরিত্র জামীর জীবন সংগ্রাম কেন্দ্র করে আবর্তিত।
জীবন সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত লুকায়িত প্রেমের অবথিত বেদনা আর হাহাকার বোধ। ‘সমুদ্র সংগম’ ও ‘মধ্যবয়সের প্রেম’ দুটি গল্পই পরকীয়া নিয়ে। পরকীয়া প্রশ্নটি যাচাই করা হয়নি গল্প দুটোয় বরং গল্পকার মনি হায়দার দেখিয়েছেন প্রেমে মানুষের তীব্র আবেগীয় সংকট। ‘সমুদ্র সংগম’ গল্পটিতে রাজন-কণার প্রেমের বিয়ে। ব্যবসার কারণে বিদেশে থাকতে হয় মাসে একবার দুইবারের মতো। কিন্তু এটুকুতেই কখন কণার জীবনে প্রবেশ করে ফেলে হিমেল, তা রাজন বুঝতেও পারেনি। শেষে আমরা দেখি, রাজন কণার ওপর প্রতিশোধ নিতে কক্সবাজার সৈকতে কণাকে মেরে ফেলবার পরিকল্পনা করে। আমরা পাঠকরা যখন নির্জন সমুদ্রসৈকতে সুন্দরী একজন নারীর মৃত্যু দেখতে প্রস্তুত হই, তখন গল্পকার মনি হায়দার পাঠকদের জন্য নিয়ে আসেন ভিন্নদৃশ্য কল্প। বিশাল সমুদ্রের উত্তাল জলরাশির তরঙ্গ আর কণা বিপন্ন মুখ দেখে রাজন, কণাকে হত্যা করে না, প্রতিশোধ নেয় অন্যভাবে। ফলে গল্পটি পাঠকদের কাছে নতুন এক পরিপ্রেক্ষিতে স্থির থাকে। প্রেমের জায়গায় মানসিক দ্বন্দ্ব আরো তীব্র হয় যখন আমরা পাঠ করি গল্পের শেষ অংশ : কণার বিষণ্ণ বিপন্ন বিধস্ত মুখের ওপর দিয়ে রাজন তাকায় সফেদ সমুদ্রের দিকে। হঠাৎ সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নিজেকে সম্রাটের মতো লাগে। আবার নিজেকে ক্ষণস্থায়ী ঢেউয়ের মতোও মনে হয়। বিশাল এই সমুদ্রের জলে কত পাপ, কত অনাচার, কত আবর্জনা ছড়িয়ে আছে। সমুদ্রের বিশালতার সামনে নিজেকে খুব ক্ষুদ্রতম কীট মনে হলো! নিজের প্রতি উল্টো একটা ধিক্কারও জন্মাল, নিশ্চয়ই আমার মধ্যে কোনো শূন্যতা আছে, যা আছি জানি না। শূন্যতার সেই গোপন গলি দিয়ে কণার জীবনে প্রবেশ করেছে হিমেল। আমিই ব্যর্থ...। একজন ব্যর্থ মানুষের কোনো অধিকার কি আছে, সমুদ্রের অতল জলে কণাকে বিসর্জন দেওয়ার! কণাকে ছেড়ে দেয় রজান, যাও তুমি মুক্ত। কিন্তু তোমার সঙ্গে এই জীবনে আমার দেখা হোক আমি আর চাই না। দ্রুত লোকালয়ের দিকে হাঁটতে থাকে রাজন। পেছনে পড়ে থাকে কণা, সমুদ্র আর সমুদ্র তরঙ্গের শোঁ শোঁ আওয়াজ!
কক্ষ বিচ্যুত কণার জন্য কি করুণা জাগে না? গল্পকার মনি হায়দার কেনো অপ্রতিরোধ্য গল্পকার? এ জন্য যে কক্ষচ্যুত কণার জন্য পাঠকের জমিনে করুণা জাগাতে পারেন।
‘মধ্যবয়সের প্রেম’ হাফিজুর রহমানের মধ্যবয়সের এক পশলা বৃষ্টির মতো প্রেমে পড়বার গল্প। এই গল্পটি পরকীয়া না মানুষের সাধারণ আবেগে জারিত প্রেমের ক্ষেত্রে নানা সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশের গল্প তা নির্ণয় করবার দায়িত্ব পাঠকের। গল্পকার শুধু চিত্রটটুক বর্ণনা করে গেছেন দারুণ দক্ষতায়। স্বামীর অনুপস্থিতিতে মনিকাও কি চায়নি শূন্যতাটুকু দূর করতে? হাফিজুর রহমানকে কাছে টানতে? নাকি মনিকা সচেতন কৌশলে হাফিজুর রহমানকে কেবল পরিস্থিতির শিকার বানাতে? নারীর চিরায়ত লাবণ্যের লবণে একজন মধ্যবয়সী হাফিজুরকে নিয়ে একটু খেলতে? এ ধরনের নানা প্রশ্ন তৈরি হয় গল্পটি পড়তে পড়তে। আবেগীয় সংকটের চিত্রায়ণ হিসেবে গল্পটি সার্থক।
‘জায়গা জমিন’ গল্পটি আমাদের বাস্তব সমাজের একটি মুমূর্ষু খণ্ডচিত্র। এই গল্পটি শুরু করবার সময়ে অন্য কিছু মনে হলেও গল্পের শেষে সেই ‘অন্যকিছু’ দাঁড়ায় একবারে ভিন্ন অণুতে। গল্পকার মনি হায়দার অনন্য দক্ষতায় গল্পটাকে মোচড় দিয়ে পাঠকদের দাঁড় করিয়ে দেন নিজের সামনে। মানুষের সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে জমি টাকাপয়সা অন্যতম নিয়ামক। দেড় বিঘা জমি ভাই ভাই সম্পর্কের ছেদ টানে আর জড়িত হয়ে পড়ে একটি পুরো পরিবার সর্ম্পকের সুইসুতো থেকে ছিটকে পড়ে, তারই নির্মম আখ্যান। সম্পর্ক যদিও ভাঙে, অখণ্ড থেকে যায় যে সংশ্লিষ্ট স্মৃতিসমূহ, সেই স্মৃতি এই গল্পের শ্রেষ্ঠ আরতি। জমিজমার স্থায়িত্ব কতটুকু? লোভ, কূটকৌশল ধরনের কালো পোকাগুলো তো আমাদের সমাজে চারপাশেই ঘুরে বেড়ায়। সোহাগ রহমান আসলে সমাজের একটা বড় ভুক্তভোগী অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
মনি হায়দার আমাদের কালের ছোটগল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারিগর। শাশ্বত বাংলার মাটি আর জলের মানচিত্র আঁকেন তিনি গল্পের তরঙ্গে তরঙ্গে। একজন গল্পকার গল্পে কতটা নিবিষ্ট, কতটা নিবেদিত—গল্পকার মনি হায়দার উদাহরণ। তোরোতম গল্পগ্রন্থ ‘জিহ্বার মিছিল’ এ বারোটি গল্পই একেক মাত্রায় উজ্জ্বল। পৃথিবীর সমস্ত গল্পই বলা হয়ে গেছে এমনটি যদি সত্যও হয়, তবুও পৃথিবীর সব কথা বলা হয়নি। বলা সম্ভব নয়। প্রতিদিন জগতে নতুন মানুষ আসে, জন্ম হয় নতুন গল্পের আখ্যান। অসংখ্য কথা অসংখ্যভাবে বর্ণিত হতে হতে তৈরি হচ্ছে গল্পের মিছিল। মনি হায়দারের ‘জিহ্বার মিছিল’ সেই গল্পের মহামিছিলের উৎফুল্ল অংশ।