মোস্তফা কামালের সাহিত্য বহুমাত্রিক
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল এ মাসেই কলকাতায় বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন, পেয়েছেন ‘সায়েন্স ফিকশন সাহিত্য পুরস্কার’ ২০১৭। সাংবাদিকতা পেশার ব্যস্ততার মধ্যে যাঁরা সৃষ্টিশীল কাজের ধারা বজায় রাখতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মোস্তফা কামাল। প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তাঁর একাধিক বই প্রকাশিত হয়। তিনি আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সায়েন্স ফিকশন, টিভি নাটক এবং শিশু-কিশোর উপযোগী রচনার নিয়মিত লেখক। কলামিস্ট হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও রয়েছে তাঁর। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘অগ্নিপুরুষ’ ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাড়া জাগানো ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘অগ্নিকন্যা’র দ্বিতীয় পর্ব এটি।
২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ এবং ‘তেলবাজ’ নতুন ধরনের দুটি উপন্যাস। ২০১৫ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয় ‘চাঁদের আলোয় রাগিব আলী এবং সে’ নামক ম্যাজিক রিয়ালিজমের অনন্য আখ্যান। অন্যদিকে তাঁর ‘রুবীর কালো চশমা’ সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। নানা ধরনের কিশোর উপন্যাস লিখে মোস্তফা কামাল ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছেন। এ ধরনের একটি গ্রন্থ ‘ডাকাতের কবলে ফটকুমামা’। মোস্তফা কামালের রঙ্গব্যঙ্গ সিরিজ বেশ জনপ্রিয়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘পাগলছাগল ও গাধাসমগ্র-৯’। মোস্তফা কামাল নিজেই গ্রন্থটির ভূমিকায় লিখেছেন ‘রঙ্গব্যঙ্গ-এর দীর্ঘ এগারো বছরের পথচলায় অনেক বাধা-বিপত্তি, হুমকি-ধমকি, এমনকি মামলাও হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনোদিন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি। অন্যায়কারী যতই শক্তিশালী হোক, অন্যায়কে ‘না’ বলব। সারাজীবন না-ই বলব। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার যে শপথ নিয়েছি, তার থেকে এক চুলও বিচ্যুত হব না।’
অন্যদিকে তাঁর সায়েন্স ফিকশন ‘বিমান রহস্য’ এবং ‘হাসির চার উপন্যাস’ সংকলনও দৃষ্টিনন্দন। এ ছাড়া কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ছয়টি সায়েন্স ফিকশন ও পাঁচটি গোয়েন্দা উপন্যাসের সংকলন নিয়ে মোস্তফা কামালের আরো দুটি গ্রন্থ। আগেই উল্লেখ করেছি সায়েন্স ফিকশনে তিনি কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি কল্পবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য একজনকে সায়েন্স ফিকশন সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কল্পবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখায় মোস্তফা কামালকে পুরস্কার দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, সায়েন্স ফিকশন লেখালেখির দেড় দশক পর (ঢাকা ও কলকাতা থেকে ১৫টি বই বের হয়েছে) এই স্বীকৃতি মিলেছে তাঁর। মোস্তফা কামালের সামাজিক উপন্যাস ‘জননী’ ব্যাপক পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০১১ সালে তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জনক জননীর গল্প’ প্রকাশিত হয়। এসব গ্রন্থের আগেই তিনি ‘সিরিয়াস’ ধারার উপন্যাস রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘বারুদ পোড়া সন্ধ্যা’ (২০০৫), ‘হ্যালো কর্নেল’ (২০১০) পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। এরপর তিনি লিখেছেন ‘জিনাত সুন্দরী ও মন্ত্রী কাহিনী’ (২০১২), ‘কবি ও একজন নর্তকী’ (২০১৩) প্রভৃতি উপন্যাসের বাস্তবধর্মী কাহিনী। মোস্তফা কামালের একটি ছোটগল্প সংকলন ছাড়াও তাঁর অন্যান্য সংকলনগ্রন্থ ‘সায়েন্স ফিকশন সমগ্র’, ‘চার জয়িতা’, ‘চার অপরূপা’ এবং গবেষণাগ্রন্থ ‘আসাদ থেকে গণঅভ্যুত্থান’ (১৯৯৩) খ্যাতি লাভ করেছে। ১৯৯৩ সাল থেকে এই লেখকের নিয়মিত বই প্রকাশিত হচ্ছে। সব মিলে এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক।
২.
মোস্তফা কামালের প্রথম লেখা ছড়া ‘দুষ্টুছেলে’। প্রথম গল্প ‘বীরাঙ্গনার লড়াই’। প্রথম উপন্যাস ‘পাপের উত্তরাধিকার’। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘আসাদ থেকে গণঅভ্যুত্থান’। তিনি এ বিষয়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কভার স্টোরি করেছিলেন। তাতে ব্যাপক সাড়া পান। ওই বিষয়ে আরো কিছু গবেষণা কাজ করেন। তারপর একটি জাতীয় দৈনিকে ওই একই শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে ১ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ২০ জানুয়ারি ছিল আসাদ দিবস, মানে ওই দিনে আসাদ শহীদ হন। এর ফলে তাঁর লেখা সুধীমহল থেকে শুরু করে অনেক সাধারণ পাঠকমহলেও প্রশংসিত হয় এবং আসাদ পরিষদ বইটি বের করে। লেখার সূচনা থেকেই সাংবাদিকতার গুরুত্ব ছিল তাঁর কাছে অনেক। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে বলেন, ‘আমার লক্ষ্যই ছিল আমি লেখক সাংবাদিক হবো। লেখাপড়া ছাড়া আমার আর কোনো জগৎ নেই।
সাংবাদিকতা পেশায় থাকার কারণে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যদিও অনেকে বলেন, পত্রিকা অফিসে এত সময় দেওয়ার পর লেখালেখির সময় পান কোথায়? আসলে আমি প্রতিদিন লিখি বলেই বছর শেষে কয়েকটি বই দাঁড়িয়ে যায়। যা বলছিলাম, আমি এ পর্যন্ত আফ্রিকা মহাদেশ বাদে সবগুলো মহাদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশে তৃণমূল পর্যায়ে রিপোর্টিংয়ের কাজ করেছি। সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ নিয়ে দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে উপন্যাস লিখেছি। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম এবং অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি। ফলে এসব অভিজ্ঞতা লেখালেখিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। অন্য পেশায় থাকলে হয়তো এই অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকত।’ অবশ্য তাঁর কথাসাহিত্যে দেশের রাজনীতি, শাসনব্যবস্থা, সমাজনীতি, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও সমাজ জীবনের নানা কাহিনী উঠে এসেছে। যেমন, ‘বারুদপোড়া সন্ধ্যা’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর রাজনীতি, যুদ্ধাপরাধীদের বাড়বাড়ন্ত, প্রগতিশীল চেতনা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে লেখা উপন্যাস। এর ইংরেজি সংস্করণও বেরিয়েছে ২০১০ সালে। তার নাম ‘ফ্লেমিং এভেনটাইড’। ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন পাঠকদের কাছ থেকে। সিরিয়াস কলামের চেয়ে রঙ্গব্যঙ্গ কলাম লিখতে বেশি সময় যায় মোস্তফা কামালের। বেশি ভাবতে হয় তাঁকে। এ জন্য তাঁর প্রতিটি লেখাই মৌলিক। রঙ্গব্যঙ্গ কলাম প্রতিটিই সমসাময়িক ঘটনার ওপর লিখিত। কিন্তু প্রতিটিই আলাদা একেকটি গল্প।
আসলে মোস্তফা কামালের গল্প-উপন্যাসে বিচিত্র ভাবনা উঠে এসেছে। কখনও হাস্যরস, ব্যঙ্গ, কল্পবিজ্ঞান, সমাজ সংকট- নানা বৈচিত্র্য আছে তাঁর লেখায়। বাস্তব জীবনে কোনো সংকটকে তিনি কখনোই বোঝা মনে করেন না। সংকট অতিক্রম করেই এগোতে হয়েছে তাঁকে। আর সংকট না থাকলে তো জীবনটা সংগ্রামমুখর হবে না। তবে সংকটময় মুহূর্তে তিনি রম্য ও হাসির উপন্যাস লেখেন কিংবা সায়েন্স ফিকশন অথবা গোয়েন্দা কাহিনী। জীবনকে দুঃখ কষ্টে ভারাক্রান্ত করার পক্ষপাতী নন তিনি। জীবনটা খুবই ছোট। দুঃখ কষ্ট আসতেই পারে। তাকে হাসিমুখে গ্রহণ করতে জানতে হবে। সে রকম পরিস্থিতিতে হয়তো তাঁর হাসির লেখালেখি বেড়ে যায়। অন্যদিকে কিশোর-তরুণদের জন্য লেখেন সায়েন্স ফিকশন। তাঁর মতে, ‘সায়েন্স ফিকশন পড়লে চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। আমি নিজেও পড়তে পছন্দ করি। সায়েন্স ফিকশনের কোনো ছবি সুযোগ পেলেই দেখি। আমি পুরোপুরিভাবে বিজ্ঞানের ছাত্র নই। তবে আমি পুরোপুরি একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ।’
মোস্তফা কামালের একটি ব্যতিক্রমী গ্রন্থ হলো ‘হ্যালো কর্নেল’। ‘হ্যালো কর্নেল’ হলো পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিবাদের উত্থান, তাদের কর্মকাণ্ড, সেনাবাহিনী ও তালেবান জঙ্গিদের সম্পর্ককে উপজীব্য করে লেখা উপন্যাস। এটি সত্যাশ্রয়ী একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসে তিনিই প্রথম বলেছিলেন, ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানেই আছে। তার আরো দুই সহযোগী আইম্যান আল জাওয়াহিরি ও মোল্লাহ ওমরও পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। তাদের ব্যাপারে আইএসআই সব জানে। এ উপন্যাসে একটি বড় সময়কে ধরে রাখা হয়েছে। আবার আছে ভবিষ্যতের ইঙ্গিতও। একটি উপন্যাসের কাহিনী ১০ বছর পরে সত্য প্রমাণিত হওয়ার ঘটনা কিন্তু বিরল। পাঠক হিসেবে বলতে পারি উপন্যাসটি যুগ যুগ ধরে পঠিত হবে। এরশাদের শাসনামলের ভেতরের কাহিনী উঠে এসেছে ‘জিনাত সুন্দরী ও মন্ত্রীকাহিনী’ উপন্যাসে। স্বৈরশাসকরা দেশটাকে কীভাবে লুটেপুটে খেয়েছেন তার উদাহরণ হচ্ছে, এরশাদের শাসনকাল।
অপশাসন, দুর্নীতি আর নারী কেলেঙ্কারির ৯ বছর বললেও ভুল বলা হবে না। ‘জননী’ উপন্যাসে আছেন বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মা। তাঁর দুঃখকষ্ট, তাঁর সংগ্রাম, একটি পরিবারকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া; অর্থাৎ একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সত্যিকারের চিত্র। কেবল একটি মধ্যবিত্ত পরিবারই নয়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে আর্থসামাজিক বিবর্তন, তা পরিপূর্ণভাবে উঠে এসেছে এ আখ্যানে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ উপন্যাসে নারী সমাজের দুঃখ বেদনার কথা উঠে এসেছে। এক হতভাগ্য মেয়ের জীবন নিয়ে লেখা এটি। সত্য এবং কল্পনার মিশেলে তৈরি হয়েছে হতভাগ্য মেয়ের জীবনালেখ্য।
৩.
কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহাসিক ঘটনা ও রাজনীতি মোস্তফা কামালের প্রিয় বিষয়। তবে তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় সিদ্ধহস্ত। লিখেছেন ‘অগ্নিকন্যা’ ও ‘অগ্নিপুরুষ’ নামক রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক উপন্যাস। এ দুটি উপন্যাসে একটা বিশেষ সময়কে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি শিল্পরূপ পেয়েছে তাঁর আখ্যানে। কাহিনীতে ঘটনা ও চরিত্রগুলো সত্য। সেই সময়ের নায়কদের কার কী ভূমিকা ছিল সেই বর্ণনা দিয়েছেন ঔপন্যাসিক। দীর্ঘ উপন্যাসের এই পর্ব রচনা করতে তাঁকে শতাধিক গ্রন্থ, সংবাদপত্র, সাময়িকী এবং সার্চ ইঞ্জিন গুগলের সহায়তা নিতে হয়েছে। এসব থেকে সত্য খুঁজে বের করতে হয়েছে—অজানা কাহিনী, কিন্তু ধ্রুব সত্য। ঐতিহাসিক ঘটনা গল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার কাজটি অনেক কঠিন। ভাষার দিকটিও তাঁকে লক্ষ্য রাখতে হয়েছে। কারণ তাঁর মতে, ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে না ধরলে তা পড়তে চান না পাঠক। তাকে বইয়ের ভেতরে ঢোকাতে হলে ভাষার শক্তি থাকতে হবে। প্রেমের উপন্যাস, ভৌতিক কিংবা রহস্য উপন্যাস লেখা সহজ। কিন্তু ঐতিহাসিক বিষয়ে উপন্যাস লেখা সবচেয়ে কঠিন।
২৫৫ পৃষ্ঠার ‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসটির আখ্যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এর সময় কাল ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা উপস্থাপন থেকে শুরু করে বাঙালির অধিকার আদায়ের সামষ্টিক প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। ‘অগ্নিকন্যা’ ও ‘অগ্নিপুরুষ’ পাঠ করে বোঝা যায় ইতিহাসের যে লক্ষ্য ঘটনার বস্তুনিষ্ঠতা বা তথ্যনিষ্ঠতা বজায় রাখা তা মেনেও ঔপন্যাসিক কল্পনার আঙিনায় সাঁতার কেটেছেন। ইতিহাস একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে ব্যক্ত করার জন্য সত্য তথ্য প্রকাশ করে। সাহিত্য ঠিক নির্দিষ্ট থেকে অনির্দিষ্ট, বিশেষ থেকে নির্বিশেষ সত্যের দিকে ধাবমান। সাহিত্যের সত্য লেখকের মনোলোকে নির্মিত হয়। এ জন্যই ইতিহাসের নিছক তথ্যনির্ভর ঘটনা বিন্যাস ও চরিত্রের বিবরণ দিলেই উপন্যাস হবে না। বরং ইতিহাসের তথ্যসত্যকে স্বীকরণ করে সৃজনী কল্পনার প্রাণরসে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে হবে। সত্যের জন্য ইতিহাস পাঠ অনিবার্য আর আনন্দের জন্য সাহিত্যপাঠ আবশ্যক। সাহিত্যের কল্পনার আতিশয্যে ইতিহাসের সত্য দিয়ে সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ আছে। যেমন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এন্তার অপপ্রচার প্রচলিত। তা থেকে ঐতিহাসিক উপন্যাসে ভ্রান্ত ঘটনা পরিহার করাটা জরুরি। ঐতিহাসিক উপন্যাস প্রথমে উপন্যাস পরে ইতিহাস এটা মেনে নিয়েও আমরা বলতে পারি যে, ভ্রান্ত বা বিকৃত ইতিহাসের তথ্য সত্য বলে পরিবেশন করেননি মোস্তফা কামাল। বরং শ্রমনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন প্রকৃত ইতিহাসের ঘটনা অনুসরণের ক্ষেত্রে, চরিত্র নির্মাণে।
৪.
দেশ এবং সমাজের যত অন্যায়, অনিয়ম, দুঃখ-কষ্ট এগুলো মধ্যবিত্ত মোস্তফা কামালের মাথায় ভর করে। তারপর সেগুলো নিয়ে তিনি গদ্য সাজান। এ জন্য তাঁর উপন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্রই বেশি এসেছে। লেখক মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকটটা ভালোভাবে জানেন। তবে গ্রামীণ পটভূমিও তাঁর উপন্যাস রয়েছে। ‘পাপের উত্তরাধিকার’, ‘মায়াবতী’সহ বেশ কিছু উপন্যাস এবং ছোটগল্প গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত। লেখার ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে যায় সেদিকেই নিয়ে যান তিনি। তখন লেখাটা আসলে একদম পরিকল্পনা মাফিক হয় না। ঘটনাপ্রবাহ টেনে নিয়ে যায়। ‘চাঁদের আলোয় রাগিব আলী এবং সে’ উপন্যাসটি একটি ম্যাজিক রিয়েলিজম। বিভিন্ন ধরনের ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। কখনো তিনি সংলাপ প্রধান আখ্যান বুনন করেছেন। তুলে ধরেছেন রহস্য উপন্যাসের ভেতর-বাইরের উদ্দীপনাসমূহ।
মূলত মোস্তফা কামালের লেখালেখিই ধ্যান-জ্ঞান, আরাধনা, সাধনা। তাঁর সমস্ত ভাবনা আর সত্তাজুড়ে আছে লেখালেখি। তাঁর দেওয়া কয়েকটি সাক্ষাৎকার পাঠ করে জানা যায়, ছোটবেলা থেকে লেখার জগতে তাঁর অনুপ্রবেশ। তাঁর প্রথম প্রেম লেখার সঙ্গে। এ জন্য তাঁকে তৈরি হতে হয়েছে। প্রতিনিয়ত পড়তে হয়েছে। সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করেন বলে অনেক প্রলোভনও জয় করেছেন। একটা গল্প, উপন্যাস কিংবা অন্য যেকোনো লেখা লিখে যে আনন্দ পান, তিনি তা আর কিছুতে পান না। তবে তিনি সব ধরনের বিষয় নিয়েই লিখতে পছন্দ করেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, কখনো ভৌতিক, গোয়েন্দা, সায়েন্স ফিকশন আবার কখনো প্রেম, বিরহ, হাসির বিষয়ে গল্প-উপন্যাস, নাটক লেখেন। সিরিয়াস বিষয় নিয়েও কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, জঙ্গিবাদ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সামাজিক বিষয় নিয়েও গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। লেখার প্রতি ভালোবাসার কারণেই তিনি নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এমন কিছু কাজ করতে হবে যা বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন করে নিতে পারে। আমার ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে লেখালেখি। আমি নিরলসভাবে সেটাই করছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সেই কাজটি করে যেতে চাই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লিখে যেতে যাই। এমন কিছু করতে চাই যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যায়। কালজয়ী হয়।’ মোস্তফা কামালের জন্মদিনে প্রত্যাশা রাখি তিনি আমৃত্যু লিখে যাবেন এবং বাংলা সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করবেন।