সাক্ষাৎকার
কবিতা মানে কবিতার ইতিহাস : সলিমুল্লাহ খান
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বাংলাদেশের একজন স্বনামখ্যাত লেখক, চিন্তাবিদ ও শিক্ষক। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা, বক্তব্য ও ভাষণ রয়েছে। ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’, ‘আহমদ ছফা সঞ্জীবনী’, ‘আদমবোমা’, ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’ ও ‘আমি, তুমি ও সে’ সলিমুল্লাহ খানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ। সম্প্রতি ‘পরস্পর’ সাহিত্য ওয়েবজিনের পক্ষ থেকে কে এম রাকিব তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেন। সলিমুল্লাহ খান ও ‘পরস্পরে’র সম্মতিতে সাক্ষাৎকারটি এখানে প্রকাশ করা হলো।
প্রশ্ন : আপনি নিজেও একজন কবি। আপনাদের সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত বাংলা কবিতার ক্রমপরিবর্তনকে কিভাবে দেখেন?
সলিমুল্লাহ খান : এখনকার কবিতার সাথে আমার বেশি পরিচয় নাই। কাজেই প্রথমে এই দোষটা স্বীকার করা ভালো। কিন্তু মাঝেমধ্যে যা দেখি—যেমন [সোহেল হাসান] গালিবের কবিতা আমি দেখি—তাতে মনে হয় এখনকার কবিদের মধ্যেও অনেক নতুন প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব হয়েছে । দুঃখের মধ্যে তাঁদের সাথে আমার পরিচয় নাই। তাই এখনকার কবিদের সম্পর্কে কিছু কথার মতো কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি যখন অনিয়মিতভাবেই দেখি, [কিছু অনিয়মিত কথা হয়তো বলা যায়]।
আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম সত্তরের দশকে। আমাদের সময়ে বা একটু আগে যাঁরা কবিতায় নামধাম করেছেন তাঁদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন [অন্যান্যের মধ্যে] নির্মলেন্দু গুণ আর আবুল হাসান। মানে এঁদের তখন ভরাযৌবন। আমরা তখন মাত্র ছাত্র।
প্রশ্ন : শামসুর রাহমান কি ততদিনে কবিখ্যাতি পেয়েছিলেন?
সলিমুল্লাহ খান : শামসুর রাহমান তো আরও আগের দিনের মানুষ। তাঁর প্রথম কবিতা উনিশশো পঞ্চাশের দশকে—হতে পারে আরো আগেই—বেরিয়েছিল। শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৯ সনে। তার মানে ভাষা-আন্দোলনের সময় তাঁর বয়স ২২-২৩ বছর।আর শামসুর রাহমান তখনই কবিতা প্রকাশ করা শুরু করেছেন।
প্রশ্ন : আল মাহমুদ কি আরও পরে করেছেন, নাকি সমসাময়িক?
সলিমুল্লাহ খান : যতটুকু খবর রাখি, বয়সে আল মাহমুদ শামসুর রাহমানের চেয়ে খানিক ছোটই হবেন । ধরেন, আল মাহমুদের জন্ম—আমি যদি ভুল না করে থাকি—ইংরেজি ১৯৩৬ সাল । সৈয়দ শামসুল হকের জন্মসালও তাই হবে হয়তো। কথাটাকে বাংলায় এইভাবে বললে আরো ভালো হয়, ইংরেজি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর, ঢাকায় নতুন কবিতার আন্দোলন—তাকে সমাবেশও বলতে পারেন—শুরু হয়।
ঢাকা তখন একটা মফস্বল শহর। তার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, আপনি জানেন, ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন । ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি নামের একটা সংকলন বের করেন হাসান হাফিজুর রহমান। তিনিও তখন বয়সে বেশ তরুণ। ওখানে ছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আলাউদ্দিন আল আজাদ ওখানে ছিলেন কিনা মনে করতে পারছি না। থাকার কথা। তবে ঐ সংকলনে যাঁদের কবিতা তখন ছাপা হয়েছিল তাঁদের বয়স তখন ১৮ থেকে ২১ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ওঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ ছিলেন। শামসুর রাহমানও ছিলেন আশপাশেই। অর্থাৎ ওঁদের আমরা ‘পঞ্চাশের দশকের’ কবি বলে থাকি, বলতে পারি।
ষাটের দশকে ভিন্ন একদল কবি বেরিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ ইতি আদি। মানে কবিতার প্রথম প্রকাশের দিক থেকে বলছি। নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছিল ১৯৭০ সালের শেষে। ঐ যে বিখ্যাত বই...
প্রশ্ন : ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ ।
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ। সেটা ১৯৭০ সালের শেষদিকে বেরিয়েছিল। ১৯৭১ সালের পর যে নতুন কবির দল বেরিয়েছেন তাঁদের মধ্যে নাম করেছিলেন [দাউদ হায়দার ইত্যাদি]। নাম মনে আছে এমন কবিদের মধ্যে আছেন আবুল হাসান। আরও অনেক কবি এসেছেন, সবার নাম বলার হয়তো প্রয়োজন নাই। আমরা এসেছি ১৯৭৫ সালের পরে, ঢাকায়। আমাদের সাথে উল্লেখযোগ্য কবি যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে মোহন রায়হান, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কথা মনে পড়ে । এঁদের বই ১৯৭৯ সালে বের হয়। এজন্যে এঁদের ‘সত্তর দশকের’ কবি বলি। আমার নিজের প্রথম কবিতার বই—এক আকাশের স্বপ্ন—বের হয় ১৯৮১ সালে ।
প্রশ্ন : অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের বক্তৃতার উপরে আপনার বইটা বের হয় কখন? কবিতার বইটা প্রকাশের আগে না পরে?
সলিমুল্লাহ খান : না, না। কবিতার বইটা ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলায় বের হয়। তখন বইমেলা ছোট আকারে হতো, বাংলা একাডেমিতে। আর রাজ্জাক সাহেব বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন ১৯৮১ সালের মে মাসে। মানে আরও চার মাস পরে। তো সেই বক্তৃতার আমি রিভিউ লিখেছি। সেটি বের হয়েছে ১৯৮৩ সালে।
প্রশ্ন : এই বইটাই সম্ভবত লেখক হিসেবে আপনাকে পরিচিতি দেয় প্রথম...।
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ, কথাটা অসত্য নয়, আমার কবিতার বইটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই। এটাতে আমার কোন লজ্জা নাই।
প্রশ্ন : স্বাভাবিক...।
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ, স্বাভাবিক। লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই, কিন্তু প্রত্যেক মানুষ নিজের সাধ্য অনুসারেই করে। তো, আমি গদ্যপদ্য দুটোই লেখা শুরু করেছি ঢাকায় এসে, বই প্রকাশের আগে আমার বহু গদ্যপদ্য, আলাদা পদ্য, আলাদা প্রবন্ধ বেরিয়েছে। রাজ্জাক সাহেবের বক্তৃতার পর আমি যে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি—আমাদের দেশে দীর্ঘ প্রবন্ধের চল তেমন নাই—সেটা আমাকে বই আকারেই প্রকাশ করতে হয়েছে । প্রথম প্রকাশের সময় পাতার সংখ্যা ছিল ১০৪ অর্থাৎ আজকালকার যা ঢিলাঢালা ছাপা তাতে দেড়শ পৃষ্ঠার মতো হবে। সেই বইটি, হ্যাঁ, দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । করার দুটো কারণ। [একটা কারণ সম্ভবত এই যে] তখন রাজনৈতিক প্রবন্ধের বিশেষ চল ছিল না। দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক কিছুই লিখতেন না সাধারণত, ঐটাই তাঁর প্রথম বই। সেটার সমালোচনা অন্যরা—বুদ্ধিমানরা—না করলেও আমি বোকা ছিলাম বলে করেছিলাম। সমালোচনার মধ্যে দুইটা ভাগ ছিল...।
প্রশ্ন : এইটা কেন বলছেন? বুদ্ধিমানরা না করলেও...।
সলিমুল্লাহ খান : আবদুর রাজ্জাকের মতো মহান জ্ঞানীর সমালোচনা করার মতো বিদ্যা তখন আমার ছিল না। কাজেই পাগলেরা অনেক সময় যেটা করে, শিশুরাও তেমনই করে। সে রকম আর কি। অর্থাৎ তাঁর সাথে আমার তুলনার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেটা সঠিক ছিল..। আমি ঐ ঘটনার পরে—আরও ৪০ বছরের মাথায় বলছি, সত্য বলতে ৩৫ বছর পরে আর কি— বলছি যে কোন রকমের পাল্টা সমালোচনা কেউ বের করেনি, করতে পারেনি। তাঁর ভক্তের সংখ্যা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিই ছিল, নিতান্ত কম ছিল না। সেই সময় আমাকে পছন্দ করেন নাই অনেকেই...।
প্রশ্ন : আপনার সেই লেখার আর্গুমেন্টকে কেউ রিফিউট করেছিল তখন?
সলিমুল্লাহ খান : না। কিন্তু মৌখিকভাবে অনেকেই রিফিউট করেছিল, যেমন সরদার ফজলুল করিম।
প্রশ্ন : তার রিফিউটেশনের জায়গাটা কী ছিল?
সলিমুল্লাহ খান : সবাই। যেমন আহমদ ছফা এই জায়গা থেকে পছন্দ করেন নাই, তিনি বলেছিলেন, তুমি একজন প্রবীণ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে লিখে নিজেকে অজনপ্রিয় করে তুললা।
প্রশ্ন : এখানে তো নবীন-প্রবীণ কম্পিটিশনের ব্যাপার হওয়ার কথা না, আলাপটা...।
সলিমুল্লাহ খান : হওয়ার কথা না, আমার যতটুকু মনে আছে [তার কথাই] বলছি আর কি। যা হোক। আমার দুই-একজন সমবয়সী বন্ধু পত্রিকায় সদয় রিভিউ-টিভিউ লিখে থাকতে পারেন, সেগুলি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই। এইটাই আর কি।
প্রশ্ন : আমরা মনে হয় কবিতা নিয়া আলাপ থেকে দূরে সরে গেছি।
সলিমুল্লাহ খান : আমি বলছিলাম আমার প্রথম বই কবিতার বই... এটা বলার জন্যই। যা হোক, সেটা আমার প্রবন্ধের যে বই তার দুবছর আগে বের হয়। মাঝে মাঝে কবিতা লিখেছি বটে কিন্তু পরে কবিতার বই প্রকাশের আর অবকাশ হয় নাই। অনেক পরে ১৯৯৮ সালে আরেকটা বই বের করেছিলাম।
প্রশ্ন : সেটা তো অনূদিত কবিতার বই।
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ সেটা আবার মূল বই না। অনুবাদের বই।
প্রশ্ন : ‘আল্লাহর বাদশাহি’?
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ, নাম রেখেছিলাম ‘আল্লাহর বাদশাহি'। এবং যাঁর বই আমি অনুবাদ করেছি তিনি জার্মানির কবি হলেও জার্মান কবিরা তাঁকে অত বেশি চিনতেন না। কারণ, জার্মানদেশে আমরা যাকে বলি ‘মেইনস্ট্রিম’, তার বাইরে ছিলেন তিনি। তবে তিনি খুব উচ্চশিক্ষিতা মহিলা। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল [ধর্মতত্ত্ব, তবে] তিনি ছিলেন একটু, যাকে বলা হয় ‘বামঘেঁষা’…। জার্মানিতে তখন ডানপন্থা খুব প্রবল ছিল, পশ্চিম জার্মানিতেই তিনি [কায়েম-মোকাম ছিলেন]। বসবাস করতেন হামবুর্গে। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ভিয়েতনাম-যুদ্ধ-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। খ্রিস্টধর্মের নিরিখে— ল্যাতিন আমেরিকার পরিপ্রেক্ষিত থেকে বলছি—যাকে বলা হয় ‘লিবারেশন থিয়োলজি’, ঐ গ্রুপের লোক তিনি। ধার্মিক হলেও তিনি ছিলেন প্রগতিশীল এবং সমাজতান্ত্রিক [ভাবধারার পক্ষপাতী]।
প্রশ্ন : ভাসানী বা এইরকম সমাজতান্ত্রিক ধারার কাছাকাছি বলতে পারি?
সলিমুল্লাহ খান : না, ভাসানী ছিলেন রাজনীতিবিদ। উনি ছিলেন কবি।
প্রশ্ন : আদর্শের জায়গাটা বামপন্থা।
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ। মেইনস্ট্রিম [কোন প্রকাশনা সংস্থা] থেকে তিনি তাঁর কবিতা বের করেন নাই। বই করেছেন কতগুলো অপ্রধান জায়গা থেকে। তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয় মার্কিনদেশে থাকার সময়। তারপরে, এই পরিচয়সূত্রে, ১৯৯৫ সনের দিকে আমি তাঁর কবিতার সাথে পরিচিত হই। তাঁর বই অনুবাদ করতে আমার দুই-তিন বছর লেগেছে। তাঁর অনুমতি নিয়েই আমি ওই বইটা প্রকাশের ব্যবস্থা করি। তাঁর একটা ইন্টারভিউ আমি নিয়েছিলাম, সেটি এখানকার একটি পত্রিকায় বেরও হয়েছিল।[পত্রিকাটার নাম খুব সম্ভব “মানব জমিন” । ঐ পত্রিকায় রাজু আলাউদ্দিন তখন চাকরি করতেন। মনে হয় তিনিই ওই ইন্টারভিউটা ছেপেছিলেন। ইন্টারভিউটি হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে আমার খুব একটা ভালো লাগছে না। বইটায় বেশ ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। দেখা গেল রাজু আলাউদ্দিন, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী,এবং আরও কয়েকজন—ঢাকার ৪-৫ জন কবি—সমালোচনা বা (আমি বলবো) বেশ প্রশংসাই করেছিলেন। তখন বোঝা গেল কবি হিসাবে [আমি হয়তো পুরাপুরি] মারা যাই নাই। এই আর কি! তারপরে ঐ বইটার ২য় সংস্করণ বের হয়েছিল অনেক দিন পরে, আল্লাহর বাদশাহি : ডরোথি জুল্লের নির্বাচিত কবিতা নামে।
প্রশ্ন : প্রথমেও কি আল্লাহর বাদশাহি নামে ছাপা হয়েছিল?
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ। আমি নাম বদল করিনি। ২য় সংস্করণটা প্রকাশনার দিক দিয়ে অনেক বেশি শোভন হয়েছিল। এইটাই আমার মনের মতো একটা বই হয়েছে। কবিতার সাথে সম্পর্ক আমার আপাতত এই দুই বইয়েই সীমাবদ্ধ। আরেকটা সম্পর্ক আছে কবিতার সাথে আমার। প্রত্যেকটা বইয়ের উৎসর্গপত্রে আমি কবিতা লিখেছি। সে রকম লিখতে লিখতে আমার অনেক কবিতা জমেছে। সেগুলো দিয়ে কোন কবিতার বই করি নাই। ভবিষ্যতে হয়তো কখনও করব। এই হচ্ছে কবিতার সাথে আমার সম্পর্ক। আমার প্রধান পেশা [বা ব্যবসায়] কবিতা নয়। তাই বলে কবিতা আমি ত্যাগ করেছি এমনও নয়।
প্রশ্ন : এই সময়ে যাঁরা কবিতা লিখছেন তাঁদের কবিতার সাথে কি যোগাযোগ...?
সলিমুল্লাহ খান : পড়ি। অনেকের কবিতা পড়েছি। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত পড়তাম।[সুব্রত অগাস্টিন] গোমেজের কবিতার প্রশংসা করেছি। আমি যাঁদের পছন্দ করি তারা একটু ভিন্ন ঘরানার কবি। আর পছন্দ করি শুধু কবিতার কারণে নয়, আরও কারণে, অন্য কারণেও পছন্দ করি। আমার বিচারে [কবিতাকে তো] প্রথমত কবিতা হতে হবে, তারপরে অন্য বিষয় আসবে। যেমন, [মতিন বৈরাগী] আমার চেয়ে বয়সে হয়তো গোটা দশ বছরের বড় হবেন, কবি হিসেবে তিনি খুব ভালো নন কিন্তু কবিতার সাথে পঞ্চাশ বছর লেগে আছেন, এটা একটা শ্রদ্ধেয় বিষয়। অন্তত একটি কবিতা ভালো লিখেছেন তিনি। আমি মনে করি জীবনে অন্তত একটি কবিতা যে ভালো লিখেছে সেও কবি। এমনকি নবি-পয়গম্বররাও চব্বিশ ঘণ্টা ওহি লাভ করেন না। মাঝে মাঝে তারা ওহি পান। যারা সাধারণত খারাপ কবিতা লেখেন, তাঁরাও মাঝেমধ্যে দুই-একটা ভালো কবিতা লেখেন। মতিন বৈরাগীর কবিতা—সত্যি বলতে কি—আমি প্রথমে পছন্দ করতাম না। কিন্তু [অনেকদিন পর] হঠাৎ ‘সক্রেটিস’ বলে তাঁর একটা কবিতা পড়লাম । এইটা আমার ভালো লাগল।
প্রশ্ন : সক্রেটিস?
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ। এইটা আমার ভালো লাগল। আমি লিখেছিও। অনেক লম্বা কবিতাটা, প্রায় আট পৃষ্ঠা।
প্রশ্ন : তাহলে তো দীর্ঘ কবিতা।
সলিমুল্লাহ খান : এইটা নিয়ে আমি লিখেছি। যদি আপনি সত্যি কৌতূহলী হন তাহলে এটা পাবেন [আমার পরের বইয়ে], [অদূর ভবিষ্যতে] আমার একটা বই বেরোচ্ছে, আমি এখন ওটার সম্পাদনাকর্ম করছি। [বইটা শিগগির]—ধরেন এই বছর—বের হবে আশা করছি।
প্রশ্ন : নামটা ঠিক হয়েছে?
সলিমুল্লাহ খান : এখন পর্যন্ত ঠিক আছে।[নাম মাসে মাসে] বদলে যায় কিনা! নাম তো সবসময়ই একটা প্রজেক্ট আকারে থাকে। এইটার নাম দিয়েছি ‘সাহেব বিবি গোলাম’। এটা হলো এখনকার কবি এবং লেখকদের যে সকল কাব্য বা গদ্য বইয়ের আলোচনা-সমালোচনা আমি করেছি সেগুলির একটা সংগ্রহ। প্রায় পঞ্চাশটির মতো লেখা নিয়ে [এই সংগ্রহশালা]।
প্রশ্ন : বইটা করছে কারা?
সলিমুল্লাহ খান : প্রকাশক ঠিক হয় নাই। কিন্তু আমি আগে তো সম্পাদনা করে দেব। এখন পর্যন্ত ৪৭টা লেখা আছে। আরও লেখা নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমি কারও বইয়ের প্রশংসাপত্র লিখে দিয়েছি, কারও ভূমিকা বা রিভিউ করেছি। সেগুলিই একত্রিত করলেও এরকম একটা বই হয়। তরুণ কবিসহ অনেকের সম্পর্কেই আমি লিখেছি। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ সম্পর্কেও চারটা লেখা লিখেছি। বলে রাখা ভালো তারেক মাসুদও একসময় কবিতা বা ছড়া লিখতেন।
প্রশ্ন : লেখাটা কি কবি তারেক মাসুদের উপরে না চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের উপরে?
সলিমুল্লাহ খান : চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদকে নিয়েই মূলত, একটু স্মৃতিকথার ধরনে। তারেক মাসুদ ঢাকায় এসে প্রথম ছড়া লিখতেন। আমার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ছিলেন মোহন রায়হান আর, তারেক মাসুদ। আমার অন্যান্য বন্ধু যারা ছিলেন, [যেমন আওলাদ হোসেন তালুকদার, ইনি এখন ময়মনসিংহে আছেন], যেমন কামাল চৌধুরী [উঁচুদরের সরকারি চাকুরে, সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন]... এঁদের সাথে এখন আর আমার যোগাযোগ নেই। মতামতের দিক থেকে আমরা অনেক ভিন্নমতের লোক, কিন্তু বড় মারামারি হয় নাই (হাসি)।
প্রশ্ন : আজফার হোসেন, নূরুল কবীর এঁরাও কি আপনার বন্ধুস্থানীয়?
সলিমুল্লাহ খান : আজফার হোসেন, নূরুল কবীর এঁরা বয়সে আমার চেয়ে সামান্য ছোট হবেন । আমারও তো বয়েস হয়ে গেছে—বৃদ্ধ হয়ে গেছি। হায়, আমার বয়স এখন ষাট। এঁরা ষাট ছুঁই ছুঁই। যা হোক, এই হচ্ছে কবিতার সাথে আমার সম্পর্ক। আমি এখনো কবিতা পড়ি। আমি অনেক বিদেশি কবিতার অনুবাদ করেছি, যেগুলো প্রকাশিত হয় নাই। যেমন ফিনল্যান্ডের একজন কবি, পেন্টি সারিকোস্কি [Pentti Saarikoski] তাঁর নাম। আমি ১৯৯১ সালে তাঁর কিছু কবিতার অনুবাদ করেছিলাম। এখনও একটা পাণ্ডুলিপি কোথাও আছে, হয়তো কোনদিন বেরোবে।
আমি আরও একজন কবির কবিতা পছন্দ করি। তাঁর নাম কাদিয়া মলোদোভস্কি। ইনি পূর্ব ইয়োরোপের কবি। তারঁ মাতৃভাষা ইদ্দিশ, জার্মানির তথা পূর্ব এয়ুরোপের (আশকেনাজি) এয়াহুদি জাতির ভাষা। ওইসব ভাষা খুব একটা জানি না বিধায় ইংরেজি তর্জমা থেকে তর্জমা করি। তাই প্রকাশনার ক্ষেত্রে একধরনের সংকোচ কাজ করে আমার।
আমি সচরাচর মূল ভাষা দেখে তর্জমা সংশোধন করারও চেষ্টা করি। ওই যে ফিনিশ ভাষা জানতাম না, এইজন্যে ফিনিশ ভাষাও শেখার চেষ্টা করেছি কিছুদিন। খুব সফল হইনি। সম্প্রতি ইদ্দিশ শেখার চেষ্টা করছি। ইদ্দিশ জার্মান ভাষার একটা উপভাষা। লেখা হয় হিব্রু হরফে। তো আমি সম্প্রতি হিব্রু হরফ পড়াটা অল্প অল্প শিখছি। হিব্রু এখন ইসরাইলের ভাষা। কিন্তু হিব্রু যে হরফে লেখা হয় সে হরফে লেখা হলেও ইদ্দিশের ব্যাকরণটা কিন্তু জার্মান ভাষার ব্যাকরণের মতো। স্পোকেন জার্মানের মতো—এইটা বললেই বরং ভালো হয়।
যা হোক, আমি যে কবিকে চিনি কাদিয়া মলোদোভস্কি, ওঁর সাথে আমার কদাচ দেখা হয় নাই। ইনি মারা গেছেন ১৯৭৫ সালে। তাঁর কবিতার ইংরেজি তর্জমা আমি প্রথম পড়ি ১৯৯৮ সালে। ঘটনাচক্রে দুনিয়াতে যাঁরা আমার চোখে ভালো কবি অথচ ভালো বলে সাধুসমাজে খুব বেশি পরিচিত নন তাঁদের ভালো বলতে আমার সংকোচ হয় না। আমি যদি দেখি পড়ে আমার ভালো লাগছে, আমি সাহস করি অনুবাদ করার। এই আর কি। কবিতা সম্পর্কে আমার অতি অল্পই জানাশোনা।
প্রশ্ন : একটা বহু পুরানো বিতর্ক আছে। শিল্পসাহিত্যে দুইটা ডমিন্যান্ট ধারা, যদিও সবসময় বিভাজনটা স্পষ্ট না, সেটা হচ্ছে একদল ‘আর্ট ফর আর্টস সেইক’-পন্থী—কথাটা সম্ভবত অস্কার ওয়াইল্ডের, যাকে সুধীন দত্ত বলেছেন 'কলাকৈবল্যবাদ'—[সেই ধারার]। আরেকটা ধারা আবার শিল্পকে সরাসরি রাজনীতির হাতিয়ার বানাতে চায়। অনেকের তো মনে হয় এটা প্রপাগান্ডার মাধ্যম। এই দুই এক্সট্রিমের মাঝামাঝিও আছে। আপনার অবস্থান বা এই বস্তাপচা বিতর্কের বিষয়ে কিছু বলার আছে কি...।
সলিমুল্লাহ খান : আমাদের ছোটবেলা থেকেও এটা চালু ছিল। এইটাকে দুর্ভাগ্যজনক বলতে হয়। আমি বলছি। যেমন ধরেন চিকিৎসাশাস্ত্রকে চিকিৎসাশাস্ত্রই হতে হবে। অথচ অনেক ডাক্তার দেখা যায় যাঁরা পেশায় চিকিৎসা-ব্যবসায়ী, কোম্পানির ওষুধপত্র প্রমোট করেন, তাঁদের কাছে পয়সা কামানোটাই বড় কর্তব্য মনে হয়। এরকম কবিদের মধ্যেও কেউ কেউ, দেখা যায়, বিজ্ঞাপন লেখেন। এই যে আপনারা চোখে দেখেন না—প্রপাগান্ডার কথা যে বলছেন—এই যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে যাঁদের আপনারা বড় কবি মন করেন এঁরা সকলেই—বিজ্ঞাপন সংস্থায় একসময় না আরেক সময় কাজ করেছেন। এমনকি বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় বহুদিন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করতেন। প্রচারণার কাজে সকলেই অংশগ্রহণ করে, কিন্তু সেই প্রচারণা যদি আপনার পছন্দ হয়, আপনি সেইটাকে প্রচারণা মনে করেন না, শিল্পটিল্পই মনে করেন। আর যাঁর প্রচারণা আপনার পছন্দ হয় না, তাঁর সম্পর্কে আপনি নানা কথা বলেন।
প্রশ্ন : জর্জ অরওয়েলের একটা কথা আছে সম্ভবত, অল আর্ট ইজ প্রপাগান্ডা।
সলিমুল্লাহ খান : আর্ট তো প্রপাগান্ডা বটেই। তারপরও কথা হচ্ছে কি, আমি যে আর্ট পড়ি সেখানকার প্রপাগান্ডায় চোখ দেব না। এখন লোকে বোরডম কাটানোর জন্যে শিল্পে ধর্ষণ ব্যবহার করে, সেক্স ব্যবহার করে। এটা আপনার জানার কথা। কবিতার ক্ষেত্রে আমি বলছি কবিতাকে প্রথমে কবিতা হতে হবে। তো কবিতা হবে কিনা এটা বুঝবেন কি করে? আমি মনে করি কবিতা মানে কবিতার ইতিহাস। অনেকে বলেন কবিতার ইতিহাস নাই। আমি বলি আছে। কারণ কবিতা ‘শেষ পর্যন্ত’ মানুষ ভাষা দিয়েই লেখে, ‘শেষ পর্যন্ত’ কথাটা আমি জোর দিয়ে বললাম। কারণ নানা সময়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন হয় ভাষার ভিতর দিয়ে।
অ্যারিস্টটল বলেছিলেন মানুষ তার ‘আত্মা’ দিয়ে চিন্তা করে। এটা ভুয়া কথা। আপনি লিখতে পারেন। মানুষের ‘আত্মা’ বলে কিছু নাই। ‘আত্মা’ একটা মিথ,এই ধরেন অধুনা পরিত্যক্ত ‘ইথার’ নামক কথাটার মতো। মানুষ কিন্তু চিন্তা করে ‘ভাষা’ দিয়ে। ভাষা বলতে বিজ্ঞাপনের যে ভাষা, আমি ঐ ভাষার কথা বলছি না। মানুষ যখন চিন্তা করে তখন সে নানাভাবে প্রকাশ করে। ভাষা ছাড়া কোন ভাব প্রকাশ করা সম্ভবই নয়। তাই হয়তো বলা যায়, ভাষাই চিন্তার কারণ, ইচ্ছা হয় আাপনি বলতে পারেন ‘অপর কারণ’ ।
‘চিন্তা’ কথাটাকে আমি দুভাবে বলব, মানুষ ‘অংক’ কষে'—এটাও তার চিন্তার একধরনের প্রকাশ। আবার মানুষ যখন ইংরেজিতে যাকে ‘প্যাশন’ বলে তার প্রকাশ ঘটায় তাও চিন্তা বৈকি! সে চিন্তার প্রকাশভঙ্গি অন্য রকম। কবিতার মধ্যেও একধরনের চিন্তার প্রকাশ হয়। কিন্তু এই চিন্তার প্রকাশভঙ্গি অন্যরকম। এর মধ্যে রূপক, লক্ষণা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা এইসমস্ত জিনিশ থাকে। যদি বলেন আপনার চিন্তা পূর্ণ তো আপনার প্রকাশও পূর্ণ হবে। আমরা এখন কি করে বুঝব আপনি এখন কি চিন্তা করছেন? আপনি যা প্রকাশ করেন তা দেখেই তো বুঝব। এই যে বললাম সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কবিতা ভালো, কারণ ভাষার উপর তার প্রচণ্ড দখল। বাংলা ভাষার ইতিহাসের সাথে তার পরিচয় অনেক বেশি গাঢ় ।তাঁর ভাষা দেখেই বুঝি তাঁর চিন্তার ক্ষমতা আছে । সত্য ধরা পড়ে ।
আরেকটা কথা হলো কি, প্রতিভা বলে একটা কথা তো আছেই । শেষকথা এইটাই—প্রতিভা । একজনের প্রতিভা আরজন নকল করতে পারে না। ওতে তাঁর আপন মুদ্রাই অংকিত হয়। যেমন আপনার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ আমার হাতের ছাপের সঙ্গে মিলবে না। গোমেজের যেহেতু ভাষার উপর দখল আছে, আমি উদাহরণ দিয়েই বলছি, সেই কারণে তাঁর কবিতার মধ্যে যে ছন্দের স্ফূর্তি পরিস্ফুট হয়, শব্দের সাথে শব্দের সংঘর্ষে যে দ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটে সেটা আপনা-আপনি আপনার হৃদয়ে আঘাত হানে। তাঁর সব কবিতার অর্থ যে আমি বুঝি তা নয়। কবিতা আমরা অর্থের জন্যে পড়ি না। সেটা বাংলায় যাকে বলে দোলা দিয়ে যায়।
প্রশ্ন : কবির সিগনেচার থাকে...
সলিমুল্লাহ খান : ওটা কেউ কেউ অর্জন করে। কবিতা পড়লে আমরা সহজেই বুঝতে পারি কোনটা মাইকেলের, কোনটা রবীন্দ্রনাথের, কোনটা জীবনানন্দের বা নজরুলের। তরুণ কবিদের ঐ মুদ্রাটা অর্জন করতে কিছু সময় লাগে। আমি যাঁদের কথাই বলছি যেমন এই গোমেজেরই লেখা গদ্য যখন পড়ি, আমার মনে হয় যেন একটা শিশু লিখছে। যেমন ‘বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ’ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর কিছু কিছু শিশুসুলভ ধারণা আছে।
প্রশ্ন : যেমন? এটা কেন মনে হলো আপনার?
সলিমুল্লাহ খান : আমাদের এক বন্ধু ছিলেন আলম খোরশেদ নামে। তার একটা বইয়ের রিভিউ উনি ‘প্রথম আলো’ নামক এক পত্রিকায় লিখেছিলেন। সেটা পড়েই আমি বলছি। তাঁর কতগুলি অদ্ভুত ধারণা আছে, যেমন তিনি নিজে প্রচণ্ড শক্তির সঙ্গে আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেন কিন্তু আপনি যদি গোটা এক গণ্ডা আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেন তিনি বলবেন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ করছেন। এগুলো হচ্ছে শিশুসুলভ কথা। অর্থাৎ ফার্সি শব্দ ব্যবহার করলে মুসলিম সাম্প্রদায়িক হয়, এইধরনের যে শিশুসুলভ চিন্তাটা ওঁর আছে। বাঙ্গালি বলতে, [ওঁর ধারণা যাঁরা মুসলমান নন, যদিও কথাটা মুখ ফুটে বলার সাহস তাঁর নাই, কিন্তু তাঁর আবহ-ইঙ্গিত দেখে তা পরিষ্কার ধরতে পারবেন]। ওঁর মধ্যেও একটা ইনফিরিয়রিটির বোধ কাজ করে, কারণ কি জানি না, হতে পারে তিনি জাতে বাঙ্গালি অথচ তালে দেশি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানে ধর্মবিচারে সংখ্যালঘু গোছের মনে করেন নিজেকে। এই জটিলতার আলামত আছে তাঁর গদ্যে। উদাহরণ যেহেতু আপনি চাইছেন তাই বলি। তার পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে এক সভায় আমাকে ডেকে নিয়ে যায় অনিকেত শামীম। এই শাহবাগেই জাতীয় জাদুঘরের ভিতরের কোন এক ছোটঘরের অনুষ্ঠানে ।
প্রশ্ন : কবে এটা?
সলিমুল্লাহ খান : এই দুবছর আগে। আমার সালজ্ঞান তালজ্ঞান ঠিক নাই। আমি বললাম গোমেজ হচ্ছেন—ওঁ যে রসিকতা বুঝতে পারেন না সেটাই বলছি আর কি এবং নির্দোষ রসিকতার মধ্যেও দোষের আক্রোশ দেখেন তার উদাহরণ দিচ্ছি মাত্র—বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ খ্রিস্টান কবি। সে যে খ্রিস্টান এটা অনেকেই জানে, অনেকেই জানেও না। আমিও রসিকতা করার জন্যে যখন বললাম মাইকেল মধুসূদনের পরে তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি খ্রিস্টান কবি—দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি কবি বললে কোন দোষই হতো না—তিনি প্রমাদ গুনলেন। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ নজরুল প্রভৃতি বড় কবি মাঝখানে... এরকম আরো আছেন তাই আমি একটু রসিকতা করে বললাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত হলেন শ্রেষ্ঠ বাঙ্গলি খ্রিস্টান কবি, এক নম্বর কবি। আর সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ হলেন দুই নম্বর বড় কবি। আসলে আমার মনে কি ছিল কে জানে। হয়তো বলতে চেয়েছিলাম, এদেশে আরও খ্রিস্টান কবি নাই কেন, থাকা তো উচিত। সুখের মধ্যে, এতদিন পর যাক বাঁচা গেল, একটা প্রতিভাবান খ্রিস্টান কবি পাওয়া গেল! তখন কিছুদিন পর শুনলাম তিনি আমাকে গালি দিলেন ‘মুসলমান সমালোচক’ বলে। অর্থাৎ রসিকতাটা মাঠে মারা গেল, [বলতে পারতাম বজ্রপাতে ‘শহিদ’ হলো]। আমি যে মুসলমান তা আমার অস্বীকার করার কোন ইচ্ছা না থাকায় আর কথা বাড়াইনি ।
প্রশ্ন : আরেকটা ব্যাপারও হতে পারে, দুই নম্বর শব্দটার মধ্যে একটু নেগেটিভ কনোটেশন আছে, ওইটাতে হার্ট করছে কিনা?
সলিমুল্লাহ খান : কবি যেমন রসিকতা করবেন, গদ্যকারও কি তেমন রসিকতা করবেন না! আমাকে যে তিনি মুসলমান বলে সাথে সাথেই [শুনলাম ভিডিয়োযোগে] গালি দিলেন, তাতেই হার মানলাম। বোঝা গেল রসিকতাটা তিনি নিতেই পারেন নাই।
প্রশ্ন : এখন যদি তিনি বলেন যে, আমিও আসলে খ্রিস্টান কবি বলার মতো ‘মুসলমান সমালোচক’ বলেছি রসিকতা করে?
সলিমুল্লাহ খান : আমি তো আলোচ্যসূচিতে না। আমি তাঁর আলোচক। আমার উপর যখন তিনি আলোচনা করবেন তখন [ধরা যাক দুমাস বা] দুবছর পর তিনি তা বললে কোনো সমস্যা ছিল না। নগদ যে তিনি বলে পাঠালেন অস্ট্রেলিয়া থেকে... ওই ইয়াতে... তার বন্ধুদের সাথে ফোনালাপে [কি ভিডিয়ো-আলাপে], এইটা আমি রিপোর্টযোগে শুনেছি। যা হোক, এটাই হচ্ছে ঘটনার ঘনঘটা। আমি তাঁর লেখাতেও দেখেছি, মাত্র একটা উদাহরণ দিয়েছি আপনাকে। কবি পরিচয়ে প্রথম শ্রেণির হয়েও চিন্তাবিদ প্রণয়ে উনি চতুর্থ শ্রেণির হতে পারেন। এইটা উদাহরণ দিয়ে বললাম। বললাম দুঃখের কথাই। আরও অনেক আছেন। যেমন ধরেন মাসুদ খান একদা ভালো কবিতা লিখতেন। কিন্তু দেখবেন কি, তাঁর চিন্তাভাবনাও অত্যন্ত নিম্নমানের। সামাজিক চিন্তার কথা বলছি, আর কিছু নয়।
প্রশ্ন : তার গদ্যও কি... তার গদ্যের সাথে আপনি পরিচিত?
সলিমুল্লাহ খান : সব কথা আজ একসাথে বলা যাবে না। তিনি যে চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন,তার আলোকে বলছি ওসব আমার কাছে মনে হয় অতি নিম্নশ্রেণির, অপরিপাটি। কবি হিসাবে তিনি বেশ ভালো ছিলেন, কিন্তু গদ্য লেখাটা কোনদিন ঠিক শেখেননি। গদ্য লেখা বলতে বলছি চিন্তা করা, প্রকাশ করাটা শেখেননি।
প্রশ্ন : এই কথাগুলো কি আমরা রাখব ইন্টারভিউতে? বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু।
সলিমুল্লাহ খান : কেন রাখবেন না ! অফকোর্স! তা তো বটেই। বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্যেই তো আপনি [সাক্ষাৎকার নিতে] আসছেন।
প্রশ্ন : আচ্ছা।
সলিমুল্লাহ খান : আমি উদাহরণ দিয়ে বলছি। যাদেরকে আমি কবি হিসাবে ভালো মনে করি তাদের অনেকেই ভালো গদ্য লেখেন না। বাংলাদেশে সমালোচনা সাহিত্য বড় বিকশিত হয় নাই। কেন, আমি এই কথাটাই বলছি। পিঠ-চুলকানো চিন্তাভাবনাই এই দেশের প্রায় সমস্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । বাংলাদেশে সাহিত্য পত্রিকার নামে যতগুলি কাগজ বেরোচ্ছে অধিকাংশই এই টাইপের। অর্থাৎ আপনি যে প্রকাশনার তরফে এসেছেন সেই পরস্পর অনলাইন পত্রিকার কথাই ধরুন না কেন, এই প্রকাশনাও ব্যতিক্রম নয়, হয়তো পরস্পর পত্রিকাও পরস্পর-গোষ্ঠীর লোকদেরই তোষামোদ করেন। এইরকম আর কি। তাঁরা যে প্রশংসাটা করেন,তা আবার এমন একটা ধোঁয়াশা ভাষায় করেন, কেন যে প্রশংসাটা করছেন আদৌ বোঝা যায় না।
প্রশ্ন : আমি প্রচুর কবিতা পড়ি না, ভুলও হতে পারে, কিন্তু মনে হয় ওভার-অল বাংলা কবিতার চাইতে বাংলা কবিতার সমালোচনা পড়ে বোঝা কঠিন। ‘মহাকাল’, ‘গভীর জীবনবোধ’ ইত্যাদির ভিড়ে সমালোচনা সান্ধ্যভাষার মতো লাগে।
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ। [এই জাতীয় সান্ধ্যভাষার লেখার মধ্যে] সবচেয়ে ভালো হচ্ছে গালিবের লেখা। মজার কথা, গালিবের লেখা আমি কিছুই বুঝি না। গালিব আমার ভালো বন্ধু। আপনে কথাগুলি ছাপতেও পারেন। তিনি যে কোন কবিতা ভালো মনে করেন, ‘পরস্পর’ যখন বের করেন দেখি যে অনেক [কবির কবিতা ছাপেন, কারও তিরিশটি কবিতা ছাপেন, কারও বত্রিশপাটি দাঁতও দেখান], কিন্তু ঘুরেফিরে আমরা যে তিমিরে ডোবা সেই তিমিরেই ডুবে থাকি। অর্থাৎ গালিবের সবই আছে। চিন্তা করার ক্ষমতাটাই খালি আল্লা দেয় নাই। বুঝতে পেরেছেন? আমি কেন কবিদের সংসর্গ ত্যাগ করেছি তা বুঝানোর জন্যে আপনাকে এই ঘরের উদাহরণটা দিলাম। এঁরা সকলেই ভালো কবি বটেন। গোমেজ সম্ভবত আমাদের সময়ের সবচাইতে ভালো কবি। তাঁর সাথে আছেন সাখাওয়াত টিপু, খুব ভালো কবি। কিন্তু গোমেজ আর সাখাওয়াত টিপু হয়তো পরস্পর কথা বলে না। শামসেত তাবরেজী আরেকজন ভালো কবি। আমি যতদূর পড়েছি, [হিজল জোবায়ের আরেকজন শক্তিমান কবি।] এঁদের [কবিতার] সাথে কি আপনি পরিচিত?
প্রশ্ন : এঁদের কবিতা পড়েছি। কমবেশি সবারই।
সলিমুল্লাহ খান : আগেই বলেছি মাসুদ খান ভালো কবি। এমনকি সাজ্জাদ শরিফও খারাপ কবি নন। ব্রাত্য রাইসুও ভালো কবি। আমার কোনো বিরোধ নাই এঁদের, এই কবিদের সাথে। কিন্তু এঁরা যখন, ধরুন ব্রাত্য রাইসু যখন গদ্য লেখেন তখন মনে হয় যেন কোন লেখাপড়া জানেন না। এখন বলে রাখি, লেখাপড়া জানা কবির জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। তিনি যে লেখাপড়া জানেন না একথা তো সত্য, অস্বীকার করা যায় না। এটা ভালো কি মন্দ আমি জানি না। যখন তিনি বলেন কিনা ‘আমার লেখাপড়া জানার দরকারই নাই, আর লেখাপড়া জানলে কবিতা হয় না’, তখন আপনে কি করবেন, বলেন দেখি (হাসি)! অনেকে লেখাপড়া জানাটাকেই কবিতার শত্রু মনে করেন। এটা একধরনের কবিসুলভ অভিমান।
প্রশ্ন : আবার কবিতার ক্ষেত্রে বা যে কোন শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেই অনেক সময় দেখা যায় পণ্ডিতি-দেখানো, জ্ঞান বা উদ্ধৃতি-ভারাক্রান্ত [রচনা] ইত্যাদি আছে, কিন্তু মানের দিক দিয়ে তা নিম্নমানের। এমনও আবার প্রচুর আছে কিন্তু।
সলিমুল্লাহ খান : আসলে না জানলে তো আর কিচ্ছু করার নাই। কথা হচ্ছে কি, কার্ল মার্কস সাহেবের জন্মের দুই শত বছর পূর্ণ হচ্ছে এবছর । তাঁর নাম স্মরণ করা অন্যায় হবে না কবিতার ক্ষেত্রেও। তিনিও অল্প বয়সে অল্পসল্প কবিতাপত্র লিখেছেন।
প্রশ্ন : প্লেটোও লিখেছেন কবিতা, যিনি তাঁর আদর্শ স্টেটে কবিদের জায়গা দিতে চান নাই।
সলিমুল্লাহ খান : ওই যে মার্কস সাহেব এক জায়গায় বলেছিলেন, অজ্ঞানতা কাউকে সাহায্য করে না, কথাটা ফেলনা নয়। জ্ঞান লাভ করে আপনি কাজে লাগাতে পারেন, নাও লাগাতে পারেন। কিন্তু অজ্ঞানতা আজ পর্যন্ত কাউকে তো কোন সাহায্য করেনি, ভাই । তো,আমাদের ব্রাত্য রাইসু এ সত্যের একটা করুণ উদাহরণ। আমি তাঁকে খুব পছন্দ করি, রীতিমতো স্নেহই করি বলতে পারেন। আমার ‘আল্লাহর বাদশাহি’ নামক (অনুবাদ) কবিতার বইটা প্রকাশে তাঁর অনেক সাহায্য ছিল। সে কথা ভোলার মতো নয়। আমার অনুপস্থিতিতে বইটা উনিই (আর বলা প্রয়োজন সাজ্জাদ শরিফ) প্রকাশক যোগাড় করে বের করেছিলেন। আমি যাঁদের কাছে যেখানে যে ঋণ করেছি তা স্বীকার করতে হবেই। আর করলে দোষটাই বা কি? কিন্তু দুঃখের কথা, তিনি নিজে লেখাপড়া করেন না। মনে হয় এই না করাটাকেই তিনি একটা ধর্মে উন্নীত করতে চান। আমি বলি, আপনি লেখাপড়া করতে ইচ্ছা না করে তো করবেন না। কিন্তু যাঁরা লেখাপড়া করতে চায়, তাঁদের দোষ দিচ্ছেন কেন?
প্রশ্ন : যারা লেখাপড়া করেন তারাও অনেকে আবার লেখাপড়া করাটাকে ধর্মে উন্নীত করতে চান, এই জায়গার বিরোধিতা থেকেও হয়তো হতে পারে। আমি জানি না, তার পজিশন বা বক্তব্য কি এ ব্যাপারে।
সলিমুল্লাহ খান : আমি ধর্মের বিরোধিতা করতে চাই না। আমি মনে করছি যে ধর্মচর্চা হিসাবে আমরা একমত যে ‘লাকুম দিনুকুম ওয়াল ইয়াদিন’ নীতিটা মাননীয়। তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার। এইটাই হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি।
প্রশ্ন : এইটাকেই এডওয়ার্ড সায়িদ সম্ভবত সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ হিসাবে দেখেছেন।
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ, হ্যাঁ। যাই হোক, আমার কথা হচ্ছে কিনা কবিতা আমাদের দরকার। কিন্তু কবিতার বাইরেও যারা শিল্পের অন্যান্য ফর্ম চর্চা করেন তাদের দিকেও তো একটু মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের দেশে কবিতা যত বিকশিত হয়েছে সাহিত্য সমালোচনা যেটা বলা হয় সেটা অত বিকশিত হয়নি। কারণ কি? ছোটবেলা থেকেই আমার সঙ্গীসাথীদের মধ্যে কবিরা আছেন। যাঁদের কথা বললাম এঁরা সকলেই একসময় আমার বন্ধু ছিলেন, এখনও আছেন বলেই আমি মনে করি।। আমি এখনও কাউকে শত্রু মনে করি না। কবিদের আমি পছন্দ করি, সকল দোষের পরেও দোষ সত্ত্বেও কবিরা নমস্য। তো আমার কথা হচ্ছে ওদের কাছ থেকে একটু দূরে দূরে থাকি। যেমন [সোহেল হাসান] গালিবকে আমি পছন্দ করি। কিন্তু সামনা-সামনি হলে বলি, গালিব আপনারা এগুলো কি করেন? না, তাতে তিনি তো আমার শত্রু হন না। তিনি বলেন যে আপনার কাজটা আপনি করেন, আমার কাজটা আমি করি। আমি গালিবকে ভাইয়ের মতোই মনে করি। কিন্তু গালিবের কবিতা আমি মাথার উপর নেব এমন তো নাও হতে পারে। আমি বলি আপনার কবিতা আমি বুঝি না। মানে আপনার পদ্য আমার প্রাণে আবেদন জাগায় না। কিন্তু জসীম উদদীনের কবিতা? জাগায়, আমি আনন্দ পাই। এই যে আমি ‘প্রাচীনপন্থী’ হয়ে গেলাম!
প্রশ্ন : হা হা হা...
সলিমুল্লাহ খান : আচ্ছা, আপনি আহমদ ছফার কবিতা পড়েছেন?
প্রশ্ন : পড়েছি। তবে খুব বেশি না। প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা আর কিছু বিচ্ছিন্ন কবিতা।‘কবি ও সম্রাট’...
সলিমুল্লাহ খান : প্রবীণ বটের কাছে তো অনেক আগের লেখা। শেষ বয়সে তিনি 'কবি ও সম্রাট'নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন। লেনিন ঘুমাবে এবার বইতে। এইটা একটু পড়েন আপনি। আমি ওটাকে একটা ভালো কবিতা মনে করি। মানে আমাকে বোঝার জন্যে আমি ভালো কবিতার একটা উদাহরণযোগে সংজ্ঞাই দিচ্ছি। আমি রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো কবিতাও পছন্দ করি। আমি একটু প্রাচীনপন্থী, এটা বলতে লজ্জাবোধ করি না।
প্রশ্ন : আহমদ ছফা সঞ্জীবনীতে ছফার কবিতা নিয়ে কিছু লিখেছেন।
সলিমুল্লাহ খান : সব কিছু লিখি নাই। ঐটা তো লিখেছিলাম ৭৭-৭৮ সালে। প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা বের হবার পরপরই একটা রিভিউ লিখেছিলাম। আহমদ ছফার কবিতা নিয়ে আমি আর কোন কিছু লিখি নাই। ভবিষ্যতে আল্লা চাহে তো লিখব। যা হোক, আমি প্রাচীন এবং আধুনিক কালের মধ্যে কোনো বিরোধ কল্পনা করি না। ইংরেজিতে বলে হিস্ট্রি ইজ এ কন্টিনিউয়াম। আমার ভেতরে অতীতও আছে, বর্তমানও আছে।
প্রশ্ন : সমাজব্যবস্থা, সময়, প্রযুক্তি, মূল্যবোধ—এইগুলার তো পরিবর্তন হয়। সেই বদলের অভিঘাত শিল্পে-সাহিত্যেও লাগার কথা না?
সলিমুল্লাহ খান : আছে তো। পরিবর্তনের মধ্যে কিছু কিছু আমি প্রার্থনা করি, কিছু কিছু পরিবর্তনে আমি সহায়তা করি। কিছু কিছু পরিবর্তনের আমি বিরোধিতাও করি। একসময় ফাসিবাদ আসছিল। এইটাও তো পরিবর্তনই।ওটা আমি পছন্দ করি না। কমিউনিজম পছন্দ করি, এটা তো আমি লুকাই না কখনো।
প্রশ্ন : এই যে এনালজিটা, কবিতার পরিবর্তন, ফ্যাসিবাদের সাথে মিলিয়ে এইটা...
সলিমুল্লাহ খান : কবিতার ক্ষেত্রেও সমস্ত ইনোভেশন আমার ভালো লাগবে এমন কোনো কথা নাই। আমার এইখানে পছন্দ-অপছন্দ আছে। যেটা আমি বুঝতে পারি না সেইটা আমি ভালো বলব কেন? এখন কেউ যদি বলে আপনি এখানে ‘রাজার নতুন জামা’ পরে বেরিয়েছেন, আপনি তো কিছু জানেন না এইটাই প্রমাণিত হলো। তথাস্তু। আমি যেটা জানি সেটার কথাই বলছি। যেটা জানি সেটা বলি, কবিতার মধ্যে আমি বোদলেয়ার পড়েছি, তাঁর উপর দুটা সেমিনারও করেছি। ফরাসিতেও কিছু কিছু পড়েছি। গদ্যকবিতাগুলোও পড়েছি। আমার পৃথিবীতে প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন এই বোদলেয়ার। অন্য কবিদেরও আমি পছন্দ করি। সুতরাং আমার কবিতার রুচি সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা আছে। যাদের কবিতার কথা বলছি, যেমন ব্রাত্য রাইসুর মধ্যে একটা ক্ষমতা ছিল। সেটা হচ্ছে তাঁর চমকপ্রদ কথা বলার ক্ষমতা, তিনি বলতে পারতেন চমৎকার। কিন্তু ওই যে চমক দেওয়ার মোহ... মৃদুল দাশগুপ্ত তাঁর সম্পর্কে মনে হয় সঠিক কথাই বলেছেন: এই চমক দিয়ে সারাজীবন চলা যায় না। উনি কিন্তু গত বিশ বছরে একইঞ্চিও বড় হননি। বনসাঁই বলে একটা কথা আছে না? রাইসু হচ্ছেন বনসাঁই। তাঁর নাম রাইসু বদলে কেউ যদি বনসাঁই দেন তাহলে চমৎকার একটা কাজ হয়। হি ডিড নট সিমপ্লি গ্রো।
প্রশ্ন : বাংলা কবিতার মধ্যে আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি একটা...
সলিমুল্লাহ খান : ওইটাই তো। ভালো কবিতার বই। এরপরে কিন্তু আর কিছু লিখতে পারে নাই। হালিকের দিন ওটাও আমি পড়েছি। আমাকে তাঁর বইয়ের রিভিউ লিখতে তিনি বলেছিলেন। দুঃখের মধ্যে, আমি রিভিউ লেখার কিছু খুঁজে পাই নাই। কারণ তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন। আমি যে সমস্ত শব্দ বা বাগ্বিধি পছন্দ করি না, সে যে সমস্ত ‘চ’ শব্দ ব্যবহার করেন, আমি ওটা রুচিবহির্ভূত বলেই মনে করি। আশা করি আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি রবীন্দ্রনাথ নই, আমি মোটেও রুচিবাগীশ নই। কিন্তু এখন একজন লোক, কোন আধুনিক কবি যদি তাঁর আম্মাজানকেই বিয়ে করতে চান, তিনি করতে পারেন, আমি এটা অনুমোদন করব না।
প্রশ্ন : এইরকম মাকে বিয়ে করা বা ইনসেস্ট—এরকম ব্যাপার কি আসলে তাঁর কবিতায় আছে?
সলিমুল্লাহ খান : ওঁর কবিতা সেরকমই। যখন বাংলা ভাষায় কেউ চ-শব্দ ব্যবহার করেন, তখন বুঝতে হবে তিনি তাই করছেন। অর্থাৎ তাঁর পাপটা হচ্ছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়,সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সংস্কৃতির একটা আয়না আছে। প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে প্রমোশন পাওয়া যায়। তিনি সেটার বিরোধিতা করছেন।
প্রশ্ন : এভাবেও তো কেউ বলতে পারে যে, এই যে শব্দের ভালোমন্দ, মার্জিত-অমার্জিত হওয়ার ব্যাপার —এগুলাও আসলে একধরনের শ্রেণিরুচির ব্যাপার, ডমিন্যান্ট বা ডমিনেটেড শ্রেণির মূল্যবোধগত ব্যাপার। অ্যাবসলিউট কিছু না।
সলিমুল্লাহ খান : আমার বক্তব্যটা আমি বলছি। আমি ওটাকে মনে করি সংস্কৃতির বিরোধিতা। আমি যেটিকে সংস্কৃতি মনে করি, এখন আমার এটাকে আপনারা সমালোচনা করেন, আমার তো আপত্তি নাই। আমি আমার কথাই বলছি। আমি অন্যের কথার দায়িত্ব নেব না। রাইসুর কবিতাতে যে সমস্ত ‘চ’ জাতীয় শব্দ আছে, আরও অনেক কবিরই আছে, আরও উদাহরণ আছে, রাইসু অপেক্ষাকৃত ভালো কবি বলেই তাঁর নামে আলোচনাটা হচ্ছে। এগুলোকে আমি আমার রুচির যে [ছোটমতো] গণ্ডি, তার বহির্ভূতই মনে করি। অর্থাৎ আমার যে কাব্যের আসর, তাতে তার স্থান হবে না। তাঁর আসরে তো আমি জায়গা খুঁজতেছি না, তাই না?
প্রশ্ন : কবিতা নিয়ে তো আলাপ হলো। কবিতার বাইরে গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি এইসময়ের লেখকদের পড়া হয়?
সলিমুল্লাহ খান : পড়া হবে না কেন! আমি সাহিত্যের ব্যবসায় করি। ছোট ব্যবসায়ী যদিও (হাসি)। আমি লিখতে পারি না, এটা অবশ্য সত্য।
প্রশ্ন : আপনার প্রকাশিত প্রায় সব লেখাই আমি পড়েছি যেহেতু, আপনার বেশির লেখাই শিল্পসাহিত্য নিয়ে, যদিও তাত্ত্বিক, চিন্তক বা বুদ্ধিজীবী হিসাবেই আপনি বেশি পরিচিত।
সলিমুল্লাহ খান : মানুষ তাত্ত্বিক হিসাবে, বুদ্ধিজীবী হিসাবে, জন্মগ্রহণ করে না। সে ঘটনাচক্রে এটা-ওটা হয়ে ওঠে। আমরা তো ঘটনাবলির, পরিবেশ-পরিস্থিতির সন্তান। যাঁরা খুব বীরপুরুষ তাঁরা পরিবেশ-পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেন। আমরা যাঁরা ছোটপুরুষ কিংবা পুরুষই নই, নেহায়েতই জীব, কৃষ্ণের জীব, আমরা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হই। অসুবিধা নাই, আমাকে গালি দিলেও আমি মাইন্ড করব না। আপনি গালি দিতে পারেন। আমার বক্তব্য হলো, আমি গল্প-কবিতা কিছুটা পড়েছি। সব পড়ি নাই। সবকিছু পড়া সম্ভব নয়।... আনন্দ না পেলে আমি পড়ি না। অনেক সময় চাকরি হিসেবে পড়ি যে, এইটা পড়ে আপনাকে একটা মত দিতে হবে। সেটা অন্য জিনিশ। যেমন, ছোট বয়সে, সত্তরের দশকে আমি হাসান আজিজুল হকের গল্পের উপরে লিখেছি। নামহীন গোত্রহীন নামক তাঁর চতুর্থ বইটা যখন বের হয় স্বাধীনতার পরে—ঐটাতে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি আছে—ওইটা আমি পড়েছিলাম। এখন আমি জানাই, ওই বইটা তাঁর যে লেখার স্বাভাবিক ক্ষমতা, ঐটা আছে বলে তিনি লিখতে পেরেছেন এবং আমাকে আকৃষ্ট করেছিল তাঁর গদ্যের ধারালো ভাবটা...
প্রশ্ন : একটা নিরাবেগ নির্মোহ ভঙ্গি...
সলিমুল্লাহ খান : কাটা কাটা গদ্য আর কি। সেটা আমিও পছন্দ করি। করতাম তখন বেশি, এখনও করি। হাসান আজিজুল হকের লেখা এখনও পড়া যায়। অর্থাৎ আপনি ক্লান্ত বোধ করবেন না। এই যে গুণ তাঁর মধ্যে... উইট আছে, হিউমার আছে গদ্যে। কিন্তু জীবন ঘষে আগুন যখন বের হয় তখন আমি ওটা মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছি, খুবই কঠিন ছিল। তারপরেও আমি বেশ কয়েক বার পড়ার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন : আগুনপাখি লিখলেন পরে, উপন্যাস।
সলিমুল্লাহ খান : ঐগুলি আমি আর পড়ি নাই। সোজা কথা, আমি প্রথম দুটো বই পড়েছি। আত্মজা ও একটি করবী গাছ, আরেকটা কি যেন নাম ভুলে গেছি, আর তৃতীয় জীবন ঘষে আগুন ইত্যাদি । হাসান আজিজুল হকের গল্প যে কোন সংকলনে পাওয়া যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কিছুদিন চাকরি করেছিলাম। এখনো হাসান আজিজুল হকের সাথে আমার যোগাযোগ আছে, পরিচয় আছে। উদাহরণ দিয়ে বলছি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প একটু পরে পড়েছি আমি। অন্যঘরে অন্যস্বর, দুধেভাতে উৎপাত এগুলো পরে পড়েছি। অন্যঘরে অন্যস্বরটাই একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলাম। মনে হলো উনি তো তাঁর গল্পে একজন যেমন “এই মনোরম, মনোটোনাস শহরে...” [তিনিও অনেকটা তেমনই]।
প্রশ্ন : ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা'। ওটা তো একদম প্রথম দিকের ইলিয়াসের লেখা।
সলিমুল্লাহ খান : তিনি আসলে কবিই—‘বুর্জোয়া কবি’। কিন্তু মজা হলো কি...
প্রশ্ন : কিন্তু নিরুদ্দেশ যাত্রার যে ইলিয়াস, ওখান থেকে ইলিয়াস কিন্তু পরবর্তীতে অনেক সরে গেছেন।
সলিমুল্লাহ খান : হ্যাঁ, ইলিয়াস অনেক পরিবর্তিত হয়েছেন। তার গদ্য আমি মোটামুটি পড়েছি। অনেক পরে শওকত আলীর গদ্যও পড়েছি। কারো সাথে কারো পুরোপুরি মেলে না, কিন্তু তারা সবাই এক যুগের। এমনকি আল মাহমুদও অনেক গল্প লিখেছেন। আমি বলছি, আমরা হলাম ওই যুগের লোক। আমি নির্মলেন্দু গুণের গদ্যও পড়েছি। আপন দলের মানুষ নামের একটা গল্পের বই ছিল তার। আহমদ ছফা, বশীর আল হেলাল এঁদের গল্পও আমি কিছুদিন পড়েছি। অন্তত একসময় পড়তাম। আমি এঁদের সবাইকে একযুগের লোকই মনে করি। অন্যদের কথা, বলা বাহুল্য, কায়েস আহমেদ পড়েছি, হুমায়ুন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক পড়েছি ...
প্রশ্ন : হুমায়ুন আহমেদ কেমন লেগেছে?
সলিমুল্লাহ খান : ভালো, খুব ভালো। হুমায়ুন আহমেদের প্রথম দুটো বই—নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার—একসময় পড়েছি। এর পরেও দুই-একটা একটু-আধেকটু পড়ে পড়ে দেখেছি।
প্রশ্ন : আর টানে নাই?
সলিমুল্লাহ খান : নাহ্, আর টানেনি। ওই দুটি পড়ে বেশ ভালো লেগেছিল। তখন আমারও বয়স কম ছিল, ওনারও বয়স কম ছিল। পরবর্তীকালে উনি অনেক বড় হয়েছেন, আমি আর বড় হইতে পারি নাই। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখাও দুই-একটা পড়েছি। কারণ তাঁদের সাথে আমার পরিচয় ছিল [আহমদ ছফার মধ্যস্থতায়]। হুমায়ুন আহমেদের সাথে আমার পরিচয়, বলা যায় একপ্রকার বন্ধুত্বই ছিল। এঁরা সকলেই ভালো লেখক।
কিন্তু আমি যাঁকে বড় লেখক মনে করি তার উদাহরণ একমাত্র আহমদ ছফা। রবীন্দ্রনাথের পরে সর্বশেষ বড় লেখক আহমদ ছফা। শুধু এই স্বাধীন বাংলায় না, ওই ভারতাধীন বাংলায় না, সব বাংলাতেই—গদ্যে, পদ্যে, গল্পে, কবিতায়, চিন্তায় সবচেয়ে বড় লেখক আহমদ ছফা। কবি হিসেবেও ছফা অনন্য। গালিবদের আমার পছন্দ হয় না কি জন্য জানেন? তাঁরা আহমদ ছফার কবিত্ব বোঝেন না। তাঁরা তো ইম্ম্যাচিউর, [ওঁরা পাকেন নাই]। আহমদ ছফার কবিতা বুঝতে যে বয়সের দরকার তা ওঁদের হয় নাই। গালিবের হয়নি, রাইসুর হয়নি, সাজ্জাদের হয়নি, গোমেজের হয়নি। তাহলে এদের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাড়া আমি আর কি বলতে পারি? লিটমাস টেস্ট বলে একটা বাক্য আছে... আপনি এইটার পরীক্ষা দিবেন তো রঙটা বদলায় কিনা দেখতে পারবেন...।
আহমদ ছফার কবিতা যাদের ভালো লাগে না তাঁদের ভালো কবি বলার কোনো কারণ আমি দেখি না। আহমদ ছফা ফাউস্ট অনুবাদ করেছেন। এটাকে তাঁরা ভালো বলছেন গ্যেটের কারণে। যে লোক গ্যেটেকে এমন অনুবাদ করেন... [তিনি কি আর খারাপ কবি হতে পারেন! আমাদের এই ভদ্রমহোদয়দের ভাবখানা এইরকমই।] আমি বলি আহমদ ছফা গ্যেটেকে বিকৃতই করেছেন। বিকৃত করে শেষতক যা দাঁড়িয়ে গেছে তার নামই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক দিয়েছিলেন ‘গ্যেটে প্লাস আহমদ ছফা’। আমার বিশ্বাস এই দেওয়াটা ঠিকই হয়েছে। এখানে শুধু এইটুকু বলি, বিকৃত করার জন্যও তো কবিত্বশক্তি লাগবে!
প্রশ্ন : কবিতার অনুবাদ ভালো হতে গেলে তো মিনিমাম কবিত্ব থাকতে হয় অনুবাদকের।
সলিমুল্লাহ খান : যে লোক এত ক্ষমতার অধিকারী আমি তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখক বলি না, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন বলি, তাতে অসুবিধাটা কোথায়! বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর সেরা লেখক আহমদ ছফা। একদিকে এত চিন্তাশীল আরদিকে এত সৃষ্টিশীল... দুইটা এক জায়গায় করলে, যুক্ত করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছেন আহমদ ছফা, আহমদ ছফা ছাড়া আজ বাংলামুলুকে [বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র আর ভারতের অধিভুক্ত বাংলাপ্রদেশ জুড়ে] এমন কেউ আর নাই।
প্রশ্ন : গদ্যের ক্ষেত্রে আপনি মনে করছেন আহমদ ছফাই... শীর্ষে।
সলিমুল্লাহ খান : শুধু গদ্যে না, পদ্যেও। আমি জানি আপনাদের জন্যে এ কথাটা গ্রহণ করা এবং ছাপানো—দুটাই চ্যালেঞ্জিং হবে । এটা মেনে নিতে কষ্ট হবে । তবে আমি সবিনয়ে এ সত্যই নিবেদন করি।
প্রশ্ন : এই সময়ে যাঁরা লিখছেন তাঁদের মধ্যে কারও লেখা ভালো মনে হয়?
সলিমুল্লাহ খান : কারা লিখছেন, আপনি বলেন। আপনি তরুণ, আপনাদের কাছ থেকে শিখি...।
প্রশ্ন : কত লেখকই তো লিখছেন। শাহাদুজ্জামান, মামুন হোসাইন, কাজল শাহনেওয়াজ, ওয়াসি আহমেদ, শাহীন আখতার, জাকির তালুকদার—কত নামই তো শোনা যায়।
সলিমুল্লাহ খান : এঁরা ভালো লেখক। এঁদের বিষয়ে আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। যেমন শাহাদুজ্জামান, বয়সে আমার ছোট। [মানে ওঁকে আমি অনেকদিন থেকেই চিনি। আমি ওঁকে খুব পছন্দও করি। ওঁর বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে আমার কষ্ট হয়। আমার সম্পাদিত পত্রিকায় একদা (১৯৮৩-৮৪ সালে) ওঁর লেখা আদর করে যত্ন করে ছেপেছি।] এতদিনেও দেখছি উনি গদ্য লিখতেই শেখেননি। গদ্যে আর পদ্যে যে একটা তফাত আছে এটা ওঁকে এতদিনে কে শেখাবে! জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে একটা ফাতরা বই লিখেছেন তিনি। বইয়ের নাম একজন কমলালেবু। যাঁর ন্যূনতম আত্মসম্মান আছে তাঁর তো এ রকম বই লেখা উচিতই নয়। জীবনানন্দের উপর একটা মশকরার বই লিখেছেন তিনি। প্রথমে দর্শনে, ভুলের প্রকোপে, একবার পড়েছিলাম ‘একডজন কমলালেবু'। পরে দেখি, না, বইয়ের নাম 'একজন কমলালেবু'।
পরীক্ষা করার জন্য ‘আট বছর আগের একদিন’ নামের কবিতাটা নিয়ে যে চ্যাপ্টারটা তিনি লিখেছেন, [সেটা পড়ে দেখলাম, পড়ে যারপরনাই হতাশ হলাম। দেখি কি কবিতাটার ভিতরটাই তিনি বুঝতে পারেন নাই।] [প্রসঙ্গক্রমে বলি, বুঝতে পারলাম আরও এক কারণে । আমি নিজেও ঐ কবিতা নিয়ে সম্প্রতি বাংলায় একটা সহজ প্রবন্ধ লিখেছি। বলা বাহুল্য নয় বাংলা লেখাটা আমার প্রায় দশ বছর আগের একপ্রস্ত ইংরেজি কঠিন প্রবন্ধের তর্জমা নয়।] দেখলাম ওইটা আমার তাহলে আর পড়ার দরকার নাই।
প্রশ্ন : বইয়ের বেশিরভাগ লেখার যে বিষয়, তা আবদুল মান্নান সৈয়দের শুদ্ধতম কবি-তেই আছে। এর বাইরে বেশি কিছু নাই।
সলিমুল্লাহ খান : আবদুল মান্নান সৈয়দের কথা আমার বলা উচিত ছিল। তাঁর কবিতাও আমি পড়েছি। আবদুল মান্নান সৈয়দ কখনও প্রাপ্তবয়স্ক হন নাই। ঠগ বাছতে গেলে ভাই গা উজাড় হবে। সবার নাম নিয়ে বলা তো মুশকিল। আসাদ চৌধুরীকে আমি চিনতাম। আমি বলব না তিনি একজন মহাকবি। সবার তো মহাকবি হতে হবে না। তিনি একজন সৎ মানুষ। রফিক আজাদের কবিতা আমি অনেকটা পছন্দ করতাম। তাঁর কবিতায় একধরনের গদ্যপ্রবণতা আছে, কবিতাকে উনি ‘পদ্যপ্রবন্ধ’ই বলতেন। নির্মলেন্দু গুণ আর আবুল হাসানকেও আমার এখনও ভালো লাগে। আবুল হাসানকে নিয়েও আমি একটা নিবন্ধ লিখেছি।
প্রশ্ন : ‘আবুল হাসানের অজ্ঞান'।
সলিমুল্লাহ খান : আমি অতি সামান্য লেখক। নিজের সম্পর্কে বেশি কথা বলা ঠিক নয়। আমি আপনাকে মাত্র দেখাচ্ছি বাংলা কবিতার সাথে আমার কি রকম [অতি সামান্য] পরিচয় আছে।
প্রশ্ন : তাও তো বাংলাদেশের পরিচিত কবিসাহিত্যিকদের অনেককে নিয়েই লিখেছেন।
সলিমুল্লাহ খান : ফরহাদ মজহারের এবাদতনামা-র সমালোচনা কেউ করার আগে আমি লিখেছিলাম। বইটি প্রকাশ পাবার পরপর—১৯৯০-৯১ সালের কথা—তার খারাপ সমালোচনা করেছিলেন দুজন প্রথিতযশা লেখক—একজন রফিক আজাদ, অন্যজনের নাম পূরবী বসু, ইনি একজন গল্পকার। আমি তাঁদের দুজনের সমালোচনার জবাব দিয়েছিলাম। ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় আমার সেই সমালোচনার একটা সমালোচনা লিখেছিলেন অধ্যাপক আজফার হোসেন। আমি সেটার কোনো উত্তর দেই নাই। কারণ আক্ষরিক অর্থেই তাঁর যুক্তি ছিল অকাট্য, মানে কাটলে রোগী মারাই যাবেন। আমার লেখার সমালোচনা আপনিও করতে পারবেন। আর সবকিছুর জবাব আমাকেই দিতে হবে বা দিতেই হবে এমন কথা তো নাই। পাঠকসমাজ এটা বিচার করবেন। ভালো সমালোচকদের আমি আমার খাঁটি শিক্ষক মনে করি।