হায়াৎ মামুদ ও রুশ লেখকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ
এমন সুন্দর করে গল্প বলতে আর কোনো লেখক পারেন এই ভাষাতে! মনে হয় গল্প শুনছি বড় ভাইয়ের কাছে, কিংবা ছোট চাচার কাছে, অথবা অকালে বুড়িয়ে না-যাওয়া দাদুর কাছে। গল্প শুনলে মনে হবে, কোনো পণ্ডিতি নেই কথার মধ্যে। কিন্তু অন্তরালের বিষয় হচ্ছে ব্যাপক এবং গুলে-খাওয়া পাণ্ডিত্য না থাকলে কেউ এভাবে গল্প বলতে পারেন না।
জন্মভূমি ছাড়াও তিনি দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন অধূনালুপ্ত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে। বাস করেছেন পুঁজিবাদের শিখরস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং কানাডায়। কিন্তু জিজ্ঞাসিত হওয়ামাত্র তিনি নির্দ্বিধায় বলেন— মস্কোর জীবন ছিল পাশ্চাত্যের তুলনায় অনেক ভালো, অনেক সুন্দর, অনেক স্বস্তির, অনেক আনন্দের।
কারণটা কী?
এই রচনালেখকের ধারণা, অনেকের মধ্যে প্রধান একটি হচ্ছে, তিনি মস্কোতে ছিলেন আলেকজান্ডার পুশকিন, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি থেকে শুরু করে মিখাইল শলোখফ, আন্না আখমাতোভা কিংবা রাসুল গামজাতভের বসবাসসঙ্গী। রুশসাহিত্যে প্রতিভার যে মিছিল এসেছে, তা পৃথিবীর অন্য ভাষায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোনো ভাষাতে কোনো দেশে একসঙ্গে এতজন আকাশছোঁয়া প্রতিভাবান লেখক-কবি জীবন যাপন এবং রচনামগ্ন ছিলেন—ভাবতেই শিহরণ জাগে। সেই তাঁদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন হায়াৎ মামুদ। দেড়শ বছরের প্রতিভার মিছিলের সঙ্গে। নিজে লেখক তিনি। আর লেখক মানে সবচাইতে মগ্ন পাঠক। পাঠের এমন সুযোগ যে মস্কো এনে দিয়েছে, তাঁর কাছে মস্কোবাস যে আনন্দের সাথে পয়লা স্থান অধিকার করবে, তা তো একধরনের চোখ বুঁজে বলে দেবার মতোই ব্যাপার।
তাই রুশসাহিত্য শুধু নয়, রুশ লেখক-কবির জীবন এবং চিন্তার রাজ্যে প্রবেশের ব্যাপারে তাঁর হাত সত্যিকারের সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করে। রুশলেখকের ‘জীবনচরিতে প্রবেশ’-এর সবচেয়ে বড় ‘সিসেম ফাঁক’ মন্ত্রটি এই দেশে কেবল হায়াৎ মামুদেরই জানা। এবং তিনি যে কাউকে আনন্দের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানান সেই জগতে প্রবেশের।
০২.
তিনি আমাদের নিয়ে যান পুশকিনের সান্নিধ্যে। দেখতে পাই ‘মাঝারি গড়ন, একহারা চেহারা, গাত্রবর্ণ ফ্যাকাশে-মলিন, একমাধা কোঁকড়ানো বেপরোয়া চুল, সরু নাক, বড় বড় ডাগর দুটো চোখ একটু যেন ঠেলে বেরিয়ে আসা, আর প্রায় চিবুক পর্যন্ত নেমে আসা ঘন ও দীর্ঘ গালপাট্টা, শ্মশ্রু বা গুম্ফের চিহ্ন নেই, ঠোঁট পুরু ও মোটা’ একজন মানুষকে। যিনি নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। শত্রুরাও, যেহেতু তাঁর প্রতিভার তুলনায় বামন সবাই, সুযোগ পেলে পুশকিনকে আঘাত করেন চেহারার বর্ণনা দিয়ে। তাদের ভাষায় পুশকিন হচ্ছে—‘ফরাসি, বাঁদর আর বাঘের চেহারার মিশ্রণ’।
নাতালিয়া গনজারেভার মতো রুশ সুন্দরীশ্রেষ্ঠাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। সারা রাশিয়ার অভিজাত সমাজে এই কথা প্রচারিত হয়েছিল— এটি হচ্ছে অপ্সরার সঙ্গে দানবের বিবাহ।
আর নিজের চেহারা নিয়ে তীব্র অসন্তুষ্ট পুশকিন তো নিজেকেও ব্যঙ্গ করতে ছাড়তেন না। প্রথম সন্তান মারিয়া জন্মানোর পরে বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন— ‘ভাবতে পারো, আজ আমার স্ত্রী স্রেফ বোকার মতো আমারই এক মিনিয়েচার লিথোগ্রাফ উপহার দিয়েছেন। মনটা বড়ো মুষড়ে পড়েছে।’
কিন্তু চারিত্রিক দিক দিয়ে দেখা যাচ্ছে অসম্ভব উদ্দাম একজন মানুষ পুশকিন। জীবনকে যিনি ভালোবেসেছিলেন সর্বতোভাবে। প্রিয় ছিল ‘আহার ও নিদ্রা, কর্ম ও আলস্য, মদ্য ও নারী, কবিতা ও নৃত্যগীত এবং বন্ধুবান্ধব। তীক্ষ্ণ আত্মসম্মান ও সাহস ছিল বুকে; তেজি ঘোড়ার মতো একরোখা ও চঞ্চল ছিলেন এবং শিশুর মতো সরল ও বিবেচনাহীন।’
হায়াৎ মামুদ দেখাচ্ছেন—‘জীবৎকালে পুশকিন খ্যাতি এবং অখ্যাতি উভয়েরই শীর্ষে ছিলেন।’ খ্যাতির কারণ তাঁর কবিতা, গল্প, কাহিনীকাব্য ও কাব্যনাট্য। জারসম্রাটের সেন্সর না-পাওয়া কবিতা পাণ্ডুলিপি থেকেই কপি করে নিয়েছে মানুষ, তারপর লোকের মুখে মুখে পঠিত হয়েছে সেইসব কবিতা। বই বেরোনো মাত্র বিক্রি হয়েছে হাজার হাজার কপি। রাশিয়াতে তিনিই প্রথম লেখক যিনি সাহিত্যকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। ‘আমি আমার নিজের জন্য লিখলেও ছাপাই কিন্তু টাকার জন্য, সুন্দরীদের কেবল একটু হাসির জন্য নয়।’
অন্যদিকে জারের পুলিশের কাছে তিনি ছিলেন ‘রাশিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি’। আমৃত্যু পুলিশের গুপ্তচর তাঁর পিছে ছায়ার মতো ঘুরেছে, স্ত্রী-কে লেখা প্রেমপত্র পর্যন্ত খুলে খুলে পড়েছে, মৃত্যুর পর তাঁর সকল কাগজপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়েছে সেগুলোর মধ্যে জারের বিরুদ্ধে মানুস খেপানোর কোনো উপাদান আছে কি না দেখার জন্য। ১৮২৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর জারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয়, সেখানে বিপ্লবীদের সবার পকেটেই পাওয়া গিয়েছিল পুশকিনের কবিতা। পুলিশপ্রধান বেনকেনডার্ফ ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধান করতেন পুশকিনের ওপর পুলিশী কার্যক্রম। দীর্ঘদিন এই কাজ করতে গিয়ে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বুঝতে পেরেছিলেন কবিকে। তিনি জারকে বলেছিলেন, ‘হুজুর, এই পুশকিন লোকটা কোনোকিছু নিয়েই ভাবে না; অথচ যেকোনো কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সবসময় তৈরি; যা কিছু ও করে সবই তাৎক্ষণিক আবেগের দ্বারা চালিত হয়ে করে।’
এই তাৎক্ষণিক আবেগ আর তীব্র আত্মসম্মান দ্বারা চালিত হয়েই আগ্নেয়াস্ত্র কীভাবে ধরতে হয় তা না জেনেও ডুয়েলের আহ্বান জানিয়েছিলেন ঘাতক দ্যতাঁকে।
পুশকিনের কবিতা-গল্প-কাব্যনাটক অতুলনীয় অবশ্যই। সবগুলোই তাঁর কৃতির সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় কীর্তি তাঁর হচ্ছে আধুনিক রুশ সাহিত্যের জন্য একটি ভাষা নির্মাণ করে দেওয়া।
০৩.
তা পুশকিনকে তো আমরা অল্প-বিস্তর চিনি। চিনি তলস্তোয়, দস্তয়ভস্কি, তুর্গেনেভ, ইভান বুনিন, চেখভ, গোর্কিদের। কিন্তু হায়াৎ মামুদ আমাদের এমন একদল কবি ও কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যাদের সম্পর্কে খুব কম জানা আমাদের। তাদের তিনি বলছেন ‘রূপালী যুগের রুশ সাহিত্যিক’। যুগটিকে বলছেন ‘রৌপ্যযুগ’। ১৮৯২ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত চল্লিশ বছর। তার মানে রুশ বিপ্লবের আগে ও পড়ে ছড়িয়ে আছে সেই রুপোলি সময়। কত বিচিত্র সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে সেই সময়খণ্ডে! সিম্বলিজম, আকমেইজম, ফুতুরিজম, ফর্মালিজম, ইমাজিনিজম, সেরাপিওনভি ব্রাতিয়া, কন্সট্রাক্টিভিজম... । সেই সময়ের লেখক-কবিদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তীকালে বিশ্বখ্যাত হয়েছেন। আলেকজান্ডার ব্লোখ, আন্দ্রিয়েই বিয়েলি, আন্না আখমাতোভা, সের্গেই ইসিয়েনিন, ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, ভিক্টর শক্লোভস্কি, রোমান ইয়াকবসন, ওসিপ মান্দেলস্তাম, বরিস পাস্তেরনাক। নাম একসাথে করা হচ্ছে বটে, কিন্তু এরা অধিকাংশই ভিন্ন ভিন্ন দলের।
হায়াৎ মামুদ গভীর পাঠের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দেন, সকলের মধ্যে ওসিপ মান্দেলস্তাম ছিলেন একেবারেই ভিন্নধর্মী, এবং সম্ভবত, সবচাইতে প্রতিভাবানও। স্তালিনের রোষ তাকে শ্রমশিবিরে পাঠিয়েছিল। এবং সেখান থেকে পরপারে। কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে সাড়া জাগিয়ে ছিলেন সমগ্র রাশিয়ায়। তার মধ্যে একটি ব্যঙ্গ কবিতা রচিত হয়েছিল স্তালিনকে নিয়ে। যদিও কবিতাটি ছাপা হয়নি কোথাও। তবু খবরটি পৌঁছেছিল স্তালিনের কানে। সমসাময়িক কোনো লেখক বা কবিই পৌঁছে দিয়েছিল খবরটি স্তালিনের কোনো গোয়েন্দো বাহিনীর কাছে। তারপরেই গুম হয়ে গেলেন মান্দেলস্তাম। তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে নিকোলাই চুকোফস্কি লিখেছেন, ‘ওসিপ এমিলিয়েভিচ মান্দেলস্তাম আমার খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন। তাঁকে সতেরো বছর ধরে চিনতাম; প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, কিন্তু আমি তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলাম না—কারণ, অংশত আমাদের বয়সের ফারাক, আর অংশত আমার লেখাপত্রের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা যা তিনি কখনোই লুকোননি। তাঁর সততা ছিল একেবারেই তাঁর নিজস্ব ধরনের।’
তারপরে লিখছেন—‘তিনি (ওসিপ মান্দেলস্তাম) সব সময় হতদরিদ্র অবস্থার ভেতরেই থেকে গেছেন। প্রত্যেক দিনই খাওয়ার সময়ে তাঁকে ভাবতে হয়েছে কোত্থেকে দু-চারটে রুবল জোগাড় করবেন কিছু কিনে খাওয়ার জন্য। কিন্তু নিজের মূল্য সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিল। তাঁর আত্মসম্মানজ্ঞান ছিল প্রচণ্ড। খুব অভিমানী স্বভাবের মানুষ ছিলেন, সামান্য কিছুতেই অভিমান হতো তাঁর, আর সেটা তিনি গোপনও করতেন না। তখন, ঠিক মোরগ যেন, ঘাড়টা পিছন পানে ঠেলে দিতেন, ছোট্ট মাথাটার ওপর কয়েকগাছি চুল কাঁপত, ক্ষৌরী-করা সুন্দর মুখের নিচে গলার কণ্ঠার হাড় ঠেলে বেরিয়ে আসত এবং তিনি বর্ষীয়ান আমলার ঢঙে উষ্মা প্রকাশ করতেন।’
আর শেষ দিকের দেখা-সাক্ষাতের বর্ণনা এসেছে এইভাবে—‘তাঁর মেজাজ প্রায়শই খিঁচড়ে থাকত, সামান্যতেই মনে আঘাত পেতেন, তিনি যেন কেমন উৎকণ্ঠায় আর ভয়ে ভয়ে থাকতেন। দেৎস্কোয় সেলো-তে একবার এক গ্রীষ্মে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়, তখন তাঁর অস্থির ও ছটফটে ভাবভঙ্গি লক্ষ করেছি, যেন মানসিক অবসাদের রোগী। প্রচুর কথা বললেন, এই বসছেন, এই উঠে দাঁড়াচ্ছেন, কখনো টেবিলের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকছেন, একবার মাথা তুলতেই দেখি দুচোখে জল টলটল করছে। সিগারেট খাওয়ার সময় ছাইদানি ব্যবহার করতেন না, নিজের বাঁ কাঁধের ওপর ছাই ফেলতেন, তাঁর কোটের বাঁ দিকের কাঁধ সর্বদা ছাইয়ে ভরা থাকত।’
স্তালিনের রোষ তাঁকে গুম করে দিয়েছিল।
তারপরেই হায়াৎ মামুদ আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন অনিন্দ্যসুন্দরী এবং শতাব্দীর অন্যতম প্রতিভবান কবির সঙ্গে। আন্না আখমাতোভা। সমকালীন একজন কবির ভাষায়—‘আন্না আখমাতোভাকে রূপসী বললে কিছুই বলা হয় না। তার চেয়েও আরো বেশি কিছু। আমি আর কোনো মহিলাকে দেখিনি যিনি এতখানি এক্সপ্রেসিভ, অন্যের মনোযোগ কেড়ে নিতে এতখানি সক্ষম। তাঁর স্মিতহাসি ছিল আনন্দোচ্ছ্বল, যেন পাশে বসে থাকা কারও কানে ফিসফিস করে কিছু বলার মতো দুষ্টুমিভরা। কিন্তু পড়বার জন্য যখন উঠে দাঁড়াতেন তখন তাঁর আদলটাই পাল্টে যেত, কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যেতেন, ক্ষীণ পরিহাসের অনুরণন লাগত কণ্ঠে।’ ‘সাবাকা’(নেড়ি কুত্তা) নামের একটি ভূগর্ভস্থ ক্যাফেতে আড্ডায় শরিক হতেন আন্না অন্য সমকালীন সহিত্যিক-শিল্পীদের সাথে। এমন এক ক্যাফে, যার দরজাই খোলা হতো মাঝরাত নাগাদ। এখানে আসতেন কারা? যারা ভবঘুরে, উড়নচণ্ডী, বোহেমিয়ান, যারা সমাজের কোনো শেকল গলায় পরতে চান না, যাদের সংসারজীবন নড়বড়ে, এমন সব মানুষের জন্য এই ক্যাফে। আসতেন মায়াকোফস্কি, ব্লোখ, গুমিলিওফ, মান্দেলস্তাম, আখমাতোভার মতো কবি, ওলগা প্লেভোবার মতো অভিনেত্রী-নৃত্যশিল্পী-গায়িকা, ভিক্তর শক্লোফস্কির মতো সাহিত্যবেত্তা, সমালোচক, ভ্লাদিমির শিলেইকোর মতো প্রত্নতত্ত্ববিদ কবি, ইতালি থেকে আসা ফুতুরিস্ত কবি ও নাট্যকার ফিলিপ্পো মরিনেত্তি, এবং এমন আরও কতজন। যশঃপ্রার্থী, অখ্যাত, বিখ্যাত শিল্পের সমস্ত শাখার মানুষ আসতেন উজ্জীবিত হতে, সময়ের হাওয়া কিংবা হাওয়াবদল বুঝে নিতে। গান, কবিতাপাঠ, আলোচনা, বিতর্ক চলত অবিরাম। তর্ক চলত তত্ত্ব নিয়ে, চলত পণ্ডিত ও সৃজনশীলদের মধ্যে ভাবনাজগতের লড়াই। তারই মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়া, সম্পর্কের নির্মাণ এবং সমাপ্তি।
এখানেই আখমাতোভার সাথে মন দেওয়া-নেওয়া ঘটল আকমেইজম সাহিত্যতত্ত্বের সংগঠক গুমিলিওফের। যদিও আন্না বলতেন যে, তিনি গুমিলিওফকে ভালোবাসেন না, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন বলে মনে করেন, তবু বিয়ে হয়েছিল তাদের। অসম্মত থাকলেও বিয়েতে অবশেষে রাজি হয়েছিলেন আন্না। কারণ হিসেবে বলেছিলেন যে গুমিলিওফ ছিলেন তাঁর ‘নিয়তি’। আট বছর টিকেছিল সেই বিয়ে। পরে আরও দুজনকে স্বামীত্বে বরণ করেছিলেন আন্না। কিন্তু ‘নিয়তি’ তাঁর শেষ পর্যন্ত বাঁধা ছিল গুমিলিওফের সাথেই।
প্রতিবিপ্লবী সন্দেহে গুমিলিওফকে ধরে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলল বলশেভিক পুলিশ। আন্না তখনও সোভিয়েত লেখক ইউনিয়নের সদস্য। কিন্তু অচিরেই তাঁকে বহিষ্কার করা হলো। বিখ্যাত ইংরেজ পণ্ডিত, অক্সফোর্ড-অধ্যাপক, রুশ বিশেষজ্ঞ ইসায়া বার্লিন তখন ছিলেন মস্কোতে ব্রিটিশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি। তিনি ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে আন্নার সাথে দেখা করেন। সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশের ধারণা হয় যে আন্না দেশের গোপন তথ্য তুলে দিয়েছেন বার্লিনের হাতে। সোভিয়েত লেখক ইউনিয়নের প্রধান তাত্ত্বিক ঝদানভ বললেন যে আন্না হচ্ছেন ‘আধা বৈরাগী আধা বেবুশ্যে’। পুত্র লিয়েফ গুমিলিওফকে ধরে নিয়ে জেলে আটকে রাখল পুলিশ। চাকরি হারালেন আন্না। লোকে ছুটকো কাজ দেওয়াও বন্ধ করে দিল সরকারের ভয়ে। রেশনকার্ড কেড়ে নেওয়া হলো যাতে তিনি খেতে না পেয়ে শুকিয়েই মারা যান।
কিন্তু অনাহারে মৃত্যু হয়নি আন্নার। কারণ বছরের পর বছর ধরে প্রতিটি দিন অনামা, অপরিচিত মানুষজন স্রেফ আন্না আখমাতোভার কবিতার প্রতি ভালোবাসার টানে তাঁকে খাবারের প্যাকেট পাঠিয়ে গেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বন্ধুরা বারবার আহ্বান জানিয়েছে, তাদের কাছে চলে যেতে। কিন্তু দেশ ছাড়েননি আন্না আখমাতোভা। যেমন ছাড়েননি বন্ধু বরিস পাস্তেরনাক।
১৯১২ তে বেরিয়েছিল আন্নার কবিতার বই ‘ভিয়েচর’ (সন্ধ্যা), ১৯১৪-য় ‘চিওৎকি’ (জপমালা), ১৯১৭ সালে বিপ্লবের বছর ‘বিয়েলায়া স্তাইয়া’ (শ্বেত বলাকা), ১৯২১-এ ‘পদরোজনিক’ (ওষধি)। তারপরে ১৯২৩ সালে ‘প্রভুবর্ষ ১৯২১’। মোট পাঁচটি কবিতার বই। রাশিয়া তো বটেই , পৃথিবীজুড়েই তখন ব্যাপকভাবে পঠিত হচ্ছে আন্না আখমাতোভার কবিতা। এখনো। কারণ, অনেকেই মনে করেন আন্না আখমাতোভা হচ্ছেন বিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী কবি।
০৪.
রুশ কবি-লেখকদের বাংলাভাষীদের কাছে পরিচিত করাতে গিয়ে নিজস্ব লেখালেখির প্রসঙ্গ প্রায় তুলতেই চান না হায়াৎ মামুদ। সেসব নিয়ে বারান্তরে কথা হবে। তবে এটুকু বলতেই হবে যে, অসাধারণ এক বাংলাগদ্যের অধিকারী তিনি। গদ্যের জাদুতেই পাঠক আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। আর যা লিখেছেন, যা নিয়ে লিখেছেন, সেগুলো বাড়তি পাওনা। সেই ‘বাড়তি’ আবার এতটাই বাড়তি যে আমাদের অতিদরিদ্র চিন্তাজগতের ভাঁড়ার অনেকটাই ভরে ওঠে হায়াৎ মামুদের সেইসব রচনা দিয়ে।