তথাপি আমার গুরু
এখন আমি ‘না বাসবো’ আর ‘বাসবো না’—এই দুই ধাঁধার মধ্যে
বসে একাকী কবিতা লেখার চেষ্টা শেষে সরল গদ্যে
লিখেছি ক্ষুধার কাহিনী কতক
ভালোবাসা কি সর্ষেক্ষেতে দোজবধুর মাছের মড়ক
—সলিমুল্লাহ খান (১৯৮১ : ৪৭)
ইদানীং প্রায়ই সলিমুল্লাহ খান জিজ্ঞেস করেন, ব্যর্থ কবিরা গদ্য লেখক হন, আর ব্যর্থ গদ্যকাররা তাহলে কী হন? নিজের সম্পর্কে আজকাল প্রায়ই তিনি এই প্রশ্ন করেন। প্রশ্ন তো নয়, যেন ধাঁধা। আমি এর কোনো উত্তর দিই না। শুধু হাসি। তবে মনে মনে বলি, ব্যর্থতা এক আপেক্ষিক ব্যাপার। লেখক নিজের কাছে সারা জীবনই ব্যর্থ থাকেন, কিন্তু অপরের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন সাফল্যের পরাকাষ্ঠা। যেমন আমার কাছে। পাঠক হিসেবে শুধু নয়, সলিমুল্লাহ খানের ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি তিনি সফল লেখক এবং যুগপৎ সফল শিক্ষক। মাঝেমধ্যে আমি তাঁকে দার্শনিক বলেও সম্বোধন করি। তবে এক আলাপে তিনি বলেছিলেন, চিন্তক বা শিক্ষাবিদ নন, তিনি নিজেকে লেখক হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করেন। আর ভালোবাসেন শিক্ষকতা করতে। জীবন-জীবিকার জন্য শিক্ষকতা করতে হয় বটে—এমন কথা বললেও সকলেই জানেন শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজেই নিজের তুলনা।
অজস্র বিষয়ের ভেতর দিয়ে জীবনের নানা দর্শনই তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। সেগুলো একে একে বলা যাবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা আমি পেয়েছি তা হলো কী করে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। এ প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খান একবার নয়, বহুবার, ফ্রয়েড পড়াবার সময়, লাকাঁ পড়াবার সময়,এমনকি নিজের একাধিক লেখাতেও একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়েছেন, বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে। ঘটনাটি হলো : একবার বজ্রের দেবতা প্রজাপতির সামনে উপস্থিত হয় তিন প্রকারের ছাত্র। তাদের একদল দেবতা, একদল মানুষ ও অন্যদল অসুর। তো প্রজাপতি তাদের বললেন, দ, দ, দ।
এই তিন ‘দ’ শুনে দেবতারা বুঝেছিল দ মানে দম্যত, অর্থাৎ নিজেকে দমন করতে হবে। মানুষ বুঝেছিল দ মানে দত্ত, অর্থাৎ দান করতে হবে। আর তৃতীয় প্রকার ছাত্র অসুর বুঝেছিল দ মানে দয়াধ্বম, অর্থাৎ দয়া করতে হবে। সলিমুল্লাহ খান এই প্রজাপতি-উপদেশের দিশা পেয়েছিলেন জাক লাকাঁর ‘দ্য ফাংশন অ্যান্ড ফিল্ড অব স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ইন সাইকোঅ্যানালাইসিস’ প্রবন্ধ থেকে। লাকাঁর মতে ‘দমনে’র সত্যিকার অর্থ হলো ভাষার নিয়মের কাছে নিজেকে দমন করতেই হয়। ‘দানে’র গূঢ় অর্থ হলো ভাষার দেওয়া উপহার আদানপ্রদানের ভেতর দিয়েই মানুষ একে অপরকে চেনে। আর ‘দয়া’র নিগূঢ় অর্থ হলো প্রতিধ্বনি বা পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে ভাষার আবাহন করতে হয়। স্যার বলেন, শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে শিক্ষার্থীর এই তিন ‘দ’-কেই মনে রাখতে হবে। জ্ঞানের বিপরীতে নিজের অহমকে দমন করতে হবে, জ্ঞানার্জনের জন্য পারস্পরিক জ্ঞানের আদানপ্রদান করতে হবে, আর জ্ঞানচর্চাকে পুনরাবৃত্তির মধ্যে ফেলে দিতে হবে। তাহলে একটা সময় আসবে যখন চাইলেও আর জানা জিনিসটাকে ভোলা যাবে না। এভাবেই প্রকৃত অর্থে জ্ঞানার্জন হয়। এর চেয়ে বড় মন্ত্র আমি আর কোথাও থেকে শিখিনি।
ওপরের মন্ত্র কিন্তু স্যারের প্রথাগত কোনো ক্লাস থেকে শেখা নয়। শিক্ষকতা করতে তিনি এতটাই ভালোবাসেন, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার পর যে দুদিন ছুটি থাকে—শুক্র ও শনি—সেই দুদিনও তিনি ক্লাস নেন, বিষয়ভিত্তিক নানা সেমিনার। আমি সেই সপ্তাহান্তে পরিচালিত ক্লাসগুলোরই ছাত্র। ২০০৩ সাল থেকে। বিষয় মূলত তিনটি : দর্শন, মনোবিশ্লেষণ ও সাহিত্য। স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৩-এর শুরু থেকেই। তখন অধুনা বিলুপ্ত এক সাহিত্য পত্রিকা ‘ভোরের শিশিরে’র সঙ্গে আমি যুক্ত, সহ-সম্পাদক হিসেবে। স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ছি। সৈয়দ মুজতবা আলীর ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা বের করব। সেটা নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছি। মুজতবা আলীর বড় ছেলে সৈয়দ মোশাররফ আলীর বাসায় যাচ্ছি। সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। সৈয়দ মুজতবা আলীর ছোট ছেলে সৈয়দ জগলুল আলীর সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছিল। সাহিত্য পত্রিকাটির কার্যালয় ছিল মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে। এর অনতিদূরেই, ইকবাল রোডে তখন সদ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে এশিয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ইংরেজি অনুবাদের সংক্ষেপে তা দাঁড়ায় কাক (Centre for Asian Arts and Culture, CAAC)।
কাক গড়ে তোলার পেছনে সে সময় যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমি অগ্রজপ্রতিম জহিরুল ইসলাম কচি ও সাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার শওকতকে চিনতাম। এদের দুজনই তখন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টকে তালাক দিয়েছেন। আমারও বিচ্ছেদ ঘটেছে বছর দেড়েক আগে। তো রাজনৈতিক সংগঠনের সুবাদে এদের দুজনকে আমি চিনতাম। আমার সঙ্গে দেখা হলেই কচি ভাই ও শওকত ভাই বলতেন তাঁদের কাকের অফিসে যেতে।
একদিন সাহিত্য পত্রিকার অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইকবাল রোডে কাকের কার্যালয়ে গেলাম। শওকত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ভেতরে কর্মশালা চলছে। ঢুকলাম। ভেতরে কচি ভাই ছিলেন। বললেন, বসো। দেখলাম ঝুটি বাঁধা এক ভদ্রলোক বক্তৃতা দিচ্ছেন কার্ল মার্ক্সের পুঁজি বইটির ওপর। আমি বসলাম, এরপর অনেকটা যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলাম মার্ক্সের সার্কিট অব ক্যাপিটালিস্ট প্রোডাকশন, সার্কিট অব এক্সটেন্ডেড প্রোডাকশন নিয়ে আলোচনা। এমন করে বাম রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কখনো শুনিনি। অথচ কার্ল মার্ক্সকে নিয়েই তাঁদের কারবার। যাই হোক পরিচিত হলাম। জানলাম বাগ্মী ভদ্রলোকটির নাম সলিমুল্লাহ খান।
আমি মোটামুটি একটি ঘোর নিয়ে বাড়ি ফিরি। এর কয়েকদিন পরই আমি ফোন দিই কাকের অফিসে। সেখান থেকে নাম্বার নিই সলিমুল্লাহ খানের। তাঁকে ফোন দিয়ে বললাম, সৈয়দ মুজতবা আলীর ওপর লেখা দিতে হবে। সেটাই প্রথম টেলিফোনে যোগাযোগ। তিনি বললেন, প্লেটোর রচনা অনুবাদ করছেন তিনি, কাজেই ওই সময় মুজতবা আলীকে নিয়ে তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। আমাদের যেহেতু পত্রিকার বের করার তাড়া ছিল, তাই আমিও আর জোরাজুরি করিনি।
পরে ২০০৫ সালে প্লেটোর অনূদিত রচনা বের হয় গ্রন্থাকারে : ‘প্লাতোন রচনাসংগ্রহ (প্রথম ভাগ) : এয়ুথুফ্রোন, সক্রাতিসের সাফাই, ক্রিতোন’। এই বইটির আরেকজন সহঅনুবাদক ছিলেন, সলিমুল্লাহ খানের ভ্রাতুষ্পুত্রী দেসদিমোনা খান। এই বইটির আগে অবশ্য স্যারের আরো একটি অনুবাদের বই প্রকাশ হয় ‘আল্লাহর বাদশাহি : ডরোথি জুল্লের কবিতা’ (১৯৯৮)। ডরোথি জুল্লের সঙ্গে স্যারের দেখা হয়েছিলো। জার্মান এই কবি ধর্মতত্ত্বের শিক্ষক ছিলেন। ডরোথি খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিবাদী লুথারিয়া শাখার সভ্য ছিলেন এবং তিনি পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে শত্রুজ্ঞান করতেন।
কথায় কথায় স্যার একবার বলছিলেন, এই জুল্লের অনুবাদের বইটিই তাঁর অন্য বইগুলোর চেয়ে সবচেয়ে প্রিয়। নিজের মৌলিক গ্রন্থ না হলেও, তিনি এই বইটি কবর পর্যন্ত নিয়ে যেতে চান বলেও বলছিলেন একদিন। বইটি নিয়ে আরো গল্প আছে। তার একটি হলো কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে এক বইমেলায় দেখা হয় হুমায়ুন আজাদের। তিনি নিজস্ব বাচনভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন, কি সলিমুল্লাহ, তুমি নাকি ইসলাম ধর্ম প্রচার করছ? স্যার তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ইসলাম কোথায়? আমি তো স্যার খ্রিস্টধর্ম প্রচার করছি। এই কথা শুনে হুমায়ুন আজাদ নাকি গটগট করে চলে যান।
(প্রকাশিতব্য বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে অংশবিশেষ)
দোহাই
১. সলিমুল্লাহ খান, এক আকাশের স্বপ্ন (ঢাকা : প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি, ১৯৮১)।