বানান বিতর্ক
বাংলা বানানের যম ও নিয়ম (প্রথম পর্ব)
বাংলাদেশে ‘ভাষা ও সাহিত্যের জাতীয় প্রতিষ্ঠান’ বলিয়া কথিত বাংলা একাডেমী ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে একটি পত্র প্রকাশ করেন ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে। বর্তমানে উহার প্রথম সংস্করণ সহজে পাওয়া যায় না। আমি অনেক চেষ্টা করিয়াও— উদাহরণের জন্য বলিতেছি— প্রথম বারের কোন কপি যোগাড় করিতে পারি নাই।
১৯৯৪ সালে ছাপা দ্বিতীয় পরিমার্জিত ও সংশোধিত সংস্করণ অবশ্য এখনও পাওয়া যায়। ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ নামে বাংলা একাডেমীর অপর প্রকাশনার শেষে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পরিশিষ্ট অংশে যাহা ছাপা দেখা যায় তাহা কিন্তু দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণের সংশোধিত মুদ্রণ অর্থাৎ তৃতীয় সংস্করণ। প্রথম সংস্করণ পড়িতে পারি নাই বলিয়া আমার এই লেখায় একটা অন্যায় থাকিয়াই যাইতেছে। ভাবিয়া বেশ সংকোচেই আছি।
ভরসা একটাই। পাঠিকা মার্জনা করিয়া পড়িবেন। এই সুযোগে হয়তো বলিয়া রাখা অন্যায় হইবে না, আমি বানান কি ব্যাকরণ ব্যবসায়ী নহি। তবে কর্তব্যের অনুরোধে আমাকেও নিত্য বাংলায় লিখিতে হয়, পড়িতেও হয়। তাই লিখিতেছি। যে অধিকারে লিখিতেছি তাহাকে (আর কোন ভাল শব্দ জানি না বলিয়া) বলিব ‘ব্যবহারকারীর অধিকার’।
উদ্দেশ্য ও বিধেয়
‘ভাষা সব সময়ে যুক্তি মানে না।’
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাংলাভাষা-পরিচয়, পৃ. ৪৯)
প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণেতা ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ তাঁহাদের পত্রে তৃতীয় সংস্করণের মুখবন্ধযোগে লিখিয়াছেন, ‘বাংলা বানান সংস্কার করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।’ তবে এত চেষ্টাচরিত্রের প্রয়োজন পড়িল কেন? তাঁহারা হলফ করিতেছেন, ‘আমরা কেবল বানানের নিয়ম বেঁধে দিয়েছি। বরং বলা যায়, বানানের নিয়মগুলিকে ব্যবহারকারীর সামনে তুলে ধরেছি। এইসব নিয়ম বা এইসব বানানে ব্যাকরণের বিধান লঙ্ঘন করা হয়নি।’
আমরা— গরিব ব্যবহারকারীরা— ঠিক তাঁহাদের কথায় আস্থা প্রকাশ করিতে পারি? সবিনয়ে নিবেদন করি, পারি না এবং পারিতেছি না দুই কারণে। এক নম্বরে, ‘বাংলা বানানের সংস্কার করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়’— এই কথাটি অকপট বলিয়া মনে হয় না। পত্রের দ্বিতীয় সংস্করণে বাংলা একাডেমী লিখিয়াছেন, ‘এটি কোনো বানান-সংস্কারের প্রয়াস নয়।’ তাঁহারা যাহা করিতেছেন তাহার অনুরূপ কাজকেই তো পুরাকালে ‘বানান সংস্কার’ বলা হইত। বাংলা একাডেমীর মুখবন্ধেই তো পরিষ্কার লেখা আছে: ‘বলা বাহুল্য, বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই ক্ষেত্রে যে পথিকৃতের কাজ করেছিলেন তার জন্য সকল বাঙালিই তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
পাঠিকার কৌতুহল হইতেই পারে উঁহারা পথিকৃতের কাজ বলিয়া যাহা নির্দেশ করিতেছেন তাহা কি বস্তু? ১৯৩৬ সালের মে মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রচারিত ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ পত্রে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যে ভূমিকা যোগ করিয়াছিলেন তাহাতেই খবর পাওয়া যাইতেছে, উদ্দেশ্য বানান সংস্কার।
‘কিছুকাল পূর্বে রবীন্দ্রনাথ চলিত বাংলা ভাষার বানানের রীতি নির্দিষ্ট করিয়া দিবার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করেন। গত নভেম্বর (১৯৩৫) মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম সংকলনের জন্য একটি সমিতি গঠিত করেন। সমিতিকে ভার দেওয়া হয়— যে সকল বানানের মধ্যে ঐক্য নাই সে সকল যথাসম্ভব নির্দিষ্ট করা এবং যদি বাধা না থাকে তবে কোন কোন স্থলে প্রচলিত বানান সংস্কার করা।’
বানান সংস্কার সমিতির তের সদস্যের এক সদস্য বিজনবিহারী ভট্টাচার্য। তাঁহার বিবরণ হইতে লিখিতেছি, ‘বানান সংস্কারের কাজটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্যোক্তা উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ প্রধান সমর্থক। দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি প্রধান অংশ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেন।’ (বঙ্গভাষা ও বঙ্গসংস্কৃতি, পৃ. ২৩)
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ও এই কাজে হাত দিয়াছিলেন। বাংলা একাডেমীর বিশেষজ্ঞগণ তাহা জানেন না এমন নহে। তাঁহারাই তো বলিয়াছেন ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পথিকৃতের কাজ। উঁহারা যাহা করিয়াছিলেন বাংলা একাডেমীও ভিন্ন কালে আধাভিন্ন এক দেশে এই কাজই করিতেছেন। উঁহাদের কাজ যদি ‘সংস্কার’ পদবাচ্য হইয়া থাকে, তো আপনাদের কাজ কেন সংস্কার বলিয়া গণ্য হইবে না? তাই বলিতেছিলাম বাংলা একাডেমীর ঘোষণা অকপট ভাষণের উদাহরণস্থল হয় নাই।
‘বানানের একটি রীতি নির্দিষ্ট করিয়া দিবার উদ্দেশ্যেই,’ বিজনবিহারী ভট্টাচার্য লিখিতেছেন, ‘বানান সংস্কার সমিতির প্রবর্তনা ঘটে।’ তিনি সমিতির কাজের ফিরিস্তি উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা হইতেই উদ্ধার করিয়াছেন:
‘বাংলা ভাষায় প্রচলিত শব্দসমূহের মধ্যে যেগুলি সংস্কৃত ভাষা হইতে অপরিবর্তিতভাবে আসিয়াছে তাহাদের বানান প্রায় সুনির্দিষ্ট। কিন্তু যে সকল শব্দ সংস্কৃত নহে, অর্থাৎ যেগুলি দেশজ বা অজ্ঞাতমূল, বিদেশাগত, অথবা সংস্কৃত বা বিদেশী শব্দের অপভ্রংশ, তাহাদের বানানে বহুস্থলে বিভিন্নতা দেখা যায়। ইহার ফলে লেখক, পাঠক, শিক্ষক ও ছাত্র— সকলকেই কিছু কিছু অসুবিধা ভোগ করিতে হয়। বাংলা বানানের একটা বহুজনগ্রাহ্য নিয়ম দশ-বিশ বৎসরের মধ্যে যে আপনা হইতেই গড়িয়া উঠিবে এমন লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। বাংলা ভাষার লেখকগণের মধ্যে যাঁহারা শীর্ষস্থানীয় তাঁহাদের সকলের বানানের রীতিও এক নহে। সুতরাং মহাজন-অনুসৃত পন্থা কোন্টি তাহা সাধারণের বুঝিবার উপায় নাই।’ (বঙ্গভাষা ও সংস্কৃতি, পৃ. ২৫)
শ্যামাপ্রসাদ এই কথাগুলি লিখিয়াছিলেন ১৯৩৬ সালের মে মাসে। পরের বছরের মাঝামাঝি (শ্রাবণ ১৩৪৪) রবীন্দ্রনাথও পত্রযোগে এই কথারই প্রতিধ্বনি করিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতে যে প্রস্তাবটি বানান-সমিতি স্থাপনের মূলে তাহা প্রধানত সংস্কৃত শব্দ লইয়া ব্যস্ত হইবার জন্য নহে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বিষয়টি এই রকম:
‘প্রাকৃত বাংলা যখন থেকেই সাহিত্যে প্রবেশ ও বিস্তার লাভ করল তখন থেকেই তার বানানসাম্য নির্দিষ্ট করে দেবার সমস্যা প্রবল হয়ে উঠেছে। প্রাকৃত বাংলার সংস্কৃত অংশের বানান সম্বন্ধে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নেই— যাঁরা সতর্ক হতে চান হাতের কাছে একটা নির্ভরযোগ্য অভিধান রাখলেই তাঁরা বিপদ এড়িয়ে চলতে পারেন। কিন্তু প্রাকৃত বাংলার প্রামাণ্য অভিধান এখনো হয় নি। কেননা, আজও তার প্রামাণিকতার প্রতিষ্ঠাই হতে পারে নি।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭৯)
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬-৩৭ সালে যে সমিতির মধ্যস্থতায় বানানের নতুন নিয়ম নির্ধারণ করেন তাহার নাম ‘বানান সংস্কার সমিতি’। ঢাকার বাংলা একাডেমী ১৯৮৮ সালে ‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ নামে আরেকটি পুঁথি প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইহার ১০৬ পাতা। পুঁথির ভূমিকায় লেখা হইল, ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানানের নিয়মাবলী প্রবর্তনের পর দীর্ঘকাল পার হয়ে গেছে। বানানের এই নিয়মাবলী নতুন করে প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তাও সকলে অনুভব করছেন।’ (পৃ. ১১)
চারি বৎসর পর বাংলা একাডেমীর নবগঠিত ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ বলিতেছেন তাঁহারা ‘বানান বা লিপির সংস্কারের প্রয়াস’ করেন নাই। যাহা করিয়াছেন তাহা ‘বানানকে নিয়মিত, অভিন্ন ও প্রমিত করার ব্যবস্থা’ মাত্র। ভাবিতেছিলাম এই কপট কমিটিকে বিশ্বাস করা যাইবে, না যাইবে না?
বাংলা একাডেমীর কপট ভাষণের আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। এইখানে মাত্র একটি দিলেই অন্যান্য উদাহরণের পথ পরিচ্ছন্ন হইবে। ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমীও বাংলা বানানের মাত্র তিনটি নিয়ম স্থির করিয়াছিলেন। একটি সংস্কৃত (বা ‘তৎসম’) শব্দ বিষয়ে। আরটি অসংস্কৃত (বা ‘তদ্ভব, দেশী, বিদেশী ও মিশ্র’) শব্দ বিষয়ে। শেষ নিয়মটির নাম ‘বিবিধ’।
সবশেষে ‘চলতি ভাষায় ক্রিয়াপদের কতকগুলি রূপ’ নামে একটি অধ্যায়ও যোগ করা হইয়াছিল। ২ নম্বর নিয়মের ছায়ায় ১৬ উপনিয়ম। ১ নম্বর উপনিয়মের অংশবিশেষ উদ্ধার করিব। এই উপনিয়মযোগে বলা হইয়াছে বাংলা ভাষায় ‘কি’ শব্দের বিকল্প ‘কী’ বলিয়া আরেকটা শব্দ সৃজন করিতে হইবে। সঙ্গে আদি ‘কি’ শব্দটিও থাকিবে। ব্যবহারভেদে বানানভেদের এই ব্যাকরণ অভিনব বটে।
‘সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন : কী করছ? কী পড়ো? কী খেলে? কী আর বলল? কী জানি? কী যে করি? তোমার কী? এটা কী বই? কী করে যাব? কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে। কী আনন্দ! কী দুরাশা!’
‘অন্য ক্ষেত্রে অব্যয় পদরূপে ই-কার দিয়ে কি শব্দটি লেখা হবে। যেমন : তুমিও কি যাবে? সে কি এসেছিল? কি বাংলা কি ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী।’ (২য় সংস্করণ, পৃ. ১০)
ওয়াকেবহাল ভাষা ব্যবসায়ী কি ব্যবহারকারী মাত্রেই জানেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ বলিয়া যাহা পরিচিত তাহার প্রথম ও চূড়ান্ত (অর্থাৎ তৃতীয়) কোন সংস্করণেই এই নিয়মটির কোন চিহ্ন নাই। রাজশেখর বসু সম্পাদিত ‘চলন্তিকা’ অভিধানের শেষে যাহা আধাআধি ছাপাইয়া রাখা হইয়াছে তাহা ১৯৩৭ সালের জুন মাসে প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণ বটে।
বলার হয়তো দরকারই নাই, রাজশেখর বসু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োজিত বানান সংস্কার সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করিয়াছিলেন। বাংলা একাডেমী ১৯৮৮ সালে ‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ নামা যে পুস্তিকা বাজারে ছাড়িয়াছিলেন তাহার শেষেও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানানের নিয়ম আধাআধি ছাপা আছে। যে কেহ ইচ্ছা হয় যাচাই করিয়া দেখিবেন। নেপাল মজুমদার সম্পাদিত ‘বানান বিতর্ক’ বইতে ভূমিকাসুদ্ধ তৃতীয় সংস্করণ আর মিতালী ভট্টাচার্যের বইতে ভূমিকাবাদে সব কয়টি সংস্করণই ছাপা আছে।
ইহাতে কি কিছু প্রমাণ হইতেছে? প্রমাণ হইতেছে যে বাংলা একাডেমীও বাংলা বানানের ‘সংস্কার’ করিতেছেন। একাডেমীর কপট বিশেষজ্ঞগণ লিখিয়াছিলেন, ‘বিশেষত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়মে বিকল্প ছিল কিছু বেশি। বিকল্প হয়তো একেবারে পরিহার করা যাবে না, কিন্তু যথাসাধ্য তা কমিয়ে আনা দরকার। এইসব কারণে বাংলা একাডেমী বাংলা বানানের বর্তমান নিয়ম নির্ধারণ করছে।’
‘কি’ ও ‘কী’ বানানের নিয়ম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তো আদপেই নির্ধারণ করেন নাই। অথচ বাংলা একাডেমীই এই বিকল্প বাড়াইতেছেন। সত্যের অনুরোধে বলিতে হইবে, বিশ্বভারতী নিয়মটির প্রস্তাব করিলেন। আর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বিচার করিয়া শেষে এই বিকল্প প্রত্যাখ্যানই করিয়াছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহিত ‘বাংলা বানানের নিয়ম,’ তৃতীয় সংস্করণে ইহার কোন সদ্ভাব নাই, অভাবই বরং প্রকট। কেননা দ্বিতীয় সংস্করণে এই প্রস্তাব ছাপাও হইয়াছিল। যদিও প্রথম সংস্করণে ইহা ছাপার হরফে হাজির হয় নাই। তিনটি সংস্করণ মিলাইয়া দেখিলে আমার কথার প্রমাণ পাইবেন।
প্রশ্ন উঠিবে, তাহা হইলে কি দায় পড়িয়াছে? বাংলা একাডেমী কেন এই লুকোচুরি খেলায় মাতিলেন? কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলা বানানের নিয়ম,’ দ্বিতীয় সংস্করণে (সেপ্টেম্বর ১৯৩৬) লিখিয়াছিলেন, “অব্যয় হইলে ‘কি’, সর্বনাম হইলে বিকল্পে ‘কী’ বা ‘কি’ হইবে, যথা: ‘তুমি কি যাইবে? তুমি কী (কি) খাইবে বল’।” (নিয়ম ৭)
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার সমিতি ইহার সপক্ষে একটা যুক্তিও পেশ করিলেন: ‘অর্থ প্রকাশের সুবিধার নিমিত্ত ‘কি’ ও ‘কী’র ভেদ বিকল্পে বিহিত হইল।’ বাংলা একাডেমী কোন যুক্তির অবকাশই রাখেন নাই।
উল্লেখ করা অপ্রয়োজনীয় হইলেও অপ্রাসঙ্গিক নহে, বানান সংস্কার সমিতি প্রকাশিত পত্রটির দ্বিতীয় সংস্করণের গোড়াতেই রবীন্দ্রনাথের হাতে জুড়িয়া দেওয়া হয়— ‘বাংলা বানান সম্বন্ধে যে নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন আমি তাহা পালন করিতে সম্মত আছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬।’ নিচে আরও ছাপা হয়— ‘শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১লা আশ্বিন, ১৩৪৩।’ (মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, বাংলা বানান, পৃ. ১৬)
দুর্ভাগ্যের মধ্যে, দ্বিতীয় সংস্করণই শেষ সংস্করণ হইল না। বাহির হইল তৃতীয় সংস্করণ। যথাসময়ে, ১৯৩৭ সালের জুন মাসে। এই সংস্করণে ‘কি’ শব্দের বিকল্পে ‘কী’ (বা কি) বিহিত হইল না। রবীন্দ্রনাথ সমর্থন প্রত্যাহার করিয়া লইলেন। প্রমাণের জন্য ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ দেখা যাইতে পারে। এই বই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করিলেও রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানবিধি প্রথম সুযোগে সমূহ লংঘন করিলেন। (মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, ‘বানান সংস্কারের চিন্তা অবান্তর নয়,’ পৃ. ৩৬০)
রবীন্দ্রনাথের গৌরবের প্রতি বানান সংস্কার সমিতির কোন পক্ষপাত ছিল না— এই কথা প্রমাণ করা শক্ত। তবু বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের কথার মধ্যেও বিষয়গৌরব কম নাই। তিনি দাবি করিয়াছেন, ‘যুক্তির প্রতি, বিচারবুদ্ধির প্রতি, ব্যবহারিক কর্মপদ্ধতির প্রতি তাঁহাদের দৃষ্টি ছিল।’(বঙ্গভাষা ও বঙ্গসংস্কৃতি, পৃ. ২৪)
বানান সংস্কার সমিতির পক্ষ লইয়া বিজনবিহারী যাহা লিখিয়াছেন তাহা আরও তুলিয়া দিতেছি:
‘বানান সংস্কার সমিতি স্বীয় দায়িত্বের গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন, নিজেদের শক্তি এবং অধিকারের সীমা সম্পর্কেও তাহারা অচেতন ছিলেন না। সমগ্র দেশের শিক্ষিত সমাজের সম্মিলিত প্রয়াসের উপরেই বানান সংস্কারের সাফল্য নির্ভর করে একথা তাঁহারা জানিতেন এবং সেইজন্য তাঁহাদের সহযোগিতা আমন্ত্রণ এবং গ্রহণ করিয়াই তাঁহারা কর্মারম্ভ করেন। বস্তুত লিখন পঠন অধ্যয়ন অধ্যাপন লইয়া যাঁহাদের দিন কাটে তাঁহাদের মতামতের উপর ভিত্তি করিয়াই বানান সমিতি তাঁহাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হইয়াছে এবং একাধিকবার পরিবর্তন হইয়াছে। ইহা হইতেই বুঝা যায় সংস্কার সমিতি খোলা মন লইয়া কাজে নামিয়াছিলেন।’ (বঙ্গভাষা ও বঙ্গসংস্কৃতি, পৃ. ২৪)
বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের কহতব্য সত্য বলিয়া ধরিয়া লই তো স্বীকার করিতেই হয় ব্যক্তিগৌরবের কথা ভাবিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত মাথা নত করিতে সম্মত হন নাই। কিন্তু এই এতগুলি বছর পর বাংলা একাডেমী ঠিক তাহাই করিলেন। কেননা বাংলা ‘কি’ শব্দের বিকল্পে ‘কী’ বিহিত করার বিধানের ভিত্তি একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগৌরব ছাড়া আর কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। পাঁচ বছর পর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিও একই সুরে গলা মিলাইলেন। বোঝা গেল শুদ্ধ ব্যাধি নয়, স্বাস্থ্যও সংক্রামক।
প্রাচীন বাংলা হইতে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা পর্যন্ত সমগ্র বাংলা সাহিত্য খুঁটিয়া খুঁটিয়া দেখিবেন, কোথাও অর্থ প্রকাশের সুবিধার নিমিত্ত ‘কী’ লেখা হয় নাই। চর্যাপদ ওরফে ‘বৌদ্ধগান ও দোঁহা’ নামে অভিহিত পুরাতন বাংলা কেতাবটিতে কোথাও ‘কী’ নাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ বইয়ের এক জায়গায় পাদটীকাযোগে হইয়াছে ‘পরে দেখা গেছে, কি এবং কী-এর বিশেষ প্রয়োগ পুরোনো বাংলা পুঁথিতেও প্রচলিত আছে।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯০)
মণীন্দ্রকুমার ঘোষ দাবি করিয়াছেন ‘কী’ নব্য বানান নহে। খাঁটি কথা। আমরা ঘোষ মহাশয়ের ঘোষণা মানিয়া লইতেছি: “প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ‘কী’ বানানের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বিদ্যাপতি-পদাবলীতে, গোবিন্দদাসের পদাবলীতে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, ময়নামতীর গানে, মহারাষ্ট্রপুরাণে, পদ্মাপুরাণে দীর্ঘ-ঈকারান্ত ‘কী’ শব্দের অজস্র প্রয়োগ আছে।” ঘোষ মহাশয়কে অগণিত ধন্যবাদ জানাই।
পরের বাক্যেই তিনি স্বীকার গিয়াছেন, “তবে একথা ঠিক যে প্রাচীন পদকর্তারা নির্বিচারে ‘কি’ ও ‘কী’ ব্যবহার করিয়াছেন। কোন প্রকার অর্থ-বৈলক্ষণ্য দেখান নাই। বর্তমান যুগে রবীন্দ্রনাথই অর্থ-পার্থক্য দেখাইয়া ‘কী’ বানান প্রচলন করিয়াছেন।” (বাংলা বানান, পৃ. ৭৯; মোটা হরফ আমাদের)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁহার আবিষ্কার-গৌরব হইতে বঞ্চিত করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যদি তাহা করিয়া থাকেন তাহার দায় সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই লওয়া উচিত। যে মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলা বানানের নিয়ম’, শেষ সংস্করণ, প্রকাশ করেন সেই মাসেই (জুলাই ১৯৩৭) কবি আলমোড়া হইতে জনৈক পত্র ব্যবহারকারীকে লিখিতেছেন, ‘তৎসম শব্দ সম্বন্ধে আমি নমস্যদের নমস্কার জানাব।’ অন্যান্য শব্দের বেলা তিনি হাত তুলিবেন না। ‘অভিমানি প্রভুর’ ভাষা চিরস্মরণীয়।
“কিন্তু তদ্ভব শব্দে অপণ্ডিতের অধিকারই প্রবল, অতএব এখানে আমার মতো মানুষের কথাও চলবে— কিছু কিছু চালাচ্ছিও। যেখানে মতে মিলছি নে সেখানে আমি নিরক্ষরদের সাক্ষ্য মানছি। কেননা, অক্ষরকৃত অসত্যভাষণের দ্বারা তাদের মন মোহগ্রস্ত হয় নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সমিতির চেয়েও তাদের কথার প্রামাণিকতা যে কম তা আমি বলব না— এমন-কি, হয়তো— থাক আর কাজ নেই।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭৭)
রবীন্দ্রনাথের এই ভিন্নমতের গোড়া অন্যান্যের মধ্যে তাঁহার প্রস্তাবিত ‘কী’ বানান গ্রহণ না করার কারণেও পোতা আছে। রবীন্দ্রনাথ এই বিকল্প বিধান— যতদূর খুঁজিয়া পাইতেছি— প্রথম প্রকাশ করেন বেনামে, বাংলা ১৩৩২ সালে। ঐ বছর অগ্রহায়ণ মাসে প্রসিদ্ধ ‘প্রবাসী’পত্রিকায় ‘চ’ল্তি ভাষার বানান’ নামে একটি নিবন্ধ ছাপা হইয়াছিল। বিজ্ঞ লেখকের নাম প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ইনি পরে অন্য কারণে আরও প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন।
ওই নিবন্ধের প্রস্তাবনাযোগে মহলানবিশ মহাশয় জানাইলেন, ‘কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থস্বত্ত্ব যখন বিশ্বভারতীর হাতে আসে, তখন বাঙ্লা বানান, বিশেষত ‘চ’ল্তি ভাষার বানান-সম্বন্ধে একটি সাধারণ রীতি অবলম্বন করবার কথা হয়। এ কাজের প্রধান কর্ত্তা শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এমএ. ডিলিট্, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খয়রা ভাষাতত্ত্ব-অধ্যাপক। শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিএ. (প্রবাসীর ভূতপূর্ব্ব সম্পাদক), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙ্লার অধ্যাপক, এ কাজে সাহায্য ক’রেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে সাধারণভাবে এই পদ্ধতিটিকে অনুমোদন ক’রে দিয়েছেন।’ (‘চ’ল্তি ভাষার বানান,’ পৃ. ৩০১)
এই বাক্যের ইংরেজি কায়দা কাহারও চোখ এড়াইবে না। চোখ এড়াইবে না খোদ ‘চ’ল্তি শব্দেরই কষ্টকর বানান। তুলনা করিলে মজাও পাইবেন। বিশ্বভারতীর প্রচারপত্রের নাম ‘চ’ল্তি ভাষার বানান’, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুস্তিকায় তাহা সহজ হইয়াছে— ‘বাংলা বানানের নিয়ম’। অথচ ঢাকার বাংলা একাডেমী নতুন একটা শব্দ আদেশ করিয়া নিজ পত্রের নামে জুড়িয়া দিলেন, ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’। ‘প্রমিত’শব্দটি অচলতি। প্রমাণের জন্য বাংলা একাডেমীর ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ই যথেষ্ট। ওই অভিধানে উদাহরণ হিসাবে দুইটি বাক্য দেখানো হইয়াছে। এই দুই বাক্যেই ‘প্রমিত’ শব্দ সরাসরি ব্যবহার করা হয় নাই। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত হইতে, ‘প্রতর্ক আর প্রমিতির মধ্যে প্রভেদ থাকে না’আর জীবনানন্দ দাশ হইতে, ‘এয়ারোপ্লেনের চেয়ে প্রমিতিতে নিটোল সারস’— দুই বাক্যেই নাক বরাবর ‘প্রমিত’ শব্দ নাই। কান টানিয়া আনা হইয়াছে ‘প্রমিতি’কে। প্রশ্ন হইতেছে, এই অচলিত সংস্কৃত শব্দ টানিয়া আনিবার কি এমন প্রয়োজন পড়িয়াছিল? শুদ্ধ মনীষার দৈন্য দিয়া এই গ্লানির পুরা ব্যাখ্যা হইবে না।
শিখণ্ডী প্রশান্তচন্দ্রের আধবাংলা প্রবন্ধে পায়ে পায়ে টীকা দিয়া জানাইয়া দেওয়া হয়, ‘এখন থেকে বিশ্বভারতী কর্ত্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের সমস্ত লেখা এই পদ্ধতি অনুসারে ছাপা হবে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ও এই রীতিটিকে অনুমোদন ক’রেছেন।’ (‘চ’ল্তি ভাষার বানান’, পৃ. ৩১০)
বলা বাহুল্য সাধারণের কাছে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের স্বাক্ষরে ছাড়া পাওয়া এই নিবন্ধই বিশ্বভারতী প্রস্তাবিত বানানবিধি বলিয়া পরিচিত। বাংলা একাডেমী প্রশান্তচন্দ্রের নাম, প্রস্তাবনা ও মূলসূত্র— এই তিন তিনটি গৌরবপূর্ণ অধ্যায় এবং ‘নিয়মাবলী’ অধ্যায়ের শিরোনাম পর্যন্ত লুকাইয়া ছাপাইয়া বাকি অংশ ছাপার অক্ষরে পুনঃপ্রকাশ করিলেন তাঁহাদের ‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ পুস্তিকার পরিশিষ্ট আকারে। আর মহলানবিশের ভূমিকাংশ ঢাকার পণ্ডিতরা নিজেদের নামেই চালাইয়া দিয়াছিলেন। সাধুতে সাধুতেই তো মাসতুতো বেরাদর, সংশয় কোথায়!
সব মিলাইয়া বিশ্বভারতীর মোট ১১টি নিয়ম। ৬ নিয়মের ২ উপনিয়ম এই: “সাধুভাষা ও ‘চ’ল্তি ভাষা দুয়েতেই প্রশ্নসূচক অব্যয় কি [হ্রস্ব] ই-কার দিয়ে লেখা হবে। নির্দ্দেশক সর্ব্বনাম ‘কী’ [দীর্ঘ] ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন: তুমি কি খাবে? [অব্যয়], তুমি কী খাবে? [সর্ব্বনাম], তুমি কী কী খাবে [সর্ব্বনাম]।” [‘চ’ল্তি ভাষার বানান’, পৃ. ৩০৯] এই জায়গায় একটা পায়ে টীকা ফুটাইয়া জানান হইয়াছিল, “পুরানো বাঙ্লা পুঁথীতে ‘কী’বানান অনেক জায়গায় পাওয়া যায়।” [‘চ’ল্তি ভাষার বানান’, পৃ. ৩১০]
দেখা যাইতেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩২ সালেই [ইংরেজি ১৯২৫] জানিতেন “পুরানো বাঙ্লা পুঁথীতে ‘কী’বানান অনেক জায়গায়”পাওয়া যাইত। ১৯৩৭ সালের [বাংলা ১৩৪৪] চিঠিতে সেই প্রশ্নের উদয় হইলেও তিনি কোন জায়গায় তাহা উল্লেখ করেন নাই। ইহা নিতান্ত বাহিরের কথা।
ভিতরের কথা একটাই। পুরানা পুঁথিতে লোকে ‘কি’ লিখিতে ‘কী’ লিখিতেই পারে। সেখানে অর্থের পার্থক্য বা অর্থ-বৈলক্ষণ্য দেখানো হয় নাই। ‘কী’ রবীন্দ্রনাথেরই আবিষ্কার। মণীন্দ্রকুমার ঘোষের এই ঘোষণাই এই বিষয়ে শেষ কথা।
আমাদেরও যোগ করিবার মতন এক ফোটা শিশির আছে। পরাধীন যুগের বাংলা সাহিত্যের কোথাও আপনি একটা ‘কি’ শব্দও খুঁজিয়া পাইবেন না যাহার বানান ‘কী’। কি প্যারীচাঁদ মিত্র, কি কালীপ্রসন্ন সিংহ, কি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাঁহারও রচনায় আপনি একটিও ‘কী’ বানান পাইবেন না। অথচ হেন অর্থ নাই, কি সর্বনাম, কি অব্যয়, কি ক্রিয়া-বিশেষণ, কি শুদ্ধ বিশেষণ সমস্ত ব্যবহারেই ‘কি’ চালাইয়া আসিয়াছেন ইঁহারা। অর্থ প্রকাশে কোথাও তো কোন ব্যাঘাত হইয়াছে বলিয়া আমাদের মনে হয় নাই।
আমি রাজা রাজমোহন রায় আর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলীর সবটুকু না হইলেও কিছু বড় অংশই পরখ করিয়া দেখিলাম, কোথাও একটা ‘কী’ পাইলাম না। শুদ্ধ একটা ‘কী’ পাইলাম দীনবন্ধু মিত্রের রচনাবলীতে। তাহাও জোর দিবার জন্য— সর্বনাম কি বিশেষণ কি ক্রিয়া-বিশেষণ ফলাইবার জন্য নহে।
আমার স্থানাভাব। তাই অগত্যা মধুসূদন হইতেই একটি স্থান তুলিয়া লইতেছি। রবীন্দ্রনাথের নামে কি অনর্থই না বাধাইতেছেন আমাদের মনীষী ও বিশেষজ্ঞ মহাশয়েরা!
নিশার স্বপনসম তোর এ বারতা
রে দূত! অমরবৃন্দ যার ভূজবলে
কাতর, সে ধনুর্ধরে রাঘব ভিখারী
বধিল সম্মুখ রণে? ফুলদল দিয়া
কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?—
হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি!
কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?
কি পাপ দেখিয়া মোর হে দারুণ বিধি,
হরিলি এধন তুই? হায় রে, কেমনে
সহি এ যাতনা আমি?...
...হায়, সূর্পনখা
কি কুক্ষণে দেখেছিলি তুই রে অভাগী
কাল পঞ্চবটীবনে কালকূটে ভরা
এ ভূজগে? কি কুক্ষণে (তোর দুঃখে দুঃখী)
পাবক-শিখা-রূপিনী জানকীরে আমি
আনিনু এই হৈম গেহে? ...
—(মেঘনাদবধ কাব্য, প্রথম সর্গ, প. ৮০-৮৮, ৯৯-১০৫)
ব্যাকরণ প্রণেতাদের মধ্যে দেখিবেন রাজা রামমোহন রায় ‘কী’ বলিয়া কোন শব্দ আমলই করেন নাই। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কিম্বা মুহম্মদ এনামুল হকের ব্যাকরণেও ইহার ব্যবহার নাই। পণ্ডিত হরনাথ ঘোষ ও সুকুমার সেনের ‘বাঙ্লা ভাষার ব্যাকরণ’ বইতে শুদ্ধ এক জায়গায় ‘কী’ শব্দের ব্যবহার দেখানো হইয়াছে নিছক বিকল্প আকারে। যথা; ‘তুমি কি (বা কী) বই পড়িতেছ বল।’ (পৃ. ২৭৭) পুরানা ব্যাকরণ প্রণেতাদের লেখা আরও দেখিতে হইবে। উনিশ শতকের একখানি বহুল প্রচারিত ব্যাকরণের লেখক জগদ্বন্ধু মোদক। তাঁহার বইয়ের ঊনবিংশ সংস্করণ দেখিলাম। না, কোথাও ‘কী’ নাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক ব্যাকরণ প্রণেতা যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি শুদ্ধ এক কারণে ‘কী’ লেখা যায় বলিয়া রায় করিয়াছেন। তাহা হইতেছে ‘ক্রোধে’ ও ‘ক্ষোভে’-যেমন: ‘কী, —কী এত আস্পর্ধা!’ (বাঙ্গালা ভাষা, প্রথম ভাগ [ব্যাকরণ], পৃ. ২৩৮)
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োজিত বানান সংস্কার সমিতি ও পরিভাষা সমিতি দুইটারই সভাপতি ছিলেন রাজশেখর বসু। তাঁহার সম্পাদিত ‘চলন্তিকা’য় ‘কী’ শব্দ যেখানে আছে সেখানে বলা হইয়াছে ‘কি দেখ’। ‘কি’ স্থানে কি বস্তু আছে?
আছে, ‘কি’ শব্দটি ‘কিম্’ হইতে আসিয়াছে। ইহা জাতে অব্যয়, ব্যবহৃত হয় ‘সংশয়সূচক প্রশ্নে’। যথা: ‘তুমি কি যাবে?’। ব্যবহৃত হয় ‘কিংবা’ [সমুচ্চয় সর্বনাম] অর্থে। যথা: ‘কি ধনী কি নির্ধন’। শব্দটি বিশেষণ বা ক্রিয়া-বিশেষণ আকারে ‘কোন্’, ‘কেমন’ বা ‘কত’ এই অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন: ‘কি জিনিস, কি করিয়া। কিজন্য, কিরূপ, কিহেতু। কি বুদ্ধি! কি ভয়ানক!’
‘কি’ ব্যবহৃত হয় সর্বনাম হিসাবেও, বিশেষত কোন্ বস্তু বা বিষয় অর্থে। যথা ‘কি চাই বল।’ অথবা ‘বল কি!’
ইহার আরও এক অর্থ— ‘কিছু নাই বা কিছু নয়’। যথা: ‘তাতে আর সন্দেহ কি। কি জানি। বেল পাকলে কাগের কি।’
চলন্তিকায় পরিশেষে ‘কী’শব্দ স্বীকার করা হইয়াছে: “বেশী জোর দিতে, যথা— ‘কী সুন্দর!’ ‘তোমার কী হয়েছে?’ ” মণীন্দ্রকুমার ঘোষ বলিতেছেন, ‘বেশী জোর দিতে দীর্ঘ-ঈকার’এই যুক্তি তাঁহার মনঃপূত হইতেছে না। তাঁহার মত এই যে জোর দেওয়ার জন্য বানান-পরিবর্তনের প্রয়োজন নাই। মণীন্দ্রকুমারের কহতব্য আমারও মনে ধরিয়াছে। তিনি লিখিয়াছেন:
“মৌখিক ভাষায় আমরা শুধু ‘কি’ শব্দের উপরই জোর দিই না, অন্যান্য শব্দের উপরও জোর দিয়া থাকি। কিন্তু সেজন্য লৈখিক ভাষায় এ সমস্ত শব্দের বানান-পরিবর্তন আবশ্যক হয় না, কেবল ‘কি’ শব্দের বেলাই বানান-পরিবর্তন হইবে কেন? ‘তুমি খেয়েছ কিনা’, এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে আমরা বলি ‘তুমি কি খেয়েছ?’—জোর দেওয়া হয় ‘খেয়েছ’ শব্দের উপর। কিন্তু যদি উত্তর না দেও, কিংবা উত্তর দিতে বিলম্ব কর, তখন বিরক্ত হইয়া একই প্রশ্ন একটু পাল্টাইয়া বলি ‘তুমি খেয়েছ কি?’—এবার জোর পড়িতেছে ‘কি’ শব্দের উপর। এইজন্য যদি ‘কি’ শব্দের বানান বদলাইতে হয়, তাহা হইলে ‘তুমি’শব্দের উপর জোর দিলে ‘তুমি’ শব্দেরও বানান বদলাইতে হয়।” (বাংলা বানান, পৃ. ৮০)
মণীন্দ্রকুমার ঘোষের এই যুক্তি টেকসই বলিয়াই মনে হইতেছে। কিন্তু খটকাটি অন্য জায়গায়। তিনিও রবীন্দ্রনাথের পথ ধরিয়া আনমনে বলিতেছেন, ‘কিন্তু অর্থভেদে বানান-পরিবর্তন আবশ্যক।’তিনি অগত্যা রবীন্দ্রনাথের দোহাই দিয়াছেন:
“প্রশ্নসূচক অব্যয় ‘কি’এবং প্রশ্নসূচক সর্বনাম ‘কি’উভয়ের কি এক বানান থাকা উচিত? আমার মতে বানানের ভেদ থাকা আবশ্যক। একটাতে হ্রস্ব-ই ও অন্যটাতে দীর্ঘ-ঈ দিলে উভয়ের ভিন্ন জাতি এবং ভিন্ন অর্থ বোঝার সুবিধা হয়। ‘তুমি কি রাঁধছ’, ‘তুমি কী রাঁধছ’— বলা বাহুল্য এ দুটো বাক্যের ব্যঞ্জনা স্বতন্ত্র। তুমি রাঁধছ কিনা, এবং তুমি কোন্ জিনিস রাঁধছ, এ দুটো প্রশ্ন একই নয়, অথচ এক বানানে দুই প্রয়োজন সারতে গেলে বানানের খরচ বাঁচিয়ে প্রয়োজনের বিঘ্ন ঘটানো হবে।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯০)
বলা প্রয়োজন, উপরের উদ্ধৃতিটিও এক চিঠিরই অংশ। একই যুক্তি রবীন্দ্রনাথ আরেক চিঠিতেও লিখিয়াছিলেন:
“আমার বক্তব্য এই যে, অব্যয় শব্দ ‘কি’এবং সর্বনাম শব্দ ‘কী’এই দুইটি শব্দের সার্থকতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাদের ভিন্ন বানান না থাকলে অনেক স্থলেই অর্থ বুঝতে বাধা ঘটে। এমন-কি, প্রসঙ্গ বিচার করেও বাধা দূর হয় না। ‘তুমি কি জানো সে আমার কত প্রিয়’আর ‘তুমি কী জানো সে আমার কত প্রিয়’, এই দুই বাক্যের একটাতে জানা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হচ্ছে আর একটাতে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে জানার প্রকৃতি বা পরিণাম সম্বন্ধে, এখানে বানানের তফাত না থাকলে ভাবের তফাত নিশ্চিতরূপে আন্দাজ করা যায় না।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮৪-৫)
অতয়েব রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত হইতেছে, ‘কি’শব্দটি অব্যয়রূপে প্রয়োগ করা হইলে বানান হইবে ‘কি, সর্বনাম বা সর্বনামজাত বিশেষণরূপে প্রয়োগ করা হইলে বানান হইবে ‘কী’। অন্তত মণীন্দ্রকুমার ঘোষ এই সিদ্ধান্তে স্থির হইয়াছেন।
আমরা কি রবীন্দ্রনাথ কি মণীন্দ্রনাথ কাঁহারও সহিত ভাব করিব না। তাঁহাদের কাঁহারও সহিত আমাদের বনিতেছে না। আমরা বলিব অর্থব্যক্তির জন্য শব্দের বানান পরিবর্তন করিবার কোন নিয়ম বাংলা ভাষায় নাই। রবীন্দ্রনাথ যাহা প্রস্তাব করিয়াছিলেন তাহা নিয়ম নহে, নিয়মের যম মাত্র। রামমোহন এই জাতীয় অন্য আচারের বেলা বলিয়াছিলেন ‘নিয়মের ব্যভিচার’। (গৌড়ীয় ব্যাকরণ, পৃ. ৫০)
(চলবে)
( লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০১০ সালের ১৫ মে, নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত ‘নতুনধারা’ সাময়িকী পত্রিকার সপ্তম সংখ্যায়। এখানে ওইসময়কার বানানই অবিকৃত রাখা হয়েছে।– ফিচার সম্পাদক)