আমাদের অলৌকিক নক্ষত্র
লৌকিক বিচারে— জগৎ সংসারে ব্যক্তির বয়স হইতেছে তাহার জীবনের বিয়োগ ফল। মানে যাহা তিনি জীবন সাঁতরাইয়া পার করিয়া আসিয়াছেন তাহারই বর্গমূল। হিসাব করিয়া বলা যায়, ব্যক্তির আয়ু তাহার জীবনের সমান। বেশিও নহে, আবার কমও নহে। কিন্তু ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যখন বয়স ছাপাইয়া যায় অলৌকিক জগতে তাহাকে দীর্ঘায়ু বলা হয়। দীর্ঘ আয়ুর লৌকিক জগৎ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব আকারে সাব্যস্ত করিয়াছে। চীনা দার্শনিক লাওৎসেও ইহার কাছাকাছি কিছু বলিয়াছেন। লাওৎসের কথায় দুঃখ আমাদের গ্রাস করিতে পারে। জগতের নিত্য-অনিত্যের কালে বাংলার ভাবুক সলিমুল্লাহ খানের বয়স ৬০ বছর গড়াইয়াছে, ভাবিলে আমার ভয় হয়। ২০১৮ সালে ১৮ আগস্ট ৬০ বছর গড়াইবে। মনে হয় তাহার বয়স ১৬ হইলে নির্ভাবনায় আনন্দ জাগিত। আমাদের দুঃখের কারণ জীবনের বিয়োগ ফল, আর আনন্দের কারণ তাহার শুভ জন্মতিথি। জীবনের এমন নিয়ম মানিয়া লইতে মানুষ বাধ্য। আমরাও মানিয়া লইলাম। তবে মানুষ তাহার বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা দিয়া তাহার বয়স অতিক্রম করে। সুখের খবর এই— সলিমুল্লাহ খানও তাহার বয়স অতিক্রম করিয়াছেন। কীভাবে?
আমাদের কিশোর বয়সে সলিমুল্লাহ খানের নামের খ্যাতি চাটগাঁ শহরে শুনিয়াছি। প্রথমত, প্রতিভাবান ছাত্র হিসাবে, দ্বিতীয়ত প্রাক্সিস জার্নালের সম্পাদক হিসাবে, তৃতীয়ত কক্সবাজারের শ্রমিক আন্দোলনের কারণে। প্রথম পদেও খ্যাতি তাহার আনুষ্ঠানিক বিদ্যায় শীর্ষচূড়ায় অধিষ্ঠান। দ্বিতীয় পদের খ্যাতি তাহার তত্ত্ববাগীশ বলিয়া। মজার ঘটনা বলি— আশির দশকে স্বৈরাচারি কবি এরশাদ শাহী ক্ষমতা হইতে নামি নামি করিতেছেন। সেই সময় চাটগাঁ শহরের জাতীয় এক ছাত্রনেতার সহিত আড্ডা মারিবার অবসর পাইয়াছিলাম। আড্ডায় নানাসঙ্গের সহিত প্রাক্সিস জার্নালের কথা উঠিয়াছিল। তাহাকে জিজ্ঞাসিলাম— প্রাক্সিসের সলিমুল্লাহ খানকে চিনিতেন কি না? নানাচ্ছলে ছাত্রনেতা বলিয়াছিলেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সমীহের পাত্র ছিলেন। খান হলের যে রুমে বাস করিতেন, তাহার সামনে দিয়া হাঁটিবার সময় পায়ে বিশেষ শব্দ করিতেন না। টিপিয়া টিপিয়া হাঁটিতেন। কারণ বিশেষ শব্দ ফুটিলে খানের পড়ার ব্যাঘাত ঘটিবে কি না! তৃতীয় পদের খ্যাতি খেটে খাওয়া মানুষের আন্দোলনে সামিল হইবার কারণে। বিশেষ করিয়া কক্সবাজারের লবণ শ্রমিক ও পান চাষীদের আন্দোলনের কথা উঠিলে সলিমুল্লাহ খানের নাম অনেক কমিউনিস্ট কর্মীর মুখে শুনিয়াছি। সর্ব পদের বাহিরে আমরা সলিমুল্লাহ খানকে কবি বলিয়া জানিতাম। তাহার একপ্রস্থ কবিতার বইয়ের নাম ‘এক আকাশের স্বপ্ন’। এই বই লইয়া এককাণ্ড ঘটিয়াছিল। তাহা মনে হইলে আনন্দ আনন্দ লাগে। আনন্দ মানে কী?
‘এক আকাশের স্বপ্ন’ বইখানা আমি কিনিয়াছিলাম নাম মাত্র দামে। বিখ্যাত অমর বইঘর হইতে। যেদিন কিনিয়াছিলাম সেদিন পড়ন্ত বিকেলে আমাদের বোহেমিয়ান জাঁদরেল কবি আবদেল মাননানের সহিত দেখা। মাননান ভাই আমাকে খুব স্নেহ করিতেন। মাঝে মাঝে তাহার সহিত চাটগাঁর ডিসি হিলের চূড়ায় উঠিয়া আকাশ দেখিতাম। পাহাড়ি শহরকে মনে হতো সবুজ শোভিত টিলার সমাহার। দুনিয়ায় এত্ত সুন্দর আবহ আর কোথাও নাই! যাগ গে! সেদিন এই বই লইয়া আমি ও মাননান ভাই ডিসি হিলের মাথায় উঠি। বায়ু সেবন করিতে করিতে তিনি বলিলেন, এই বই পড়ছ নাকি? বলিলাম, ‘পড়ি নাই, কিনিলাম মাত্র।’ ফাঁকে মাননান ভাই হঠাৎ ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে’ রবীন্দ্র সঙ্গীত গাহিয়া উঠিলেন। গান শেষে তাহাকে জিজ্ঞাসিলাম, ‘আপনি পড়েছেন নাকি?’ তিনি উত্তর দিলেন বাঁকা, ‘সত্তরের বাঙালি কবিদের কাঁধের ওপর শামসুর রাহমান ভর করে বসে আছেন।’ বলিলাম, ‘জনমানসে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব এড়াবেন কীভাবে?’ বলিলেন, ‘বাস্তবের আকাশ আর স্বপ্নের আকাশের ফারাক অনেক।’ গোধূলী সন্ধ্যায় তিনি আরও বলিয়াছিলেন: ‘দেখ, বাস্তবের আকাশ কত লাল! স্বপ্নের চেয়ে বাস্তব অনেক কাছাকাছি।’ মৃদুমন্দ বাৎচিতে সেদিনের আকাশ আমাদের স্বপ্নেই ঠেকিয়াছিল!
সলিমুল্লাহ খান কবি। কিন্তু জীবন ভর কবিতা না রচিয়া তিনি নিজের উপর খানিক অবিচার করিয়াছেন। তবে কদাচিৎ কদাচিৎ লিখিয়াছেন। কোনো কোনো কবিকে দেখিয়াছি তাহার কবিতা মুখস্ত আওড়াইতে। এক আকাশের স্বপ্ন হইতে মাটিতে নামিবার পর তিনি বেশ কিছু ভাল কবিতা লিখিয়াছেন। কেন যে তাহা কিতাব মোড়ানো হয় নাই আল্লামালুম। কেহ কেহ বলেন, তিনি ব্যর্থ কবি! যাহা তিনি মনোনিবেশ করেন নাই তাহাতে ব্যর্থতা খোঁজা হাস্যকর বটে! তবে এও সত্য— জগৎ সংসারে কবি বাঁচিয়া থাকেন ‘এক শব্দে’ কিংবা ‘একবাক্যে’ নয়তো গোটা ভাবের অর্থ ধরে। সেই বেলায়— ভাষার ভেতর অর্থের রূপান্তরও একজন কবিকে জাগাইয়ে রাখিতে পারে।
সলিমুল্লাহ খানের নিবিড় পাঠক যাহারা তাহারা হয়ত এহেন রূপান্তর পরখ করিতে পারেন। আমরা দুয়ছত্র ইশারা করিব মাত্র। তাহার প্রথম দিককার রচনা ‘এক আকাশের স্বপ্ন’ আর ‘জাতীয় অবস্থার চালচিত্রে’ ভাষার গঠন একই সুরের। পদ্যে আর গদ্যে প্রমিত ভাষারই গাঁথুনি। তবে তাহার ভাষার বদল ঘটিয়াছে নব্বই দশকে। বিশেষত ডরোথি জুল্লের কবিতার অনুবাদ বইয়ের ভেতর দিয়া। গুরুচণ্ডালি ভাষার ভেতর দিয়া তিনি সাধু ভাষায় পৌঁছিয়াছেন। ‘আল্লার বাদশাহি’ হইতে ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’ বই পরখ করিলে তাহা টের পাওয়া যাইবে। অতিরিক্তের নিক্তিতে বলিলে আদতে কবিতাই তাহার ভাষা বদলের চাবিকাঠি। ফলে তিনি কবিই রহিয়া গিয়াছেন।
প্রশ্ন জাগিতে সলিমুল্লাহ খানের সাধু বাংলা কেমন? কেহ বলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়ের নব সংস্করণ, কেহ বলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আধুনিক রূপ, কেহ বলেন দীনেশচন্দ্র সেনকে ভাঙাইয়া যাইতেছেন। নানা সমালোচনা বাজারে বলবৎ। ইতিহাস পরখ করিলে দেখা যাইবে তিন মহাশয়দের গদ্য আদতে বাংলা গদ্যের গঠন কাল। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যের চালিয়াতিতে সংস্কৃত ভাষাকে যেই রূপ আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিলেন, তাহাতে খানিক তফাৎ ছিলেন শাস্ত্রী আর সেন মহাশয়। ভাষাশাস্ত্রের বিচারে অপর দুইজন অনেক গণতান্ত্রিক ছিলেন। সেই তরফে সলিমুল্লাহ খানের গদ্য ভাষা তাহাদেরই উত্তরাধিকার বটে। কিন্তু খানের বিশেষত্ব কী? খানের গদ্য গুরুচাড়ালি মিশ্রিত সাধুভাষার নতুন রূপ বটে। শাস্ত্রী আর সেনের ভাষার চাহিতে খানের ভাষায় কাব্যিকতা অল্প বেশিই বলা যায়। এই কাব্যিকতা তাহার ভাষাকে নতুন রূপের আবির্ভাব দিয়াছে। আমাদের কলিযুগ প্রমিত ভাষার যুগ। বাংলাদেশের সংবিধান ছাড়া আর কোথাও সাধু ভাষার চর্চা দেখা যায় না। খান এইখানে ভাষার ব্যতিক্রম। মুখের ভাষা আর লেখার ভাষা ফারাক মানিয়া লইলে পূর্ববাংলায় কবি জসীমউদদীনের পর তিনি সাধু ভাষার চল বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন।
বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ খুব বিস্তৃত নহে। হাতে গোণা যে জনা কয় বুদ্ধিজীবীর নানা আসরে দেখা মিলিয়া থাকে সলিমুল্লাহ খান তাহাদের প্রথম সারির একজন। অসামান্য পণ্ডিত তো বটে, বাগ্মী শিক্ষক হিসাবেও সমান সমাদৃত তিনি। এমন কি তাহার কট্টর সমালোচকগণও তাহা একবাক্যে মানিয়া লয়েন। বাংলা চিন্তার জগতে তিনি প্রধানত তিনজনের চিন্তাকে সামনে আনিয়াছেন। প্রথমত জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ‘বাংলাদেশ : স্টেট অব দ্য নেশন’ ওরফে ‘বাংলাদেশ : জাতির অবস্থা’ কিতাবের সমালোচনা, দ্বিতীয়ত আর আহমদ ছফার উপন্যাস বিচার ‘ছফামৃত’ আর ফরাসি দার্শনিক জাক লাকাঁর তত্ত্ববোধিনী। গেল দশকে খানের গঠিত ‘জাক লাকাঁ বিদ্যালয়’ তরুণদের ভিতর বেশ সাড়া জাগানো দর্শন চর্চার পাটাতনে পরিণত হয়। মূলত তিনি ফ্রয়েডিয়ান দার্শনিক লাকাঁর গঠনতন্ত্রেও বাংলা তত্ত্বকার। বলা যায়, সক্রাতেস, রেনে দেকার্তে, ইমানুয়েল কান্ট, ভিলহেম হেগেল, কার্ল মার্কস, বেনেডিক্ট স্পিনোজা, ফ্রানৎস ফানোঁ, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, তালাল আসাদসহ দর্শনের নানা খুঁটিনাটি তাঁর দর্শন সভায় আলোচিত হইয়াছে।
প্রশ্ন উঠিতে পারে— বুদ্ধিজীবী হিসাবে সলিমুল্লাহ খান কোন পদের? একবার এক পাটাতনে বলিয়াছিলাম, তিনি লাকাঁনিয়ান মার্কসিস্ট। তাহাতে কেহ কেহ বাঁধ সাধিয়া ছিলেন। সেই এখন পাথর বাটি! কেননা মুক্ত চিন্তা বলিয়া জগতে কিছু নাই। চিন্তা পদে পদে মিলিয়া মিলিয়া গেলে পদার্থ হইয়া ওঠে। এমন কি আদি সক্রাতেসের চিন্তাকে একমুঠো করিলে প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রের সমাজ, সংস্কৃতি আর রাষ্ট্র ব্যবস্থারই আমূল বদলে দেয়া চিন্তা হিসাবে জায়মান হইয়াছে। চিন্তা এক ভাষা হইতে অপর ভাষায় প্রতিস্থাপিত হয়। নব রূপ লয়। সেই বাবদে তিনি তত্ত্বের সহিত ইতিহাসের মিলন ঘটান। বাস্তব দশা হইতে সত্যেরই তালাশ করেন। অন্তত তাহার বইমালা সেইদিকের ইশারা দেয়।
বাংলায় জাতি শব্দের অর্থ জন্ম। আজ বাঙালি জাতি আর বাংলা ভাষা সলিমুল্লাহ খানের জন্মদিনে গৌরব বোধ করিবে নিশ্চয়ই। মনে রাখিতে হইবে চিন্তার গৌরব মানে জাতির গৌরব। চিন্তা দিয়াই জাতি কিংবা সমাজ বাঁচিয়া থাকে। সমাজ সৌন্দর্যের দীর্ঘ প্রতিফলক তো জ্ঞানই। জ্ঞানের প্রতীক হইয়া তিনি আরো দীর্ঘজীবী হউন। অলৌকিক নক্ষত্রের দূর আলোকবর্তিকায় দাঁড়াইয়া তিনি প্রকাশিত হউন। আশাই আমাদের ভরসা। আমেন।