মিলু শামসের একগুচ্ছ কবিতা
বৃক্ষরোপণ অভিযান
ভবিষ্যতে ‘গাড়ি ঘোড়া’ চড়ার
স্বপ্নময় পাঠ-প্রস্তুতি নেয়ার কালে
প্রায়ই বৃক্ষরোপণ অভিযান হত
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
স্কুল মাঠের মাঝ বরাবর আম্রবৃক্ষ তলে
সবাইকে জড়ো করে একসঙ্গে
হেডস্যার বলতেন,
যতো বেশি বৃক্ষ রোপণ করবে
ততোই বিশুদ্ধ অক্সিজেনময় ধরণী পাবে।
তারপর আওড়াতেন চেনা সেই বচন—
‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’
বর্ষা মওসুমে শুরু হতো অভিযান—
বনে বাদাড়ে ঘুরে
শিরীষ তেঁতুল কৃষ্ণচূড়া জারুল
আর শাল সেগুন কড়াই, এমনকি
আশশ্যাওড়ার চারা তুলে এনে
সবুজে ভরানো হত বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ।
দিনকয় চলতো নিবিড় পরিচর্যা—
মাটি আল্গা করে নিয়মিত পানি দেয়া
জৈব সার দিয়ে কঞ্চির ঠেকনা
চতুষ্পদীর লোভাতুর দৃষ্টি থেকে
সজাগ পাহাড়ায় রাখা;
তখন জানা ছিল না
রোপণ অভিযান ছিল আসলে এক
সফল প্রকল্পের নাম
যা থেকে চারারা বৃক্ষে পরিণত হয় না কোনদিন
কোনদিন ফোটে না ফুল তাতে
হয়না ফলবতী।
বুঝিনি, মূল থেকে তুলে এনে চারা
আঙিনা ভরানো গেলেও,
বাহবা পেলেও প্রচুর স্যারদের থেকে
শেকড় ওপড়ানো গাছ কিছুতেই মেশে না
নতুন মাটি ও শেকড়ে।
বর্ষা ফুরলে প্রায়ই শেষ হত
বৃক্ষ রোপণ অভিযান; তারপর
কেউ আর আগ্রহ দেখাতো না
কোন গাছ গেল কোথায়, কার হল কি পরিণতি
খণ্ডকালীন বৃক্ষ চাষের ওখানেই হত অবসান।
স্কুল মাঠের আম্র বৃক্ষ তলায়
জড়ো হওয়া
কিশোর কূলও আজন্ম রয়ে যায় সে রকম—
খণ্ডকালীন কিংবা মওসুমী মানুষ
কেননা বৃক্ষ রোপণ অভিযানটিই ছিল ভুল।
পায়ে পায়ে পঞ্চাশ
আটচল্লিশ কিংবা পঞ্চাশেও প্রৌঢ় হয় না
আজকাল কেউ
বরং গন্তব্য নিশ্চিত করে
সুস্থির করে পথ চলা
তুমি কোন পথে হাঁটছ হে?
এতোটা পথ পেরিয়ে এলে টালমাটাল
এ বয়সেও ঠিক করতে পারলে না গন্তব্য।
উন্মুক্ত আকাশের নিচে বাঁ দিকের মেঠোপথ
তোমায় টানেনি;
আড়মোড়া ভেঙে পথ ভোলা পথিকের মতো
যদিও পা ফেলেছ দুয়েকবার ওদিকে
অন্তর্গত দ্বিধায় তারপর
পিছিয়ে এসেছ দশ পা।
ডানের চওড়া সড়কের মাথায় দেখেছিলে
টইটম্বুর দিঘীর জল, মৃদুমন্দ দখিন হাওয়া
ইচ্ছে পরীর নর্তন আর বটবৃক্ষের ছায়া;
সে দিকেই ভিড়লে তুমি
মজলে সে সব বিভঙ্গে।
ঠিক আছে; সুস্থির থাকতে পারতে তাতেই
নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে।
তবু জানা যেত ‘চরিত্র’ বলে যে শব্দের প্রচলন অভিধানে
তার একটি স্কেচ আঁকা হলো তোমার শরীরে
সেখানেও থাকলে না তুমি।
দখিনের সড়ক ছাড়োনি যদিও
তবে বারবার হড়কাচ্ছো পা
খানা খন্দ, পচা ডোবা, মজা পুকুরে
হাবুডুবু খেয়ে নাজেহাল এ বয়সেও।
আর কতোটা পথ হাঁটলে
সাবালক হবে তুমি?
তোমার পিঠ বরাবর দেখা দেবে
মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রধান লক্ষণ সটান শিরদাঁড়া?
সূর্যের অপেক্ষায়
শহরের মাঝ বরাবর
লাল ইটের হেরিংবন্ড রাস্তার দু’ধারে
একদা আবাস ছিল সবুজ তৃণের
ফুল ফল জন্ম দিয়ে যারা
প্রকৃতির বুকে নিজেদের মতো বেড়ে
প্রাকৃতিক নিয়মে যেত ঝরে।
তাদের আব্দার ছিল না কোনো
মাটির কাছে—
ফুল ফলকে আরেকটু নির্যাস দিয়ে
বেড়ে তোলার,
আকাশের কাছে—
নীল সাদা মেঘ ছোঁয়ার,
বাতাসের কাছে—
শুদ্ধ অক্সিজেন পাওয়ার,
চাওয়ার ছিল না কিছুই;
কেননা যে জীবন করছিল তারা যাপন
তাকেই ভেবে নিয়েছিল শাশ্বত, চিরন্তন।
একদিন শক্তপোক্ত
অশত্থ গাছ এক জন্মায় সেখানে
হাঁক দিয়ে বলে, শোনহে তৃণ দল—
তোমাদেরও আছে অশ্বত্থ হওয়ার অধিকার
পরিপুষ্ট ফুল ও ফসল ভরা
সংসার পাতার।
সেই প্রথম চমকায় তারা
খাড়া হয় শিরদাঁড়া
হেরিংবন্ডের লাল ইটের রাস্তায়
হেঁটে যায় পায়ে পায়;
রক্ত জবার নির্যাস মাখা রেড ওয়াইনের গ্লাস
অভিনব কৌশলে এনে দেয় আত্মবিশ্বাস।
অশত্থের কথা ফলে অক্ষরে অক্ষরে
ফুল ফলে সংসার যায় ভরে।
তারপর আসে এক আঁধারের রাত
শহরে ঢুকে পড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ করাত
ইস্পাত দাঁতে এ ফোঁড় ও ফোঁড় অশ্বত্থ গাছ
শহর থেকে উঠে যায় লাল ইটের হেরিংবন্ড।
এখন সড়ক চলে গেছে হাইওয়ে বরাবর
জ্ঞানপ্রাপ্ত তৃণরা মিইয়ে গেছে এবার
আশার আঁকশী ধরে টিকে আছে কোন মতে
একদিন পূবাকাশ ভরে যাবে
টকটকে লাল সূর্যের অবয়বে।
অভিবাসী সন্ন্যাসীর অলৌকিক ঝুলি
তিনিও যাত্রা করলেন অবশেষে
তিনশ’ পঁয়ষট্টি দিনের
একেকটি পাতা উল্টিয়ে;
উজান স্রোতে ভেসে আসা পদ্মফুল
জাহাজের দেখা পেলেন শেষ বিকেলে।
মাস্তুলে বসে আছে অতিকায়
দাঁড়কাক দুটো
দুঃসংবাদ রটানোর অপেক্ষায়—
আয়োজন সম্পন্ন সব; জেটি থেকে ভেতরে ঢোকার
দূরত্বটুকু বাকি রয়।
আধ ছেঁড়া রবাবের স্যান্ডেল পায়
এবড়োখেবড়ো দুঃখের দুর্গগুলো
পার হয়ে নিঃসীম নিসঙ্গতায়
অভিবাসী সন্ন্যাসী মিলিয়ে গেলে
সফেদ জ্যোৎস্নায়
ভিক্ষার ঝুলিটি উড়বে বিষণ্ণ সন্ধ্যায়।
তারপর পরচর্চা হবে এ নিয়ে
পাড়া বেড়ানো কাক ও প্যাঁচাদের মাঝে।
কারোরই জানা হবে না
অলৌকিক ঝুলির অন্তর্গত রহস্যটি—
ভালবাসার একদানা খুদ কুঁড়ো
সেখানে কোনদিন জমা পড়েনি।