বইয়ের কথা
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সন্দীপন পাঠাশালা’
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সন্দীপন পাঠশালা’ একটি উপন্যাস। এতে এমন এক সময়কে দেখানো হয়েছে, যখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের অধীন। শহরাঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার জোয়ার আসতে শুরু করলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে তখনো সেভাবে শিক্ষার আলো পৌঁছাতে শুরু করেনি। তার ওপর সমাজে তখন জাত-পাত, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ প্রবল। নীচু জাতের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে উঁচু জাতের ছেলেমেয়েরা পড়তে বসবে, এটা অনেকেই মেনে নিতে পারত না। আর গ্রামের অশিক্ষিত চাষা-ভুষারা শিক্ষার গুরুত্বও বুঝত না। এমন একটা সময়ে বাংলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের মাহিষ্যশ্রেণি থেকে উঠে আসা সীতারাম পণ্ডিতের জীবনের গল্প দেখিয়েছেন সাহিত্যিক। উপন্যাসটা পড়ার সময় রুশ লেখক চিঙ্গিস আইৎমাতভের 'প্রথম শিক্ষক' গল্পটার কথা মনে পড়ছিল বারবার।
গ্রামের রমানাথ চাষির মা-হারা ছেলে সীতারাম নরমাল স্কুল শেষ করেছে। সে বাবার আপত্তি উপেক্ষা করে শহরে কলেজে পড়তে যায়। সামান্য কিছু পড়াশোনা করে সে গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামের এক অশিক্ষিত সরল বালিকা মনোরমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সীতারাম বাবার মতো চাষি হতে চায়নি। তাই সে জমিদারের দুই ছেলেকে সামান্য বেতনে পড়ানোর চাকরি নেয়। ছোটবেলায় সে দেখেছিল, নীচু জাতের হওয়া সত্ত্বেও তার মাস্টারমশাইকে জমিদারের ছেলেরাও ‘স্যার’ বলে ডাকত। নিজের জাতের ঊর্ধ্বে ওঠার চিন্তাই তাকে এ কাজ বেছে নিতে উৎসাহিত করে।
জমিদারের বড় ছেলে ধীরানন্দের সঙ্গে পরিচয় হয় সীতারামের। বয়সে ছোট হলেও মেধাবী ধীরানন্দ সীতারামের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পরবর্তীকালে ধীরানন্দ স্বদেশি আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খাটে। ধীরানন্দ জাত-পাতের বিচার, ঈশ্বর কিছুই মানত না। মায়ের অমতে বিয়েও করেছিল নীচু জাতের শিক্ষিত এক মেয়েকে। একসময় ধীরানন্দ ভারতের একজন বড় লেখক হয় এবং সীতারামের জীবনী লেখার দায়িত্ব নেয়।
উপন্যাসে ধীরানন্দ চরিত্রটি একটি প্রত্যক্ষ বিপ্লবী চরিত্র, যাকে দেশবাসী একনামে চেনে, মানে। পক্ষান্তরে সীতারাম এক নীরব বিপ্লবের কর্মী। যদিও শুরুতে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে সীতারাম সুখের সমস্ত আয়োজন উপেক্ষা করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু পরে সমাজের জন্য কাজ করতে গিয়ে সে সত্যিকার অর্থে ত্যাগী-নিঃস্বার্থ মানুষ হয়ে ওঠে।
সীতারাম নীচু জাতের শুড়িদের (যারা মদ বানায়) গ্রাম রত্নহাটায় বাচ্চাদের জন্য ‘সন্দীপন পাঠশালা’ চালু করে। স্কুলের নামটা ধীরানন্দের দেওয়া, সন্দীপন মুনীর কাছে শ্রীকৃষ্ণ পড়তেন বলে এ নামকরণ। সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষদের টিটকারী, ষড়যন্ত্র–সবকিছু সামাল দিয়ে সীতারাম স্কুলটা দাঁড় করিয়েছে। বিপ্লবী ধীরানন্দকে সমর্থন করা, ছাত্রদের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা এবং চরকা কাটার দায়ে তার স্কুল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অনেক ঝামেলা পোহানোর পর স্কুলটা একবার উচ্ছেদ হলেও পরে আবার সীতারাম তা দাঁড় করায়। একসময় সীতারাম বৃদ্ধ হয়, সন্দীপন স্কুলটা আর থাকে না। তবে আরো অনেক স্কুল হয় গ্রামে, লেখাপড়ার হারও বাড়ে। ধীরানন্দ ফিরে আসে সীতারামের কাছে, তার জীবনের গল্প লিখবার জন্য।
পাড়াগাঁয়ের সামান্য শিক্ষা থেকে সমাজের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাটি বুঝতে পারলেও দেশ-ধর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতির অনেক জটিলতা বুঝতে পারেনি এই সরল পণ্ডিত। তবু সে যেটুকু জেনেছে, বুঝেছে, ঠিক মনে করেছে, তাই সে ছাত্রদের শিখিয়েছে। নিজের মেয়ে রত্নাকে বিয়ে না দিয়ে শিক্ষক বানানোর স্বপ্ন দেখেছিল সীতারাম। যদিও সে তা করতে পারেনি। তার মেয়ে একসময় বিধবা হয়ে ফিরে আসে।
সীতারামকে ঔপন্যাসিক একেবারে মহামানব বানিয়ে উপস্থাপন করেননি। চরিত্রটি কখনো ভুল করেছে, আবার সঠিকটা উপলব্ধি করতে পেরেছে অনেক ক্ষেত্রে। বিবাহিত হয়েও পাশের বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকার প্রতি গোপন প্রেমের জন্য নিজেকে অপরাধীও ঠাওরেছে। বৃদ্ধ বয়সে সীতারামকে আমরা দেখি প্রায় অন্ধ অবস্থায় অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকতে। আর তখনই একটা প্রশ্ন জাগে–প্রচণ্ড প্রতিকূল সময়ে সীতারামের মতো যারা শিক্ষার আলো জ্বেলেছিল, তাদের কথা কেউ কি মনে রেখেছে?
উপন্যাসে কোনো নাটকীয়তা নেই, কোনো উত্তেজনাকর মুহূর্ত নেই। সরলভাবে সাহিত্যিক গল্পটা বলে গেছেন। এমন একজন সীতারামের জীবন আমাদের সামনে লেখক তুলে ধরেছেন, যার জীবনটা সরল অথচ সংগ্রামমুখর।