মান্টোকে নিয়ে চলচ্চিত্র
সাদাত হোসেন মান্টো। উর্দু ভাষার বিখ্যাত লেখক। বেঁচে থাকতে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। ছিল অতিরিক্ত পানের বদভ্যাস। এমনকি মৃত্যুর আগেও তাঁর আবদার ছিলো অন্তত কয়েক ফোঁটা মদ। সে ইচ্ছা তাঁর পূরণ হয়েছিল।
বিতর্কিত মান্টোর জীবনের শেষভাগ নিয়ে এবার পাকিস্তানে নির্মিত হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ‘ম্যায় মান্টো’। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন পাকিস্তানের নামকরা থিয়েটারকর্মী শাহিদ নাদিম এবং পরিচালনা করছেন সারমাদ খুসাত। মান্টোর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন খোদ পরিচালক খুসাত। আগামী এপ্রিলে ছবিটি মুক্তির কথা রয়েছে।
পাকিস্তান ছাড়াও ভারতে কাজ হচ্ছে মান্টোকে নিয়ে। অভিনেত্রী এবং পরিচালক নন্দিতা দাস ব্যস্ত সে ছবির চিত্রনাট্যের কাজে।
১৯৫৫ সালে পাকিস্তানে মারা যান মান্টো। এর আগে পাকিস্তানের মাটিতে সাতটি বছর বিক্ষিপ্ত সময় কাটিয়েছেন তিনি। মান্টোর গল্প-উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে এর আগে মঞ্চে বেশকিছু কাজ করেছেন নাদিম এবং খুসাত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ ‘আখেরি স্যালুট’, ‘টিটওয়াল কা কুত্তা’, ‘নায়া কানুন’, ‘সাহিব-ই-কারামাত’ এবং ‘তোবা তেক সিং’।
মান্টোর লেখা এসব কাজ নিয়ে ভারতেও গিয়েছেন তাঁরা। সেখানেও সাড়া পেয়েছেন ভালোই। কারণ অখণ্ড ভারত-পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন মান্টো। দেশভাগ কখনোই মেনে নিতে পারেননি তিনি। সেই না মেনে নেওয়াটা রয়ে গেছে তাঁর লেখার মধ্যে।
ভারতে মান্টোর কাজ দর্শক কিভাবে নিয়েছেন জানতে চাইলে চিত্রনাট্যকার নাদিম বলেন, ‘আমরা যখন পাকিস্তানের ইসলামাবাদ ও লাহোরে নাটকগুলো মঞ্চস্থ করেছি, ভালো সাড়া পেয়েছি। কিন্তু ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন কাজ করেছি, তখন দেখেছি মানুষ কাঁদতে কাঁদতে হাততালি দিচ্ছেন।’
মান্টোর ভেতরে সারাজীবন পীড়া দিয়েছে দেশভাগ। বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক আর উর্দু গল্পলেখক সাদাত হোসেন মান্টো যেন একই সময়ে একই ব্যথায় কেঁদেছেন। দুজন আলাদা দুই শিল্প মাধ্যমে সেই হতাশা আর কষ্টের কথা বলে গেছেন।
১৯১২ সালে অখণ্ড ভারতের লুধিয়ানায় জন্মেছিলেন মান্টো। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝিতে চলে যান মুম্বাইয়ে। সেখানে সিনেমার জন্য সংলাপ এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন মান্টো। পাশাপাশি লিখেছেন ছোটগল্প। কিন্তু দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে সপরিবারে লাহোরে চলে যান মান্টো। জীবনে ছেদটা পড়ে সেখানেই। মুম্বাইয়ে নিজের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
লাহোরে বিভিন্ন পত্রিকার জন্য কলাম লিখতে শুরু করেন মান্টো। পাশাপাশি ছোটগল্প লিখেছেন সমানে। এই সময়ে দুটি ছোটগল্প ‘ঠাণ্ডা গোশত’ এবং ‘তোবা তেক সিং’ লেখেন মান্টো যা পরে দারুণ খ্যাতি পায়। একই সময়ে লেখায় অশ্লীলতার দায়ে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে তাঁকে। তখন থেকেই মদ্যপানে অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়েন মান্টো।
ছবিতে লাহোরের মান্টোকে তুলে ধরা হয়েছে। যে জীবনের সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেননি মান্টো। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন সবকিছু তাঁর মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিলে। যা দাগ রেখে গেছে তাঁর সেই সময়ের লেখায়।
একটা রক্ষণশীল সমাজ, আইনের আশ্রয়ে বারবার লেখককে আক্রমণ করে যাচ্ছে, হেনস্থা করছে আর সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। লেখার অপরাধে যতবার মান্টো আদালতে গেছেন ততবার মনে হয় এই উপমহাদেশের আর কোনো লেখককে যেতে হয়নি।
আটপৌরে সমাজব্যবস্থার বিপরীতে নিতান্তই অসহায় ছিলেন একা মান্টো। স্ত্রী আর তিন কন্যার দেখভাল করাটা তাঁর জন্য হয়ে পড়েছিল পাহাড়সম বাধা।
পাকিস্তানের জিও টেলিভিশন প্রথমে মান্টোকে নিয়ে ২০ পর্বের দীর্ঘ এক টেলিভিশন ধারাবাহিক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। ‘ম্যায় মান্টো’ নামের ওই সিরিয়াল দিয়ে মান্টোর কাজগুলোকে তুলে ধরার একটা ইচ্ছা ছিল তাদের। কিন্তু কাজ শুরুর আগে ধারাবাহিককে সিনেমায় রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করে চ্যানেলটি।
সেখান থেকেই শুরু হয় ‘ম্যায় মান্টো’ ছবির কাজ। আর এই ছবির কলাকুশলীদের বেশিরভাগই পাকিস্তানের টেলিভিশনের অভিনয়শিল্পী, যাঁরা ভারতেও বেশ জনপ্রিয় এবং ভারতীয় টিভি ধারাবাহিকে নিয়মিত কাজ করেন।
মান্টোর জীবনে নিয়ে চিত্রনাট্য রচনা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নাদিম বলেন, ‘এখন তো সাহিত্যের প্রতি মানুষের ঝোঁক তেমন একটা নেই। তাই মান্টোর লেখার সাথেও কারো কোনো যোগাযোগ নেই। তারা মান্টোর স্ক্যান্ডালগুলোই শুধু জানে।’
মুম্বাইতে থাকতে মান্টো যেসব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য এবং সংলাপ লিখেছিলেন, সেসব ছবি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বলতে গেলে মুম্বাই থেকে হারিয়ে গেছে মান্টোর কাজ। মুম্বাইয়ে মান্টোর স্মৃতি বলতে রয়ে গেছে কিছু ফটোগ্রাফ আর পত্রিকায় লেখা কলাম।
৪২ বছর বয়সে মান্টো যখন মারা যান তখন তার তিন মেয়ে খুবই ছোট। তাদের কাছেও বাবার কোনো বর্ণনা নেই। প্রায় বিস্মৃত মান্টোর চরিত্রে রূপদানের ক্ষেত্রে ‘ম্যায় মান্টো’ ছবির পরিচালক এবং মান্টোর ভূমিকায় অভিনয় করা খুসাত বলেন, ‘মান্টোর গল্প পড়ে আমি তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। তা ছাড়া মান্টো সম্পর্কে বিভিন্ন লেখা পড়েছি। নিজের সম্পর্কে তিনি একবার বলেছিলেন লেখার সময় চেয়ারে মুরগির মতো ঝিম মেরে বসে থাকেন তিনি। আমি সেভাবে টেবিলে বসে লেখার চেষ্টা করেছি।’
তবে মান্টোর যে পাতলা এবং চিকন কণ্ঠস্বর সেটা আর পর্দায় পাওয়া যাবে না। তবে পোশাকী মান্টো ঠিকই থাকছেন সাদা কুর্তা আর পাজামা নিয়ে। থাকছে মান্টোর গোল চশমা। মান্টোর শূচিবায়ু স্বভাবকেও ছবিতে দেখানো হয়েছে। সেইসাথে চিকন করে কাটা পেন্সিল বা ছোট কলম দিয়ে লেখার অভ্যাস ছিল তাঁর সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাখা হয়েছে ছবিতে।
মান্টোর জীবনী হুবহু ফুটিয়ে তোলার কোনো চেষ্টা করা হয়নি এই চলচ্চিত্রে। নির্মাতা মান্টোর জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময়কে তুলে ধরতে চেয়েছেন। একজন লেখকের কষ্ট এবং সমাজের সাথে তাঁর যুদ্ধই ছবির মূল বিষয়।