জন্মদিন
ক্ষুব্ধ যুবকের নাম অমিতাভ
সত্তুরের দশক। বলিউডে প্রথম সুপারস্টার রাজেশ খান্নার চমকে গমকে মন্ত্রমুগ্ধ সবাই। টানা ১৫ ছবি হিট, আচ্ছন্ন না হয়ে উপায় কি! অথচ, সময়টা বিশেষ সুবিধের নয় তখন! অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব, অভাব, বৈশ্বিক রাজনীতির অস্থিরতার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে অপরাধ! তখন যেন মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের লম্বা সংলাপের বদলে অন্য কিছু চাই। ক্লিন্ট ইস্টউডের ‘ডার্টি হ্যারি’র মতোন, ‘ওয়েল, হোয়েন অ্যান অ্যাডাল্ট মেল চেইজ আ ফিমেল উইদ ইনটেন্ট টু কমিট রেইপ, আই শ্যুট দ্যাট ব্যাস্টার্ড। দ্যাটজ মাই পলিসি!’ কী দাপটের কথা! এমন কথা মুম্বাইয়ে বলবে কে, মানাবেই বা কার গলায়? তবে সময় বা নিয়তি হয়তো তার নিজস্ব প্রয়োজন বিচিত্রভাবেই পূরণ করে ফেলে। ছয় ফুটের অধিক লম্বা, হ্যাংলা, হেঁড়ে গলার এক যুবক এলো বলিউডে। খ্যাপাটে গলায় জানান দিল, ‘যব তক ব্যঠ্নে কো না কাহা যায়ে, শরাফত সে খাড়ে রাহো। ইয়েহ্ পুলিস স্টেশন হ্যায়, তুমহারে বাপ কা ঘর ন্যাহি’!
প্রকাশ মেহরার ‘জঞ্জির’ ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এই বিখ্যাত সংলাপের সাথে বোধ করি এও জানেন, এই ছবির মাধ্যমেই বলিউডে ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ ফর্মুলার গোড়াপত্তন ঘটে সফলভাবে। অমিতাভ এমনভাবেই রাগী যুবক হিসেবে ভারতীয় ছবিতে নিজের নাম লেখালেন সাফল্যের সাথে। এরপর ‘দিওয়ার’ ছবিতে দর্শক আবারও শুনল যৌবনের হুংকার, ‘ম্যয় আজ ভি ফেকে হুয়ে প্যয়সে নাহি উঠাতা’!
অমিতাভ বচ্চন তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৭৯ সালে, ‘সাত হিন্দুস্তানি’ ছবি দিয়ে। সেরা নবাগত হিসেবে জাতীয় পুরস্কার জুটল বটে, তবে ক্যারিয়ার এগোল না মোটেও। এগোবেই বা কি করে? সে সময় নায়কদের জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে অনেক বড় নির্ধারক ছিল নাটকীয় সংলাপ, প্রেমময় উপস্থাপন, নাচগান কিংবা ইমোশনাল মেলোড্রামার। অমিতাভ যখন প্রথম এলেন, তখন ঢ্যাঙা গড়নের এই লিকলিকে তরুণকে মোটেও গোনায় ধরেননি মোড়ল ঘরানার নির্মাতারা। ধরবেনই বা কেন? যেখানে রাজেশ খান্নার রাজত্ব চলছে, অন্যদিকে শাম্মী কাপুরের নাচ কিংবা শশী কাপুরের রোম্যান্টিক শিভালরির দাপটও সমানতালে কাঁপাচ্ছে বলিউড-সেখানে আপাতদর্শনে এক বিদঘুটে দৈত্যাকৃতি যুবক দিয়ে কী করবে মুম্বাই? তবে, অমিতাভকে আসলে বলিউড নয়, প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে খোদ সময়। চারদিকে অস্থিরতা, হট্টগোল, অভাবের পাশাপাশি অপরাধ-নির্যাতনের সাথে পাল্লা দিয়ে পারা যাচ্ছে না। সিনেমাহলে গিয়ে সেই আধো আধো বুলির প্রেম আর ধনিক শ্রেণীর ভালোবাসায় কি শুধু চলে? প্রকাশ মেহরা অমিতাভের মধ্যে দিয়ে কেবল ইন্সপেক্টর হ্যারি ক্যালাহানের (ক্লিন্ট ইস্টউড অভিনীত) বলিউডি সংস্করণ ইন্সপেক্টর বিজয়ের জন্ম দিলেন না, সেইসাথে তৈরি করলেন অ্যাংরি ইয়ংম্যান ফর্মূলা। এই ফর্মূলাতে পরবর্তী সময়ে অমিতাভ ‘দিওয়ার’, ‘শোলে’, ‘ডন’, ‘কালিয়া’, ‘কুলি’, ‘বিজয়পথ’, ‘শাহেনশাহ্’ কিংবা ‘অগ্নিপথ’ এর মতো ছবিই নয়- পরবর্তী সময়ের রাগী নায়কদের জন্যও পথ তৈরি করে দিয়ে গেছেন।
তবে, রাজেশ খান্নার পর আরেকজন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ বলিউড স্টার বোধ করি যুতসইভাবে অমিতাভই হয়ে উঠতে পেরেছেন। কারণ কেবল রাগী যুবক নয়, এমন কোনো ধরনের বা ঘরানার চরিত্র নেই যেখানে তিনি সাফল্য পাননি। একদিকে ইন্সপেক্টর বিজয় বা বিজয় দীননাথ চৌহান তথা ট্রেডমার্ক ক্যারেক্টার ‘বিজয়’ চরিত্রে বারংবার সাফল্যের পাশাপাশি ‘চুপকে চুপকে’ বা ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’র কমিক ক্যারেক্টার কিংবা ‘সিলসিলা’, ‘কাভি কাভি’, ‘অভিমান’; অথবা একালের ‘সরকার’ ছবির গডফাদার স্টান্ট, ‘নিঃশব্দ’-এর বিচিত্র চরিত্র, ‘ভূতনাথ’-এর শিশুবাৎসল্য, ‘ব্ল্যাক’ বা ‘মোহাব্বতে’ ছবিতে অভিভাবকসুলভ অমিতাভকেই কিন্তু ‘পা’ ছবিতে দেখা গেছে এক বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুর চরিত্রে!
বলিউড ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতার নাম অমিতাভ বচ্চন— এ কথা বলার জন্য আরো কি উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে? আর উদাহরণ দিতে গেলে তো দেখেও শেষ করা যাবে না!
১৯৪২ সালের আজকের দিনে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তি কিন্তু দারুণ জনপ্রিয় তাঁর ওই কণ্ঠস্বরের জন্যও। রাগী যুবকের ক্যাপা ডায়লগ কেবল নয়, মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’, সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র মতো ছবিতে অসামান্য কণ্ঠে দিয়েছেন ধারাবর্ণনা। মজার বিষয়, ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’তে কিন্তু এই কণ্ঠস্বরের দামটা পাননি অমিতাভ, অডিশনেই খারিজ হয়ে গিয়েছিলেন!
আরেকটি মজার ব্যাপার, আশির দশকে অমিতাভ এতই জনপ্রিয় ছিলেন, তাঁকে নিয়ে কমিক বই পর্যন্ত বের হতো নিয়মিত। সেখানে তিনি ছিলেন ‘সুপ্রিমো’ নামের এক সুপারহিরো, সিরিজের নাম ছিল ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব অমিতাভ বচ্চন’! সিনেমার শুটিংয়ের পাশাপাশি সুপারহিরোর তাবত কাজকারবারই করতেন সুপ্রিমো! এই প্রৌঢ় বয়সে, টুইটারে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিটি নিজেকে কিন্তু অনেক সাধারণ ভাবেন এখনো। এই সাধারণের অসাধারণ হয়ে ওঠার নামই অমিতাভ বচ্চন। ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তি।