গ্রন্থালোচনা
ইতিহাসের পাতায় জিয়া-মঞ্জুর-এরশাদ ত্রয়ী
বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানগুলোর পেছনের ইতিহাস অনেকটাই অজানা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ঠিক কতগুলো সামরিক ক্যু/ প্রতিক্যু হয়েছে, তা বের করা রীতিমতো গবেষণার বিষয়।
তবে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড এখনো জাতির কাছে অস্পষ্ট। যদিও তাঁর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তৎকালীন চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুরকে অভিযুক্ত করেন কেউ কেউ। তাঁকে আটকও করা হয়। কিন্তু সেনা বিদ্রোহের দায়ে তাঁর বিচার করে শাস্তি দিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ইতিহাস একে বিচার নয়, হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে। এ বিষয়টি এখনো আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় আছে।
জেনে নেওয়া ভালো, জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর আত্মগোপনে থাকা মঞ্জুরকে পুলিশ আটক করে। ১৯৮১ সালের ২ জুন তাঁকে পুলিশ হেফাজত থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনার ১৪ বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মঞ্জুরের ভাই আইনজীবী আবুল মনসুর আহমেদ চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ২৭ জুন এরশাদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।
অভিযোগপত্রভুক্ত অপর চার আসামি হলেন মেজর (অব.) কাজী এমদাদুল হক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোস্তফা কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া, মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল লতিফ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শামসুর রহমান শামস। তাঁদের মধ্যে শেষোক্ত দুজনের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সরকারি কৌঁসুলি আসাদুজ্জামান খান।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর মামলাটির বিচার নিষ্পত্তির জন্য প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এ মামলার গতি কমে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে মামলায় গতি আসে। ২০১২ সালে তিনি এ মামলায় সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব নেন। এখনো রায়ের অপেক্ষায় দিন গুনছে জাতি। সঙ্গে জানতেও চায়, আসলে কী ঘটেছিল?
তবে মঞ্জুর হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণের আগে প্রয়োজন জেনে নেওয়া কি করে জিয়া ক্ষমতায় এলেন, কীভাবে তিনি নিহত হলেন এবং কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এরশাদ ক্ষমতার গদিতে বসলেন।
অতীত ঘুরে আসা
এ-সংক্রান্ত নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকার পাতায় উঠে এসেছে। তবু আলোচনা করা যেতে পারে দুটি বই নিয়ে। দেখে নেওয়া যেতে পারে এই দুটি বইয়ের লেখক কী সব তথ্য একত্র করেছেন।
প্রথম বইটি ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’। লেখক লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি। এই বইটি মূলত ১৯৭৫ সালে সংঘটিত তিনটি সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে রচিত। তবে এ আলোচনায় আমরা শুধু জিয়া হত্যাকাণ্ড, মঞ্জু হত্যা এবং এরশাদের বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকব।
সে সময়ের ঘটনা নিয়ে অধিকাংশ বই কিংবা জার্নালিস্টিক রিপোর্টগুলো শুনে শুনে কিংবা পড়ে পড়ে লেখা। কিংবা একটা বিশ্লেষণের মধ্যে আলোচনা করা অথবা দূর থেকে প্রত্যক্ষ করে রচনা। কিন্তু এম এ হামিদ পিএসসির বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি খুব কাছ থেকে সবগুলো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন বলে দাবি করেছেন।
তিনি ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো নিয়েই তাঁর বইয়ে আলোচনা করেছেন। এসব অভ্যুত্থানের সময় হামিদ পিএসসি ছিলেন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের প্রধান নায়কদের সঙ্গে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এ বিষয়ে অবশ্য হামিদ পিএসসি জিয়া ও এরশাদের দুজনের সঙ্গে পরিচয়ের বিষয়টিও স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা করেছেন।
যেমন, জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর কোর্সমেট ছিলেন বলে দাবি করেছেন লেখক। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে তাঁরা একসঙ্গে দুই বছর ক্যাডেট হিসেবে অধ্যয়ন করেন। শুধু কোর্সমেটই দাবি করেননি লেখক, তিনি দাবি করেছেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল ‘তুই তুকারের’।
জিয়াউর রহমান সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের কথাও উল্লেখ করেন হামিদ পিএসসি। এ প্রসঙ্গে বইটির ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘বরাবরই জিয়া ছিল মেজাজি এবং প্রবল আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন একজন সৎ ও সচেতন অফিসার। কিন্তু সে অসৎ অফিসারদের কানে ধরে কাজ করাতে সুবিধা হয় বলে মনে করত। তার সাথে জেনারেল ওসমানী, মোশতাক আহমদ, জে. খলিল প্রমুখদের বনিবনা না থাকা সত্ত্বেও যেভাবে সবার সঙ্গে একা লড়ে ফাইট করে উপরে ওঠে আসে, তা ছিল অবিশ্বাস্য ব্যাপার, লিডারশিপ কোয়ালিটির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।’
একইভাবে জেনারেল এরশাদ নিয়েও তিনি ভূমিকায় কথা বলেন। তাঁর সম্পর্কে বলেন, “জেনারেল এরশাদ প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন এক অখ্যাত দুর্বল প্রকৃতির অফিসার। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনিই ছিলেন একমাত্র অফিসার, যার দুর্বলতাই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ঊর্ধ্বে ওঠার বড় ‘প্লাস পয়েন্ট’।”
জেনারেল এরশাদের সঙ্গে হামিদ পিএসসির পরিচয় হয় কোয়ার্টার স্টাফ কলেজে কোর্স করার সময়। ১৯৬৭ সালে তাঁরা একসঙ্গে কোর্স করেন।
যাই হোক, দ্বিতীয় বইটি হলো, জুলফিকার আলী মানিক রচিত ‘জিয়া হত্যাকাণ্ড নীল নকশার বিচার’। এ গ্রন্থটিতে মূলত ৮১ সালে জিয়া হত্যা পরবর্তী গোপন সামরিক বিচারে কী ঘটেছিল তারই অনুন্ধানমূলক প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনটি ২০০০ সালের ২২ অক্টোবর ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে ২৩ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ভোরের কাগজে প্রকাশিত জেনারেল আইনউদ্দিনের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারও গ্রন্থে রয়েছে।
গ্রন্থটি থেকে আমরা জানতে পারি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ’৮১ সালের কোর্ট মার্শাল হলেও সেখানে জিয়া হত্যার বিচার হয়নি। বিচার হয়েছিল চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের। প্রকৃতপক্ষে সেখানে বিচারের নামে যে প্রহসন হয়েছিল তা-ই উদঘাটিত হয়েছে মানিকের গ্রন্থে।
এবার বই দুটি নিয়ে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। দুটি বই থেকে উঠে আসে ইতিহাসের দুটি অধ্যায়। যার মধ্যে রয়েছে জিয়া হত্যাকাণ্ড এবং এর পরবর্তী অবস্থা। জিয়াউর রহমানের এ হত্যাকাণ্ডের পরপর হত্যা করা হয় জেনারেল মঞ্জুরকে। এ হত্যাকাণ্ডটিও অত্যন্ত আলোচিত। কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়, জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের অনেক ঘটনা হয়তো জানতেন। এ জন্যই তাঁকে হত্যা করেন এরশাদ।
জিয়া হত্যাকাণ্ডের কারণ
লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি রচিত ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ের একটি অধ্যায় জিয়া হত্যাকাণ্ড : চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থান।
অধ্যায়টিতে বলা আছে, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ক্যান্টনমেন্টে প্রায় ১৮টি ছোটবড় সেনা অভ্যুত্থান হয়।
এসব অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮১ সালের অভ্যুত্থানটি তিনি ঠেকাতে পারেননি।
তবে মঞ্জুর কেন জিয়াকে হত্যা করবে? এ বিষয়টি এখনো ইতিহাসে অজানাই রয়ে গেছে বলে মনে করেন হামিদ পিএসসি। যদিও হামিদ পিএসসি মঞ্জুরকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলেও উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে আবার এও উল্লেখ করেছেন, মঞ্জুর ছিল জিয়ার প্রিয় এবং বিশ্বস্ত সেনাপতি।
তবে এরশাদের বিষয়ে হামিদ পিএসসি নানা তথ্যও দাঁড় করান। যেমন, এরশাদের ডাবল প্রমোশন পাওয়া। এ বিষয়টি ক্যান্টনমেন্টের অনেকেরই পছন্দ হয়নি। এরশাদ সব সময় জিয়ার কাছাকাছি থেকে নানাভাবে তাঁর কান ভারী করতেন বলেও লেখক উল্লেখ করেছেন। যার ফলে লেখক হামিদ পিএসসিকেও জিয়াউর রহমান দূরে ঠেলে দেন বলে বইয়ে বলা হয়েছে।
পরবর্তীকালে একইভাবে এরশাদের কূটকৌশলের কারণে মঞ্জুর-জিয়ার সম্পর্কেও ফাটল ধরে। এ কারণে দেখা যায়, মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম ডিভিশন থেকে অপসারণ করে স্টাফ কলেজে বদলি করা হয়। এসব নিয়ে মঞ্জুর-জিয়ার সম্পর্কে অনেকটা তিক্ততার জন্ম দেয়।
শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, জিয়াকে হত্যার সঠিক কোনো কারণ আজও ইতিহাসে অজানা। তবে হামিদের ধারণা মতে, মঞ্জুরের প্ল্যান ছিল জিয়াকে বন্দি করে ক্যান্টনমেন্টে এনে এরশাদের পদচ্যুতিসহ কিছু দাবিদাওয়া আদায় করা।
জিয়া হত্যার ঘটনা
৩০ মে ১৯৮১ সাল। প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রাম যান। একসঙ্গে জেনারেল এরশাদেরও যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তিনি গেলেন না।
এখন এরশাদকে এই প্রশ্নটি করা যেতে পারে। কেন এবং ঠিক কোন কারণে সেদিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে যাননি।
সেদিন রাত ১১টায় রাজনৈতিক আলাপ শেষ করে জিয়া ঘুমাতে যান। রাত ৩টায় বিদ্রোহী কর্মকর্তারা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সার্কিট হাউসে আক্রমণ চালান।
হামিদের বই থেকে জানা যায়, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আক্রমণের প্ল্যান ও উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি।
যাইহোক। প্রথমে রকেটলঞ্চার থেকে সার্কিট হাউসের ওপর রকেটবর্ষণ করা হয়। এ সময় মেশিনগান থেকে অবিরামভাবে গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় প্রহরীরা। বলতে গেলে অনেকটা বিনা বাধায় সার্কিট হাউসে প্রবেশ করেন সেনাসদস্যরা। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজেই তখন দরজা খুলে বের হন। জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কী চাও?
হামিদ পিএসসির বইয়ের সূত্র থেকে জানা যায়, এ প্রশ্নের পর তাঁর কাছে দণ্ডায়মান লে. মোসলেহ উদ্দিন রীতিমতো ঘাবড়ে যান। এমন সময় হঠাৎ করে লে. কর্নেল মতি ছুটে এসে তাঁর স্টেনগান দিয়ে অতি কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ওপর সরাসরি গুলি করেন। আনুমানিক ৪টা ৩০ মিনিটে জিয়া মৃত্যুবরণ করেন।
হত্যা নিয়ে প্রশ্ন
এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে হামিদ পিএসসি বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন, নেপথ্যে থেকে তাহলে নাটাইয়ের সুতাটি টেনেছিল কে? লে. কর্নেল মতি কার নির্দেশে ছুটে গিয়ে জিয়ার বুকে স্টেনগান ধরলেন? মঞ্জুর তো জিয়াকে হত্যা করার নির্দেশ দেননি। তাহলে মতি এককভাবে এ কাজটি কেন করলেন?
ঘটনাপ্রবাহ থেকে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের চারদিন আগে চট্টগ্রামে মতির সঙ্গে হিলপট মেসে এরশাদের দুই ঘণ্টা অন্তরঙ্গ পরিবেশে আলোচনা হয়েছিল। সব প্রটোকলের বাইরে জুনিয়র মতির সঙ্গে সেনাপ্রধানের এমন কী ব্যক্তিগত গোপন আলাপ হতে পারে ওই সন্ধিক্ষণে? কদিন আগে ঢাকায় গিয়েও মতি সেনাপ্রধান এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। ওই দিন এরশাদ মিলিটারি একাডেমির নির্ধারিত ভিজিট বাতিল করে প্রায় সারা দিন মঞ্জুরের সঙ্গে গভীর আলোচনায় লিপ্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছিল?
জিয়া হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী ঘটনা
এরশাদের নির্দেশে রেডিও বাংলাদেশ জেনারেল মঞ্জুরকে জীবিত অথবা মৃত গ্রেফতার করার জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা আসে। অবশেষে একটি চা বাগানে একজন কুলির জীর্ণ কুটিরে ধরা পড়েন জেনারেল মঞ্জুর। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। কিন্তু পুলিশের কাছ থেকে সেনাবাহিনী অনেকটা ছিনিয়ে নিয়ে যায় মঞ্জুরকে।
চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বন্দি বেশে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে নিয়ে যাওয়া হয়। খুব কাছ থেকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয় মঞ্জুরকে। সঙ্গে সঙ্গে টিভি বেতারে খবর আসে উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যের হাতে নিহত হয়েছেন মঞ্জুর।
২.
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর এরশাদের ক্ষমতার গদিতে বসাটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ বিষয়ে সেনাবাহিনীতে একটি গোপন সামরিক বিচারের আয়োজন করা হয়। যার পেছনে নেতৃত্বে ছিলেন এরশাদ। এ বিচার প্রক্রিয়া নিয়েই জুলফিকার আলী মানিকের ‘জিয়া হত্যাকাণ্ড নীল নকশার বিচার’।
জুলফিকার আলী মানিক এই ধাপটিকে উল্লেখ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা নিধনের উদ্যোগ হিসেবে। চাঞ্চল্যকর এই বিচারে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যার হিসাবে, ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সময় সেনা বিদ্রোহের অভিযোগে অনুষ্ঠিত কোর্ট মার্শালকে সামরিক বাহিনীতে ‘৭৭ সালের সামরিক ট্রাইব্যুনালের পরে সবচেয়ে বড় গোপন সামরিক বিচার হিসেবে কোনো কোনো অভিযুক্ত তাঁদের ব্যক্তিগত ধারণায় প্রকাশ করেন।
আমরা আমাদের আলোচনা জুলফিকার আলী মানিকের বইয়ের আলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে নিতে পারি।
জিয়া হত্যা নয়, সেনা বিদ্রোহের বিচার
মানিকের বই থেকেই জানা যায়, জিয়া হত্যার অভিযোগে সেনা কর্মকর্তাদের আর্মি অ্যাক্ট-৩১ ধারা অনুসারে কোর্ট মার্শালে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এরশাদ ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি হলেও ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জিয়া হত্যার বিচারের কোনও উদ্যোগই নেননি।
বই থেকে এও জানা যায়, কোর্ট মার্শাল ও বিভিন্ন পর্যায়ে চাকরিচ্যুতির মাধ্যমে এরশাদ তাঁর অপছন্দের লোকদের সরিয়ে দিয়ে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করে নিয়েছিলেন।
কঠোর গোপনীয়তা ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা
চট্টগ্রাম জেলখানার ভেতরে ভবনের একটি অংশকে আদালত হিসেবে ঘোষণা করে ’৮১ সালের ১০ জুলাই থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত কোর্ট মার্শালের বিচারকাজ চলে। এসব কিছুই হয় কঠোর গোপনীয়তায়। শুধু তাই নয়, জেলখানার ভেতরে এবং বাইরে কঠোর প্রহরার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। তবে জুলাই মাসে বিচারকাজ শুরু হলেও অভিযুক্তদের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি করা হয়। তখন থেকেই জেলখানার চারদিকে সেনা, বিডিআর ও পুলিশের সমন্বয়ে প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
নির্যাতন ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়
কোর্ট মার্শালে বিচার শুরুর আগেই অভিযুক্তদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে তাদের কাছ থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছিল বলেও মানিক উল্লেখ করেছেন।
মানিক তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন অভিযুক্তদের নানা শক্ত জিনিস দিয়ে পেটানো হতো, গায়ে সিগারেটের ছেঁকা দেওয়া হতো, পুরুষাঙ্গের ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো কাচের চিকন দণ্ড, নখের মধ্যে সুই ফুটিয়ে দিত নির্যাতনকারীরা।
ঘোষিত রায় নিয়ে নানা অভিযোগ
চূড়ান্তভাবে অভিযুক্ত ২৯ জনের মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন কোর্ট মার্শালের বিচারকরা।
আদালত কর্তৃক ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছিল আরো বেশিসংখ্যক অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাকে। তবে তৎকালীন সেনাপ্রধান তাঁর ক্ষমতাবলে কয়েকজনের ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও চাকরিচ্যুত করেন।
আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড এবং নীল নকশার বিচারে কে জড়িত ছিলেন এ বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া যায় দুটি বই হাতে নিলে।
উপসংহার
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অনেক অজানা অধ্যায় রয়ে গেছে, যা এখনো উন্মোচন হয়নি। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড তেমনই একটি ঘটনা। যাকে কিছুটা হলেও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি। আর বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে পূর্ণ গবেষণালব্ধ কাজ করেছেন সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক। তাঁদের দুটি বই-ই ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবে থাকবে।
হামিদ পিএসসির বইটি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা আবার অন্যদিকে মানিকের বইটি রচিত হয়েছে গবেষণা নথিপত্র, সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করে।
বইয়ের তথ্য
১. ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’
লেখক . লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি
হাওলাদার প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : লেখকের উত্তরাধিকার
দাম : ২৫০ টাকা
(বইটিতে লেখক ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো নিয়েই নিজের অভিজ্ঞতা এবং সামগ্রিক ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অভ্যুত্থানের সময় হামিদ পিএসসি ছিলেন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের প্রধান নায়কদের সঙ্গে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।)
২. জিয়া হত্যাকাণ্ড নীল নকশার বিচার
লেখক : জুলফিকার আলী মানিক প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০০৬
সময় প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য : ৭৫ টাকা
(এ গ্রন্থটিতে মূলত ১৯৮১ সালে জিয়াহত্যা পরবর্তী গোপন সামরিক বিচারে কী ঘটেছিল তারই অনুন্ধানমূলক প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনটি ২০০০ সালের ২২ অক্টোবর ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে ২৩ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ভোরের কাগজ প্রকাশিত জেনারেল আইনউদ্দিনের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারও গ্রন্থে রয়েছে।)