ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আমাদের অন্ধকার যুগে নিয়ে যাবে : শাহরুখ খান
‘৫০ বছরে পা দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। অনেকের জন্য বিষয়টা একরকম ভীতিকরও হয়ে ওঠে, হায় হায়, বেলা যে চলে গেল। কিন্তু মানুষটি যখন হন শাহরুখ খান, তখন ব্যাপারটা অন্যরকম হতেই পারে। এটা কি কেবলই জন্মদিন, নাকি জীবনের ল্যান্ডস্কেপে জলরঙের আরেকটা পরত?’
ভারতের প্রভাবশালী সাংবাদিক বরখা দত্ত ‘বলিউড কিং’ শাহরুখ খানের সাথে বসতে গিয়ে এভাবেই শুরু করলেন আলাপ। ফিল্মের খবরাখবর, ক্যারিয়ার কিংবা জীবন ছাপিয়ে বরখা যে ভারতজুড়ে চলমান অস্থিতিশীলতা বা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার আলাপও জুড়ে দেবেন, সে কথা বোদ্ধামাত্রই অনুমান করতে পারেন। হয়েছেও তাই। আজ সোমবার এনডিটিভিতে দেওয়া এই লম্বাচওড়া সাক্ষাৎকারে শাহরুখ খান সাবলীলভাবেই সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন। এর মধ্যে চুম্বকাংশ তুলে ধরা হয়েছে পাঠকদের জন্য।
শুরুর দিকেই বরখা শাহরুখকে জিজ্ঞেস করলেন বয়সের বাড়তি ধাপে এগোনোর কথা। এতটা সময় পেরিয়ে গেছে, মৃত্যুচিন্তা কি আসে না একটুও? ভয় হয় না? শাহরুখ তখন এক গল্প শোনালেন। সে দীর্ঘ গল্পের মোদ্দা কথা, সবকিছুই সময়মতো হয়ে যায়, আর যা পেরোনোর তাও পেরিয়ে যায়। জীবন যেমনই হোক না কেন, তা একসময় ঠিকই দিব্যি কেটে যাবে। কাজেই মৃত্যু নিয়ে এতটুকুও ভয় নেই তাঁর। এই মন্তব্যে একটু পাল্টা প্রশ্নও করেন বরখা।
বরখা : কিন্তু তুমি এক সময় প্রিয়জন হারানোর কথা বলেছিলে। বলেছিলে যে কাছের মানুষ হারানোর কতটা কষ্ট। নিজের জীবন নিয়ে এভাবে বলছ কীভাবে? কারণ তোমারও তো প্রিয়জন আছে, তুমিও তো অনেকের প্রিয়জন!
শাহরুখ : দেখ আমি এ ব্যাপারটাই বলতে চাই। এটাই হলো কারণ যে আমি একটুও ভয় পাই না। এমনকি বলতে পারো যে চিন্তাও করি না। কারণ আমি খুব কাছে থেকে মৃত্যু দেখেছি, প্রিয়জনের চলে যাওয়া দেখেছি। এটা অবধারিত। কাজেই ভেবে তো কোনো লাভ নেই! এমনকি বয়স বেড়ে যাওয়া নিয়েও আমি চিন্তিত নই।
বরখা : বয়স বেড়ে যাওয়া নিয়েও তুমি চিন্তিত নও কেন? ইন্ডাস্ট্রিতে তো এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
শাহরুখ : আমি এসব নিয়ে ভাবি না। আমরা তো আসলে টিকে থাকাটাই উদযাপন করি, বয়স বেড়ে যাওয়া নয়।
বরখা : এখন এই যে বয়স বেড়ে গেছে, কোনো কিছুতে নিজেকে আনফিট মনে হয়? মানে এ রকম মনে হয় কি যে অমুক জিনিসটায় আমাকে মানাবে না বা এটা আমার জন্য যুঁতসই নয়-এমন কিছু?
শাহরুখ : না। আমার যখন যেমনভাবে যা করতে ইচ্ছে হয় সেটা করি। সেটা ব্যক্তিজীবনে কী কাজের ক্ষেত্রে। ‘রা-ওয়ান’-এর সময় কে যেন বলেছিল যে ভারতীয় দর্শক সায়েন্স ফিকশন ছবি এক শতাংশেরও কম পরিমাণে দেখে। সেখানে এতবড় একটা ছবি, এত টাকাপয়সা খরচ, না জানি কী হয়! আমি তখন একেবারেই ভেবেছিলাম, এটা তো তাহলে করতেই হবে! আসলে ২৫ বছরের জীবনে এত কিছু পেয়েছি, এখন যদি ব্যতিক্রম কিছু না করি সেটা খুবই অন্যায় হবে। একই ঢঙে একই জিনিস নিয়ে কাজ করতে থাকলে সেটা খুব বিরক্তিকর হয়ে উঠবে।
বরখা : তুমি বলেছিলে যে সৃষ্টিশীলতার জন্য পাগলামি খুব দরকার? তোমার মধ্যে কী কী পাগলামি আছে?
শাহরুখ : আসলে এটা কি বলব, যখন যেমন মনে হয় তাই তো করি। ধর, যখন আমার মন প্রচুর খারাপ থাকে, তখন কিন্তু আমি প্রচুর হাসতে থাকি!
এভাবেই জীবন আর ফিল্ম নিয়ে আলাপ চলেছে তাঁদের মধ্যে অনেকক্ষণ। এরই মধ্যে শাহরুখ জানালেন, তাঁর জীবনে কখনোই নির্দিষ্ট কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল না। আরো স্পষ্ট করে বলেন তিনি, তার কখনোই কোনো বন্ধু ছিল না, তিনি জানেন না কীভাবে বন্ধুত্ব করতে হয়। তবে তিনি সংযোগকে গুরুত্ব দেন। যেকোনো মানুষের সাথেই তিনি সেই সংযোগটা অনুভব করেন, একেক ক্ষেত্রে একেকভাবে। এর পরই কথার মোড় ঘুরতে থাকে ভিন্ন দিকে।
বরখা : তোমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। সামান্য কয়েকজনই বলে, তুমি তাদের মধ্যে একজন। পশ্চিমে কিন্তু এমনটা হয় না।
শাহরুখ : দেখ ওখানে একটা ব্যাপার, মতামত ওখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত একটা বিষয়। এখানে, তোমার মতামতের সঙ্গে যদি কারোটা না মেলে তখন বিষয়টা গুরুত্ব বা সম্মান ছাড়িয়ে আক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। তুমি কথা বললে তোমার সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা বেশি। আমরা পক্ষ নিয়ে ফেলি। জেতার চেষ্টা করি। একমত না হলেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ি, মানতে চাই না কোনো কিছু। আমি চাইলে তো অনেক কিছু বলতে পারি। কিন্তু বলি না। বলে কী হবে, আমার তিনদিনের শুট বাতিল হবে, ছবি রিলিজ পাওয়া পিছিয়ে যাবে, এই সেই ঝামেলা। এতে আমার কোনো ভয় নেই, কিন্তু আমার সাথে বহু মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে।
বরখা : কিন্তু তুমি তোমার অবস্থান নিয়েছ। আইপিএলে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের খেলতে পারার প্রসঙ্গে তোমার অবস্থান নিয়েছ। তোমার মন্তব্যে অনেকে খেপেছে। অন্য বিষয়েও অবস্থান নিয়েছ।
শাহরুখ : সৃষ্টিশীল মানসিকতাকে কোনো কিছু দিয়ে বিচ্ছিন্ন করার তো কোনো মানে হয় না।
বরখা : এসব বিষয় নিয়ে এখন অনেক বাড়াবাড়ি হচ্ছে। গরুর মাংস খাওয়া না খাওয়া বা নিষিদ্ধ করার বিষয়গুলো এখন তর্ক ছাড়িয়ে ভায়োলেন্সের দিকে চলে গেছে। আমরা ভয়াবহরকম অসহিষ্ণুতা দেখতে পাচ্ছি। তোমার কাছে এ বিষয়টা কী ভয়াবহ মনে হচ্ছে না যে কিছু বলতে গেলে বলার পরিস্থিতি থাকছে না, আবার রীতিমতো আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে! এই অসহিষ্ণুতা...
শাহরুখ : এর একটা কারণ হচ্ছে প্ল্যাটফর্মও। হয়তো এখন বেশি প্ল্যাটফর্ম হয়েছে, সবাই এখন বলতে পারে, সেগুলো সবাইকে শোনানোরও উপায় থাকছে। কাজেই এমনো হতে পারে যে এ বিষয়গুলো আগেও ছিল কিন্তু বলার কোনো জায়গা ছিল না! এখন সেটা হয়েছে। আমি ভাবি যে হয়তো ব্যাপারগুলো আগেও এমনই ছিল, এখন কেবল শোনা যাচ্ছে, এই আর কী!
তাই আমি বলব যে যেহেতু কথাগুলো শোনা যাচ্ছে, কাজেই আমাদের একটু দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আরেকটু সহনশীল হওয়া উচিত। একটু দায়িত্ব নিয়ে কথা বলা উচিত। কোনো অবস্থাতেই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কম গুরুত্বের বিষয় হতে পারে না। একটা ধর্মকে দিনরাত জপে যাওয়া আর আরেকটা ধর্মকে অসম্মান করা, এটা কেমন কথা?
আমি জানি যে আমার কথাটা একটু আজব শোনাবে। তবুও বলব, এভাবে যদি আমাদের দেশে দিনের পর দিন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে কথা বলতে হয়, তাহলে এটা আমাদের অন্ধকার যুগে ঠেলে নিয়ে যাবে। এই বিষয়টা আমাকে একেবারে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। এটা হলো যেকোনো পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা। তুমিই চিন্তা করো যে এসব ঘটনার পর তুমি যখন বাইরে যাবে তুমি কীভাবে মানুষজনের প্রশ্নের উত্তর দেবে? এসব ঘটনা খুবই হতাশাজনক, রীতিমতো শকিং। এসবের যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে আমাদের জন্য বড় দুর্ভাগ্যই অপেক্ষা করছে।
এই প্রসঙ্গে দেশপ্রেম নিয়েও স্পষ্ট করে বলেন বলিউড কিং। ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতা নিয়ে সামগ্রিক অর্থে দেশকে ভালোবাসার কথাই বলেন শাহরুখ। তাঁর কথার মতোই, দেশকে কি আর খণ্ডিতভাবে ভালোবাসা যায়?