গণজাগরণমুখী আবৃত্তির ইশারা ‘বস্তুবাদী আবৃত্তিতত্ত্ব’
বাংলাদেশে আবৃত্তি একটি জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম। শিল্পের অন্যান্য জগতের মতো এখানে আবৃত্তির আকাশেও একাধিক তারকা আছেন। এখানকার আবৃত্তিশিল্পীদের মধ্যে একটা প্রগতিমনস্কতা রয়েছে। তাঁরা সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং কিছু কিছু প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। যেসব কবিতা এ দেশে বেশি আবৃত্তি হয় বিশেষ করে দলীয়ভাবে, তা প্রতিবাদমূলক। আবৃত্তি এমন একটি শিল্প, যা শিল্পী একাই করতে পারেন, শ্রোতা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো সঙ্গী দরকার হয় না। তা সত্ত্বেও আবৃত্তিকে ঘিরে এ দেশে ও পশ্চিমবঙ্গে অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে। বোঝাই যাচ্ছে আবৃত্তি এমন একটি শিল্প, যা তাত্ত্বিকভাবে একা একা করা গেলেও বাস্তবে তা বিস্তৃতরূপে সম্ভব হয় না। হয়তো এর কারণ আবৃত্তির সঙ্গে নাটকের একটা গভীর মিল রয়েছে।
আবৃত্তির সামাজিক ভিত্তি নিঃসন্দেহে নাটক, যা অন্য শিল্পমাধ্যমের চেয়ে অনেক ব্যাপক ও গভীর। আবৃত্তি ছাড়া প্রাচীন থেকে আধুনিক পর্যন্ত কোনো যুগের মানুষেরই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন অসম্ভব। লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত আবৃত্তিই ছিল মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডার এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরের একমাত্র মাধ্যম। লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের পরও এ প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। এমনকি আধুনিক কালেও সব সমাজের লোকজ্ঞান প্রধানত আবৃত্তির মধ্য দিয়েই বেঁচে আছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তর হচ্ছে। হয়তো জল ও হাওয়ার মতো আবৃত্তির এই ব্যাপক অবস্থিতির কারণেই তাকে স্বতন্ত্র শিল্পের সংকীর্ণ মর্যাদায় সীমিত করার প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। যতই দিন গড়াচ্ছে জগতে বিশুদ্ধ জল ও হাওয়ার পরিমাণ যেমন কমছে, দূরদর্শনের যুগে তেমনি কমছে জীবনে আবৃত্তির পরিমাণ। এমনও হতে পারে যে, সে কারণেই আবৃত্তির জন্য একটা স্বতন্ত্র শিল্পের মর্যাদা যুগের দাবি হয়ে উঠছে।
আবৃত্তির সঙ্গে নাটকের ওতপ্রোত সম্পর্ক। শুরুর পর থেকে বহুকাল পর্যন্ত আবৃত্তিই ছিল নাটকের মূল দিক। নাটক মাত্রই ছিল কাব্যনাট্য, আবৃত্তিই ছিল তা দর্শকহৃদয়ে পৌঁছে দেওয়ার প্রধান মাধ্যম। নাটক যখন থেকে শ্রুতিনির্ভর থেকে দর্শননির্ভর হতে শুরু করে, আবৃত্তির স্থান তাতে কিছু কমে যায়। এখনো মানুষ যাত্রা শুনতে যায়, আর নাটক যায় দেখতে। তবুও নাটকে আবৃত্তির স্থান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নাটকের সংলাপ উচ্চারণকে আবৃত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, সেটি অভিনয়েরই অংশ। নাটক থেকে বিচ্ছিন্ন করে কথামালা উচ্চারণের যে শিল্প তাকেই আবৃত্তি বলে মনে করা হয়। তাই বলে সংবাদ পাঠ আবৃত্তি নয়, কেননা সেটি নাটকও নয়। নাটকের সঙ্গে কাব্যের সম্পর্ক এতটা ওতপ্রোত যে, প্রাচীন ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রে নাটককে মনে করা হয় কাব্যেরই দৃশ্যরূপ, দৃশ্যকাব্য। আগের দিনের বড় নাট্যকার মানেই বড় কবি।
কবির বক্তব্য উচ্চারণের মাধ্যমে সফলভাবে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়াই আবৃত্তি। কবির বক্তব্য যে কবিতারূপেই সবসময় প্রকাশিত হবে, এমন নয়। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, চিঠি, ভাষণ যেরূপেই কবিমনের কথামালা প্রকাশিত হোক না কেন, তা বা তার অংশবিশেষ একজন আবৃত্তিকার নিজ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে জারিত করে উচ্চারণের মাধুরী মিশিয়ে শ্রোতাকে উপহার দেন। প্রচলিত আবৃত্তিতে যা প্রধানত থাকে তা এই উচ্চারণের মাধুরী। যার প্রধান উদ্দেশ্য শ্রোতাকে মুগ্ধ করা। শ্রোতা মোহিত হলেই আবৃত্তি সফল মনে করা হয়। এজন্য চর্চার মাধ্যমে আবৃত্তিকার তার উপযুক্ত কণ্ঠস্বর তৈরি ও উচারণের প্রমিতরূপ রপ্ত করেন। মোটামুটি এটাই প্রচলিত আবৃত্তির তাত্ত্বিক ভিত্তি। উপযুক্ত কণ্ঠস্বর তৈরি ও উচারণের প্রমিতরূপ রপ্ত করার জন্য শুরুতে কিছু প্রশিক্ষণ দরকার হয়। আমাদের দেশের আবৃত্তির বিভিন্ন দল যেসব প্রশিক্ষণ আয়োজন করে, তা এই চাহিদাটুকু পূরণের উদ্দেশ্যে।
কিন্তু কোনো শিল্পের তাত্ত্বিক ভিত্তি যদি দীর্ঘদিন একইরূপ থাকে, তার বিকাশ হয় না। কোনো শিল্পের তাত্ত্বিক ভিত্তি সমাজের ক্ষমতাসীন শ্রেণী ঠিক করে দেয়। সেজন্য সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার হাত বদলের সাথে সাথে শিল্পের প্রচলিত তাত্ত্বিক ভিত্তিতেও রদবদল হয়। আবার শিল্পীরা সমাজের সবচেয়ে অনুভূতিপ্রবণ ও সচেতন অংশ হওয়ায় তাঁরাও প্রয়োজনে শিল্পের প্রচলিত তাত্ত্বিক ভিত্তিতে রদবদল করে বিদ্যমান শ্রেণীগুলোর মধ্যে ক্ষমতার হাত বদলকে তরান্বিত করেন। ক্ষমতার চূড়ান্ত হাতবদল রাজনৈতিক ঘটনারূপে আবির্ভূত হয়। সব শিল্পের ক্ষেত্রেই এটি ঘটেছে। কিন্তু আবৃত্তি যে ভাষায় একটি স্বতন্ত্র শিল্পের মর্যাদা অর্জন করছে, সেই বাংলাভাষায় আবৃত্তির প্রচলিত তাত্ত্বিক ভিত্তির ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য বিচলন ঘটেনি। এই ভিত্তিকে প্রথমবারের মতো বিচলিত করেই তারিক সালাহউদ্দিন মাহমুদ তাঁর বস্তুবাদী আবৃত্তিতত্ত্ব নির্মাণ করেছেন। শিলালিপি ২০১১ সালে তরুণ ঘোষের প্রচ্ছদে ‘বস্তুবাদী আবৃত্তিতত্ত্ব’ বইটি প্রকাশ করে।
এ বই ও এর লেখক সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পেতে এর ফ্ল্যাপে মুদ্রিত বিশিষ্ট আবৃত্তিকার আশরাফুল আলমের মন্তব্যটি পড়ে দেখা যায়। তিনি বলছেন, “তারিক নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি খুব পছন্দ করত। কবিতাটির এক জায়গায় আছে, ‘সর্বাঙ্গে দংশিল মোরে নাগ নাগবালা।’ ‘নাগ নাগবালা’ শব্দ দুটি উচ্চ স্বরগ্রামে নিয়ে তারিক এমনভাবে উচ্চারণ করত যা আজও আমার শ্রবণে লেগে আছে। তার কণ্ঠস্বরটি ছিল আভিজাত্যপূর্ণ, পরিশীলিত ও দরাজ। কণ্ঠ সুন্দর হলেই ভালো আবৃত্তি করবে এমন কোনো কথা নেই। তারিকের যেটা সবচেয়ে বড় গুণ সেটা হলো আবৃত্তির জন্য কবিতাকে নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় নির্মাণ করা। এই নির্মাণ কৌশলে কোনো অপরিমিতি ছিল না এবং তা স্বকীয়তায় ছিল ভাস্বর। ফলে সে তার মতো করেই আবৃত্তি করত এবং এ আবৃত্তির পেছনে আবেগ এবং যুক্তি যথাযথভাবে ক্রিয়াশীল থাকত। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তখন তো তার আবৃত্তির জয়-জয়কার। এরপর ধীরে ধীরে সে স্বেচ্ছা অবগুণ্ঠনে চলে গেল। মন দিল আবৃত্তির গবেষণায়। ভিন্ন দৃষ্টিকোণে ভিন্ন মাত্রায় আবৃত্তি বিষয়ে নিবন্ধ লিখতে শুরু করে যা আবৃত্তির ক্ষেত্রে আর কখনোই লেখা হয়নি।”
বইটির ফ্ল্যাপে মুদ্রিত আরো দুটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। লেখক যতীন সরকারের মতে, ‘বিশ শতকের ষাটের দশকে আমাদের সামনে তারিক সালাহউদ্দিনই হয়ে উঠেছিলেন শিল্পসম্মত আবৃত্তিচর্চার স্বশিক্ষিত পথিকৃৎ। তাঁর মুখ থেকে উৎসারিত যেকোনো বাক্যকেই মনে হতো শিল্প।’ কবি কাজী রোজীর মতে, ‘ওর কণ্ঠ দিয়ে শব্দের জাদু বেরিয়ে আসত।’ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, বর্তমান গ্রন্থালোচনাটির লেখক একবার তারিকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কেন আনুষ্ঠানিক আবৃত্তিচর্চা ছেড়ে দিলেন। তিনি জানান, “আমি তখন কলেজে পড়াই। একদিন ‘ময়মনসিংহ বাংলাদেশ পরিষদ’-এর পরিচালক আমাকে আবৃত্তি করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সময়টা উনিশশ পঁচাত্তর-ছিয়াত্তরের দিকে। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করলাম। আবৃত্তি শুনে পরিচালক ভদ্রলোক এতটাই উদ্বুদ্ধ হলেন যে, তিনি ছুটে এসে করমর্দন করে বললেন, তারিক ভাই, সব হলঘর কাঁপছিল আপনার আবৃত্তির সময়; শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত। কিন্তু আমার মনে সেদিনই প্রশ্ন জাগল, আবৃত্তি করে লোক ঠকাচ্ছি নাতো? মনে হলো প্রথাগত বা আধুনিক আবৃত্তি একটা কৃত্রিম ব্যাপার। কেননা তাতে মনের ভাব প্রকাশ পায় না। মনে হলো, আনুষ্ঠানিক বা আধুনিক আবৃত্তি চর্চা করে নিজেকেও ফাঁকি দিচ্ছি। কেননা আধুনিক আবৃত্তি করে কবি-বাণী শ্রোতার মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারি না। কেবল কণ্ঠের আর কৃত্রিম ভাবাবেগের খেলা সেখানে। এসব ভেবে সেদিন থেকেই আমি প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক আবৃত্তি ছেড়ে দেই।”
তারিকের বিশ্বাস ‘আবৃত্তি সর্বশাস্ত্রানাং বোধাদপি গরিয়সী’ - এই সংস্কৃত শ্লোকে। কিন্তু তিনি আশ্চর্য হন, ‘তবু আবৃত্তি শুনে লোকের বোধোদয় হয় না।’ অর্থাৎ মানুষের আলোড়ন বা জাগরণ হয় না। তিনি এর কারণ খুঁজে বলেছেন, ‘যেসব রীতি মৌল-জ্ঞানে এতকাল আবৃত্তি করেছি, যেমন- শুদ্ধ উচ্চারণ, কবিতার ছন্দ, গানের সুর, লক্ষ্যহীন আবেগ- এই সমস্ত অপ্রাকৃতিক উপাদান ত্যাগ করাটাই আবৃত্তিশিল্পের গোপন কথা।’ তিনি মনে করেন, ‘আবৃত্তির প্রকরণগত আসল কথা হচ্ছে বিষয়গত চেতনা ও তার ভাবগত প্রকাশ, আবৃত্তির ছন্দকলা এবং সাধারণ ভাষার সচেতন প্রকাশ। যান্ত্রিক উচ্চারণ নয়, তা যতই শুদ্ধ হোক, অনিকেত আবেগ নয় এবং গানের সুর ও কবিতার ছন্দ নয়।’ তাঁর মতে, ‘আধুনিক আবৃত্তিতে প্রকৃত বিষয় ও বিষয়ী নেই। তা কবিতার ভাষায় কথা বলে। আধুনিক আবৃত্তির ভাষা থেকে যায় প্রকৃত আবৃত্তি-ভাষা থেকে ঢের দূরে। আধুনিক আবৃত্তি নির্ভর করে চেতনারহিত সাধারণ ভাষা, গান বা শব্দসুর এবং কবিতার ছন্দের ওপর। এই উপাদানগুলো আবৃত্তিকারকে বাস্তব জগতে যেতে দেয় না। আবৃত্তিকার কবিতার ফর্মের ভেতরেই বন্দী থাকেন।’
তাহলে প্রকৃত আবৃত্তি কী? লেখকের মতে, ‘আবৃত্তির মূলধারার ইতিহাস আলাদা। ... জাদু যুগের মন্ত্র উচ্চারণ, ধর্মীয় ভক্তির আবৃত্তি, ব্রতকথা, মহাকাব্যের বয়ান প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে।’ তিনি লিখেছেন, ‘প্রাচীন গ্রিস দেশে আবৃত্তি ছিল স্বতন্ত্র শিল্পকলা। বংশপরম্পরায় তার ঘরানা ব্যবস্থাও ছিল, যার অবশেষ কবিয়ালদের কূটতর্ক, কেচ্ছাকাহিনী ইত্যাদিতে আজও দেখা যায়।’ কিন্তু যন্ত্রযুগের আবৃত্তি ক্লাসিক্যাল আবৃত্তি থেকে ভিন্ন হয়ে যায়। এর কারণ সমাজে নগদ টাকার শাসন। ফলে ‘আমাদের দেশে আধুনিক আবৃত্তি যা ইউরোপ থেকে এসেছে এবং যা ডিরোজিও, মধুসূদন, সঞ্জীবচন্দ্র প্রমুখ এ দেশে পত্তন করেছেন, তা অতীতের মৃত ধারারই পুনরাবৃত্তির বিকাশ।’
হালের আবৃত্তি শিক্ষা নিয়ে তাঁর বক্তব্য হলো কবিতার ছন্দ দিয়ে আবৃত্তি ব্যাখ্যা করাতেই সংকটের মূল নিহিত। আধুনিক তথা প্রচলিত আবৃত্তির মানুষকে জাগানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণ এটা বুঝতে না পারা যে, ‘কবিতার ছন্দ আবৃত্তির কোনো কাজেই আসে না। বরং বিপরীতটাই ঘটে- তা প্রকাশের বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’ এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘সাধারণ ভাষার অন্ধোচ্চারণ ত্যাগ করতে হবে। কবিতার ছন্দ বিলোপ করতে হবে এবং শব্দসুরকে ত্যাগ করতে হবে। কেননা এগুলো আবৃত্তিকারকে বাস্তব জগতে যেতে দেয় না।’ গ্রন্থটির একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘কবিতার গঠন ভেঙে দেওয়াই আবৃত্তির মুক্তির মৌল শর্ত’- এ থেকেও এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্যটি পরিষ্কার বোঝা যায়।
‘একটি নমুনা অনুশীলন’ অধ্যায়ে তিনি বলছেন, ‘আবৃত্তির আগে কবিতার অর্থ-মর্ম-তাৎপর্য নিঃশেষে আত্মীকরণ করে নিতে হয়। এরপর সচেতনতাসহ ভাব-আবেগ এবং আবৃত্তির ছন্দ-যোগে তা প্রকাশ করতে হবে। ... কবিতার অর্থ-মর্ম-তাৎপর্য নিঃশেষে আত্মীকরণ মানে কবিতার অন্ধ-আত্মসাৎ বা গলাধঃকরণ নয়। কবিতার বিষয় ও রূপকে সমালোচনার চোখেও দেখতে হবে। কবিতার বিষয় যদি সমালোচনায় টিকে যায় তবে কথা নেই, তাকে যথাযথ গ্রহণ করতে হবে। বিষয়ে কোনো ভুল বক্তব্য থাকলে আবৃত্তিকার সত্যের নিরীখে তা ঠিক করে নেবেন; আবৃত্তির ভাষার সাহায্যে, নন্দনতত্ত্বের আলোকে শুধরে নিতে হবে।’ অর্থ-মর্ম-তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য নমুনা হিসেবে যে কবিতাটিকে তিনি এখানে বেছে নিয়েছেন তা জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’। তাঁর ব্যাখ্যা এক ব্যতিক্রমী অনুভব যা সমগ্র জীবনানন্দকে এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে।
তারিক লিখেছেন, ‘কবিতাটিকে আপাতদৃষ্টিতে নিছক আত্মঘাতী ক্লান্তি, পলায়নপর মনোবৃত্তি, আত্মহত্যা, নৈরাশ্যবাদ, জীবনজ্বর বা/এবং ভোগবাদের কবিতা বলে মনে হতে পারে। বিদ্যমান বিভিন্ন অর্থহীন ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি-আক্রান্ত ব্যাখ্যায় কবিতাটিকে এ আঙ্গিকে ব্যাখ্যাও করা হয়েছে, হচ্ছে। আমরা দেখেছি, গোটা কবিতাটি পুঁজিবাদের ধস এবং সাম্যবাদী সমাজের অনিবার্যতাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র, ধনবাদী সভ্যতার বিধি-ব্যবস্থার প্রতি যার অনাস্থা চূড়ান্ত, তার আত্মদান লোকজাগরণের লক্ষ্যে, বিপ্লব নির্মাণের লক্ষ্যে সংঘটিত। বঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত মানুষের বিপন্নতার কথা ভেবে ভেবে বহু বিনিদ্র রাত পার করে সে এ ব্যবস্থার অসারতা প্রমাণপূর্বক এর প্রতিকারের লক্ষ্যে আত্মাহুতি দিল।’
চোখ পাল্টায়ে কয় : ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার-
কী এর মানে? তারিক লিখেছেন, ‘ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া শ্রেণির প্ররোচনা বিবেককে উল্টে ফেলে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়, বলে, দুঃসময় ঘনিয়ে এসেছে, সভ্যতা ভেসে গেছে, বেশ হয়েছে, এ সুযোগকে কাজে লাগাও। লুটেপুটে খাও। ভেবেচিন্তে সময় নষ্ট না করে বরং এই বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে মজুদ করো, দ্রব্যমূল্য বাড়াও, তাতে যদি লোক মরেও তাতে ভ্রুক্ষেপ করা বোকামি।’ আত্মাহুতির পূর্বে তাই তার প্রতিজ্ঞা, ‘বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব কালীদহে বেনোজলে পার।’ কবিতাটির প্রতীকাশ্রয়ী শব্দমালা ভেদ করে ও একে স্তরে স্তরে ছেদ করে তারিক দেখিয়েছেন, ‘কবিতাটি নেহায়েত আত্মহত্যার নয়- আত্মাহুতির, প্রতিবাদের, বিপ্লবী মৃত্যুর, বিপ্লবী উত্থানের।’
কোন কবিতার এরূপ প্রত্যক্ষ জীবন-জগৎ সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়া এর কাঙ্ক্ষিত আবৃত্তিই সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে কবিই কি কেবল তার কবিতার শ্রেষ্ঠ আবৃত্তি করতে সক্ষম যেহেতু এটি তাঁর অনুভবজাত? তারিকের মতে, কবিরা বরং তাঁদের কবিতার খারাপ আবৃত্তিই করেন, যেহেতু আবৃত্তির ভাষা ভিন্ন এবং আবৃত্তি একটি স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম। আর আবৃত্তিকার কবিবাণীর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেন না, বরং নিজস্ব সত্যবোধ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি তাতে শিল্পসম্মত উপায়ে যোগ-বিয়োগ করেন। এদিক থেকে আবার দেখা যায় কবির সৃষ্টি আবৃত্তিকারের কাছে একটি টেক্সট মাত্র। তাহলে আরেকটি প্রশ্ন উঠতে পারে, আবৃত্তিকারকে কবির কাঁধে ভর করে স্বাতন্ত্র্যের দাবি করতে হচ্ছে কেন? কবিভাষার বেশির ভাগ অংশ যদি আবৃত্তিকার বিসর্জন দিতে চান, তবে তিনি নিজেই তার সৃষ্টির অর্থাৎ আবৃত্তির টেক্সট তৈরি করছেন না কেন? যদি তা করেনও তাহলে আবার অন্য আবৃত্তিকার কীভাবে তা ব্যবহার করবেন, নাকি কখনো ব্যবহার করবে না?
বইটির বেশির ভাগ আলোচনা আবৃত্তিকারদের ছন্দের জালে আটকেপড়ার বিভ্রান্তি ও তা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে। কিন্তু আমাদের আবৃত্তিকারদের ছন্দের জালে আটকে পড়ার কারণ তারা কবিতাকেই তাদের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা দৃষ্টিকে প্রসারিত করে উপন্যাসের অংশ, গল্প, নাট্যাংশ, প্রবন্ধ ইত্যাদিকে তেমন একটা গ্রহণ করেননি। কবিতাকে ভালোবেসেই তারা আবৃত্তিতে এসেছেন আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। এখন প্রয়োজন অন্যান্য ভাষাশিল্পের দিকেও মনোনিবেশ করা। বৃহৎ অর্থে অন্য ভাষাশিল্পীরাও কবিই তো। যদি আবৃত্তিকাররা কবিতা ছাড়া অন্য দেশ থেকেও তাদের কাঁচামাল নেন, তাহলে হয়তো ছন্দের মায়াজাল কাটাতে কোনো বড় যুদ্ধের দরকার হবে না।
তারিক সালাহউদ্দিন মাহমুদের বস্তুবাদী আবৃত্তিতত্ত্ব বেশ কিছু দিন ধরে জারি আছে, কিন্তু এটি অনেককে নাড়া দিলেও এখনো তেমন সাড়া ফেলেনি। তাকে যিনি ‘আবৃত্তির নয়া ভাষার রূপকার’ বলে মনে করেন এবং গুরু মানেন সেই ব্যতিক্রমধর্মী বিশিষ্ট আবৃত্তিকার কামরুল হাসান মঞ্জুও এই তত্ত্বকে মাথায় করে রেখেছেন, কিন্তু পুরোপুরি পালনের ঝুঁকি নেননি। বাস্তব মানে হাতেনাতে প্রয়োগ ছাড়া এ তত্ত্বের পুরো যাচাই সম্ভব না। তবে মঞ্জুর আবৃত্তিতে যে একটা ভিন্ন মাত্রা আছে যা তাকে দেশের অন্যান্য আবৃত্তিকার থেকে সহজেই পৃথক করে দেয়— তা যে এরূপ আবৃত্তি-ভাবনার একটা প্রতিফলন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বর্তমান আবৃত্তি যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা অতি নড়বড়ে। আবৃত্তিকে একটা স্বতন্ত্র শিল্পের মর্যাদায় প্রচারিত ও অধিষ্ঠিত হতে গেলে একটা ভালো জমি প্রয়োজন। তারিক সালাহউদ্দিন মাহমুদের বস্তুবাদী আবৃত্তিতত্ত্ব আবৃত্তিকে একটা শক্ত মাটির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। তার এ বই আবৃত্তির বর্তমান দুর্বল ভিত্তিটা ভেঙে ফেলে একটা গণজারণকামী সর্বজনমুখী সবল ভিত্তির দিকে ইশারা।