চলচ্চিত্র সমালোচনা
মোহের তোড়ে বিধ্বস্ত মানবসত্তা
মানুষ কি আসলে মরে? বেশির ভাগ মানুষই হয়তো মারা যায়, তবে কেউ কেউ বেঁচে থাকে। আমাদের সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথাই ধরুন না। তিনি তো মাত্র ২১ বছর বয়সে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। অথচ সুকান্ত তো আমাদের মাঝে আজও দিব্যি বেঁচে আছেন। এই গুণী কবি, অ্যাকটিভিস্টের মতো আরো অনেকেই মরে গিয়েও বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। আবার এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া কোটি কোটি মানুষ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যাদের কথা কেউ মনে রাখেনি, রাখবে না। তাই কর্মটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কর্মটাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে অনন্তকাল, নচেৎ মৃত্যু।
গত ৭ নভেম্বর পরপারে পাড়ি জমান প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তাঁর এই অকাল প্রয়াণে চলচ্চিত্রপ্রেমী-সংশ্লিষ্টদের মনে নেমে আসে অব্যক্ত শোকের ছায়া। যার রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। বাপ্পাদিত্যের প্রয়াণ শোকে মুহ্যমান হলেও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের কিন্তু একটা সান্ত্বনার জায়গা আছেই। আর সেটা হলো, তাঁরা জানেন বাপ্পাদিত্য আসলে মরেননি! তিনি তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে হয়তো বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। ‘শিল্পান্তর’ (২০০২) তাঁর এমনই একটি কর্ম। এখানে এই চলচ্চিত্রকে ধরেই এগিয়ে যাবে আলোচনা।
২.
এক ‘পাগল-ছাগল’ নিবারণ-এর গল্প শিল্পান্তর। নিবারণ পটচিত্র আঁকেন। ছোটবেলায়, মা-বাবাকে হারিয়ে নিষ্ঠুরতার মধ্যে বেড়ে ওঠা নিবারণ পৌরাণিক যমপুরীর নির্মম অত্যাচারের চিত্র এঁকেই তৃপ্ত। তিনি নির্মমতা ছাড়া ‘ভালো’ কিছু আঁকতে পারেন না। তাই তাঁর ঘর-সংসারও হয় না। অবশ্য এ নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপও নেই। কিন্তু একসময় তাঁর পটচিত্রই তাঁকে গিলে খেতে চায়। তাই তিনি বাঁচতে বিয়ে করেন সার্কাস দলের কুসুমকে। যে কুসুম অন্নাভাবে জ্যান্ত মুরগি, সাপ খাওয়ার কৌশল রপ্ত করেছিল অনেক আগেই। নিবারণের সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় কুসুম ভেবেছিল হয়তো তার অন্ন-কষ্টের দিন ফুরিয়ে এলো। কিন্তু না, পট আঁকার আঙুল দুটি হারিয়ে স্বামী নিবারণও জ্যান্ত মুরগি, সাপ খাওয়ার কৌশল রপ্ত করতে চান। একপর্যায়ে নিবারণ কুসুমকে ছাপিয়ে নিজের আঙুল খাওয়ার কৌশলও রপ্ত করেন।
৩.
‘... আমি ... অর্থের বিনিময়ে কোনো বাণিজ্যিক কাজ করি না কিংবা কারো প্রতিকৃতি এঁকে দেই না কিংবা কোনো ফরমায়েশি ছবি আঁকি না ...।’ ‘আলোকিত বাংলাদেশ’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘সৎ মানুষ সত্যিই বিরল’ শিরোনামে এই কথাগুলো বলেন চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশির। এই চিত্রশিল্পী বেঁচে থাকার জন্য বছরে দু-একটা ছবির প্রদর্শনী করেন। তা দিয়েই চলে তাঁর জীবনযাপন। কিন্তু মুর্তজা বশির তাঁর শিল্পীসত্তাকে কখনো বিক্রি করেননি। কারণ শিল্পসত্তা যে কখনো বিক্রি হতে পারে না। তাই মুর্তজার মতো কোনো শিল্পীই পারেন না কোনো কিছুর বিনিময়ে ফরমায়েশি কাজ করতে। হোক না তিনি চিত্রশিল্পী কিংবা অন্য কোনো শিল্পী। শিল্পী চলেন তাঁর আপন খেয়ালে। বলেন নিজের বা আপনার কথা।
মুর্তজা বশির বেঁচে থাকার স্বার্থে বছরে দু-একটা প্রদর্শনী করলেও ‘শিল্পান্তর’-এর নিবারণ সেটুকুও করতেন না। তিনি পটচিত্র শুধু তাঁর মনের খোরাক মেটানোর জন্যই আঁকতেন। কারণ হয়তো তিনি তাঁর নিজের বা আপনার খোঁজ পেয়েছেন। তাই তিনি তাঁর আপনসত্তার সাধন করে চলেন। আর যে নিজেকে চেনে সে তো অন্যদেরকেও স্পষ্টভাবে চিনতে বা দেখতে পায়। সেই সঙ্গে দেখতে পায় সমাজ-রাষ্ট্রের শাসন-শোষণ-নির্যাতনের চিত্র। সে জন্য হয়তো নিবারণের পটচিত্রে বারবার উঠে আসে ‘সভ্য’ সমাজের নির্যাতন, নিপীড়নের চিত্র। ফলে নিবারণের পক্ষে সম্ভব হয় না অর্থ বা কোনো কিছুর বিনিময়ে অন্য কারো মতো করে চিত্র আঁকা। আর জোর করে করাতে গেলেই বাধে বিপত্তি। তাই ‘শিল্পান্তর’-এ দেখা যায়, দারোগাবাবু ডাক্তারের পরামর্শে অসুস্থ মেয়ের ঘরে চিত্র আঁকার জন্য নিবারণকে জোর করে ধরে নিয়ে আসেন। নিবারণ যেন তাঁর অসুস্থ মেয়ের ঘরের দেয়ালে দেব-দেবী, লতা-পাতা, কুসুম-কলি, জোসনা পরীর মতো সুন্দর সুন্দর চিত্র এঁকে দেন। কিন্তু নিবারণের পক্ষে এমন ‘সুন্দর’ চিত্র আঁকা সম্ভব হয় না। তাই তিনি ফুল, লতা-পাতার পরিবর্তে এঁকে দিয়ে আসেন পৌরাণিক যমপুরীর নির্যাতনের চিত্র।
ফলে ‘সভ্য’ সমাজের মতো করে চিত্র আঁকতে না পারায় নিবারণের পটচিত্রের যেমন মূল্যায়ন হয় না, হয় না তাঁরও মূল্যায়ন। যদিও নিবারণদের কাছে এই অবমূল্যায়নের কারণ অনেকটাই পরিষ্কার। হয়তো এ নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। তাই ‘শিল্পান্তর’-এ এক ঘণ্টা ২৭ মিনিটের দৃশ্যে নিবারণকে বলতে দেখা যায়, “ওই দেখ (কুসুমকে উদ্দেশ্য করে) আমার ভিটা। আশপাশটা ঘুরে কোনো লোকজন পাইবেন লাই। গঞ্জ থেকে ভিন্ন হয়ে আমি এইঠানে একা। লোকজন বলে এইটা ভূত ভিটা। বলতে পারবে ক্যানে? সকলে যেটা বুঝতে লারে, সেটারে বদনাম দেয়গো। গঞ্জ জুড়ে লোকজনদের সাথে আমার মন তো আর মিলমিশ লাইগো। কথাটার মিলমিশ লাই। আমাকে দেখে লোকে মজা পায়। লোকে বলে আমি একটু ‘খ্যাপা’ আছি।”
নিবারণ ও তাঁর কর্মের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য মূল্যায়ন না করতে পারার কারণ আরেকটি দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সেটা হচ্ছে নিবারণ জীবন, সমাজকে যেভাবে দেখেন অন্যরা সেভাবে দেখতে পারেন না। কারণ আমাদের সমাজে পুঁজিবাদ যে মোহ, মূল্যবোধ তৈরি করে রেখেছে কিংবা যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে তার মধ্যেই সাধারণ মানুষ সব সময় আবর্ত হতে থাকে। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সাধারণ মানুষ সেই মোহ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনের পেছনে ছুটতেই থাকে, কিন্তু তাদের এই চাহিদা কোনো দিন মেটে না। আর সেই সঙ্গে মানুষ হারায় নিজেকে বোঝার অবকাশ। সেই ফাঁকে সমাজে তৈরি হয় বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতাসহ নানা ধরনের সংকট। নিবারণের মধ্যে সেই মোহ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনের প্রত্যাশা নেই বলেই তিনি সমাজের ওই ফাঁক দেখতে, নিজেকে বুঝতে পারেন। আর সেই চিত্রই নিবারণ তুলে ধরেন পটচিত্রে। আর এটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায় ২২ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের কথোপকথনে-
‘কবিরাজ : ... বাপু হে, লোকজন তো বুঝবেক লাই, এমন চিত্তির এঁকে কী লাভ?
নিবারণ : লোকজনে কী বুঝগো দাদা? কেমন চিত্তির আঁকত আমার মা, সেটা আমি জানি। আমার বাপ কি সেটার হদিস পাইয়াছিল?’
তাই বলা যায়, নিবারণ পেলেও নিবারণের বাবার মতো সাধারণের পক্ষে হয়তো তা সম্ভব হয় না।
৪.
‘শোষণ আর শাসনের মাত্রা চরমে পৌঁছালে মানুষ বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকুও হারায়। তখন মানুষ তাদের রক্ত-মাংস চুষে খাওয়া শাসক ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে ভয় পায় না। ইউরোপে সামন্তযুগে একবার এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে রাজপথে নেমে আসে শোষিত মানুষ। ফলে রাজা ও চার্চের একটানা স্বৈর-আধিপত্যের ভিত নড়ে ওঠে। এই আন্দোলন, প্রতিবাদকে দমন করতে সামন্ত প্রভুরাও নারকীয় সব পথ অবলম্বন করে। যেসব নারী সে সময় প্রচলিত নিয়ম ভেঙে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল তাদের ‘ডাইনি’ আখ্যা দিয়ে শুরু হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। প্রায় ৬০ লাখ ‘ডাইনি’কে হত্যা করা হয়েছিল ওই সময়।’
চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর নবম সংখ্যায় “পাপাত্মা’র বিপরীতে ‘মহাত্মা’ নির্মাণে গান্ধী” শিরোনামের লেখায় এই কথাগুলো বলা হয়েছে। এই আলোচনা থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না, আমাদের সমাজে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘জঙ্গি’, ‘অস্বাভাবিক’, ‘হিন্দু-মুসলিম’, ‘শিয়া-সুন্নি’, ‘ভয়ংকর’ আখ্যা কেন দেওয়া হয়। সমাজ-রাষ্ট্র তার প্রয়োজনের স্বার্থে এদেরকে নির্বিচারে হত্যা করলে সাধারণের মনে প্রশ্ন তো উঠেই না, বরং একধরনের নীরব সমর্থন থেকে যায়!
‘শিল্পান্তর’-এ এমনই একটি চরিত্র ‘রাক্ষসী’ কুসুম। সে সার্কাসে জ্যান্ত মুরগি, সাপ গিলে খায়। আর এটাই তার খেলা। এ জন্যই সবাই তাকে রাক্ষসী আখ্যা দিয়েছে। যে জ্যান্ত মুরগি, সাপ খেয়ে নেয় তাকে তো ‘রাক্ষসী’ বলাই যায়। কিন্তু সত্যের আড়ালেও তো সত্য থাকে। যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ৫৬ মিনিট ৩২ সেকেন্ডে শুরু হওয়া দৃশ্যে কুসুমকে বলতে দেখা যায়, “ওটা আর কোনো বিদ্যা লয়। ওটা খাই খাই লিশা। জন্ম থেইকে দেখছি শুধু খাই খাই লিশা। খাওয়া ছাড়া ভিটাতে অন্য কোনো স্বপ্ন ছিল না। বিয়াটা তো আমি আগেই দেইখা লিয়েছি। বরটা সোহাগ ছাইড়ে দিয়া বলত, ‘ভাত দাও। খিদা লাইগেছে।’ বলতো, ‘একদিন উহারা সব ভাত কাইরা লিবেক। তখন অন্যকিছু খাইতে হবে।’ খিদার টানে সকলকে কী না কী করতে হয়। বরটা একদিন চইলে গেল ঘর ছাইড়ে।” তারপর চলচ্চিত্রে দেখা যায়, কুসুমের বর জ্যান্ত মুরগি ধরে খাচ্ছে। আর পরে কুসুমও অন্নাভাবে সেই কৌশল রপ্ত করে নেয়।
ঠিক যেমনটি রপ্ত করে নিয়েছে ভারতের উত্তরপ্রদেশের বহু গ্রামের মানুষ শুকনো ঘাসের বীজ ও ঘাসের তৈরি রুটি খাওয়ার কৌশল (এনটিভি অনলাইনে ‘তীব্র খরা, মানুষ বেঁচে আছে ঘাসের রুটি খেয়ে’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়)। একসময় যখন শুকনো ঘাসও ফুরিয়ে যাবে তখন হয়তো উত্তরপ্রদেশের মানুষদের ‘রাক্ষসী’ কুসুমের মতোই জ্যান্ত মুরগি, সাপ ধরে খেতে হবে। যখন তাও ফুরিয়ে যাবে তখন নিবারণের মতো নিজের হাত কামড়ে খাওয়ার মতো উত্তরপ্রদেশের মানুষদের নিজেদের শরীর কামড়ে খাওয়ার কৌশল রপ্ত করতে হবে। তখন তাদেরও কুসুম-নিবারণের মতো আখ্যা দেওয়া হবে ‘রাক্ষস-রাক্ষসী’ বলে।
‘শিল্পান্তর’-এর এক ঘণ্টা ১৯ মিনিটে শুরু হওয়া গ্রাম্য সালিসের দৃশ্যে এলাকাবাসীদের বলতে দেখা যায়, ‘এ ঘাট বাঘের জঙ্গল লয় হে। এটিক এসব চলবেক লায়। সার্কাসটা ডাকিনী, এই ডাকিনী নিবারণকে বিয়া কইরাছে। এই ডাকিনী নিবারণকে খাইয়া লিবেক। বলিয়া দিলি। এ বাপ, লিবারণকে ডাকিনী পায়েছে? ওয়ার মতো কতো জুয়ান মরদ ও গিলে লিয়েছে, তার কোনো হিসাব নাই। ... শুন হে, (কুসুমকে উদ্দেশ করে সালিসে এক ব্যক্তি) নিবারণটাকে বইলা দিবা, এখন থেকে চাল-চলনটা সিদা না করলে এ গাঁ টনলে খিদাই দিব। লাথ মাইরা মুখ ভাইঙ্গা দিব। হুরকা জাম কইরে ছাইড়ে দিব। সাবধান। (কুসুমকে উদ্দেশ করে পুলিশ) আর কারো পাতা-ছাগল-মুরগিতে যদি হাত পড়ে, তাহলে জিব টেনে ছিড়ে বাঁশ পেটা করে ছাড়ব। গণধোলাই দেব।’
ঘাসের রুটি শেষ হলে জ্যান্ত পশুপাখি যখন খাওয়া শুরু করবে উত্তরপ্রদেশের ওই গ্রামবাসীরা, তখন হয়তো নিবারণ-কুসুমের মতো এভাবেই গ্রামছাড়া করার পাঁয়তারা চলবে। আর যদি ইউরোপের সামন্তযুগের মতো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নামে ওই গ্রামবাসী, তাহলে হয়তো সংকট ‘সমাধানে’ ভারত রাষ্ট্র ‘ডাইনি-ডাকিনী-রাক্ষস-রাক্ষসী’ নির্মূল অভিযান শুরু করবে।
৫.
কুসুম ক্ষুধার জ্বালায় দীর্ঘদিন কাজ করেছে যাত্রাদলে। জ্যান্ত মুরগি, সাপ খেয়ে মানুষকে দেখিয়েছে খাই খাই খেলা। আর খেলা দেখিয়ে যা আয় হয়েছে সব নিয়েছে যাত্রাদলের ম্যানেজার। সেই সঙ্গে মালিক লুটেপুটে ভোগ করেছে কুসুমের শরীর। কিন্তু যখনই কুসুমের বয়স হয়েছে, শুকিয়ে গেছে তার যৌবন; তখনই আর কুসুমের স্থান হয় না যাত্রাদলে। তাই ম্যানেজার দলের আরেক মেয়ে চম্পাকে কুসুমের খেলাটা শিখে নিতে বলে। আবার যখন চম্পার যৌবন ফুরিয়ে যাবে তখন হয়তো তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। তার জায়গায় আগমন ঘটবে নতুন কোনো চম্পা-কুসুমের।
তাই কুসুম যাত্রাদলের নরকখানা থেকে বের হয়ে ভালোবেসে বিয়ে করে নিবারণকে। কিন্তু ততদিনে নিবারণও তার পট আঁকার আঙুল দুটি হারিয়েছে (পুলিশের মেয়ের ঘরে যমপুরীর চিত্র আঁকায় নিবারণের আঙুল ভেঙে দেয় ওই পুলিশ)। আর নিবারণও বুঝে গেছে, কুসুমের মতো জ্যান্ত পশুপাখি খাওয়ার অভ্যাস করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। তাই নিবারণও কুসুমের কাছে জ্যান্ত মুরগি খাওয়ার কৌশল শিখতে চায়। কুসুম না শেখাতে চাইলে নিবারণ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এমন সময় যাত্রাদলের ঘেটু এলে কুসুমের এই অবস্থা দেখে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘তবে তুই ভালো লাইগো কুসুম। ভেবেছিলাম, সার্কুসটা থেকে যদি কেউ পালায় যায়, তবে সে বেঁচে যায়। এ তোর কেমন বাঁচা হলো রে কুসুম।’
নারী অধিকারের কথা বলতে বলতে এই সমাজ মুখে ফেনা তুলে ফেললেও আদতে তাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যাত্রাদলের ম্যানেজার, দারোগাবাবুদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী আজও ভোগ্যপণ্য। যেখানে ঘরে, বাইরে, কর্মস্থল সব জায়গাই নারী অধস্তন, পরাধীন। আশ্রয়দাতা, পালনকর্তা রূপে সব সময় সব সময়ই চলে নারীর ওপর ধর্ষণ, নির্যাতন। আর নারী এই অবস্থা কুসুমের মধ্য দিয়ে সুনিপুণভাবে তা নির্মাণ করেছেন বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
৬.
২০০২ সালে যখন ‘শিল্পান্তর’ নির্মাণ করা হয়, তখন পর্যন্ত শুভাশিস মুখোপাধ্যায় টালিগঞ্জের বেশ জনপ্রিয় কমেডিয়ান। বর্তমানেও অনেকটাই এ কথা প্রযোজ্য। তাঁর জন্মই যেন হয়েছে কমেডি চরিত্রে অভিনয় করার জন্য! তাই প্রতিটি চলচ্চিত্রে শুভাশিসের একই উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কিন্তু শুভাশিসকে ঘিরে যে ছক বা ধারণা তৈরি করা হয়েছে, বাপ্পাদিত্য তার ‘শিল্পান্তর’ দিয়ে তা ভেঙে দিয়েছেন। ‘শিল্পান্তর’-এ প্রধান চরিত্রে শুভাশিসের দুর্দান্ত অভিনয়ই তাঁর পরিচয় বহন করে। অর্থাৎ একজন নায়ক, খলনায়ক, কমেডিয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেই যে তাঁকে সব সময় ওই চরিত্রেই অভিনয় করতে হবে, বিষয়টি মোটেই এ রকম নয়। শুভাশিসকে দিয়ে বাপ্পাদিত্য বুঝিয়ে দিয়েছেন, একজন অভিনেতার ভূমিকা কী হবে চলচ্চিত্রই বলে দেবে।
৭.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির অবস্থা তখন একদম ভঙ্গুর। স্বাভাবিকভাবেই অন্য অনেক দেশের মতো এ দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা পড়েন মহাসংকটে। কারণ যুদ্ধে অন্য সবকিছুর মতো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ভেঙে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে নির্মাতাদের হাতে নেই চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো কোনো টাকা। ফলে ওই সময়টাতে নির্মাতারা ক্যামেরাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে, অনেক সময় ধার করে চলে আসেন স্টুডিওর বাইরে। টাকা নেই বলে কৃষকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য একজন কৃষককেই তারা অনুরোধ করে অভিনয় করে দিতে। এভাবে অন্যান্য চরিত্রের অভিনয়ও বাস্তব চরিত্র দিয়ে করিয়ে নেওয়া হতো। যা ধারাকে নব্য-বাস্তববাদ ধারা বলে খ্যাত।
ইতালিয়ান নির্মাতা ভিত্তোরিও ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থিফ’ এই ধারার অন্যতম উদাহরণ। এই চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন ‘পথের পাঁচালী’। সত্যজিৎ ছাড়াও ঋত্বিক ঘটক, বারীণ সাহা, নিমাই ঘোষসহ অনেকে এই ধারায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘শিল্পান্তর’-এও এই নব্য-বাস্তববাদ ধারার ব্যবহার লক্ষণীয়। চলচ্চিত্রের এক ঘণ্ট চার মিনিট ৫০ সেকেন্ডে শুরু হওয়া চড়কপূজার দৃশ্যটি ধারণ করার জন্য চৈত্র মাসে সত্যিকার চড়ক মেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন নির্মাতা। তিনি লোকেশন বাছাই করেছেন স্টুডিওর বাইরে। এর ফলে চলচ্চিত্রটি বাস্তবতার অনেকটাই কাছাকাছি যেতে পেরেছে। হয়েছে প্রাণবন্ত।
আমাদের দেশের নবীনসহ সব ধরনের নির্মাতাদের এই ধারা পথের দিশা দিতে পারে। নবীন নির্মাতারা যেমন স্বল্প বাজেটে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারবেন, তেমনই বড় বাজেটে না করে স্বল্প বাজেটে এই ধারায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে অর্থও উঠিয়ে আনা সম্ভব। সেই সঙ্গে বাড়বে চলচ্চিত্রের মানও।
৮.
‘শিল্পান্তর’-এ নিবারণ এই ‘সভ্য’ সমাজের সঙ্গে কখনো আপস করেননি। এ জন্য তাকে কম ধিক্কার, যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি। তবু নিবারণ ছিল তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। ঠিক তেমনি ‘শিল্পান্তর’-এ এমন কোনো শট, রঙের ব্যবহার, কথা, শব্দ, সুর পাওয়া ভার যা এই ‘সভ্য’ সমাজের ফাঁক-ফোকরকে সমর্থন করে। কারণ নিবারণের মতো বাপ্পাদিত্যও একজন শিল্পী যিনি সমাজ-রাষ্ট্রের ভয়াবহতাটা দেখতে পান।