জন্মদিন
তিনি সব সময়ই সৌমিত্র!
আদিবাসীদের এক বাজার। যুবকের খদ্দরের পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে সেঁটে আছে গায়ের সঙ্গে। চোলাইয়ের নেশায় পরাস্ত নয় সে, মুখ দিয়ে জালের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে অবচেতনে টেনে যাওয়া ফিল্টার টিপ্ড সিগারেটের ধোঁয়া। তবে তার চোখে ভাসছে কলকাতার কোনো এক পার্টি, যেখানে চৌকোনা গ্লাসে সার্ভ হচ্ছে ভিনদেশী স্কচ হুইস্কি। সেখানে সে নিজেও কোট-টাইয়ে ধোপদুরস্ত এক কর্মকর্তা—সামাজিকতা টিপটপ জারি রাখতে ঠোঁটের কোণের পেশাদারি হাসিটা একমুহূর্তের জন্যও ম্লান হয় না। সেখান থেকে বর্তমানে ফিরে তার মুখে নৈরাশ্য আর হিংস্রতার বাঘবন্দি হাসি ফুটে ওঠে; সেই যুবক—সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলে ওঠেন, ‘যত উঠবে, তত নামবে।’
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ যাঁরা দেখেছেন, এ দৃশ্য তাঁদের ভোলার নয়। শহর থেকে মুক্ত বাতাসের সন্ধানে আসা চার যুবকের যান্ত্রিক জীবনকে ভুলে যাওয়ার প্রচেষ্টা থেকে সবকিছু; অরণ্যের গল্পের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের নৈরাশ্য; কী ছিল না সেখানে! আর সেই সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বনাম শর্মিলা ঠাকুরের ক্যারিশমাটিক স্মার্টনেসের পাল্লাপাল্লি লড়াই- প্রেম; সত্যজিৎ রায়ের সিগনেচার মার্ক নির্মাণ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আজ একাশিতম জন্মদিন, শ্রদ্ধার উদাহরণ হিসেবে এ ছবির কথাই মনে আসে।
সত্যজিৎ রায়ের নিরীক্ষায় চোখ সব সময়ই বিশেষ কিছু। চোখের যে কত রকম ভাষা আর অভিব্যক্তি থাকতে পারে, তার তত্ত্ব-তালাশে সত্যজিৎ ক্যামেরা কত কতভাবে যে ঘুরিয়েছেন—তার ইয়ত্তা নেই। তবে হ্যাঁ, সে জন্য তো চোখের মতো চোখও থাকা চাই, নয় কি! সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কপাল-চোয়ালের কোটরে বিচিত্র চোখ; যা প্রতিনিয়তই হাস্যোজ্জ্বল, গভীর অথচ ডিপ্রেসিভ, প্রচণ্ড ভায়োলেন্ট এক রশ্মি লুকিয়ে তার মাঝে। ওই চাহনিটুকুই সৌমিত্রকে ‘সৌমিত্র’ করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল।
তবে সৌমিত্র শুধু চোখের কারবারি নন। ইন ফ্যাক্ট, সেটা তো তাঁর সহজাত একটা বিষয়। একই কথা খাটে তাঁর ভরাট আর আচ্ছন্ন করে দেওয়া জাদুকরি কণ্ঠস্বরেও। অভিনেতা সৌমিত্র অনন্যসাধারণ তাঁর ভার্সেটাইল স্মার্টনেসের তোড়ে। আর সেই সঙ্গে, সবকিছুতেই নিজের সত্তাকে চরিত্রে ফুটিয়ে তোলার ভয়াবহ ক্ষমতা। যার জন্য দিনশেষে কেন যেন অভিনয় আর অভিনয় হয়ে থাকেনি তাঁর। তা সে হীরক রাজার দেশের প্রতিবাদী শিক্ষক, অরণ্যের দিনরাত্রিতে শহর ছেড়ে আসা উঁচু মাইনের কর্মকর্তা, ফেলু মিত্তির তথা ফেলুদার অন্তর্ভেদি পর্যবেক্ষণ, কিংবা অপুর সংসারের অপু—সবকিছুতেই সৌমিত্র নিজের চরিত্রের চেয়েও বাড়তি কিছু হয়ে উঠতে পেরেছেন অনায়াসে। শেষ পর্যন্ত রুপালি পর্দার চরিত্রের চেয়েও বড় বেশি বাস্তব হয়ে উঠেছেন রুপালি পর্দার সৌমিত্র। কারণ একটাই, যখন যে চরিত্রেই দেখুন না কেন, সেই নির্দিষ্ট চরিত্রের সঙ্গে ‘সৌমিত্র’ চরিত্রটাও অদ্ভুতভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর কতই না অনায়াসে। বিশেষ করে হতাশা আর হিংস্রতায় যে বিচিত্র তিনি, তার স্পষ্ট ছাপ সব সময়ই ফুটে উঠেছে চরিত্রায়নের যেকোনো সময়। মনে রাখতে হবে, ‘দেবদাস’ ছবিতে কিন্তু উত্তম কুমারও ছিলেন—তবে চুনিলাল হিসেবে! কারণ নিশ্চয়ই স্পষ্ট, সৌমিত্রের চেয়ে মোক্ষম অপশন তো এখানে আর কেউ হতেই পারেন না।
১৯৩৫ সালে জন্ম নেওয়া এই গুণী অভিনেতার ক্যারিয়ার, গুণাবলি আর প্রাপ্তির হিসাব বলতে যাওয়া খুবই নিরর্থক প্রচেষ্টা। একে তো তাঁর পাল্লা বহু ভারী, অন্যদিকে পুরস্কার কিংবা ক্যারিয়ার দিয়ে তো আর সৌমিত্রকে বিচার করা সম্ভব নয়! অভিনয়ের জন্য এখনো প্রচণ্ড ঝোঁক তাঁর, তা মঞ্চে কিংবা ছোট বা বড়পর্দায়— যেখানেই হোক।
সিনেমার ডায়ালগের মতো তিনি কি নিজে বিশ্বাস করেন, উত্থানের সমানুপাতিক হারেই চলে পতন? কে জানে! তবে শিল্পী সৌমিত্রের উত্থানের হিসাবটাও করা দুষ্কর, আর পতনের তো কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ তিনি এমন এক একক, যার সঙ্গে আর কোনোকিছু বা কাউকেই পরিমাপ করা যায় না।
সূচনা কি বর্তমান, তিনি যে সব সময়ই সৌমিত্র!