বই আলোচনা
মানুষজীবন ও সমাজ বাস্তবতার গল্প
‘দুপুর যখন আরো তেতে ওঠে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষের ছায়া ছোট হয়ে পায়ের কাছে গড়াগড়ি খায়, তখন দেখা যায় সৈন্য দুজন গল্প করতে করতে দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হাতেম শেখ হঠাৎ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গলা তুলে ডাক দেয়- এ ভাই, শুনো।
ওরা মাথা ঘুরিয়ে হাতেম শেখকে দেখে দোকানে উঠে আসে। হাতেম শেখের শরীর মৃদু কাঁপছে তখন। অস্বাভাবিক গম্ভীর গলায় বলে- ইয়ে তো সরকারি দাওয়াখানা নেহি হ্যায়’। (আত্মহননের প্ররোচনা- পৃষ্ঠা-১১১)
পাক হানাদাররা তার ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে মূল্য না দেওয়ায় নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এভাবেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে হাতেম শেখ। শুধু হাতেম শেখ নয় এ রকম কোটি কোটি মানুষ সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির ওপর লেখা। গল্পে সে সময়কার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।
লেখক ফারুক মঈনউদ্দীন-এর লেখা ‘আত্মহননের প্ররোচনা’ গ্রল্পগ্রন্থটিতে রয়েছে মোট সাতটি গল্প- দখল, ঘাতক, অপাপবিদ্ধা, দ্বৈরথ, শারীরবৃত্তীয়, পাওনা ও আত্মহননের প্ররোচনা। এখানে বলে রাখা দরকার যে, বইটি প্রথম কলকাতা থেকে প্রায় দেড় দশক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান আলোচ্য বইটি প্রথম বাংলাদেশ সংস্করণ। প্রকাশ করেছে প্রকৃতি প্রকাশন। লেখক তাঁর ভূমিকায় বলেছেন- ‘বর্তমান সংস্করণে সন্নিবিষ্ট করার আগে গল্পগুলোকে বেশকিছু মাজাঘষা এবং ক্ষেত্রবিশেষ কিছু পরিবর্ধনও করা হয়েছে। এই সংস্করণে সদ্য লেখা ‘পাওনা’ নামের একটা বাড়তি গল্প সংযোজন করা হলো।
বইটির প্রথম গল্প ‘দখল’। এতে দেখা যায়, মফস্বল শহরের দুই ব্যক্তির আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। গোডাউনের দখলকে কেন্দ্র করে লড়াই। একপক্ষের পরাজিত নেতা- হাসেম ঢাকায় যায় বড় নেতার সাহায্য চাইতে। ততক্ষণে সেই নেতা গোডাউনের নতুন দখল নেওয়া নেতা ইসরাইল শেখের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেয়। বড় নেতা হাসেমকে নির্দেশ দেয় এলাকায় ফিরে যাওয়ায় এবং কোনো গণ্ডগোল না করার।
ফিরে আসে হাসেম। এসে আগের মতোই পরিকল্পনা করে কাজে লেগে যায় তার সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের। কিন্তু হাসেম তা পারে না, ইসমাইল শেখকে হারানোর পরিকল্পনা করে নাটক সাজিয়ে বৌকে হারিয়ে নিজেই পরাজিত হয়ে যায়। ক্ষমতা, গোডাউন আর স্ত্রী কোনোটারই দখল ফিরে পায় না হাসেম।
বইয়ের শুরুতে মফস্বল শহরের গল্প বলে লেখক পাঠকদের নিয়ে যান প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে খবির মোল্লার নামের একজনের দেখা পাওয়া যায়। ঘাতক গল্পের অন্যতম প্রধান চারিত্র খবির মোল্লা। যার জমি কেনার প্রতি খুব লোভ। নানা ষড়যন্ত্র করে দিনকে দিন অন্যের জমি নিজের করে নেওয়ার মধ্যে ওস্তাদ সে।
‘প্রতিটা জমি কেনার আগে খবির মোল্লার বহু দুপুর আর বিকেল কেটে গেছে আকবর ভেন্ডারের নকশাদার বাক্সের সামনে। ক্যাশবাক্সের মতো দেখতে ওটা আকবরের একাধারে সিন্দুক এবং লেখার টেবিল। আকবর ভেন্ডার যখন জীর্ণ, ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়া সিট-ম্যাপটা ওর বাক্সের ওপর বিছিয়ে চশমার ভেতর দিয়ে জমির আরএস, পিএস কিংবা বিএস দাগ খুঁজে বেড়াত, খবির মোল্লা তখন সামনে বসে ওর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে ম্যাপের ছোট ছোট অসংখ্য খোপের ভেতর জমিটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করত। ম্যাপের ছোট ছোট ঘরগুলো খবিরের চোখের মধ্য দিয়ে মাথার ভেতর ঢুকে বিরাট কোনো পুকুর বা আমবাগান, কখনো বা হালকা সোনালি রঙের পাকা ধানে ভরা জমি হয়ে যেত।’ (ঘাতক-পৃষ্ঠা-৩৫)
এই গল্পের শেষদিকে দেখা যায় অন্যতম চরিত্র ইসমাইলের মৃত্যু হয়। যার সাথে খবির মোল্লার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য শত্রুতা ছিল ইসমাইলের একখণ্ড জমি নিয়ে। অনেক চেষ্টা করেও সে তার কাছ থেকে জমির মালিকানা হস্তগত করতে পারেনি। শত্রুতা একসময় মিটে যায় কিন্তু ইসমাইলের মৃত্যু নতুন করে পাঠকদের কাছে প্রশ্নের জন্ম দেয়।
‘কদিন পর এক সকালে সূর্য উঠি উঠি করছে, এমন সময় সামনে সদরের দিক থেকে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে মোল্লাবাড়ির লোকজন বেরিয়ে আসে। খবির মোল্লাও সবার সাথে জটলার কাছে পৌঁছে দেখে বাড়িতে ঢোকার রাস্তার মুখে ইসমাইল উপুড় হয়ে পড়ে আছে, ওর গায়ে সেই শেয়ালি রঙের ওভারকোট, পিঠের দিকে ছুরি ঢোকার মুখটা রক্তে ভিজে কালচে হয়ে গেছে, শায়িত শরীরের নিচ থেকে খয়েরগোলা রঙের রক্ত গড়িয়ে এসে থমকে গেছে ঘাসের গোড়ায় গোড়ায়। খবির মোল্লা লাশটার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে ডুকরে ওঠার মতো করে বলে- ইয়া মাবুদ, আমারে মারতি আইসে এ কারে মাইরে রাইখে গেল!’ (ঘাতক-পৃষ্ঠা-৪৭)
সতী নামের এক পাগল নারীর পোয়াতি হওয়ার সংবাদ জানা যায় ‘অপাপবিদ্ধা’ গল্পে। পুরুষ মানুষের লালসার শিকার সতী। শুধু সতী নয়, দেশের আনাছে কানাছে ছড়িয়ে আছে এ রকম শত শত পাগলি যারা বারবার আক্রান্ত হয়, হয় লালসার শিকার। কিন্তু তারা তা প্রকাশ করতে পারে না। বিদায় তা অজানাই থেকে যায়। আর নির্যাতনের কাহিনী প্রকাশিত হলেও প্রমাণের অভাবে অপরাধী বিচারের বাইরেই থেকে যায়।
হাইস্কুল না পেরোনো এক কিশোর শাহীনের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য মামাবাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার গল্প দ্বৈরথ। গল্পটি পাঠে পাঠক ফিরে যায় একাত্তরে। এ রকম হাজারো কিশোর শাহীনের গল্প নতুন করে পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন গল্পকার। এই গল্পটির সাথে গ্রন্থটির আরেকটি গল্প ‘আত্মহননের প্ররোচনা’র কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন দুটো গল্পই মুক্তিযুদ্ধের সময়কে ধারণ করে লেখা। গল্প দুটির অন্যতম প্রধান দুই চরিত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু যোগদানের আগেই দুজনকেই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হয়। এই কাজটি করেন একজনের মামা আর একজনের চাচা। কিছুটা মিল থাকলেও দুটি গল্পের বিষয় ভিন্ন, বক্তব্যও ভিন্ন।
গার্মেন্টসকর্মীদের উদ্বিগ্ন জীবনযাপনের চিত্র দেখা যায় ‘শারীরবৃত্তীয়’ গল্পে। স্বামীহারা এক শ্রমিক মা আর তার কিশোরী মেয়ের জীবনযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে এগিয়ে যায় এই গল্প।
‘পাওনা’ গল্পে দেখা যায় জমি বিক্রি করে পাওনা টাকা না পেয়ে প্রতারণার শিকার গরিব মানুষগুলোর প্রতিবাদের চিত্র। প্রতারক ভূস্বামীর জানাজা-পরবর্তী কবর দেওয়া আটকে দেয় তারা। গল্পকার খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সমাজ, সমাজে বসবাসকারী মানুষজন, তাদের জীবনাচরণ, মানবিকতা, ক্ষমতার লড়াই, দম্ভ, সংগ্রামী মানুষের জীবনযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল, স্বদেশপ্রেম দেখার চেষ্টা করেছেন, যার প্রতিফলন আমরা তাঁর গল্পে দেখতে পাই। প্রতিটি গল্পে লেখক আঞ্চলিক ভাষার সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, যা সমকালীন বাংলা ছোটগল্পের জগতে অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। কবি সৈকত হাবিব এটিকে বলছেন গল্পে আঞ্চলিক ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ। আর গল্পকার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যৎসামান্য বাংলা গল্পপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত আকারেই বলে রাখতে চাই যে, গল্পকার হিসেবে ফারুক মঈনউদ্দীন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও হাসান আজিজুল হকের সঙ্গেই তুলনীয়।’
গল্পকার ফারুক মঈনউদ্দীন পেশাগত জীবনে একজন সফল মানুষ। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন দেশ-বিদেশের বড় শহরগুলোতে। কিন্তু তাঁর গল্প পাঠে স্পষ্ট বোঝা যায় শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হলেও তাঁর দৃষ্টি ছিল গ্রামে এবং মফস্বল শহরে। সেখানকার মানুষ, সমাজ এবং সময়কে তিনি গভীরভাবে ধারণ করেছেন।
লেখক গল্পগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন কবি আহসান হাবীবকে। যাঁর একান্ত উৎসাহ অনুপ্রেরণায় তিনি গল্প লেখা শুরু করেছিলেন। বইটির পাঠে পাঠক ছোটগল্পের সত্যিকার স্বাদ পাবেন এ কথা অবশ্যই বলা যায়। বহুমাত্রিক লেখক ফারুক মঈনউদ্দীন যদি গল্পকার হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতেন তাহলে বাংলা ছোটগল্প আরো অনেক সমৃদ্ধ হতো।
আত্মহননের প্ররোচনা
প্রথম বাংলাদেশ প্রকাশ
অমর একুশে বইমেলা-২০১৫
প্রচ্ছদ- মাসুক হেলাল
প্রকাশক-প্রকৃতি
মূল্য-২০০ টাকা।