বাংলাদেশে পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘন
গ্রন্থটি এখনো অপরিহার্য
ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের ২৩ বছর পরে সামরিক শাসকচক্রের বেঁধে দেওয়া বিধিমালা মেনেই দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ দেশের সাধারণ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল। ছয় দফার দাবিতে জনমত সংগঠিত করে দলটি পূর্ব বাংলায় তো বটেই জাতীয় সংসদেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। সামরিক জান্তা ও পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী মনে করেছিল বাঙালিরা বিজয়ী হতে পারবে না। কাজেই তাদের বেকায়দায় ফেলে পরিকল্পিত শোষণ ও দমনপীড়নে শায়েস্তা করা সম্ভব হবে। কিন্তু ঘটনা একেবারে উল্টে গেল। আওয়ামী লীগ এমনই বিজয় অর্জন করল যে একে অস্বীকার করা মুশকিল হলো। পাশা উল্টে যাওয়ায় এবার সামরিক জান্তা ও রাজনীতির ক্ষমতালিপ্সু পাঞ্জাবিচক্র সম্মিলিতভাবেই কূটচাল স্থির করে বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও নির্বাচনী বিজয়কে ভণ্ডুল করার মতলবে নতুন করে গুটি চালল। সামরিক শাসক তার ওয়াদা বরখেলাপ করে এমন এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করল যে বাংলায় ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ জনসাধারণ রাজপথে নেমে এলো।
সামরিক শাসনকর্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান নতুন ফাঁদ পাতল গোলটেবিল বৈঠকের। ঢাকায় ডাকা সংসদ অধিবেশন বাতিল করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া এই পরিস্থিতির চূড়ান্ত পরিণতির কথা ভেবে গোলটেবিলে সংলাপ চালানোর সাথে সাথে সৈন্যসামন্ত ও গোলাবারুদ বাড়ানোর গোপন ব্যবস্থা নিলেন। কিন্তু লোক দেখানো সংলাপ ব্যর্থ হলো চক্রান্ত অনুযায়ী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক বক্তৃতায় তিনি যে বক্তব্য দিয়ে শেষ করলেন সে বাক্যটি ছিল ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেইসাথে পূর্ববঙ্গবাসীর করণীয় কি তাও নির্দেশ করে বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবা।’ বিক্ষুব্ধ জনগণ রাজপথ দখল করে ‘গোলটেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ স্লোগান দিতে লাগল। গোলটেবিল ব্যর্থ হয়ে গেল আর অমনি ২৫ মার্চ ১৯৭১ মাঝরাতে পাকিস্তানি হায়েনার দল দখলদার সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলার নিরস্ত্র অধিকারসচেতন মানুষের ওপর। ‘দুর্ধর্ষ’বলে খ্যাত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামক অভিযানে যে গণহত্যা শুরু করে দিল, তা নিতান্তই কাপুরুষোচিত বেধড়ক হত্যাকাণ্ড।
তারপর গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে মৃত্যুপুরীর সূচনা করল ওরা। আর নিরস্ত্র মানুষগুলো প্রথমে বুকের পাঁজরে শান দিলেন প্রতিরোধের হাতিয়ার। গ্রাম-জনপদজুড়ে মানুষ লাঠিসোঁটা, সড়কি, বল্লম, তীর-ধনুক নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তারপর পর্যুদস্ত সেনাবাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নিজেরা হলেন সশস্ত্র। চূড়ান্ত লড়াই শেষে পরাজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অবশেষে আত্মসমপর্ণ করল মিত্রবাহিনীর কাছে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
পাকিস্তানিরা গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। হিংস্র বর্বরতার সাথে নারীপুরুষ, শিশু বৃদ্ধ সক্কলকে হত্যা করার জন্য ‘প্রভাবান্বিত’ কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে হীনবল সে ভীরুর দলকে আবার মুক্তিফৌজের বিজয়াভিযান চলাকালে সবসুদ্ধই পূর্ব বাংলা ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু থেকে শেষ অব্দি যে নিষ্ঠুরতার অযুত চিহ্ন তারা রেখে গেছে এই দেশে তারই টুকরো টুকরো কাহিনী সংগ্রহ করে ভারতীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিষদ ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ‘হাউ পাকিস্তান ভায়োলেটেড হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই সংকলিত গ্রন্থটি নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশ করেছে। এটি একটি অরাজনৈতিক সংস্থা। এরা নিজেদের কোনো বক্তব্য প্রকাশ করে না। যা ঘটে তারই বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ সংগ্রহ করে সংকলিত করে। তিনজন সাংবাদিক এবং একজন আলোকচিত্রশিল্পী সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় শরণার্থীদের সাথে কথা বলে পাকিস্তানি বর্বরতার দুঃসহ, নৃশংস কাহিনীর বিবরণ তুলে ধরেছেন। যাঁরা ভুক্তভোগী এবং যেসব মহৎপ্রাণ ব্যক্তিরা শরণার্থীদের সহযোগিতার হাতা বাড়িয়ে দিয়েছেন- তাঁদের অভিজ্ঞতা সংগৃহীত হয়েছে এই সংকলনে।
এই উদ্যোগ তাৎক্ষণিক হওয়ার কারণে সবার কাছ থেকে পাওয়া তরতাজা অভিজ্ঞতা ও হিংস্রতার নিষ্ঠুর বর্ণনা সততার সাথে গ্রন্থিত হয়েছে। আঁদ্রে মালরোর লেখা মুখবন্ধ সত্য ও সুন্দরের উচ্চকিত কণ্ঠস্বর। জাতিত্ববোধ কিংবা সহধর্মিতার মর্মে আঘাত হেনেছে ইসলামাবাদী সৈন্যরা। মালরো বলেন : দখলদার হিসেবে পাকিস্তানিরা যে কি বর্বরতার নৃশংস ঘৃণ্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তা এই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পড়লে পাঠক অনুধাবন করতে পারবেন। তাঁর এ ক্ষুদ্র আহ্বান পাঠককে সত্যেরই সন্ধান দেবে।
এ গ্রন্থের সূচনা করা হয়েছে আমারই সহযোদ্ধা সাংবাদিক বন্ধুর ওপর চালানো অকল্পনীয় নৃশংসতার নিষ্ঠুর, নিরন্তর, লোমহর্ষক ও ঘৃণা উদ্গীরণকারী বর্ণনা দিয়ে। শহিদুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতারে বন্ধু সহকর্মী স্বরূপ ছিলেন। তিনি টি এইচ শিকদারকে নিয়ে অবরুদ্ধ বাংলায় গিয়েছিলেন। তাঁদের পাকিস্তানি হায়নাদের হাতে ধরা পড়ার পর কি নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল তার লোমহর্ষক বিবরণ শুনলে যেকোনো ব্যক্তি তীব্র ঘৃণায় কুঁচকে উঠবেন। এই গ্রন্থের পরের দিকে শহিদুল ইসলামের আরেক বিবরণী আছে, যাতে বঙ্গসংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে ওই পাকিস্তানিরা কী নির্মম হয়েছিল সে কথা বিধৃত আছে।
এই গ্রন্থেই দেশের বরেণ্য চিত্রকর ও প্রগতিশীল সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব পটুয়া কামরুল হাসান, তাঁর আর্ট কলেজের ছাত্র সৈয়দ আবুলবারাক আলভি, সিনিয়র সাংবাদিক মুহাম্মদউল্লাহ চৌধুরী, গেরিলাযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদল - এমন আরো অনেকের ভয়াবহ ও বীভৎস ঘটনাবলির বর্ণনা মিলবে। তা ছাড়া মুস্তারী শফী, মওদুদ আহমদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাও যুক্ত হয়েছে।
মাদার তেরেসা ও তাঁর সহকর্মীরা নির্যাতিত মহিলা, স্নেহহারা শিশু, বিপদাপন্ন তারুণ্যের নির্মম বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তাৎক্ষণিক গ্রহণ করা এসব সাক্ষাৎকারের বিবরণ পড়লেই বোঝা যাবে পাকিস্তানিরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে কত না নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতার আশ্রয় নিয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দেওয়া মর্মান্তিক ঘটনাবলির যে বর্ণনা ২৬ জন সরাসরি যুক্ত মানুষ দিয়েছেন, তাঁদের সেই বর্ণনায় আজ কারো চেতনায় খোঁচা না লাগতে পারে। কিন্তু যারা আজো যুদ্ধাপরাধীর বিচারে বাগড়া দিতে উদ্যত এবং সন্ত্রাসী অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে আপন অস্তিত্ব, জাতিত্ব, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগ্রাম উপেক্ষা করে কথা বলার ধৃষ্টতা দেখায় তাদের জন্য এই গ্রন্থ একটি চপেটাঘাত। ওদের থোতামুখ ভোঁতা করে দেওয়ার জন্য অস্ত্র তো বটেই।
এমন কাহিনী বা ঘটনাবলির বর্ণনা সংবলিত কত না বিরাট আকার বই রচিত, মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু এত ছোট্ট বইটি সম্যক অভিজ্ঞতার রক্তউৎপল ইতিহাস হয়ে আজও পাকিস্তানি বর্বরতা, বিবেকহীন আচরণ ও হিংস্র সহিংসতার সাক্ষ্য বহন করছে। পড়ুন, পাকিস্তানে মোহমুগ্ধ যারা, তাদের জন্য এর প্রয়োজন অনেক বেশি।
সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। সুন্দর প্রতিষ্ঠিত হবেই। এই জগতটা মানুষের জন্য সত্যিই বাসযোগ্য হোক। এই কামনা রইল।
গ্রন্থের নাম : বাংলাদেশে পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘন : কয়েকটি জবানবন্দি : আঁদ্রে মালরো ও অন্যান্য
অনুবাদ : মেহেদী হাসান, মুহাম্মদ তাসনিম আলম ও রায়হান রাজু
প্রকাশক : আগামী প্রকাশনী ও আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা
পৃষ্ঠা : ১২০
মূল্য : ২২০ টাকা