শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
এ দেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক, শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ, নিভৃতচারী শিল্পী শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের চতুর্থ প্রয়াণ দিবস আজ ২০ মে।
শিল্পী সফিউদ্দীন ১৯২২ সালের ২৩ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতা থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন।
তিনি ১৯৪২ সালে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুল থেকে চারুকলায় স্নাতক এবং পরে যুক্তরাজ্যের ‘সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস’ থেকে ‘এচিং ও এনগ্রেভিং’-এর ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন।
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁর শিল্প-ভাবনা ও শিল্পচর্চা দিয়ে আমাদের ছাপাই ছবির জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন। চল্লিশের দশকে কলকাতার আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ছাপচিত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
পরে উড এনগ্রেভিং, ড্রাই পয়েন্ট, এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, কপার এনগ্রেভিংসহ নতুন নতুন টেকনিকের মাধ্যমে এ দেশের ছাপাই ছবিকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন।
ছাপচিত্রের পাশাপাশি তিনি জলরং, তেলরঙের কাজেও অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, ১৯৪৫ সালে কলকাতার একাডেমি অব ফাইন আর্ট আয়োজিত সর্বভারতীয় বার্ষিক প্রদর্শনীতে তেলরঙে করা অসাধারণ এক চিত্রকর্মের জন্য জীবনের প্রথম পুরস্কার ‘একাডেমি প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক’ পেয়েছিলেন।
লন্ডনে থাকার সময় সফিউদ্দীন আহমেদ কালোর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার করেন এচিং-অ্যাকুয়াটিন্টের মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকে তিন বছরের মতো তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু রেখাচিত্র আঁকেন, যা ‘ব্ল্যাক সিরিজ’ বা ‘কালো চিত্রমালা’ নামে পরিচিত।
তাঁর শিল্পকর্মে ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। কলকাতায় আঁকা ছবিতে এসেছে মহানগরের বস্তিজীবন, বিহারের নানা অঞ্চলের সৌন্দর্য, দুমকার প্রকৃতি ও সাঁওতাল-জীবন এবং ঢাকায় আঁকা ছবিতে বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে বন্যা, জাল, মাছ, নৌকা, ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি নানা শ্রমজীবী মানুষ।
তিনি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও অন্যান্য শিল্পী মিলে ঢাকা আর্ট কলেজ (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট এবং বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
তৎকালীন নবগঠিত ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস, ঢাকা’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন শিল্পী সফিউদ্দীন। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন প্রতিষ্ঠানে তিনি ছাপচিত্র বিভাগের প্রভাষক ও প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। এই প্রতিষ্ঠান ১৯৬৩ সালে সরকারি আর্ট কলেজে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৯ সালে এই কলেজ থেকে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে এই প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত হওয়ার পর ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি এর ছাপচিত্র বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে এবং ১৯৯৪ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ দেশের শিল্পকলায় অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার। সাত দশকের বেশি সময় ধরে শিল্পচর্চা করে দেশের শিল্পকলার জগৎকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।
বার্ধক্যজনিত কারণে ২০১২ সালের এই দিনে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমাদের শিল্পকলার এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর প্রয়াণ দিবসে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।