ঢাকার কথা ৪৭
মোগল ঢাকায় সমৃদ্ধির ছোঁয়া
মোগল শাসনযুগে বাংলা সুবার রাজধানী ঢাকায় একটি স্থিতিশীলতা এসেছিল। নগরের বিকাশ ঘটেছিল। মোগল ভারতের প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক রাজধানীগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম সম্পদশালী নগরে পরিণত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে। দেশ-বিদেশের বণিকরা ঢাকার রমরমা বাণিজ্যে যুক্ত হয়। ইরানিদের ব্যাপক আগমন ঘটে ঢাকায়। তারা প্রশাসন ও ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রের একটি নতুন ঢেউ এসে লাগে। ঢাকায় মোগল সুবার রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঐতিহ্যের মসলিন কাপড় উৎপাদন ও বাণিজ্যের গতি ঢাকায় অনেক বৃদ্ধি পায়। মসলিনের আকর্ষণে নানা দেশের ক্রেতারা ঢাকায় ছুটে আসতে থাকেন। মোগল সম্রাট ও অমাত্যগণ ঢাকাই মসলিনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।
আঠারো শতকের গোড়ার দিকেই ঢাকায় মসলিনের ব্যবসা জমজমাট হয়ে পরে। এ সময় ইউরোপের বিখ্যাত ওসটেন্ড কোম্পানি ঢাকায় আসে। ঢাকাই মসলিনের বড় ক্রেতা ছিল এই কোম্পানি। পাইকার, দালাল ও নিজ কর্মচারীদের মাধ্যমে কোম্পানি মসলিন সংগ্রহ করত। অল্পদিনেই এই ইউরোপীয় বণিকরা মসলিনের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হিসেবে চিহ্নিত করে। এ কারণেই তারা ঢাকায় স্থাপন করে বাণিজ্য কুঠি। বরাবর বাংলার বাণিজ্যে পর্তুগিজদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু সতেরো শতকের মাঝামাঝি এসে পর্তুগিজ বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। কিন্তু এরপরও ইউরোপীয় বণিকদের ঢাকায় আসা থেমে থাকেনি। ১৬৬৩ সালে ঢাকায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে ওলন্দাজরা, ইংরেজ বণিকরা আসে ১৬৬৯ সালে আর ফরাসিরা নোঙর ফেলে ১৬৮২ সালে। এদের আগেই অবশ্য ইরানি ও আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা সীমিতভাবে ঢাকাই মসলিন ইউরোপে রফতানি করত।
তবে এ কথা মানতেই হবে, ইউরোপীয় বণিকরা ঢাকায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করার পর থেকে ইউরোপে মসলিন রফতানি অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মসলিন ইউরোপের বাজার পুরোটাই দখল করে নেয়। কালক্রমে ইউরোপীয় বণিকদের কাছে মসলিনের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে তারা ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন ও কারখানা প্রতিষ্ঠার চিন্তা করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এ সময় স্থানীয় বাজারে ইউরোপীয় পণ্যের তেমন চাহিদা ছিল না। তাই নিজ পণ্য বিক্রি করে ঢাকার পণ্য আমদানি করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে ইউরোপীয় বণিকরা বাধ্য হয় ঢাকায় সোনা-রুপা ও কাঁচা টাকা এনে ব্যবসা চালিয়ে যেতে। পরিসংখ্যানমতে, ১৭৪৭ সালে ঢাকা থেকে যে পরিমাণ মসলিন ও সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র বণিকরা সংগ্রহ করে, এর মূল্য ছিল ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ পর্যায়ে তাঁতীবাজারের স্থানীয় বণিকদের ব্যবসাও রমরমা হয়ে পড়েছিল।
মোগল পর্বে ঢাকার জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। এটি নগরের সমৃদ্ধির পরিচায়ক। এ পর্যায়ে ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ লাখ। ফলে তখন নগরের পরিধিও অনেক বেড়ে যায়। মূল নগরী বুড়িগঙ্গার সমান্তরালে প্রায় ১০ মাইল প্রলম্বিত ছিল। প্রশস্ততায় ছিল আড়াই মাইল। পরে জনসংখ্যার চাপে শহর ও শহরতলি আরো ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা থেকে টঙ্গীব্রিজ পর্যন্ত ১৫ মাইল প্রলম্বিত আর মিরপুর থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত পশ্চিমে ১০ মাইল বিস্তৃত ছিল শহরতলি এলাকা। বিভিন্ন পেশাজীবীর বাস ও বাণিজ্য ছিল ঢাকাজুড়ে। তাঁদের বসবাসের এলাকাও নির্ধারিত ছিল। এ সময় ঢাকায় বসবাসকারীর মধ্যে ছিলেন সুবাদারকে ঘিরে থাকা অভিজাত সম্প্রদায়, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষুদ্র কারখানার মালিক, ব্যবসায়ী, সৈনিক, বিদেশি বণিক, নিম্নপদস্থ কর্মচারী ইত্যাদি।
মোগল যুগের শেষ দিকে ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের পর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নজরদারির অভাবে ঢাকার ঐশ্বর্যের অবক্ষয় ঘটতে থাকে।