রহস্যের কারিগর
আলফ্রেড হিচকক
ফরাসিরা সব সময় হিচককের মেটাফিজিক্স (অধিবিদ্যা) নিয়ে বাহাস করত। তাতে হিচকক কখনো যোগ দেননি, কোনো কিছু নিয়ে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ও বলেননি বেলা-অবেলায়। আজ ঠিক ৩৫ বছর হলো ‘মাস্টার অব সাসপেন্স’ চলে গেছেন আরো রহস্যময় দুনিয়ায়। ১৯৮০ সালের এই দিনটিতেই মারা গিয়েছিলেন স্যার আলফ্রেড জোসেফ হিচকক, সময় তখন রাত। পরদিন সকালে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের চলচ্চিত্র-সমালোচক ডেরেক ম্যালকম লিখেছিলেন এক বিদায়ী শ্রদ্ধাঞ্জলি। হিচককের মৃত্যুদিবস উপলক্ষে সেই লেখা ভাষান্তর করা হলো এখানে।
আলফ্রেড হিচকক মারা গেছেন। তাঁর মতো আর কেউই হয়ে উঠতে পারবেন না, সম্ভবত কখনোই না। কাজের বিচারে তিনি ছিলেন এমনই এক সিনেমা বানানেওয়ালা, যিনি কেবল এক দারুণ শিল্পীই নন, সঙ্গে দর্শককে দিয়েছেন ফাটাফাটি বিনোদন। বিনোদনের জন্য শিল্প বা শিল্পের জন্য বিনোদন—কোনোটিকেই বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে হয়নি তাঁর।
হিচ (আলফ্রেড হিচকক) দর্শক আর সমালোচকদের একই তালে খোঁচাতে পারতেন। দুনিয়া তেমনটাই জানে। এমনকি যাঁরা অতর তত্ত্বের অস্তিত্ব নিয়ে সামান্যটুকুও বোধ করি জানতেন না, তাঁরাও যেকোনো হিচকক ফিল্ম দেখতে আসতেন। কারণ, এটা তো হিচকক বানিয়েছেন! আর যাঁরা তত্ত্ব নিয়ে দেদার পড়েছেন, তাঁরাও কখনো হিচককের এই আকর্ষণী ক্ষমতা কিংবা মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্যের গভীরতা মাপার সাহস করতে পারেননি—সে তাঁর কাজের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা ব্যক্তি হিচককের ক্ষেত্রে।
এ বিষয়গুলো হিচকে প্রচুর আমোদ দিয়েছে, তাই মানুষ তাঁর কাছ থেকে যত রকম খেলা দেখতে চাইত, তত রকম খেলাই তিনি দেখিয়েছেন। এভাবেই হিচ ছবি বানিয়েছেন, আর যতটা পারা যায় বিশাল মাপে দেখিয়েছেন সবাইকে। জীবনের শেষ সময়টা পর্যন্ত তিনি যেমন সম্মাননা পেয়েছেন, তা অন্য বহু পরিচালক পাওয়ার বাসনা করতেন! সম্মান পেয়ে হিচককের মাথা কিন্তু ঘুরে যায়নি। তিনি নিজেকে ভাবতেন একজন কারুশিল্পী এবং জানতেন তাঁর কাজটা কী! নিজের মতো কাজ করে যাওয়াই তাঁর কাছে ছিল মুখ্য, যথেষ্ট।
ত্রুফোকে (চলচ্চিত্রকার ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো) হিচকক বলেছিলেন, ‘তুমি যদি মাপমতো আর ঠিকঠাকভাবে একটা ছবি বানাও, তাহলে ওটা দেখে জাপানি দর্শক যখন ভয়ে চেঁচাবে, ভারতীয় দর্শকও তখনই চিৎকার জুড়ে দেবে ভয়ে। আরেকজনকে বলেছিলেন, ‘যখন আমি শুটিং করতে যাই, আমার ভীষণ বোরিং লাগে। কারণটা কী জানো? পুরো ব্যাপারটা আমি মাথায় বানিয়ে রেখেছি মাপেমাপে। এ জন্যই শুটিংয়ে একটুও চমক থাকে না।’
কাজেই একমাত্র চমক অবশিষ্ট থাকত কেবল দর্শকের জন্য। আর সে বিষয়টির জন্যই তিনি লেগে থাকতেন। তিনি চাইতেন, সবার আক্কেলগুড়ুম করে দিতে। ফিল্মস্ট্রিপ প্রজেক্টরে চলত আর হলভর্তি মানুষ তারস্বরে চেঁচাত। পুরো ব্যাপারটাই একদম গাণিতিকভাবে—এক ওস্তাদ কারিগরের হাতে গড়ে উঠত, যিনি কোনোকিছু একচুলও ছাড় দিতেন না।
যদিও হিচকক অত্যাচারের ব্যাপারে মোটামুটি সতর্ক ছিলেন, যেটা হতো যে তাঁর মোটামুটি মানের ছবিগুলোও পারফেক্ট একটা প্ল্যানের থেকে বেশি কিছু হতো। ত্রুফো হিচকককে স্থান দিয়েছেন কাফকা, দস্তয়ভস্কি ও এডগার অ্যালেন পোর মতো সংশয়বাদী শিল্পীদের সঙ্গে। অন্যরা তাঁর ক্যাথলিসিজম নিয়ে কথা বলেছেন, ঈশ্বরের জন্য তাঁর ক্রমাগত তালাশ নিয়ে বলেছেন, তাঁর নৈতিক মূল্যবোধের জটিলতা নিয়ে বলেছেন; বলেছেন কোনো কিছু নিয়ে আমাদের মৌলিক আতংকবোধের চিত্রায়ণ নিয়ে। এগুলোতে হিচকক কখনো সায় দেননি। আবার অস্বীকারও করেননি। শুধু মনে হয়, তিনি হয়তো মাঝেমধ্যে নিজেই নিজের দিকে তাকিয়ে হাসতেন আর মহানন্দে হাত ঘষতেন!
৫০ বছর ধরে সব মিলিয়ে তিনি বানিয়েছেন ৫৩টি ছবি। এর মধ্যে অন্তত ২০টি ছবি স্বীকৃতভাবে মাস্টারপিস। আর সবচেয়ে তাক লাগানো ব্যাপার, তিনি একটুক্ষণের জন্যও ক্লান্ত হননি। এর কারণ তিনি বলেছিলেন, ‘পিওর’ ফিল্ম হলো দুর্দান্ত বিষয়—এটা নিয়ে যা করা যায়, দর্শকের সঙ্গে যা করা যায়, তা আর অন্য কিছু দিয়ে সম্ভব নয়!
স্বাভাবিকভাবেই, কেবল দর্শকের প্রতি নয়; সমসাময়িক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ওপরেও ছিল তাঁর বিশাল প্রভাব। বলতে গেলে প্রায় সবারই, যেমন ধরুন—শ্যাব্রল (চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্লদ শ্যাব্রল) তো তাঁকে রীতিমতো স্তুতি করতেন। অজস্র মার্কিনি তাঁর কাজকর্ম এমনভাবে অনুকরণ করতেন যে ভাবতেই অবাক লাগে তিনি এতটা প্রভাবশালী না হলে কী হতো! নাহ, আর কোনো হিচকক আসবেন না। কখনোই না। তবে হিচকক হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারেন সবাই, সে স্বাধীনতা অবশ্যই আছে।
৩০ এপ্রিল, ১৯৮০
ডেরেক ম্যালকম