অহঙ্কার থাকা ভালো নয় : বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের জন্ম ৯ জানুয়ারি ১৯৩৬, চাঁদপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। অবসর নিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপ-উপাচার্য। কবিতা-ছোটগল্প-প্রবন্ধ-জার্নাল-গবেষণা-চিত্রশিল্প-উপন্যাস-অনুবাদ ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গন্থের সংখ্যা ১০২টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ তোমার পছন্দের নীল শার্ট পরে (২০০৬), মুকুটহীন মহারাজ (১৯৮১), জার্নাল ৭১ (১৯৭২), জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা (১৯৯৬), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র (১৯৯৩), উপমহাদেশের গ্রামীণ গবেষণা চর্চা ও প্রাসঙ্গিক সমস্যা (১৯৭৭)।
পুরস্কার : বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৯), Roll of Honour, UNESCO and Govt of France (১৯৯৬), মুজাফফর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা (২০০৫)।
মাসউদ আহমাদ : যেকোনো সৃজনশীল লেখক মানুষ ও প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখে এবং পর্যবেক্ষণ করেন। আপনি কবে থেকে এই পর্যবেক্ষণে নিমগ্ন হলেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : যখন লেখালেখি শুরু করি তখন থেকেই। এর একটা কারণ হচ্ছে, আমি খুব অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করি। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন প্রথম আমার লেখা কবিতা বের হয়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত লিখে যাচ্ছি। আমি যেহেতু বিভিন্ন পর্যায়ে লিখেছি, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিচ্যুত হয়ে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফের এসে কিংবা বিদেশে থেকেও আমি অনবরত কাজ করেছি আর কী।
মাসউদ আহমাদ : কবিতা দিয়ে আপনার লেখালেখিতে উন্মেষ ঘটেছে। গল্প বা প্রবন্ধ চর্চায় কীভাবে এলেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : আমি প্রায় একই সঙ্গে কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ অনবরত লিখে গেছি। অর্থাৎ একটাকে ছেড়ে আরেকটাতে এসেছি, এমন নয়। সবগুলোই প্রায় একসঙ্গে এসেছে। আমি চেষ্টা করেছি সব মাধ্যমেই কাজ করতে এবং একজন শিল্পবোদ্ধা হিসেবে আমি মনে করি, একটা বড় ভূমিকাও পালন করেছি।
মাসউদ আহমাদ : আপনি একদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা, মাইকেলের জাগরণ, জার্নাল ৭১, যুদ্ধাপরাধীর বিচার নানা বিষয়ে নির্মোহ-পর্যবেক্ষণীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করছেন। সৃজনশীল লেখক হিসেবেও আপনার পদচারণা ঈর্ষণীয়। এতগুলো সত্তার সমন্বয় করেন কীভাবে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : এক হিসেবে এগুলো বিপরীতমুখী নয়। তার কারণ হচ্ছে একজন লেখক, তিনি যদি সৃষ্টিশীল হন এবং জীবনের বিভিন্ন দিকে তাঁর আগ্রহ থাকে তাহলে তিনি সব লেখাই লিখতে পারেন। এটা অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয় আর কী। তাহলে তো আমরা রবীন্দ্রনাথ বা বুদ্ধদেব বসুকে পেতাম না। এমনকি যিনি সদ্যপ্রয়াত হলেন হুমায়ূন আহমেদ তাঁকেও পেতাম না। সৃষ্টিশীল লেখক মাত্রই বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেন। যেমন সৈয়দ শামসুল হক। এগুলো স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।
মাসউদ আহমাদ : সহজাত প্রতিভার ব্যাপারটা আপনার ভেতরে উন্মেষকাল থেকেই ছিল?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : সহজাত যদি বলেন, এটা মানে কী আমি জানি না। তবে বলব লিখতে হলে পড়, ভালো লিখতে হলে পরিশ্রমী হতে হয়। পরিশ্রম বাদে লেখক হওয়া যায় না। আর একসঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয়। এসবের পাশাপাশি বলতে পারেন আমার ক্ষেত্রে আর একটা সুবিধা ঘটেছিল, গবেষণা ও অধ্যাপনার কাজে প্রায় অর্ধেক পৃথিবীই ভ্রমণ করেছি। কাজেই ভ্রমণের একটা প্রচণ্ড- প্রভাব আমার ওপর পড়েছে। যেমন ধরুন জাপান কিংবা আফ্রিকায় আমি বহুবার গেছি। আফ্রিকার স্যানেগালে আমি বহুদিন ছিলাম, গবেষণার কাজে। এগুলো এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করে। ফ্রান্সে আমি বহুবার গেছি পড়াবার কাজে। লেখালেখিতে এসব নানাভাবে কাজে লেগেছে।
মাসউদ আহমাদ : কবি হিসেবে বিশেষ পরিচিতি আছে আপনার ‘তোমার পছন্দের নীল শার্ট পরে’কাব্যগ্রন্থে গীতিময়তার অনুপম রূপায়ণ দেখি। তবু গদ্যশিল্পী হিসেবেই আপনি খ্যাতিমান। কিন্তু গদ্য কবিতাক্রান্ত নন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : এটা হয়েছে, আমি কবিতা লিখি বলেই আমার গদ্য কবিতাক্রান্ত হবে এটা বোধহয় শুদ্ধ নয়। এ ক্ষেত্রে আমি রবীন্দ্রনাথের কথা বলব তাঁর গদ্য এবং কবিতায় আকাশ পাতাল পার্থক্য।
মাসউদ আহমাদ : আপনার এই বৈশিষ্ট্যটির জন্য আলাদা কোনো প্রয়াস ছিল?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : একজন লেখক কখন কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করবেন, তার সঙ্গে যদি আপনার নিবিড় পরিচয় তৈরি হয় তাহলে মূল্যায়ন করাটা সম্ভব। সেটা না হলে মূল্যায়ন করাটা শক্ত। আমি যাকে পছন্দ করি তাঁর লেখা পছন্দ করি, ভালোবাসি। ভালোবাসার ধরনটা তো প্রকাশ করতে হয়। প্রমাণ করতে হয়। এ দেশে সাধারণত আমরা তা করি না। কতগুলো কথা আমরা বলতেই থাকি; কিন্তু সেসবের অর্থ কী তা ব্যাখ্যা করি না। শামসুর রাহমান বড় কবি; কিন্তু তিনি কেন বড় কবি? কজন পাঠক বা বোদ্ধা আছেন এই প্রশ্নের জবাব দেবেন। লেখার মাপকাঠি নিজের মনের ভেতর তৈরি করতে হয়।
মাসউদ আহমাদ : ‘মুকুটহীন সম্রাট’ আপনার আলোচিত গল্পগ্রন্থ, ‘কণ্ঠস্বর’শিরোনামে রয়েছে প্রবন্ধগ্রন্থ; বলা হয় এটি বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তিগত প্রবন্ধগ্রন্থ। কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক কোন অভিধায় আপনি স্বচ্ছন্দ বা পরিতৃপ্ত বোধ করেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : আমি নিজেকে একজন লেখক হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করি। যে কথা আমি আগেও বলেছি একজন সৃষ্টিশীল লেখক বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেন। যদি বিভিন্ন মাধ্যমকে গ্রহণ করেন তাহলে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবেন।
মাসউদ আহমাদ : প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন, শিক্ষাবিদ হিসেবেও আপনার অবদান স্মরণীয়। আমাদের বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটু বলবেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে যে শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করলেন, এটা নিয়ে আমি আপত্তি করি। কেন আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীকরণ করব। এর কারণ হতে পারে, এটা আমাদের কলোনিয়্যাল মেন্টালিটি। যেমন আমরা এক সময় বলতাম, বঙ্কিমচন্দ্র কী? তিনি স্কটের অনুসরণে উপন্যাস লেখেন। এতে তো বঙ্কিমচন্দ্রের মর্যাদা বাড়ে না। এ ধারণা বা মেন্টালিটি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। আর শিক্ষাব্যবস্থা তো দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থার অংশ। দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থা না জানলে শিক্ষাব্যবস্থাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেন ছাত্ররা পড়াশোনার কাছে যেতে চাচ্ছে না? কিংবা শিক্ষকরাও? এর বহুবিধ কারণ আছে। জবাবও আছে। জিনিসপত্রের দাম অনবরত বেড়ে যাচ্ছে। যারা বাড়াচ্ছেন তাঁরা তো ব্যবসায়ী। তাঁরা এটা কেন করছেন। তাঁরা কি এ দেশের লোক নন? সে জন্য বিভিন্ন দিক দিয়ে বিচারটা করতে হবে। অবমূল্যায়ন শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই ঘটেছে এমন নয়। সবক্ষেত্রেই ঘটছে। এর পেছনে একটা কারণ হতে পারে, মহাবিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছি না। যেমন যে লোকটি এখানে ফাঁকি দেয় কাজে, সে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে খাটাখাটনির কাজ করে গিয়ে? এসবের জবাব আমাদের খুঁজতে হবে।
মাসউদ আহমাদ : জীবনের প্রয়োজনে আমাদের একটা পেশা তো বেছে নিতেই হয়। আপনি শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় প্রায় পুরো জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন। এই বয়সে এসে বিশেষ কোনো উপলব্ধি কাজ করে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : আসলে কোনো পেশাই মহান নয়। যদি আমি বলি, শিক্ষকতা মহান পেশা, তাহলে অন্যান্য পেশাকে ছোট করা হয়। জীবনের জন্য সব পেশাই দরকার, বেঁচে থাকার জন্য। শিক্ষকরা মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন বলা হয়- আমি এটাতে আপত্তি করি। তাহলে মা-বাবা কোথায় থাকবেন। তাঁদেরও তো বিশেষ ভূমিকা আছে। এসব আসলে কতগুলো অর্থহীন কথা আমরা চালু করে রেখেছি।
মাসউদ আহমাদ : একটা বয়সে এসে মানুষ জীবনের হিসাব মেলায় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, খেদ, দীর্ঘশ্বাস। এ বয়সে পৌঁছে আপনার উপলব্ধি কী?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : আমার কোনো খেদ নেই। আর আমার মনে হয়, আমি ভালোই আছি। দীর্ঘ জীবন পেয়েছি। অনেক কিছু পেয়েছি। বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে আনন্দের। আমরা আসলে সবাই বেঁচে থাকতে চাই। আমরা কেউই চলে যেতে চাই না। তবু তো যেতে হয়। হবেই।
মাসউদ আহমাদ : ইদানীং আপনি কী লিখছেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : ইদানীং আমি কবিতা লিখছি। গল্প লিখছি। শিল্প বিষয়ে প্রবন্ধ লিখছি। জীবনযাপনের যন্ত্রণা নিয়ে এর মধ্যে রাজনীতি আসে, সেসব নিয়ে ভাবছি। যেসব মাধ্যমে আমি কাজ করেছি সেই পথেই কাজ করে চলেছি। কারণ সব মাধ্যমই আমার কাছে প্রয়োজনীয়। সব মাধ্যমেই কাজ করি বলেই আমার মধ্যে এক ধরনের সহিষ্ণুতা তৈরি হয়।
মাসউদ আহমাদ : এখন বইপত্র কেমন পড়েন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : পড়াশোনা করব বলেই তো লেখক হয়েছিলাম। শিক্ষকও হয়েছিলাম। সব রকমের বই পড়ি। উপন্যাস পড়ি, কবিতা, শিল্পসংক্রান্ত লেখা, রাজনৈতিক কলাম নানারকম লেখা পড়ি।
মাসউদ আহমাদ : আপনি কি তরুণদের লেখা পড়েন, কেমন লাগে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, পড়ি। খুবই ভালো লাগে।
মাসউদ আহমাদ : পথের বাঁকে হেঁটে এসে জীবনের একটা সময়ে অনেক লেখক-শিল্পীই আত্মজীবনী লেখেন। আপনি কি আত্মজীবনী লিখবেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : একটা কথা হচ্ছে, আত্মজীবনী লিখব কি না এমন শর্ত বিধাতার কাছে নেই। আমার যা কিছু লেখা সেসব এক হিসেবে আমার আত্মজীবনী। সে আমার কবিতা বলুন, গল্প বা রাজনৈতিকবিষয়ক প্রবন্ধই হোক না কেন। আর আমি আসলে নিজের কথাকে বিশ্বাস করি না। চারপাশের কথাকেই আমি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবি। আমি নিজেকে বড় করব কেন বলেন? আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ- এই অহঙ্কার থাকা ভালো নয়।
সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : আপনাকেও।