চলচ্চিত্র প্রযোজনা
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য
সৃষ্টির মাত্র দেড়শ বছরেই চলচ্চিত্র বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। নির্বাক থেকে সবাক—সব সময়ই একটা চলচ্চিত্র একটা সময়কে ধারণ করে, সে সময়ের মানুষের নানান অনুভূতির কথা বলে। এক-একটা চলচ্চিত্রকে ঘিরে থাকে মানুষের হরেক রকম স্মৃতি। প্রিয় মানুষের সঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখা পৃথিবীর সব দেশে খুব রোমান্টিক একটা ব্যাপার বলেই বিবেচিত। তাই মানুষ ফিরে যায় সেই চলচ্চিত্রেরই কাছে। আর এভাবেই একটি চলচ্চিত্র বহুদিন বেঁচে থাকে মানুষের মাঝে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুগের পর যুগ একটা চলচ্চিত্রের মর্যাদা একই রকম থাকে। এ রকম বহু উদাহরণ আমাদের আশপাশেই আছে। তাই সে রকম একটা চলচ্চিত্রের প্রযোজক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের সমাজের অনেক সচ্ছল মানুষের মনেই থাকে। কিন্তু বিধি বাম হয় তখন, যখন এই সুন্দর একটা চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত গলার কাঁটায় রূপ নেয়। লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত না আসায় পথে বসতে হয়। তাই এই মাধ্যম যতই রোমান্টিক মনে হোক না কেন, বাস্তবতার কশাঘাত এই মাধ্যম চরম নিষ্ঠুর। একটু অসচেতনতা, একটু খামখেয়ালি, একটু আবেগই যথেষ্ট সব হিসাব গরমিল করে দেওয়ার জন্য।
প্রায় এক যুগ ধরে একজন লেখক, পরিচালক ও প্রযোজক হওয়ার সুবাদে টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের বহু মানুষের সঙ্গে উঠ-বসের সুযোগ হয়েছে আমার। সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতাগুলো থেকেই আজকের লেখা। আমার মনে হয়েছে, এই প্রবন্ধ খুবই সময়োপযোগী এবং লেখাটি অনেকেরই উপকার নতুবা অপকারে আসবে। যেহেতু আমি বলে নিয়েছি এটা একটা অভিজ্ঞতালব্ধ লেখা, তাই কিছু সত্যিকারের ঘটনা দিয়েই আমি লেখাটা সাজিয়েছি। চলুন, দেখি কিছু প্রযোজকের গল্প।
গল্প-১
কারওয়ান বাজারের এক মাছের আড়তদারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ফিল্মের কিছু তথাকথিত অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের, যারা আসলে প্রোডাকশন বয় বা ম্যানেজার। তাদের রসালো সব কথায় প্রলুব্ধ হয়ে সেই মাছের আড়তদার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, সে বানাবে একটা চলচ্চিত্র। যেই কথা সেই কাজ, শুরু হলো শুটিং। যে কদিন শুটিং চলল, তত দিন সবাই তাকে করে বিশাল সম্মান। সেটে এলেই তার জন্য বিশাল চেয়ার, নায়ক-নায়িকারা তার হাত ধরে ছবি তোলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রের শুটিং শেষ হওয়ার পর আর কারো কোনো খোঁজখবর নেই। যারা তাকে দেখিয়েছিল নানা নিশ্চয়তা, তাদেরই তখন আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এই চলচ্চিত্র নিয়ে সে এখন করবেটা কী? অথচ এই চলচ্চিত্রেই বিনিয়োগ করেছে সে জীবনের সব পুঁজি। চাপ দিয়ে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শেষ করতে তাকে ইচ্ছামতো টাকা খরচ করিয়েছে সবাই। তার হাত হয়ে পড়েছিল একদম খালি। সেই চলচ্চিত্র পরিবেশকের কাছে পৌঁছাতেই পার হয়ে যায় প্রায় দুই বছর। এরই মধ্যে প্রায় দুই কোটি টাকা তার খরচ হয়ে গেছে। পরিবেশক সাহেব ভাবগতিক বুঝে চালানোর চেষ্টা করল চলচ্চিত্রটি। কিন্তু ব্যবসা যা-ই হোক, বলা হলো চলচ্চিত্রটি ফ্লপ। হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে পরিবেশক সাহেব সেই হিসাবে চালান দিয়ে দিলেন। প্রায় পথে বসল সেই মাছের আড়তদার। ধারদেনা করে বানানো চলচ্চিত্র হয়ে দাঁড়াল তার গলার কাঁটা। জীবনের অভিশাপ।
গল্প-২
এক পড়ন্ত বিকেলে আমার অফিসে এলেন বেশ বয়স্ক একজন মেকআপম্যান। প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি চলচ্চিত্রে মেকআপম্যানের কাজ করছেন। সংগত কারণেই তাঁর নাম উল্লেখ করছি না। তিনি এসেছিলেন কারণ, তিনি আমার প্রজেক্টগুলোতে কাজ করতে চান। বয়স্ক একজন মানুষ হওয়ায় আমি বেশ আগের দিনের গল্পে মজে গেলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম, সেই মেকআপম্যান দুটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন এবং দুটি চলচ্চিত্রই ব্যবসাসফল। সে সময়ের দর্শকপ্রিয় নায়ক-নায়িকাই তাঁর চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। কারণ, বহুদিন তাঁদের মেকআপ করায় তাঁর প্রতি সেই নায়ক-নায়িকার একটি মমত্ববোধ জন্মে গিয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ কত? তিনি বলেছিলেন, নব্বইয়ের দশকে দুটি চলচ্চিত্রে প্রায় কোটি টাকা তাঁর খরচ হয়েছিল। এত টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, আগে থেকেই হল মালিকদের বুকিং মানি, কিছু ধার আর কিছু পেমেন্ট চলচ্চিত্র রিলিজের পর মিটিয়েছেন এবং এই চলচ্চিত্রের টাকায় তিনি জমি কিনেছেন ধামরাইয়ে, একটি বাড়িও করেছেন সেখানে। আরেকটি বাড়ি করেছেন শনির আখড়ায়। আমি তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনের অনেক গল্প শুনে পার করলাম সেই বিকেলটা। দুই চলচ্চিত্রই ছিল তাঁর ব্যবসাসফল। তার মানে, একজন মেকআপম্যান হওয়া সত্ত্বেও তিনি একজন সফল প্রযোজক।
গল্প-৩
তখন ডেসটিনির রমরমা ব্যবসা। ডেসটিনির কিছু সফল ব্যবসায়ী, যাঁরা তখন আঙুল ফুলে কলাগাছ। ডেসটিনির অফিস কাকরাইলে ছিল, আর বলতে গেলে বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বেশির ভাগ অফিসই কাকরাইল আর মগবাজারে। তাঁদের সঙ্গেও একইভাবে পরিচয় হলো কিছু চলচ্চিত্রকর্মীর। যাঁরা তাঁদের বুঝিয়েছিলেন, বাংলা চলচ্চিত্র ফ্লপ হয় না, যদি পরিবেশনা ভালো হয়। সত্যিই তো, যদি পরিবেশনা ভালো হয়, চলচ্চিত্রের লগ্নিকৃত অর্থ অন্তত উঠে আসার কথা। সেই ব্যবসায়ীরা ঠিক করলেন, তাঁদের এই সহজে আয় করা পয়সা চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করবেন। কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ হলো, কয়েক মাস একটানা শুটিং চলল হালের সেরা নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে। সেসব নতুন প্রডিউসারের চোখে রঙিন স্বপ্ন। নায়িকার মিষ্টি হাসি, সঙ্গে কিছু স্মৃতিময় ছবি। সেই রঙিন স্বপ্নে দেখা দিল ভিলেনের আগমন, নায়কের শিডিউল জটিলতায় চলচ্চিত্রের কাজ শেষ হতে সময় লাগল প্রায় দুই বছর। যখন রিলিজ দেওয়ার কথা থাকল, তখন আর কাউকেই পাওয়া গেল না। বেচারারা একইভাবে গেলেন অপরিচিত পরিবেশকদের কাছে, সে সময় মাত্র ১০ প্রিন্টে রিলিজ হলো চলচ্চিত্রটি। যা হওয়ার তা-ই হলো। সেই নতুন প্রডিউসারদের ফিল্ম বানিয়ে যে টাকা ফেরত এলো, তা দিয়ে একবেলা বিরিয়ানি খাওয়াও সম্ভব ছিল না।
এ রকম গল্প অনেক বলা যাবে, কারণ এই গল্প আমাদের দেশের চলচ্চিত্রপাড়ার সাধারণ ঘটনা। চলচ্চিত্রপাড়ায় এ ধরনের নতুন প্রডিউসারদের বলা হয় ‘মুরগি’। আর বর্তমানে এই মুরগি জবাই করেই বলতে গেলে চলছে আমাদের চলচ্চিত্রজগৎ। কারণ, এফডিসির প্রযোজকরা প্রায় সবাই চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ রেখেছেন। বলা হয়, চলচ্চিত্র ব্যবসায়ের সাফল্যের মাত্রা মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা দুনিয়াতেই শতকরা ১২ থেকে ১৫ ভাগ চলচ্চিত্র ব্যবসাসফল হয়, যদি ইন্ডাস্ট্রি খুব সহায়ক হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যার হার আরো কম, কারণ এখানে কোনো নিয়মের বালাই নেই, যে যার মতো পয়সা কামানোর ধান্ধায় ব্যস্ত।
এখন আসা যাক ডিজিটাল চলচ্চিত্রের সময়ে। আগে যখন ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরায় চলচ্চিত্র শুটিং হতো, তখন শুটিংয়ের বাজেট এখনকার চেয়ে অন্তত দুই গুণ ছিল। যখনই ক্যামেরার পরিবর্তন হয়ে ডিজিটাল ফরম্যাটে চিত্রায়ণ শুরু হলো, তখন আবারো নতুন প্রযোজকদের আনাগোনা বেড়ে গেল চলচ্চিত্রজগতে, কারণ অনেকেই তাঁদের বুঝিয়েছিলেন টেলিফিল্মের বাজেটেই এখন চলচ্চিত্র হয়ে যায়। এই কল্পনাপ্রসূত চিন্তা আর স্বপ্ন নিয়ে অনেকেই এসেছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে, তবে তার বেশির ভাগই আলোর মুখ দেখেনি। বেশির ভাগ চলচ্চিত্র শুটিং শেষ হয়নি ওই বাজেটে বা শেষ হলেও অল্প কিছু হলে মুক্তির চেষ্টা করা হয়েছে বা কোনো দিনই মুক্তি পাবে না। তবে কি নতুন প্রযোজক আসা বন্ধ হওয়া উচিত চলচ্চিত্রজগতে? উত্তর, না। নতুন প্রযোজক-পরিচালক না এলে চলচ্চিত্রের ভিন্নতা আসে না। শুধু বাংলাদেশে নয়, কথায় আছে চলচ্চিত্রজগৎ চলেই এই নতুনদের পয়সায়। তাহলে এর থেকে মুক্তির পথ কী? যেকোনো ব্যবসায় তো ঝুঁকি থাকবেই, কিন্তু সে ঝুঁকি কীভাবে আগে থেকে নিরূপণ করা যায়? আসুন, সে বিষয়ে এখন কথা বলা যাক।
প্রথমেই একজন নতুন প্রযোজককে জানতে হবে, চলচ্চিত্রের বাজেট কীভাবে নির্ধারণ করা হয়। পরিচালক যে বাজেট আপনাকে দিচ্ছেন, তা কতটুকু যুক্তিসংগত। আর বাজেটই বা সাধারণভাবে কয় প্রকার হয়, কী কী থাকে এই বাজটের হিসাবে? তাত্ত্বিকভাবে না হলেও সাধারণ নজরে বাজেটের রকম নিচে আলোচনা করার চেষ্টা করা হলো।
প্রি-প্রোডাকশন বাজেট
এ সময় সাধারণত শুটিংয়ের আগে যেসব খরচ হয়, সেগুলো এই খাতে আসবে। যেমন—স্ক্রিপ্ট লেখা বাবদ সম্মানীর কিছু অংশ, শুটিং লোকেশন ফাইনাল করা, সেট নির্মাণ, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাইনিং মানি দেওয়া, মিউজিক ডিরেক্টরের পেমেন্টের কিছু অংশ, প্রি-প্রোডাকশন ফটোশুট, পরিচালকের কিছু পেমেন্ট ইত্যাদি। এ সময় ব্যয় হতে পারে মোট বাজেটের ১০ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যে।
আর্টিস্ট বাজেট
আপনার চলচ্চিত্রে যাঁরা অভিনয় করবেন, তাঁদের সবার ব্যয় এ খাতে ধরতে হবে। আপনাকে অবশ্যই বাজার যাচাই করে প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর খরচ নির্ধারণ করতে হবে। এবং তাঁদের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে লিখিত চুক্তি সম্পাদিত হতে হবে।
টেকনিক্যাল বাজেট
এ খাতে সাধারণত চলচ্চিত্রটি চিত্রায়ণ করতে যা যা যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হবে, যেমন—ক্যামেরা, লাইট, ট্রলি, ক্রেন, ড্রন, জিবর্আম, সেট নির্মাণ, জেনারেটর, ক্রু ইত্যাদি কত দিনের জন্য প্রয়োজন হবে, তার আনুমানিক খরচ।
শুটিং/প্রোডাকশন বাজেট
এ সময় শুটিংয়ের সময়কার সব খরচ, লাইট, ক্যামেরা, ক্রু, অন্য সব অয়োজন, লোকেশন চার্জ, খাওয়া-দাওয়া, ট্রান্সপোর্ট, হোটেল বিল তথা শুটিং ইউনিটের সব খরচ শুটিং চলাকালে প্রযোজককে বহন করতে হয় এবং শুটিং শেষে সব ক্রু, আর্টিস্টের পেমেন্ট অবশ্যই চুক্তি অনুযায়ী পরিশোধ করতে হবে।
পোস্ট প্রোডাকশন বাজেট
এ সময় সাধারণত শুটিং শেষ হয়ে যায়। থাকে এডিটিং এবং ডাবিংয়ের কাজ। এ কাজের সময় সাধারণ টেকনিক্যাল খরচগুলো হয়, যেমন—এডিটিং চার্জ, ডাবিং স্টুডিও চার্জ, অ্যানিমেশনের খরচ, পোস্টার ডিজাইন ইত্যাদি।
রিলিজ বাজেট
চলচ্চিত্রটি সিনেমা হল পর্যন্ত নিতে আরো অনেক খরচ হয়ে থাকে, যেমন—ডিজিটাল ব্যানার (যতগুলো হলে মুক্তি পাবে, ততটি ডিজিটাল ব্যানার করতে হবে) পোস্টার, লিফলেট, কপি প্রটেক্টেড পেনড্রাইভ ইত্যাদি।
প্রমোশনাল বাজেট
আপনার চলচ্চিত্রটিকে দর্শকের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন খুব ভালো প্রমোশন, তাই এ খাতেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন আছে।
প্রজেকশন বাজেট
চলচ্চিত্র যখন রিলিজ হবে, তখন চলচ্চিত্র চলুক আর না-ই চলুক, একজন প্রযোজককে প্রজেকশন মেশিন ভাড়া গুনতে হয়। যদিও সেটা সাধারণত সিনেমা হলে টিকিট বিক্রির টাকা থেকেই উঠে আসার কথা, কিন্তু সেটা না হলে প্রযোজককে তাঁর ভাড়াও দিতে হয় এবং এজেন্টের খরচ একটি গুরুত্বপূর্ণ খরচ, কারণ আপনার চলচ্চিত্রটি কত টাকা প্রতিদিন আয় করল, তার হিসাব এই এজেন্টই রাখে। আপনি যতগুলো প্রিন্ট হলে দেবেন, ততজন এজেন্ট দিতে হবে প্রতিটি প্রিন্টের সঙ্গে। কারণ, এজেন্ট না থাকলে সহজেই চলচ্চিত্রটি পাইরেসি হয়ে যেতে পারে।
এতক্ষণ তো গেল একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ-ব্যয়, এখন আসা যাক একটা চলচ্চিত্র থেকে কীভাবে আয় হতে পারে।
স্পন্সরশিপ
স্পন্সরশিপ একটি নতুন ধরনের আয়, চলচ্চিত্রে যা এখনো প্রথাগত হয়ে ওঠেনি। সাধারণত যাঁরা টিভি থেকে ফিল্ম নির্মাণ করে থাকেন, তাঁরা এই খাত থেকে কিছু টাকা বের করে আনছেন বেশ কিছুদিন ধরে। সাধারণত দুই ধরনের স্পন্সর থাকে চলচ্চিত্রে—একটি হলো টাইটেল স্পন্সর, অন্যটি অ্যাসোসিয়েট স্পন্সর। এ দুটো থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে, যদি চলচ্চিত্রটিতে প্রথম সারির নায়ক-নায়িকা এবং অভিনেতা থেকে থাকেন। তবে এর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ যোগাযোগ থাকতে হবে বিজ্ঞাপন সংস্থা এবং বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির পাবলিক অ্যান্ড মিডিয়া রিলেশন বিভাগের মানুষের সঙ্গে। নতুবা এটা আয় করা সম্ভব নয়।
কলার টিউনস
এটিও নতুন ধরনের আয় চলচ্চিত্রের জন্য। চলচ্চিত্রের গানগুলো বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির কলার টিউন হিসেবে চালাতে পারলে সেখান থেকেও একটা পরিমাণ আয় আসতে পারে। আর যদি গানটি শ্রোতাপ্রিয় হয়, তাহলে বেশ ভালো রকমের আয়ও হতে পারে। সেটা ধরা যাক এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় হতে পারে।
সিডি/ডিভিডি রাইটস
চলচ্চিত্রের গানের অ্যালবাম কোনো মিউজিক কোম্পনির কাছে বিক্রির মাধ্যমে এই আয় সম্ভব, যা রয়ালিটি বা এককালীনভাবে পরিশোধিত হতে পারে এবং চলচ্চিত্রটি রিলিজের পর সেটার ডিভিডি ও রাইটস বাবদ এ খাত থেকে তিন-পাঁচ লাখ টাকা আয় হতে পারে।
টিভি রাইটস
চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে প্রচারের মাধ্যমে এই আয় আসা সম্ভব। সাধারণত ঈদ বা বিশেষ দিনে সব চ্যানেলই নতুন চলচ্চিত্র চালিয়ে থাকে। চলচ্চিত্রটি দর্শকপ্রিয়তা পেলে, বেশ ভালো দামে একবার প্রচারের উদ্দেশ্যে চ্যানেলে চালানো হয়, যাতে ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হতে পারে।
সিনেমা হল রিলিজ
সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে টিকেট বিক্রির একটি অংশ প্রযোজক পেয়ে থাকে। একটি সিনেমা হলে যতগুলো শো হয়, সেই শোগুলোতে যত টিকেট বিক্রি হয়, তার ওপর ভিত্তি করে হয় প্রযোজকের আয়। যত বেশি টিকেট বিক্রি, তত বেশি আয়। এটাই হচ্ছে চলচ্চিত্রের একমাত্র প্রথাগত আয়। তাই কত টিকেট বিক্রি হলো, তার সঠিক তথ্য জানার জন্য অবশ্যই একজন বিশ্বস্ত এজেন্ট নিয়োগ করতে হবে, যে টিকেটের প্রাপ্ত অর্থের সঠিক তথ্য পরিবেশকের মাধ্যমে প্রযোজককে দেবে। চলচ্চিত্রটি যত বেশি দর্শকপ্রিয়তা পাবে, তত বেশি টাকা আয় হবে এ খাত থেকে এবং এই টিকেট বিক্রির ওপর নির্ভর করে চলচ্চিত্রের ভাগ্য।
হলবুকিং/টেবিল মানি
চলচ্চিত্র মুক্তির আগেই নায়ক-নায়িকার চাহিদার কারণে হল মালিকরা অগ্রিম বুকিং মানি দিয়ে থাকেন। আপনি সময়ের জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা নিয়ে ভালো বাজেটের একটি সুন্দর চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন—এ খবর হল মালিকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন, তাহলে অনেক সময়ই হল মালিকরা আগ্রহ করে চলচ্চিত্রটি হলে চালানোর জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে দেন। এটা অনেক দিনের অভিজ্ঞতা এবং ভালো পরিবেশকের সহযোগিতায় এ রকম আয় হতে পারে।
বিকল্প প্রদর্শন
যেসব জায়গায় চলচ্চিত্রটি পৌঁছায়নি বা হল নেই, যেসব জায়গায়, যেমন—জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন বা বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে বেশ ভালো টাকা আয় করা সম্ভব। যদিও এর জন্য পরিশ্রমও অনেক বেশি এবং বেশ কিছু অনুমতির প্রয়োজন হয়, যা চেষ্টা করলে পাওয়া সম্ভব।
করপোরেট শো
চলচ্চিত্রটি যদি সত্যিই ব্যবসাসফল হয়, তাহলে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে থাকে, যা থেকেও একটি ভালো পরিমাণ অর্থ আয় হয়ে থাকে এককালীন। তবে এর জন্য বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির মিডিয়া রিলেশন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে, নতুবা এই আয় অসম্ভব।
বহির্বিশ্বে প্রদর্শন
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী থাকেন, তাঁদের জন্য যদি চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যায়, সেটা থেকে ভালো পরিমাণ অর্থ আয় করা সম্ভব। অনেক সময় অনেক ফ্লপ চলচ্চিত্র বিদেশে প্রবাসীদের মাঝে দর্শকপ্রিয়তা পেয়ে যায় শুধু দেশের চলচ্চিত্র বলে। তাই এ সুযোগ হাতছাড়া না করাই ভালো। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশে বিকল্প প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি চলচ্চিত্র থেকে অনেক আয় করা সম্ভব, কারণ সেখানে সেসব দেশের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী টিকেটের দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। টাকায় এর মূল্যে অনেক বেশি।
আয় ও ব্যয়ের খাত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলচ্চিত্র ব্যবসায় লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে প্রযোজকদের অনভিজ্ঞতা এবং পারিপার্শ্বিক অসৎ ব্যক্তিদের কার্যকলাপে বেশির ভাগ প্রযোজকই লাভের মুখ দেখতে পান না। কিন্তু এ কথাও মেনে নিতে হবে, কোনো ব্যবসাতেই প্রথম থেকে লাভ হয় না। চলচ্চিত্র ব্যবসাও তেমনি একটি ব্যবসা, এখানে যত বেশি যোগাযোগ এবং সম্পর্ক তৈরি হবে, তত ব্যবসা করা সহজ হবে। কিছু সাধারণ বিষয় এ ব্যবসায় মেনে চলা উচিত। সেগুলো হলো :
১. আপনার কাছে বিনিয়োগ করার মতো প্রচুর অলস অর্থ থাকলেই শুধু চলচ্চিত্র ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করুন।
২. সব অর্থনৈতিক লেনদেন, কখন কীভাবে সেটা পরিশোধিত হবে এবং সব প্রতিশ্রুতি স্ট্যাম্পে লিখিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
৩. সব সময় খুব ভালো একটি স্ক্রিপ্ট বাছাই করতে হবে চলচ্চিত্র করার জন্য।
৪. চলচ্চিত্র চিত্রায়ণের ন্যূনতম দুই মাস আগে আপনার হাতে চলচ্চিত্রের পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট আসতে হবে।
৫. স্ক্রিপ্ট হাতে আসার পর অভিনেতা-অভিনেত্রী চূড়ান্ত হলে স্পন্সরশিপের কাজ শুরু করা উচিত।
৬. চলচ্চিত্রের বাজেট সঠিক হতে হবে এবং সব বিষয় নিজে যাচাই করে দেখুন ক্রস চেকিংয়ের মাধ্যামে। চলচ্চিত্র পরিবেশকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে।
৭. চলচ্চিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবশ্যই চলচ্চিত্র ঘরানার হতে হবে। টেলিভিশন থেকে কাস্টিং না করাই শ্রেয়।
৮. নতুন প্রযোজক হলে নতুন অভিনেতা, অভিনেত্রী ও পরিচালক নিয়ে কাজ না করাই ভালো।
৯. নতুন পরিচালক নেওয়ার আগে তাঁর কার্যদক্ষতা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিতে হবে যে সে কাজটি করতে পারবে কি না?
১০. পরিচালকের আগের সব চলচ্চিত্র ফ্লপ হলে বা রিলিজ না পেলে তাঁর সঙ্গে কাজ না করাই ভালো।
১১. পরিচালকের চলচ্চিত্র পরিবেশক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে কি না যাচাই করুন, না থাকলে তাঁর সঙ্গে প্রজেক্ট করা যাবে না।
১২. বর্তমান সময়ে ন্যূনতম ৬০টি সিনেমা হলে তিন সপ্তাহ সিনেমাটি চলবে এমনভাবে সব কর্মসম্পাদন করতে হবে।
১৩. বিশ্বস্ত এজেন্ট নিয়োগ করতে হবে প্রতিটি প্রিন্টের সঙ্গে। এতে পাইরেসি রোধ করা যায়। টিকেট বিক্রির সঠিক তথ্যটিও আপনি পাবেন তাঁর মাধ্যমে।
১৪. চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং পরিবেশক সমিতিতে নিয়মিত যাতায়াত থাকতে হবে।
১৫. যতটা সম্ভব চলচ্চিত্র ঘরানার মানুষের সঙ্গে নিয়মিত উঠবস করতে হবে। পরিবেশকের কাছ থেকে সম্পূর্ণ হিসাব বুঝে নিতে হবে।
১৬. একটি মাত্র চলচ্চিত্র প্রযোজনা করবেন, এ রকম কোনো তথ্য কেউ যেন না পায়; বরং সবাই যেন ভাবে, আপনি আরো অনেক চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে চান এবং সেগুলো পাইপলাইনে আছে।
১৭. প্রচুর সময় দিন এ ব্যবসায় এবং ধৈর্য ধরুন। মনে রাখবেন, কোনো ব্যবসায় প্রথম দিন থেকে লাভজনক হয় না। তাই হয়তো বা প্রথম নয়, দ্বিতীয় বা তৃতীয় চলচ্চিত্র আপনার সব ক্ষতি পুষিয়ে দেবে।
আর অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, সারা বিশ্বেই চলচ্চিত্র ব্যবসায় সফলতার হার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। তাই কোন চলচ্চিত্র সফল হবে, তা বলা মুশকিল। তবুও ভালো মানের, ভালো গল্পের চলচ্চিত্র, দর্শকপ্রিয় অভিনেতা নিয়ে নির্মিত হলে দর্শক সব সময়ই গ্রহণ করছে, ভবিষ্যতেও করবে।
চলচ্চিত্র ব্যবসায়ে নানা প্রতিকূলতা থাকলেও এর থেকে প্রাপ্তি অনেক বেশি। একজন প্রযোজক সেলিব্রটিদের সেলিব্রেটি। তাই যেখানে প্রাপ্তি বেশি, সেখানে ঝুঁকি তো বেশি থাকবেই। পৃথিবীর অন্যতম গ্ল্যামারযুক্ত পেশা হলো চলচ্চিত্র প্রযোজনা। প্রচুর অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্তি, যোগাযোগ, সেলিব্রেটিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সবই পাওয়া যায় এই পেশা থেকে। তাই সবকিছু করা উচিত বুঝেশুনে। আপনি যদি ভেবে থাকেন, আপনি চলচ্চিত্র প্রযোজক হবেন, আপনাকে স্বাগতম এই রঙিন দুনিয়ায়।