মৃণাল সেন
এখনো প্রাসঙ্গিক
মৃণাল সেন। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সচেতন এবং রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন নির্মাতা। আজ ১৪মে তাঁর ৯২তম জন্মদিন। জীবনের নয়টি দশক পেরিয়ে মৃণাল সেন অনেক পরিপূর্ণ। তাঁর সম্পর্কে জানিয়েছেন তাঁর হাত ধরে সিনেমায় নামা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। ভারতীয় দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমসে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন অনিন্দিতা আচার্য্য। সেখান থেকেই লেখাটি ভাষান্তর করা হলো।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং পরিচালকদের কাছে মৃণাল সেন জীবন্ত কিংবদন্তী। মধ্যবিত্তের সামাজিক সংকট নিয়ে ‘এক দিন প্রতিদিন’, সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে ‘খারিজ’, দুর্ভিক্ষ নিয়ে ছবি ‘আকালের সন্ধানে’, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ের উপর নির্মিত ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’ এবং ‘ভূবন সোম’ স্পষ্ট বক্তব্যের কারণে এখনো প্রাসঙ্গিক।
মৃণাল সেনের ছবি ভারতীয় সিনেমায় এক নতুন যুগের জন্ম দিয়েছে। ২০০২ সালে সর্বশেষ ‘আমার ভূবন’ ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন মৃণাল সেন। মিঠুন চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, মমতা শংকর, শ্রীলা মজুমদার, মাধবী মুখার্জি সবারই পথচলা শুরু হয়েছিলো মৃণাল সেনের হাত ধরে। স্মিতা পাতিল, শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ এবং ওম পুরির মত অভিনেতারা কাজ করেছেন তাঁর ছবিতে।
বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের মেয়ে অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী মমতা শংকর একবার বলেছিলেন, ‘মৃণাল দার কাছে আমি ঋনী। তিনি আমাকে লাইট-ক্যামেরার জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন’।
১৯৭৬ সালে ‘মৃগয়া’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেন মমতা। একই ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু হয়েছিলো মিঠুন চক্রবর্তীর। জীবনের প্রথম ছবির জন্যই সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন মিঠুন। ১৯৭৭ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন প্রাইজ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলো মৃগয়া।
২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁকে ‘অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ’ পুরস্কারে ভূষিত করেছিলেন। নিজের দেশে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মৃণাল সেন।
‘ইন্টারভিউ’ ছবির মাধ্যমে রনজিৎ মল্লিকের যাত্রা শুরু হয়েছিলো চলচ্চিত্রে। ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’ এবং ‘কোরাস’ ছবিগুলোর মাধ্যমে নিজেকে রাজনীতি সচেতন পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মৃণাল সেন।
জনপ্রিয় গায়ক, পরিচালক অঞ্জন দত্ত প্রথম অভিনয় করেছিলেন মৃণাল সেনের ‘চালচিত্র’ (১৯৮১) ছবিতে। এছাড়াও মৃণালের ‘খারিজ’, ‘একদিন আচানক’ এবং ‘অন্তরীণ’ ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। মৃণাল সেন সম্পর্কে অঞ্জন বলেন, ‘তিনি আমাকে সিনেমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাথে কাজ করে আরাম পাওয়া যায়। সহজেই সবকিছু বুঝিয়ে দিতে পারেন আবার কাজটাও আদায় করে নিতে পারেন। আমি যখনই একটু আলাদাভাবে অভিনয়টা করতে চেয়েছি, তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন নিজের মত করে করার। এখন মৃণাল দা অসুস্থ। আমরা এখন আর সিনেমা নিয়ে গল্প করিনা। যে দিনগুলো ফেলে এসেছি সেগুলো নিয়ে আলাপ করি, মজার কথাগুলো মনে করে হাসি। আমার “দত্ত ভার্সেস দত্ত” (২০১২) ছবিটি দেখতে মিক্সিং স্টুডিওতে এসেছিলেন মৃণাল দা। আমাদের সম্পর্কটা এমন যে সেটা শুধু সিনেমার মধ্যেই আটকে নেই’।
মৃণাল সেনকে নিয়ে মমতা শংকর বলেন, ‘সম্প্রতি দূরদর্শন মৃণাল দাকে নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র করেছে। আমি দাদার বেশকিছু ছবি আবার দেখছিলাম। নিজের কাজের প্রতি লোকটা বাড়াবাড়ি রকমের সৎ। ছবির মাধ্যমে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করেছেন তিনি। ১৯৮২ সালে ‘খারিজ’ সিনেমা দেখার পর থেকে লোকে বাড়িতে কাজের লোক রাখার আগে তাদের নাম ঠিকানা টুকে রাখতে আরম্ভ করেছিলো। এই সচেতনতা কিন্তু ওই ছবির মাধ্যমেই তৈরি হয়েছিলো’।
মমতা শংকর বলেন, ‘২০১০ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষের “আবহমান” ছবিতে আমার অভিনয় দেখে দাদা খুব প্রশংসা করেছিলেন। তখন মনে হয়েছিলো আসলেই বোধহয় কাজটা ভালো করেছিলাম’।
মৃণাল সেন ছাড়াও সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং গৌতম ঘোষের ছবিতে অভিনয় করেছেন মমতা শংকর। মমতা বলেন, ‘মৃণাল দা অত্যন্ত পরিশ্রমী একজন পরিচালক এবং জাগতিক মোহমায়া থেকে মুক্ত একজন মানুষ। আমার যদ্দুর মনে পড়ে মৃগয়ার পর ধর্মেন্দ্র এবং হেমা মালিনীকে নিয়ে আরেকটা সিনেমা বানানোর প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। যার বাজেট ছিলো প্রায় ৭৫ লাখ রুপি। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। আপোস করতে চাননি কাজের ক্ষেত্রে’।
১৯৭৮ সালে মৃণাল সেনের ‘পরশুরাম’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন শ্রীলা মজুমদার। তিনি বলেন, ‘মৃণাল দা একইসাথে আমার বাবা-ভাই এবং বন্ধুর মত। খুবই ছেলেমানুষ। আমরা অনেক কিছু নিয়ে আলাপ করি, ঝগড়া করি।
“এক দিন প্রতিদিন” ছবিটা দাদা সেই কবে বানিয়েছেন, কিন্তু এখনও এর বিষয় প্রাসঙ্গিক। ঘরের মেয়ে রাতে বাড়ি না ফিরলে আমাদের এখনও ওইরকমই রাগ হয়’।