পুরুষ বদলে নারীর অস্ত্র ‘সেক্স স্ট্রাইক’
গ্রিক যুদ্ধবিরোধী হাস্যরসাত্মক নাটক ‘লিসিসট্রাটা’র সঠিক রচনাকাল নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ৪১১ বছর আগে নাটকটির মঞ্চস্থ শুরু হয়। তখন প্রচলিত সাহিত্যকর্ম বলতে ছিল নাটক আর কবিতা। কথাসাহিত্যের কতক বৈশিষ্ট্য সুপ্ত অবস্থায় ছিল মহাকাব্যে। লিসিসট্রাটা নাটকটির রচয়িতা বিখ্যাত গ্রিক নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিস। সে সময় গ্রিক রাষ্ট্রগুলো নিজেদের ভেতর যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছে অ্যাথেন্স আর স্পার্টা। যুদ্ধবাজ সমাজব্যবস্থায় পুরুষজন্মই ছিল ‘বীর’ খেতাব অর্জনের জন্য—হয় যুদ্ধে ‘শহীদ’ হয়ে, নয়তো যুদ্ধজয়ী হয়ে ঘরে ফিরে। নারীরা ছিল চার দেয়ালে বন্দী। স্বামী কিংবা সন্তানের ঘরে ফেরার অপেক্ষাতেই নিঃশেষ হতো নারীজীবন। সৈন্যশিবিরে নারীদের উপস্থিতি ছিল, তবে স্ত্রী কিংবা মাতারূপে নয়, যৌনদাসী হয়ে।
আপাতদৃষ্টিতে নারীরা কর্মহীন বসে আছে বলে মনে হলেও আসলে তাদের জীবন সুখকর ছিল না। সংসার চালানোটাও তো একটা যুদ্ধ, সেই অর্থে তারাও যোদ্ধা ছিল। কিন্তু এর জন্য তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কোনো অর্জন ছিল না। যেমন—আজো আমরা নারীর গৃহকর্মকে শ্রমের মর্যাদায় ফেলতে পারিনি। তবে সে আন্দোলন ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বিষয়টি অনুধাবন করল লিসিসট্রাটা নামক এক অতিসাধারণ নারী। লিসিসট্রাটাই প্রথম ঘোষণা করে—war is concerned with women। কারণ, যুদ্ধ বলতে পুরুষ যেটা বোঝে—বিবাদ-হানাহানি, জবরদখলের লড়াই; কিন্তু নারীর চোখে আসল যুদ্ধটা হলো সংসার টিকিয়ে রাখা, আমৃত্যু সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। এবং এটাই মানবজন্মে প্রকৃত যুদ্ধ।
লিসিসট্রাটা গ্রিসের নারীদের জড়ো করে জানাল, তাদের যুদ্ধবাজ স্বামীদের যুদ্ধ থেকে ফেরানোর মন্ত্র তার জানা। এ জন্য নারীদেরও কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। যেহেতু তারা ইতোমধ্যে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করে চলেছে, কাজেই এটুকু বাড়তি কিছু বলে মনে হবে না। এরপর লিসিসট্রাটা জানায়, যতদিন না স্বামীরা যুদ্ধ-ময়দান ত্যাগ করছে, ততদিন তারা স্বামীর শয্যাসঙ্গী হবে না। অর্থাৎ যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন হিসেবে সেক্স স্ট্রাইক ডাকে লিসিসট্রাটা। সেই এই আন্দোলনের প্রবক্তা। শান্তিচুক্তিতে নিজেদের দেহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ফন্দি আটল এই নারী। সে তার এই মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য গ্রিসের সমস্ত রাষ্ট্রের নারীদের প্রতি আহ্বান জানাল।
লিসিসট্রাটার পরিকল্পনা কতটা যৌক্তিক, কতটা সফল হলো সে—সেটি আমার আলোচনার মূল বিষয় নয়। আমার আলোচনার বিষয় হলো দুটি। এক. সাহিত্যে পৃথিবীর প্রথম দিককার নারীবাদী চরিত্র হিসেবে লিসিসট্রাটাকে স্মরণ করা। দুই. একবিংশ শতকে এসে নারীর প্রেক্ষাপট থেকে সে সময়ের পৃথিবী আর এ সময়ের পৃথিবী মিলিয়ে দেখা।
এই নাটকে আমরা যেমন লিসিসট্রাটার মতো লক্ষ্যে অবিচল দৃঢ়চেতার নারীর সাক্ষাৎ পাই, তেমনি ঠিক তার বিপরীত চরিত্রের নারীদের উপস্থিতিও আমাদের চোখে পড়ে। অনেক নারীই স্বামীর সঙ্গে বিছানায় যেতে পারবে না শুনে বেঁকে বসে। অনেকে পতিভক্তির প্রসঙ্গ তুলে লিসিসট্রাটার প্রস্তাবনার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পাশাপাশি এ দুই প্রকৃতির নারীচরিত্র নির্মাণ করে অ্যারিস্টোফেনিস দেখিয়ে দিয়েছেন, নারীর ভেতর যেমন লিসিসট্রাটার মতো যোগ্য রাজনৈতিক নেত্রীসত্তা আছে, তেমনি স্বেচ্ছায় অধীনস্থ জীবন বরণ করে নেয় এমন নারীসত্তাও আছে।
যিশুখ্রিস্টের জন্মের কয়েকশ বছর আগের সেই প্রেক্ষাপট এখনো সমানভাবে বাস্তব। এখনো আমরা দেখি নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে নারীকে অবস্থান নিতে।
লিসিসট্রাটা নারী সম্পর্কে প্রথাগত যে ধারণা, তার ভেতর থেকে বের হয়ে নারীর ক্ষমতায়নের একটা ঐতিহাসিক আদর্শ হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। তার নেতৃত্বগুণ, মুক্তচিন্তা করার ক্ষমতা, কর্তৃত্ববাদী সমাজব্যবস্থার বিপক্ষে যাওয়ার সৎসাহস রাখা—সব দিক থেকেই সে অনন্য।
নাটকটিতে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে যৌনতার যে প্রকৃতি আমরা পাই, আজো তার তেমন বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। যৌনতার প্রশ্নে নারীরা এখনো তেমনভাবে অবদমিত। লিসিসট্রাটার প্রস্তাবনা থেকে বোঝা যায়, পুরুষের কাছে নারীর উপস্থিতি কেবল যৌনতা দিয়েই। অর্থাৎ নারীর বিকল্প কণ্ঠস্বর তখনো তৈরি হয়নি।
একবিংশ শতকে এসে নারী আপন শক্তি দিয়ে পৃথিবীকে চেনাতে সক্ষম হয়েছে, তাদের পরিচয় আর যৌনতা দিয়ে নয়। পুরোপুরি সম্ভব না হলেও, অন্তত সেই পথে এগোচ্ছে। সংসারে ও সমাজে পুরুষ যা পারে, নারীও তাই পারে। দরকার কেবল সমান মূল্যায়ন, সমান সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর ঐতিহাসিক ডিসকোর্স বিষয়ে জানতে ক্ল্যাসিক এই নাটকটি পাঠ অনস্বীকার্য বলে আমি মনে করি।
খানিকটা প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় টিকা হিসেবে নারী আন্দোলনে লিসিসট্রাটা প্রবর্তিত সেক্স স্ট্রাইকের কিছু উদাহরণ তুলে দিচ্ছি।
প্রাচীন আফ্রিকা : আফ্রিকার উপনিবেশ-পূর্বকালে ইগবু জনগোষ্ঠীর ভেতর নারীরা একত্র হয়ে একটি সভাকক্ষ গড়ে তোলে। অনেকটা উইমেন ট্রেড ইউনিয়নের মতো। এই নারী সমিতির উদ্দেশ্য ছিল, নারীর প্রতি পুরুষের ব্যবহার ঠিক করা, নারীকে যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত পুরুষের বিচার করা। পুরুষরা সবচেয়ে যে শাস্তিকে ভয় পেত তা হলো সেক্স স্ট্রাইক। নারীরা যখন গণ-আন্দোলনে যেত, তখন তারা পরিবারের সব দায়িত্ব ছেড়ে একটি পাহাড়ে আশ্রয় নিত। কেবল দুধশিশুদের সঙ্গে নিত। এই অভিনব আন্দোলনে কাজও হতো।
কলম্বিয়া : ২০১৩ সালে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অনুরূপ এক আন্দোলনে নামে কলম্বিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের নারীরা। গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার একমাত্র সড়কটির অবস্থা বেহাল হলে পুরুষের কোনো ভ্রূক্ষেপ হচ্ছে না দেখে নারীরা ডেকে বসে সেক্স স্ট্রাইক, যেটি পরিচিতি পায় ‘ক্রসড লেগস মুভমেন্ট’ হিসেবে।
কেনিয়া : ২০০৯ সালে কেনিয়ার দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশটির একদল নারী দেশব্যাপী সেক্স স্ট্রাইক ডাকে।
লাইবেরিয়া : লিসিসট্রাটার মতো লাইবেরিয়ায় ১৪ বছর ধরে চলা সিভিল ওয়ারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশটির নারীরা অহিংস আন্দোলনে অংশ নেয়, যার অংশ ছিল সেক্স স্ট্রাইক।
ফিলিপাইন : ফিলিপাইনে দুই গ্রামের ভেতর বহুদিন ধরে চলা কাইজা বা বিবাদ থামাতে ২০১১ সালে কয়েক সপ্তাহব্যাপী সেক্স স্ট্রাইক ডাকে নারীরা। দক্ষিণ সুদান ও টোগোতেও শান্তির জন্য সেক্স স্ট্রাইক করে নারীরা।
জাপান : গত বছর জাপানের রাজধানী টোকিওর গভর্নর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ইয়োচি মাসুজোকে বর্জনের ডাক দিয়ে নারীদের একটি গ্রুপ জানায়, যে পুরুষরা ভোট দেবে তাদের সঙ্গে নারীরা শারীরিক সম্পর্কে জড়াবে না। জাপানি নারীদের মাসুজোবিদ্বেষী হওয়ার কারণ হলো, তিনি পুরুষতান্ত্রিক মানুষ।