সাক্ষাৎকার
‘সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা না থাকলে প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায় না’
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/05/22/photo-1432270844.jpg)
এই ঐক্যবদ্ধতার পেছনের কারণটা যদি বিশ্লেষণ করেন...।
শামসুজ্জামান খান : কারণ, তেইশ বছর ধরে পাকিস্তানের দুঃশাসন। এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল। তারা বঞ্চিত, নির্যাতিত হচ্ছিল। তার পর শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা এবং তাঁর আপসহীন নেতৃত্ব মানুষের ভেতর এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু সর্বশেষ সময় পর্যন্ত আমাদের জন্য লড়ে যাবেন।
বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা ২৫ তারিখ রাতে ধরে নিয়ে গেল। তিনি মুক্তিযুদ্ধে থাকতে পারলেন না। কিন্তু তাঁর প্রতীকটা ছিল অনেক বড়। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি যদি ওই সময় তাদের হাতে মারা যেতাম, তাহলে আমি আরো বড় প্রতীকে পরিণত হতাম। আসলেই তিনি ছিলেন বিশাল এক প্রতীক। সুতরাং তাঁর কথা মনে রেখেই মানুষ লড়াকু হয়ে যুদ্ধ করেছিল।
আমরা তো প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম। যুদ্ধ যখন তীব্রভাবে শুরু হলো, তখন কিন্তু মধ্যবিত্ত অতটা সক্রিয় থাকেনি যুদ্ধে। যুদ্ধ থেকে নিজেদের কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছিল। তরুণ ছাত্ররা যুদ্ধে সক্রিয় ছিল তাদের তারুণ্যের কারণে। সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল কৃষকদের। কৃষক সন্তানরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছিল সে সময়। মুক্তিযুদ্ধ তথা জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে কৃষকের ভূমিকাই ছিল প্রধান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের অবদান কত বড় ছিল, তা বলে শেষ করা যাবে না।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা কি আপনি ময়মনসিংহেই ছিলেন?
শামসুজ্জামান খান : না, পুরো সময় ছিলাম না। আমরা ওখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত আসতে দিইনি। আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়েছিল ততদিনে। আমরা ট্রেনিং নিচ্ছি, দিচ্ছি। আর্মি, পুলিশ, বিডিআর এরা মূল ট্রেনিংটা দিচ্ছে। সফিউল্লাহ সাহেব তো ওখানে আছেনই। অতএব, প্রতিরোধের একটা ক্ষমতা মোটামুটি আছে আমাদের। একদিন একটা হলুদ বিমান পর্যবেক্ষণ করে গেল। সবাই বলল, ওটা পর্যবেক্ষণ বিমান। তার তিনদিন পর একদিকে আকাশে বিমানের বোমাবর্ষণ, অন্যদিকে ট্রেনে করে পাকিস্তানি আর্মি হানা দিল। ওরা ট্রেনটাকে সাজিয়েছিল হেভি মেশিনগান দিয়ে। আগে-পিছে সব দিকে মেশিনগান ফিট করা। ট্রেনে করে তারা এলো। ১৭ তারিখে গোলাগুলি করতে করতে ময়মনসিংহ শহর দখল করে নিল।
আপনি তখনো ময়মনসিংহ শহরে?
শামসুজ্জামান খান : আমরা তখন পালিয়ে যাই ভাগনাবাড়ি নামে একটা গ্রামে, ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে পুব দিকে। তখন আমার খুব সমস্যা ছিল মা ও নানিকে নিয়ে। আমার নানিকে কোলে করে নদী পার করলাম। তখন তিনি বলছিলেন, ‘ভাই রে, আমার তো আর ভালো লাগে না। আমাকে এখানে মেরে কবর দিয়ে রেখে যা!’ এ রকম একটা দুঃসহ অবস্থা।
তার পর আমরা সাড়ে তিন-চার মাইল দূরে ওই গ্রামে উঠলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই ওখানে পালিয়ে এসেছেন। ওখানকার চেয়ারম্যান ছিলেন ফজলু মিয়া। এখনো তিনি বেঁচে আছেন। তাঁর বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিলাম। আমার দুটি মেয়ে, আমার মা-নানি, আমি ও আমার স্ত্রী সবাই। সেই দুঃসময়ে ফজলু মিয়ার অবদানের কথা ভুলতে পারি না। অথচ তাঁর জন্য কিছুই করতে পারলাম না।
কিছুদিন আমরা ফজলু মিয়ার বাড়িতে ছিলাম। কিন্তু ওখানে থাকাটা রিস্কি হয়ে পড়ল বলে আমরা নান্দাইলে চলে গেলাম। নান্দাইলে মাত্র একদিন ছিলাম। দ্বিতীয় দিন রাতে হৈচৈ-চিৎকার শোনা গেল। কী হলো? দেখলাম, মসজিদের ইমাম মালকোচা মেরে লোকজন নিয়ে হিন্দুদের বাড়িতে হামলা করে ডাকাতি করে মালসামান নিয়ে আসছে। পরের দিনই আমরা ফজলু মিয়াকে খবর পাঠালাম যে, আমরা বিপদগ্রস্ত। খবর পেয়ে তিনি এলেন নান্দাইলে। আবার তাঁর বাড়িতে আমাদের নিয়ে গেলেন। মাসখানেক থাকার পরে ইউনিভার্সিটি থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যারা, তারা বলল যে আপনারা ক্যাম্পাসে চলে আসেন। তাই আমি সপরিবারে ক্যাম্পাসে চলে এলাম।
এসে প্রথম দিনই বিপদে পড়ে গেলাম। আমি বাসার নিচে গিয়েছিলাম। নিচ থেকে উপরে উঠব এমন সময় দুজন আর্মি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। একজন বলল, ‘শালাকো গুলি মার দো।’ আরেকজন বলল, ‘রাখো ইয়ার, বাতচিত করনে হোগা।’
এরা আমাকে অনেক কথাবার্তা জিজ্ঞেস করতে লাগল। আমার মা-নানি-স্ত্রী সবাই উপর থেকে দেখছেন আর বারবার সেজদা দিচ্ছেন। আমাকে যাতে গুলিটা না করে দেয়!
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ‘মুজিব কা বাচ্চা’, ‘শুয়রকা বাচ্চা’ ইত্যাদি বলে গালাগালি করতে করতে ওরা চলে গেল। আসলে ওরাও চাইছিল ইউনিভার্সিটি স্বাভাবিক থাকুক। কাউকে মেরে ফেললে ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে যাবে।
পুরোদমে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। একদিন ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর একজন সংবাদদাতা পালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন। অর্থনীতির অধ্যাপক শামসুল ইসলাম সাহেব তাঁকে ড. মোস্তাফা আহমেদ হোসেন ও আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি মোস্তাফা আহমেদের বাসায় গেলেন। আমিও গেলাম সেখানে। তিনি এক ঘণ্টা ধরে আমাদের সাক্ষাৎকার নিলেন। আমরা যা যা জানি সব বললাম।
সাংবাদিক চলে গেলেন, আমি বাড়িতে ফিরলাম। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি ঠিকই খবর পেয়ে গেছে যে, আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। পরদিন ভাইস চ্যান্সেলর আমাদেরকে ডেকে বললেন যে, আপনাদের চৌত্রিশজনের নামে একটা তালিকা তৈরি হয়েছে। আমি কিন্তু আপনাদের রক্ষা করতে পারব না। আপনারা পালিয়ে যান।
আমি ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরিবার-পরিজনকে ময়মনসিংহে এক আত্মীয়ের বাসায় রাখলাম। তিনদিন পর খবর পেলাম, ইংরেজির অধ্যাপক সফি আহমেদকে ধরে নিয়ে গেছে আর্মিরা। রাতের বেলায় ধরে নিয়ে ট্রাকের সঙ্গে বেঁধে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে নিয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে মেরে ফেলবে অবস্থা, শেষ পর্যন্ত মারল না। এর পর আর ময়মনসিংহে থাকাটা নিরাপদ মনে করলাম না আমি। ঢাকায় চলে এলাম। ধানমণ্ডিতে আমাদের এক আত্মীয় ছিল, তাঁর বাড়িতে উঠলাম। এরপর কিছুদিন মানিকগঞ্জের গ্রামেও থাকলাম। ডিসেম্বরে মানিকগঞ্জ অঞ্চল মুক্ত হয়ে গেল। আমি ঢাকায় চলে এলাম। ৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ চলে গেলাম। ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শত্রুমুক্ত হলো।
একজন ফোকলোরবিদ হিসেবে দেশে এবং দেশের বাইরে আপনার সুখ্যাতি। ফোকলোরের প্রতি আপনার আকৃষ্ট হওয়ার পেছনের গল্পটা শুনতে চাই।
শামসুজ্জামান খান : এটা আসলে খুবই আকস্মিক ব্যাপার। বিষয়টা সম্পর্কে যে আমার আগ্রহ ছিল না, তা নয়। এ বিষয়ে সব সময়ই জানার চেষ্টা করতাম। ’৭৩ সালে আমি বাংলা একাডেমিতে সংস্কৃতি বিভাগে উপপরিচালক হিসেবে যোগ দিই। অর্থাৎ একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান আমি। এই বিভাগের যেসব কর্মসূচি নির্ধারণ করা হতো, তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব সব আমার ওপর। আমি যখন এ কাজগুলো করছিলাম, তখন বঙ্গবন্ধুর শাসনামল। ফলে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। আমি চেষ্টা করেছিলাম, বাঙালি সংস্কৃতির আধুনিক প্রগতিশীল ধারা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ধারা, আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং যেভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে, তার রাষ্ট্রীয় নীতিগুলোকে বাংলা একাডেমির কাজের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত করতে। এসব চেষ্টা ছিল আমার। আমি সেভাবেই কাজ করছিলাম, এগোচ্ছিলাম। কিন্তু ’৭৫ সালে দেশীয় কিছু কুলাঙ্গার এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সহায়তায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। তার পর যে সরকার এলো তারা ভাবল যে, আমি তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। আমি বাঙলা, বাঙালিত্ব এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে কর্মপ্রয়াস চালাচ্ছি। তারা ভাবল যে, আমার সঙ্গে রাষ্ট্রের তৎকালীন যে নীতি তার কোনো মিল নেই, সম্পর্ক নেই।
তখন জিয়াউর রহমান সরকার এসে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’র জায়গায় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ করেছেন। তখন অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। তাঁকে সরকার কী বলেছিল জানি না, তিনি আমার ব্যক্তিগত ফাইলে লিখলেন, ‘ইনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষের লোক। বিগত সরকারের আমলে তাদের নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নে খুব সোচ্চার ছিলেন। এখন তাঁকে এখানে রাখলে বর্তমান সরকারের জন্য কল্যাণকর হবে না।’
’৭৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাবেশ অনুষ্ঠান হলো বাংলা একাডেমিতে। সেখানে কবি সুকান্তসহ অনেকে ছিল। সেদিন আমাকে হঠাৎ এনএসআইর দপ্তর থেকে ছয়জন লোক এসে বলল, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে আমাদের হেডকোয়ার্টারে।’ আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। ১৯৭৭-৭৮ সালে কাউকে নিয়ে যাওয়া হলে গুম করা হতো। তো, আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। সঙ্গে আমার কলিগ মুজাদ্দেদ সাহেবও গেলেন। আমরা তাঁকে দাদু বলতাম। তাঁকে বাইরে বসিয়ে রাখা হলো। সারা দিন ধরে আমাকে একটি ঘরে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। ওখানকার একজন উপপরিচালক ছিলেন, তিনি আমাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী, মুক্তিবুদ্ধির সমর্থক এসব বিষয়ে নানা প্রশ্ন করলেন। শেষে বললেন, ‘আমরা আপনার ওপর নজর রাখব সব সময়। আপনি ঢাকা থেকে বাইরে গেলে আমাদের জানিয়ে যাবেন।’
তখন ভিতরে ভিতরে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল আমাকে গ্রেপ্তার করা হবে কি হবে না, এসব বিষয়ে। পরে আমাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ হয়েছিল। এনএসআইয়ের ডিজি ছিলেন হাকিম সাহেব। পরে আমি শুনেছি যে, তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নাকি আমার ব্যাপারে বললেন, ‘তার বেশি বয়স নয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ করে, এ জন্য আপনি তাকে অ্যারেস্ট করবেন। করলে বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করবে, তাতে সে হিরো হয়ে যাবে। কী দরকার অ্যারেস্ট করার?’
শেষ পর্যন্ত আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো না। তাই বলে আবার আমাকে তো একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগেও রাখা যায় না! কোথায় দেওয়া যায় তবে? সিদ্ধান্ত হলো ফোকলোর বিভাগে দেওয়ার। কিন্তু ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও তো ধান ভানে। ফোকলোর বিভাগে আমাকে দেওয়ায় আমার জন্য শাপেবর হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এ ক্ষেত্রেই কাজ করব। তখন পড়াশোনা শুরু করলাম। আমি যেহেতু গ্রামে এসব লোকসংস্কৃতির সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত, সুতরাং আমার কোনো অসুবিধা হলো না। আমাকে তখন ড. এনামুল হক বললেন, ‘একটা কাজ করো, তোমাকে ফোর্ড ফাউন্ডেশন থেকে একটা বৃত্তি নিয়ে দিই। তুমি বিদেশে চলে যাও। আমেরিকা বা ইন্ডিয়ায় যেতে পারো। একটা পিএইচডি করে আসো।’ আমি ভাবলাম, আমার পিএইচডি করা জরুরি, নাকি আমাকে যে কাজে দেওয়া হয়েছে সে কাজ করা জরুরি? আমি বিস্তর পড়াশোনা করে প্রস্তুত হওয়ার পর ঠিক করলাম, ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ফোকলোরের বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিতদের নিয়ে এখানে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করব। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোরের বড় পণ্ডিত প্রফেসর অ্যালান ডান্ডেসকে আমন্ত্রণ করে আনলাম। পরে ভাবলাম, শুধু আমেরিকা থেকে পণ্ডিত আনলে তো হবে না, ফোকলোর চর্চার সবচেয়ে উন্নত দেশ নর্থের দেশগুলো। জার্মানি, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক এসব অঞ্চল। এসব অঞ্চলের ফোকলোরের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত লাউরি হঙ্কো। তিনি নরডিক ইনস্টিটিউট অব ফোকলোরের ডাইরেক্টর। আমার সৌভাগ্য যে, আমি তাঁদের পত্র লিখে এখানে আসার ব্যাপারে রাজি করাতে পারলাম। ওনাদের দিয়ে আমি এখানে একটা ওয়ার্কশপ করলাম। আরেকটা ওয়ার্কশপ করলাম হ্যানরি গ্লাসির। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোকশিল্পকলার প্রফেসর। ভারত থেকে আনলাম জওহরলাল হাণ্ডু, টুম্বা সিং ও পাকিস্তান থেকে আকাসি মুক্তিকে। তাঁদেরকে এখানে এনে ওয়ার্কশপ করালাম। আমি নিজেও লেখালেখি করলাম, পড়াশোনা করলাম। এখন আমি মনে করি, ফোকলোর চর্চার একটা ক্লাস দাঁড়িয়েছে। আমিও আমার পড়াশোনা থেকে লেখালেখি করেছি অনেক। তাতে দেশে এবং বিদেশে আমার মোটামুটি একটা জায়গা হয়েছে।
আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, সেগুলোর কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন? বাংলাদেশ কি আদৌ সেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিকে গেছে?
শামসুজ্জামান খান : যায়নি। বিষয়টা আসলে খুব কঠিন। কাউকে দোষ দিয়ে লাভও নেই। বাঙালি আসলে খুব বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি। এত কষ্ট, এত মানুষের জীবন দান, এতদিনের সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর আত্মবলিদান এত কিছু সত্ত্বেও আমরা যা কিছু করতে চেয়েছিলাম, করতে পারলাম না। যা অর্জন করেছিলাম, তার অনেকটাই আবার হারিয়ে ফেলেছি। সেই জায়গাটা পুনরুদ্ধার করা খুব কঠিন। কালচারাল সংগ্রাম চলছে। কিন্তু সেই সংগ্রামের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো সক্রিয়, স্বচ্ছ, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ধারা প্রতিষ্ঠা করে এগিয়ে যাবে, সে রকম উদ্যোগের অভাব আছে। আমাদের এখন একটা ভরসা, মানুষ এখন অনেক সচেতন। মানুষের রাজনৈতিক ও চিন্তাচেতনার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মূলধারায় এখনো আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সেটা একটা উজ্জ্বল অর্জন। সেটাকে মানুষ এখনো শ্রদ্ধা করে। এখনো যদি আমরা আরেকটু সম্মিলিতভাবে কাজটা করতে পারি তাহলে আমরা সফল হবোই।
সফল না হওয়ার পেছনে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে বা সমাজের অগ্রসর মানুষ হিসেবে আপনার বা আপনার শ্রেণির কোনো ব্যর্থতা আছে কি না?
শামসুজ্জামান খান : অবশ্যই ব্যর্থতা আছে। আমি আমার শ্রেণির কথা বলব না। কারণ, মধ্যবিত্ত কোনো মৌলিক শ্রেণি নয়। মধ্যবিত্তে অনেক সুবিধাবাদ আছে। আমরা মধ্যবিত্তরা অনেক আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে যাই, একটা নীতি-শৃঙ্খলার মধ্যে থাকি না। আমি কিছুদিন আগে ভিয়েতনামে গিয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তারা দেশটাকে কত উচ্চতায় নিয়ে গেছে, তা দেখে এলাম। তাদের গ্রোথ এইট পারসেন্ট। সুশৃঙ্খল একটা জাতি। আমাদের বহর যখন যাচ্ছে, তখন প্রতিটি লোক দাঁড়িয়ে থেকেছে। বাংলাদেশ হলে মানুষ অস্থির হয়ে যেত। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কোনো উত্তেজনা নেই। আমাদের রাজনীতিটা আরো পরিষ্কার, সুন্দর, স্বচ্ছ না হলে এবং রাজনীতি যতদিন রাজনীতিকদের হাতে না যাবে, ততদিন এটা কঠিন। এখন তো রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে।
একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য বাঙালি লড়াই করল, প্রাণ দিল। সেই রাষ্ট্রে পরবর্তীকালে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটল। এর নেপথ্যে আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করেছে কি না? নাকি এই ধারাটা বাঙালির ভেতরে আগে থেকেই ছিল? আপনার কী মনে হয়?
শামসুজ্জামান খান : বাঙালির ভেতরে এটা মোটেই ছিল না। জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে কিছুটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে। জঙ্গিরা পশ্চিমের এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে বিপুল অর্থ সাহায্য পাচ্ছে। লন্ডনে তারা ‘চ্যারিটি’ নাম দিয়ে টিভি চ্যানেল করেছে। চ্যারিটির নামে বাংলাদেশের দুস্থ মানুষের জন্য, বাংলাদেশের মসজিদ, মুসলমানদের দুর্দশা দূর করার নামে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে। সেই টাকাটা চলে যায় জঙ্গিবাদীদের হাতে। দুঃখের ব্যাপার হলো, বিদেশে গেলে মানুষ চিন্তা-চেতনায় পরিচ্ছন্ন হয়ে আসে। এখন আমরা দেখছি, অনেক পরিচ্ছন্ন চিন্তার লোকও ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে মৌলবাদী হয়ে ফিরছে। এটা কেন হচ্ছে, আমার ঠিক বুঝে আসে না। কি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে, কি মানসিক চাপে তারা ওখানে গিয়ে একেবারে উল্টে যায়, সেটা একটা বিস্ময়। আগে কিন্তু উল্টোটা হতো। এখান থেকে একটা ছেলে গিয়ে কমিউনিস্ট হয়ে, পরিচ্ছন্ন চিন্তার মানুষ, যুক্তিবাদী হয়ে ফিরত। এখন যুক্তিবাদের জায়গাটা, বিজ্ঞান চিন্তার ব্যাপারটা, সবকিছুকে খুঁটিয়ে দেখার চিন্তাটা চলে গেছে। এটা আমাদের জন্য বিরাট সমস্যা। তবে এতেও আমি হতাশ হই না। কারণ, তরুণ প্রজন্ম ঠিক জায়গাতে আছে বলে আমার ধারণা। গত নির্বাচনে তারা কী চায়, তা দেখিয়েছে। সরকারের বহু কাজে তারা অসন্তুষ্ট। তারা চায়, সরকার আরো ভালো কাজ করুক। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক এবং সুশাসনের পক্ষের লোকদের ঐক্য চায় তরুণরা।
আপনি লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন, করছেন। বাউল সম্প্রদায়ের সুফিবাদী যে ধারাটা এ দেশে রয়েছে, সেটাকে প্রতিহত করতে চায় কট্টর মৌলবাদীরা। এর কারণ আসলে কী? সুফিবাদী ধারা সম্পর্কে আপনার অভিমত?
শামসুজ্জামান খান : বাউল সম্প্রদায়ের যে ইতিহাস বা সাধনার যে ধারা, সেটা তো আর একদিনে তৈরি হয়নি। আমাদের ইতিহাসের ধারাতেই এর উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে। তুরস্কের আনাতোলিয়া থেকে শুরু করে বা তাঁরও কাছাকাছি ইরানে হাফিজ-ফেরদৌসী-মনসুর হাল্লাজরা যে সাধনা করেছেন, তার সঙ্গে বাউল সাধনার একেবারে মিল নেই এটা বলা যাবে না। সেখানকার ঐতিহ্যও কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ইরান-তুরান-পাকিস্তান-আফগানিস্তান ও ভারতের একটি অংশ হয়ে বাংলাদেশের দিকে একটি ধারা চলে এসেছে। সেই জায়গা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সুফিবাদ, তার পর এখানে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্মের উপাদান, তার পর বৌদ্ধদের তান্ত্রিকতা এসব মিলেমিশে বাউল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। এটা একেবারেই এখানকার লোকায়ত সাধনা। নানা প্রভাবে এটা তৈরি হয়েছে। বাইরের প্রভাবও আছে। বাঙালির যে বৈশিষ্ট্য, সেটি হলো বাইরের প্রভাবকে আত্মস্থ করে নিজেই একটা কিছু সৃষ্টি করে ফেলে। বাউল সাধনা সে রকমই। বৌদ্ধ তান্ত্রিকতা, বৈষ্ণববাদ, আমাদের এখানকার আদি মানুষের সর্বপ্রাণবাদ, হিন্দুদর্শন এবং মুসলিম সুফিবাদ—এসব মিলে বাউল সাধনা তৈরি হয়েছি। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, এ ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা লালন ফকির। তিনি ধারাটাকে নিজের মতো করে আরো উন্নত করার চেষ্টা করেছেন। আমরা দেখতে পাই, লালন ফকিরের রচিত গানে যে-সমস্ত চমৎকার পঙক্তি আছে, তাতে যে কথাগুলো আছে, তার চাইতে আধুনিক, প্রগতিশীল, বিপ্লবী কথা আমাদের অন্য শাখার, অনেক আধুনিক শাখার জ্ঞানী ও বিদ্বানরাও বলতে পারেননি। আমরা মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের কথা বলি। তাঁদের কথারই পুনরাবৃত্তি আমি লালন ফকিরের বাণীতে পাই। এটি একটি চরম আশ্চর্যকর ব্যাপার! লালন বলছেন, সেদিনই শান্তি আসবে যেদিন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নাহি রবে, সবাই মানব জাতি হবে। তিনি বিশাল মাপের একজন দার্শনিক ছিলেন, তাত্ত্বিক ছিলেন। মানুষকে কত বড় মর্যাদা দিয়ে গেছেন তিনি, যে মর্যাদা মার্কস-অ্যাঙ্গেলসরাও হয়তো দিতে পারেননি। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে তত্ত্বগুলো পৃথিবীতে এসেছে, তার সর্বাধিক তত্ত্ব কিন্তু আমরা লালন ফকিরের কাছ থেকে পাই।
বাঙালি সংস্কৃতি তো প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে। অনেকে বলছেন, ভিনদেশি সংস্কৃতির কারণে আমাদের সংস্কৃতি বিকৃত হচ্ছে, আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। আপনার কী মনে হয়? পশ্চিমা আগ্রাসনের কারণে আমাদের সংস্কৃতি কি আসলেই বিকৃত হচ্ছে? তাতে কি আমাদের জাতিসত্তার কোনো সাংস্কৃতিক সংকট তৈরি হবে কি না?
শামসুজ্জামান খান : মনে হয় না জাতিসত্তার সংকট সৃষ্টি হবে। কারণ, বাঙালির ইতিহাস আমরা যতটা জানি, বাইরের প্রভাব কিন্তু প্রচুর এসেছে এ দেশে। খুব আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি এখানে এসেছে। ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, ফরাসিরা এখানে এসে তাদের সংস্কৃতি বিস্তারের চেষ্টা করেছে। উত্তর ভারতের নানা রাজবংশ চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাঙালিকে তার সংস্কৃতি থেকে খুব বেশি বিচ্যুত করতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। উল্টো তাদের প্রভাবে বাঙালির ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। মধ্যযুগে মুসলিম শাসকরা অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তারাই কিন্তু বাঙালিত্বের সৃষ্টি করেছেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নিজেকে ‘শাহে বাঙালিয়ান’ বা বাঙালিদের বাদশা বলতে গৌরব বোধ করতেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ মহাভারত, রামায়ণের বাংলা অনুবাদ করিয়েছেন। তাতে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতি সমন্বিত সংস্কৃতি। জাতি হিসেবে আমরা শংকর, সমন্বিত জাতি। আমরা মানুষকেই বড় করে দেখি। এসব কিন্তু সুলতানি আমলে এসেছে। এসব অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে, বিশেষ করে ইরান থেকে। সুফিবাদের ধারাটা ওখান থেকে এসেছে। এগুলো মুসলিম আমলের অবদান। হিন্দুদের ধর্ম এবং সংস্কৃতি উত্তর ভারতের সঙ্গে একেবারে বাঁধা। সেটা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া তাদের পক্ষে মুশকিল। সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া তাদের জন্য কঠিন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের ব্যাপারটা উল্টো। বাঙালি হিন্দুদের সংস্কৃতি যেমন উত্তর ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত, বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ঠিক মক্কার সঙ্গে? না, কখনোই নয়। কারণ এখানকার ইসলাম হলো লোকাল ইসলাম। এখানকার ইসলামের মধ্যে লোকজ চাপ পড়ে গেছে। যেমন নজরুল লিখেছেন, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।’ এটা কি এখানে ছিল না? অবশ্যই ছিল। ‘তোরা দেখে যা যশোদা মায়ের কোলে’ কি এর আগে ছিল না। বাঙালি মুসলমানরা মিলাদ পাঠ করে। মিলাদের ব্যাপারটা ধরুন। ১৮৬৩ সালে এ মিলাদ সম্পৃক্ত হয়েছে। এর আগে মিলাদ বলে কিছু ছিল না। মিলাদটা কী, তা একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখুন। তার মানে আরবের মুসলিম সংস্কৃতিটা এখানে এসে শংকর হয়ে গেছে, এখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে। আরবে তো মিলাদ নাই, শবে বরাত নাই। এখানে এলো কোত্থেকে? সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, এ দেশের ইসলাম লোকাল ইসলাম।
কিন্তু আরবীয় ইসলামী সংস্কৃতি বাস্তবায়নের জন্য একটা গোষ্ঠী তো সব সময় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে?
শামসুজ্জামান খান : হ্যাঁ, সেই চেষ্টা চলছে। এটা আমাদের ক্ষতির চেষ্টা করছে। সরকারের উচিত হবে, এটার ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া। তারা যেন জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে, সেটা তাদের ঠিক করে দিতে হবে সরকারকে। তা না করে যদি স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া হয়, তাহলে জাতির জন্য খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে আমার মনে হয় না, এরা খুব বেশি কিছু করতে পারবে। মাওলানা কেরামত আলী বা ওহাবিরা তো খুব চেষ্টা করেছে। কিছুই তো করতে পারেনি। তবে সরকারকে সচেতন হতে হবে। তাদের পাঠ্যসূচি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কোন মাদ্রাসায় কী পড়ানো হচ্ছে, তার খোঁজখবর মনিটর করতে হবে।
বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক চলছে। সেই বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ভাষাবিদরা ভাষার ব্যবহার নিয়ে নানা সময় নানা কথা বলেন। বাংলা ভাষার একজন গবেষক হিসেবে আপনার কাছে জানতে চাই, আমাদের ভাষার চেহারাটা আসলে কেমন হওয়া উচিত?
শামসুজ্জামান খান : দীর্ঘকাল ধরে আমাদের প্রমিত বাংলা ভাষার মাধ্যমে যে বিশাল সাহিত্য গড়ে উঠেছে, সেই জায়গাটা নষ্ট করে যদি আমরা পুরোটাই আঞ্চলিক ভাষাটা সাহিত্যে আনি, তাহলে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে কিংবা তাঁরও আগের গোটা বাংলা সাহিত্যটা আমাদের কাছে অচেনা হয়ে যাবে। তাতে তরুণ প্রজন্ম খুব একটা সমস্যায় পড়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো দেশ এটা করে না। তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা খুব শক্তিশালী। এ আঞ্চলিক ভাষার অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। সৃজনশীল লেখকরা এর যথাযথ ব্যবহার করবেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লা ‘লালসালু’তে এর যথাযথ ব্যবহার করেছেন। শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ এই ভাষাটা ব্যবহার করেছেন। এটা আসলে নির্ভর করে লেখক কতটা সৃজনশীল আর কতটা পরিশ্রমী, তার ওপর। ফাঁকি দিয়ে কেউ যদি একটা কিছু করতে চায়, সেটা অন্য কথা। সৃজনশীল লেখকরাই ভাষার গতি নির্ধারণ করবেন।
অন্যদিকে রেডিও-টেলিভিশনে ভাষার যে বিকৃতি চলছে, এটা হতে দেওয়া উচিত নয়। তবে একটা সমস্যা হলো, পৃথিবীতে একমাত্র ফ্রান্স একাডেমি ছাড়া আর কোনো একাডেমি বা কোনো প্রতিষ্ঠানই ভাষা নিয়ন্ত্রণের সর্বময় ক্ষমতা নেয় না। একমাত্র ফরাসি একাডেমি নিয়েছে। অন্যান্য ভাষায় কিন্তু সৃজনশীল লেখকদের ক্ষেত্রে কিছু কিছু অধিকার থাকে। তাঁরা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে সেটা যদি টিকে যায়, তাহলে তার চেষ্টাটা সার্থক। যেমন আমাদের এখানে আবদুল মান্নান সৈয়দ যে বানান ব্যবহার করতেন, তা থাকবে কি থাকবে না সেটা কালের পরীক্ষায় নির্ধারিত হবে।
বাংলাদেশে শিক্ষার বিভিন্ন ধারা। একদিকে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা, সরকারি মাদ্রাসা, সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—বহু ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা বিভক্ত। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণও চলছে। শিক্ষাব্যবস্থাটা কেমন হওয়া উচিত?
শামসুজ্জামান খান : বাংলাদেশে খুবই অনুন্নত এবং অনুপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। শিক্ষা হবে বিজ্ঞানভিত্তিক, গণতান্ত্রিক এবং মুক্তবুদ্ধির। সেই জায়গা থেকে আমরা সরে এসেছি। শিক্ষা খুব সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু কম্পিউটার সায়েন্স, কমার্স এসব চালু আছে। এটা বিশ্বের কোথাও হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় মানে কী? সেখানে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে বিভিন্ন বিদ্যার লোকেরা একই সঙ্গে থাকবেন, কাজ করবেন। তাঁদের চিন্তাচেতনা বিনিময় হবে। একজনের আলাপ-আলোচনা থেকে আরেকজন প্রভাবিত হবে। তার ফলে প্রত্যেকেই সকল বিষয়ে কিছু না কিছু জানবে। তাতে তাঁরা শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হবেন। আর শিক্ষার সঙ্গে এখন সংস্কৃতির কোনো যোগ নেই। এটা বড় ক্ষতিকর। শুধু বিদ্যা অর্জন করলে হবে না, সংস্কৃতির জ্ঞানও থাকতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা না থাকলে প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায় না।
সাম্প্রতিক বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে হে উৎসব হয়ে গেল। এই উৎসব সম্পর্কে অনেক বিতর্ক উঠেছে। এ ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে চাই?
শামসুজ্জামান খান : হে ফেস্টিভাল সম্পর্কে যাদের কোনো অভিজ্ঞতা নাই, তারা এর বিরোধিতা করছে। হে উৎসবের কোনো গুরুত্ব অসাধারণ। ওয়েলসের হে-ওয়ে অন নামের একটি ছোট্ট গ্রামে পনেরোশ লোক ছিল। পনেরোশ লোকের জন্য গ্রন্থাগার ছিল ত্রিশটি। অর্থাৎ বিদ্যাচর্চা, পাঠাভ্যাস, লাইব্রেরির বিকাশ, জ্ঞানচর্চার অসাধারণ একটি কেন্দ্র সেটি। তাকে যদি আমরা বলি সাম্রাজ্যবাদের প্রয়াস—এর মতো মূর্খতা আর কিছুই হতে পারে না। যদি সাম্রাজ্যবাদী প্রয়াসই হতো, তাহলে ভারতের কেরালা, যেখানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বামপন্থী ধারার বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে, সেখানকার লোকেরা হে উৎসব করত না। ঢাকায়ও এই উৎসব হয়েছে। যারা অশিক্ষিত, মূর্খ, যাদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কোনো ভূমিকা নেই, তারাই হে উৎসবের বিরোধিতা করেছে। কয়েকজনকে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি, যারা হে উৎসবের বিরোধিতা করেছে। তাদের ছয়জনই ছিল জামায়াতের। হে উৎসব সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট কেন্দ্র আছে, যেখানে বিদ্যাচর্চার অসাধারণ একটা বিকাশ ঘটেছে। অতএব, এটা নিতে তো আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।
তাদের অভিযোগ, এটা বাংলা একাডেমি বা ভাষা চেতনার সঙ্গে যায় না?
শামসুজ্জামান খান : কেন যাবে না? বাংলা ভাষার কেউ কি বলেছে অন্য কোনো ভাষার চর্চা করা যাবে না? এটা তো কেউ কোনোদিন বলেনি! এর ফলে তো আমরা সমৃদ্ধ হব। সাম্প্রতিককালে ইংরেজি ভাষায় যারা লেখালেখি করছে তারা কী বলতে চায়, কী বলেছে, তাদের বৈশিষ্ট্য কতটা, তাদের অর্জন কতটুকু—সেটা আমরা যদি জানতে পারি তাতে কি বাংলা ভাষার ক্ষতি হবে? কোনোদিন তা হয়নি। সেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা কী বলতে চাই, বাংলা ভাষার মূল লেখকরা কী বলতে চান, সেটা যদি তাদের জানাতে পারি, তাতে কি কোনো ক্ষতি আছে? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, নিবে নেবে মিলাবে মিলিবে...। আমরাও নিতে চাই, দিতে চাই; মিলতে চাই, মিলাতে চাই।
উৎসবটার অনেক ইতিবাচক দিক আছে। যারা ইংরেজিতে লিখছে বর্তমানে উৎসবটার মাধ্যমে আমরা হয়তো জানতে পারব যে, তাদের লেখার মধ্যে এমন কোনো বস্তুই নাই। এটা যখন আমরা গভীরভাবে বুঝতে পারব, তখন আমরা বলতে পারব, তুমি যা লিখেছ আমার বাংলা সাহিত্য এর চেয়ে অনেক শক্তিমান। আমাদের দেশে এখন একটা নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, যারা ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করছে। তাতে তো কোনো ক্ষতি নেই। আমরা কি ইংরেজি বাদ দিব? আমরা কি পার্সি বাদ দিব? আমরা তো উর্দুও বাদ দিব না? সংস্কৃতিও তো বাদ দিব না। সবগুলো দরকার আছে আমাদের।
তারা যে চর্চাটা করছে, আমার বাংলা একাডেমির কাজ হবে তাদের ট্রেইন করা বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে। অর্থাৎ তুমি বাবা ইংরেজি ভাষা চর্চা করো, নো প্রবলেম। কিন্তু তোমাকে যে কাজটা করতে হবে সেটা হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যের মূলধারার লেখকদের সম্পর্কে জানতে হবে। এই তরুণদের হালছাড়াভাবে ছেড়ে দিলে তো তারা বাংলা ভাষাবিদ্বেষী হয়ে যাবে। সেখানে যদি আমি তাদের বোঝাতে পারি বাবা, তোমরা চর্চা করছ ভালো কথা। একটা ভাষার চর্চা করা ভালো। তবে তোমাকে একই সঙ্গে বাংলার মূল সাহিত্যগুলোও অনুবাদ করতে হবে। আমার যে ক্ল্যাসিক লিটারেচার সৈয়দ ওয়ালীউল্লা, শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবুল ফজল—এঁদের সাহিত্যও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করো। ইংরেজি ভাষাভাষীদের তোমরা জানাও যে, আমাদের বাংলা ভাষা খুবই রিচ, শক্তিশালী।
হে উৎসবের মাধ্যমে আমরা একটা সংকটের জায়গা চিহ্নিত করতে চেয়েছি। যারা ইংরেজিতে লিখছে, একদিকে তারা গ্রো করছে, অন্যদিকে যারা বাংলায় সাহিত্য করছে তারা গ্রো করছে। এই দুই পক্ষকে তো মিলাতে হবে। দুই গ্রুপের মধ্যে আমি একটা সম্পর্ক তৈরি করতে চাই। ওরা বলবে যে, তোমরা যারা বাংলা সাহিত্য চর্চা করছ, তোমরা কতটা শেক্সপিয়র, টলস্টয়, বোদলেয়ার পড়েছ সেটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করো। আর এরা ওদের বলবে তোমরা কতটা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ওয়ালীউল্লা, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক পড়েছ সেটা বুঝে নাও। এর ফলে বাংলা সাহিত্যের একটা ব্যালান্স হবে। এটা বেসিক একটা জায়গা। আমি তো না বুঝে কোনো কাজ করি না।
হে উৎসব পাঁচটি মহাদেশের প্রায় উনিশ-বিশটি দেশে হয়। এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা অসাধারণ। এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া বাংলা একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে আমি মনে করি। আমরা যদি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের টাকায় এখানে আগে অনেকগুলো পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করতে পারি, তাহলে এটাতে অংশ নিতে অসুবিধা কোথায়? আজকে যারা হে উৎসবের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের দু-একজন তাতে অংশীদার ছিলেন। ফোর্ড ফাউন্ডেশনই তো ছিল সাম্রাজ্যবাদের একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তখন তো তাঁরা বিরোধিতা করেননি। ওয়েলসের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের কী সম্পর্ক? আমাদের দেশের সকল প্রখ্যাত লেখকই হে ফেস্টিভালে যোগ দিয়েছেন। কোনো মেজর লেখকই এর থেকে বাদ যায়নি। কারো কোনো আপত্তি ছিল না তখন। এই উৎসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আমরা দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত হচ্ছি। আমাদের কাছে নানা রকম চিঠিপত্র আসছে। বলা হচ্ছে, বাংলা একাডেমির এত একটা চমৎকার জায়গা, এত সুন্দর ম্যাজিকাল একটা গ্রাউন্ড আছে। এবং বাংলা একাডেমির থিয়েটারও (অডিটরিয়াম) চমৎকার। একশ সিটের যে নতুন হলটা হয়েছে, সেটাও অসাধারণ। এ রকম একটা প্রতিষ্ঠান খুব কম দেশেই আছে। বাংলা একাডেমি এ ক্ষেত্রে যে অর্জনটা করেছে তার গুরুত্ব এবং মর্যাদা বিশ্বব্যাপী অনুভূত হতে থাকবে, এ রকম কথা তারা চিঠিতে উল্লেখ করেছে।
বিরোধীরা যদি বলে, বাংলা একাডেমির চেতনার সঙ্গে হে উৎসব যায় না। আমি বলব, বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলনের ফল। সেখানে বলা হয়েছে আমরা সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই। সেখানে এ কথা বলা হয়নি, কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কোনো কাজ বাংলা একাডেমি করতে পারবে না। আর এটা কি নতুন? এর আগে এই বাংলা একাডেমিতে উর্দু-বাংলা সেমিনারও করা হয়েছে। বাংলা একাডেমিতে কনটেম্পরারি লিটারেচার ইন বাংলাদেশ, এটাও ব্যুরো অব রিকনস্ট্রাকশন যেটা নিন্দিত একটা সংস্থা ছিল, এ সংস্থার উদ্যোগে এ ধরনের সেমিনার করা হয়েছে। তখন তো কোনো প্রতিবাদ আসেনি! এ ছাড়া আরো বহু আন্তর্জাতিক বিখ্যাত পণ্ডিতরা এসেছেন। এবং এখানে প্যান-এর সভাও হয়েছে। তখন কেউ প্রতিবাদ করল না কেন?
অতএব, হে উৎসবের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের যদি কোনো সম্পৃক্ততা দেখাতে পারে কেউ, তাহলে আমরা তাদের কাছে দুর্বলতা এবং নতি স্বীকার করব। আসলে তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং সুযোগ-সুবিধার জন্য, যে বিশেষ মর্যাদা চেয়েছিল, তারা সেটা না পাওয়ার কারণেই তাদের এ দুঃখ-বেদনা। তাও মাত্র দু-একজনের। সেটা নিয়ে আমাদের খুব একটা ভাবার কারণ আছে বলে মনে করি না।
তারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কথা বলে। হে উৎসবের প্রতিবাদকারীদের একজন যখন বাংলা একাডেমিতে ছিলেন, তখন কী করে গ্রামীণফোনকে টাওয়ার করতে দিলেন এখানে? এয়ারটেলকে কী করে টাওয়ার করতে দিল তারা? কোন স্বার্থে, কেন দিয়েছিল এই করপোরেট পুঁজিকে? যার ফলে বাংলা একাডেমির গাছপালা মরে যাচ্ছে, পাখি আসছে না। এটা কত বড় একটা অন্যায় হয়েছে। তা ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপকে চিরস্থায়ীভাবে একটা গেট করতে কেন দেওয়া হলো বাংলা একাডেমির? বসুন্ধরার মতো একটি গ্রুপকে বাংলা একাডেমির গেট করতে দেওয়ায় অনেকে ছি ছি করেছে তখন। গেটটি এখনো আছে। আমরা তো এ ধরনের অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্ছিত কাজ করছি না। সে ক্ষেত্রে হে উৎসব তো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। উৎসবে বিক্রম শেঠ এসেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস নিয়ে যদি আমরা আলোচনা করতে পারি, যদি তাঁর দুর্বলতা ধরিয়ে দিতে পারি কিংবা তাঁর উপন্যাস থেকে যদি কিছু নিতে পারি, তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? তাঁরা এখানে এসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যেসব কথা বলে গেছেন, সেসব তো আমাদের অভিভূত করেছে। সুতরাং সামগ্রিকভাবে মনে করি, হে উৎসব আমাদের গৌরব বাড়িয়েছে, মর্যাদা বাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাংলা একাডেমিকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতির পথ করে দিয়েছে।
একজন কবি অভিযোগ করেছেন, আপনি স্বৈরাচারীভাবে একক সিদ্ধান্তে এই ফেস্টিভালের আয়োজন করেছেন। আপনার বক্তব্য যদি বলেন...।
শামসুজ্জামান খান : অভিযোগটি একেবারেই সত্য নয়। বাংলা একাডেমির কাউন্সিল এবং বাংলার একাডেমির সভাপতি বিচার-বিবেচনা করে এর অনুমোদন করেছেন।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে আপনি প্রায় তিন বছর কাজ করছেন। শুরুতে যে পরিকল্পনাগুলো হাতে নিয়েছিলেন, তার কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন? বাংলা একাডেমি সম্পর্কে আপনার পরিকল্পনা কী?
শামসুজ্জামান খান : ২০০৯ সালে আমি যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে আমন্ত্রণ পেলাম, তখন আমি চিন্তা করলাম কী কী কাজ করা যায়, সে ব্যাপারে। আমি একাডেমির ইতিহাসের দিকে লক্ষ রাখলাম। কোন ইতিহাসের পটভূমিকায় বাংলা একাডেমি গড়ে উঠেছিল, সেটা বোঝার চেষ্টা করলাম। দ্বিতীয়ত, বাংলা একাডেমিতে আমাদের অভিভাবকপ্রতিম বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত পণ্ডিতরা ছিলেন। যেমন—ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক বা সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ। এরা বাংলা একাডেমিতে কী করতে চেয়েছিলেন? আমি লক্ষ করে দেখলাম যে, শহীদুল্লাহ সাহেব এবং এনামুল হক সাহেব বাংলা একাডেমিকে একটা গবেষণাপ্রবণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা প্রথমেই আমাদের আঞ্চলিক ভাষার একটা অভিধান করেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেক পণ্ডিতকে নিয়ে যখন শহীদুল্লাহ সাহেব কাজটি সম্পন্ন করলেন, তখন গোটা বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে এটি একটি সুদূরপ্রতিম গ্রন্থ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেল। সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি পর্যন্ত বললেন যে, এটা শহীদুল্লাহ সাহেবের একটা ‘ম্যাগনাম ওপাস’। শহীদুল্লাহ সাহেব এ রকম কিছু কাজ করতে চেয়েছেন। এর পরবর্তীকালে তিনি ‘সাহিত্যকোষ’ করতে চেয়েছেন। এ কাজটা পুরোটা সম্পন্ন হয়নি। কাজটার ওপর আমরা নজর দিয়েছি। তাঁরা আর যেটা করতে চেয়েছেন সেটা হচ্ছে ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’। এ অভিধানও শেষ হয়নি। আমি যখন গবেষণা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগের পরিচালক, তখনই এ উদ্যোগ গ্রহণ করি। এর কৃতিত্ব পুরোটাই মনজুরে মাওলা সাহেবের। তিনি আমাকে এবং তৎকালীন প্রেসের ম্যানেজার ওবায়দুল ইসলামকে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টায় ডাকতেন এবং এর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতেন। আমরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সাত-আট মাসের মধ্যে এ কাজটা শেষ করে দিলাম। ওই বইটা বেরিয়ে গেছে।
তো, তাদের সেই জায়গাটা বুঝে আমি চেষ্টা করলাম এমন একটা অভিধান করা দরকার, যে ধরনের অভিধান বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে নেই। সেটা হলো বাংলা ভাষার রূপান্তরমূলক অভিধান। অভিধানটির কাজ চলছে এখন। তিন খণ্ডে এটি বেরোবে। ড. গোলাম মুরশিদ সম্পাদনা করছেন। তাঁর সঙ্গে ১২ জন গবেষক রয়েছেন। অভিধানটি তিন হাজার পৃষ্ঠার। প্রকাশিত হলে এটি হবে বাংলা ভাষার ল্যান্ডমার্ক একটি গ্রন্থ।
এ ছাড়া ১১০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করতে চেয়েছিলেন। তিনি অনেক লেখালেখিও করেছিলেন এ বিষয়ে। কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মাধ্যমে সেমিনার করা হয়েছিল। সেই কাজটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। আমরা কাজটা সম্পন্ন করতে পেরেছি। আমাদের আড়াই বছরের চেষ্টায় বাংলা ভাষার প্রমিত ব্যাকরণটা বেরিয়ে গেছে। দেড় মাসের মধ্যে এটির আড়াই হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেছে। এখন দ্বিতীয় সংস্করণ হচ্ছে। এটি অনেক বেশি প্রশংসিত হয়েছে।
এর পর আমি হাত দিয়েছি বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস। এটি চার খণ্ডে হবে। একখণ্ড মুক্তিযুদ্ধের, একখণ্ড প্রাচীন, একখণ্ড মধ্যযুগ এবং একখণ্ড আধুনিক যুগ। এটার কাজ চলছে।
এর পরে চৌষট্টি জেলার লোকজ সংস্কৃতির ইতিহাস রচনার কাজ চলছে। আগে ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ার বের হতো। তাতে সারা দেশের সংস্কৃতির পরিচয়, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরিচয় পাওয়া যেত। সেই রকম গ্রন্থ এখন আর বের হয় না। সে ক্ষেত্রে এই গ্রন্থগুলো রচিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাস রচনার জন্য এ গ্রন্থসমূহ অমূল্য কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।
লোকসংস্কৃতির কাজটা যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তা কতটা স্বচ্ছ? যাদের কাজ দেওয়া হয়েছে তারা কি দক্ষ? তাদের দিয়ে কি কাজটা আদৌ করা যাবে?
শামসুজ্জামান খান : যাবে। কারণ যাদের এ কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে ট্রেনিং দিয়েছি। ঢাকায় দুবার ট্রেনিং হয়েছে। কক্সবাজার ও রাজশাহীতেও একবার ট্রেনিং হয়েছে। এদের ট্রেইন করে, এদের জন্য প্রশ্নমালা ও ফরম্যাট তৈরি করে দিয়ে আমরা তাদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নিচ্ছি।
কাজটা তো এশিয়াটিক সোসাইটিও করেছে?
শামসুজ্জামান খান : হ্যাঁ, করেছে। কিন্তু তারা ফিল্ডে যায়নি। তাড়াহুড়া করে করা। ফিল্ডে গিয়ে কাজ করার অর্থই হলো প্রাইমারি সোর্সে যাওয়া। আমাদের নিযুক্ত কর্মীরা প্রাইমারি সোর্সে গেছে কি না, কবে গেছে, কখন গেছে, সে জায়গার ফটো তুলেছে কি না, তারিখ আছে কি না, সাক্ষাৎকার নিয়েছে কি না, কার সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তার বয়স কত—এসব বিবরণসহ ওই এলাকার লোকসংস্কৃতির সমস্ত আঙ্গিকের ওপর তথ্যসমৃদ্ধ উপাদান পেয়েছি আমরা। এরই মধ্যে গোটা বিশেক পাণ্ডুলিপি পেয়ে গেছি। যার একেকটা চারশ-পাঁচশ পৃষ্ঠা। আমরা মনে করি, এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
অন্যদিকে, আমরা উত্তরাধিকার পত্রিকাটি বের করছি। উত্তরাধিকারকে আগে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা বলা হতো। এখন সেই বদনামটা নেই। আমরা তরুণদের যুক্ত করেছি এর সঙ্গে। তরুণদের লেখায় এটি সমৃদ্ধ একটি পত্রিকা। প্রকাশের দিক থেকে শোভন ও নান্দনিক; লেখার দিক থেকে উন্নত মানের। বাজারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক সপ্তাহের মধ্যে সব পত্রিকা শেষ হয়ে যায়। এটা একটি বড় দিক আমাদের জন্য।
বাংলা একাডেমির ইতিহাস বুঝে আমি চাইছি বাংলা একাডেমি হবে মূলত নিবিড় গবেষণামূলক। শুধু পণ্ডিতরা গজদন্ত মিনারে বসে সূক্ষাতিসূক্ষ্ম গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করবেন, এটা বাংলা একাডেমির কাজ হতে পারে না। সেই গবেষণার জ্ঞানকে তৃণমূল পর্যায়ে যাতে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি এবং তৃণমূলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমরা যাতে সংযোগ রক্ষা করতে পারি, সে জন্য আমরা এখন আঞ্চলিক সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক সম্মেলন করছি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এর অর্থ হলো বাংলা একাডেমিকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া। চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী—এ রকম অনেক জায়গায় আমরা আঞ্চলিক সম্মেলন করেছি। তাতে মানুষ বলছে যে, বাংলা একাডেমি সত্যিকার অর্থে সকল মানুষের এবং দেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে এসেছে। এটি আমাদের জন্য বড় আনন্দের সংবাদ। বহির্বিশ্বেও বাংলা একাডেমিকে পরিচিত করার চেষ্টা করছি। হে উৎসবের মাধ্যমে তা হচ্ছে। তা ছাড়া লন্ডনে আমরা বাংলা একাডেমি বইমেলা করছি গত তিন বছর। বাঙালি কমিউনিটি বাংলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তাতে। ওখানকার বাঙালিরা বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখছে। এভাবে যদি করা যায় তাহলে বাংলা একাডেমি তার যথাযোগ্য জায়গটা ধরে রাখতে পারবে।
আপনি অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন, কোনোটির কাজ চলছে। চুক্তিভিত্তিক আপনি আর এক বছর মহাপরিচালক হিসেবে থাকবেন। সরকার পরিবর্তনের পর নতুন মহাপরিচালক আসবেন। তখন কি আপনার পরিকল্পনাগুলো সঠিকভাবে চলবে? সরকারের এই প্রক্রিয়াটার মধ্যে কি কোনো জটিলতা আছে?
শামসুজ্জামান খান : এটা মোটেই যৌক্তিক নয়। যে কাজটা শুরু হবে তার সময়সীমা তো আগেই নির্ধারণ করা থাকে। কী করা হবে, সেটাও বলা থাকে। যে সরকারই আসুক, সেটা যেন পরিবর্তন না করে। তারা যদি নতুন কোনো পরিকল্পনা নেয়, তা যেন এ পরিকল্পনা শেষ হওয়ার পর নেয়। তা না হলে এটার জন্য যে জাতীয় অর্থের ব্যয় হচ্ছে, তা অপচয়ে পরিণত হবে। এবং নতুন যা করতে চাইবে, সেটা সম্পর্কেও মানুষের সন্দেহ দেখা দেবে। নিষ্ঠার সঙ্গে কেউ কাজ করবে না। তারা মনে করবে, সরকার পরিবর্তন হলে এটাও আগেরটার মতো ভণ্ডুল হয়ে যাবে। সুতরাং সকল দিক থেকে ধারাবাহিকতা রাখা দরকার। যে সরকারই আসুক, তাদের উচিত হবে চলমান কর্মসূচিগুলোকে শেষ হতে দেওয়া। তার পর অনেক চিন্তাভাবনা করে ওই কর্মসূচির সঙ্গে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন করা।