গল্প
অসমাপ্ত লিরিক

বিকেল ৩ :১৮
ইউনিভার্সিটিতে ইনডোর কনসার্ট হচ্ছে কিন্তু হিমেল আজ গাইবে না। কিছুক্ষণ আগেই সে এটা বাদ দিল অজ্ঞাত কোনো কারণে। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে কিছুক্ষণ বাবুর চায়ের দোকানে গিয়ে বসে এক কাপ চা নিল, সিগারেট বরাবরই তার খুব অপছন্দের। তারপর রিকশা নিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের উদ্দেশে। ধানমণ্ডি থেকে ঢাকা মেডিকেল, পথটা অনেক বেশি মুখস্থ। গত তিন বছরে রেশমির সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারটা অনেকটাই ডেইলি রুটিনের পর্যায়ে চলে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই ক্লাস শেষ করে ওর সঙ্গে দেখা করে বাসায় অথবা প্র্যাকটিস প্যাডে চলে যাওয়া, জীবনটা অনেক বেশি আবেগের রুটিনে বাঁধা। সবই তো আবেগ, গান, লিরিক, সুর এবং রেশমি। কে বেশি আপন এমন প্রশ্নে হিমেল প্রায়ই রেশমিকে বলে, ‘ভালোবাসাটাই আপন’।
বিকেল ৪ : ২৫
রেশমির হোস্টেলের সামনে এসে রিকশা থেকে নামল হিমেল। রিকশাওয়ালাকে বিদায় দিয়ে পাশের উঁচু জায়গাটায় বসে রেশমিকে ফোন দিল। দু-তিনবার রিং হওয়ার পরে রেশমি ফোন ধরল।
রেশমি : কনসার্ট শেষ?
হিমেল : তুই কি হোস্টেলে?
রেশমি : হুম। আর কই থাকব? কেবল ক্লাস শেষ করে আসলাম। তোর কনসার্ট কি শুরু নাকি শেষ?
হিমেল : আমি তোর হোস্টেলের সামনে। আসবি একটু?
রেশমি : (অবাক হয়ে) বলে আসবি না? এমন হঠ্যাৎ করে আসিস, এত নিষেধ করি, তবুও। আচ্ছা আমি আসছি। কিছু খেয়েছিস? নাকি কিছু নিয়ে আসব?
হিমেল : খিদে নেই, তোর খিদে লাগলে তুই খেয়ে আয়। আমি না হয় নিচেই আছি।
পাঁচ-সাত মিনিটের ভেতরেই রেশমি নামল। কালো একটা জামা পরে, ভেজা চুলে, চোখে আলতো করে কাজল দেওয়া।
রেশমি : কী হইছে তোর? মন খারাপ? কনসার্ট নিয়ে কোনো ঝামেলা হইছে নাকি?
হিমেল : নারে। সব ঠিক আছে, গাইতে ইচ্ছে হলো না। তোকে দেখতে ইচ্ছে করল খুব।
রেশমি : সত্যিই তোর মন খারাপ না তো? কী হইছে বলতো?
হিমেল : তোর লাল রঙের ওড়নাটা দিবি আমাকে?
রেশমি : হাহাহাহাহা। ক্যান? ওড়না পরার শখ হইছে নাকি?
হিমেল : ‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ।’
রেশমি : ফাজলামো করিস না। কী হইছে?
হিমেল : ‘হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি/নয়তো গিয়েছি হেরে/থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা/কে কাকে গেলাম ছেড়ে’। শুধু ওড়নাটাই তো চাইছি। দে না প্লিজ।
রেশমি : মাথা পুরো গেছে তোর। দাঁড়া, আসতেছি।
হিমেল : ‘প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট/নদী এবং নারীর কষ্ট/অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট/কষ্ট নেবে কষ্ট?’
রেশমি : খুব কাব্যিক মুডে আছিস! এত হেলাল হাফিজ ফুটাচ্ছিস। তুই ওয়েট কর। আমি আসছি, কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি চল।
হিমেল : নারে। আজ খিদে নাই। তোর ওড়নাটা দে। চলে যাব।
সন্ধ্যা ৭ : ১১
ফরহাদের বাসার ছাদে গানের আড্ডা। প্রাত্যহিক দিনের আরেক কাজ, যেটা সব সময়ই আনন্দের। আড্ডার ছলে গান লেখা, সুর করা, গান গাওয়া।
ফরহাদ : তোর কনসার্ট কেমন হলো?
হিমেল : আজ গান করি নাইরে। কেন যেন মনে হলো, সবার জন্য গান, কবিতা না। আমার গান শুনে যারা ক্যাম্পাসে আনন্দ পায়, তারা কি আমাকে ভালোবাসে নাকি গানকে?
ফরহাদ : দুইটাই তো তোর। গানও তোর, তুই নিজেও নিজের। সমস্যা তো নাই।
হিমেল : হয়তো, আবার হয়তো না। ভালো লাগেনি আজকে সবার ভালো লাগার জন্য গান গাইতে। আচ্ছা, তুই আমাকে ভালোবাসিস কেন?
ফরহাদ : কি হইছে তোর? শরীর ভালো? রেশমির সঙ্গে ঝগড়া হইছে নাকি?
হিমেল : আমাকে ভালোবাসিস কেন?
ফরহাদ : বন্ধু তুই, তাই
হিমেল : ভালোবাসাটা কি স্বভাবজাত নাকি বাধ্যতামূলক?
ফরহাদ : পাগলের মতো কথাবার্তা বাদ দে। রেশমির সঙ্গে কিছু হইছে নাকি আবার? তোদের ঝগড়া থামাতে থামাতেই আমার জীবনে আর প্রেম করা হলো না।
হিমেল : কিছু হয় নাই রে। যাই আজকে।
রাত ১০ : ৩২
হিমেল বাসায় বেল দিল, দরজা খুলল মা।
মা : এই, তুই কি সিগারেট ধরেছিস নাকি?
হিমেল : জানো না আমি একদম পছন্দ করি না সিগারেট। বন্ধুরা সবাই খায়, ওদের সঙ্গেই থাকি। তাই হয়তো জামাকাপড়ে সিগারেটের গন্ধ থাকে।
মা : তোর বাবার এক কলিগের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। সেখানে গেছে সে। ফিরতে দেরি হবে। চল খেয়ে ফেলি।
হিমেল : আমি খেয়ে এসেছি, এখন ঘুমাব।
হিমেল চলে এলো নিজের রুমে। জামাকাপড় ছেড়ে অনেক সময় নিয়ে গোসল করল আজ। পানির প্রতিটি কণা যেন সারা দিনের ক্লান্তিকে ধুয়ে দিচ্ছিল।
গোসল করে বসল বিছানায়। মোবাইলের স্ক্রিনের দেখল চারটি মিসকল, চারটিই রেশমির। ব্যাগ থেকে রেশমির ওড়নাটা বের করল। এই লাল রঙের ওড়নাটি কেন যেন ওর অনেক বেশি ভালো লাগে, অনেক বেশি আপন লাগে।
মোবাইল হাতে নিয়ে কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে হলো রেশমিকে।
রাত ১১ : ৫৮
রেশমি পড়ছে আর নিজের চুলে বিলি কাটছে। সামনে প্রফ, অনেক বেশি দুশ্চিন্তা। হঠাৎ মোবাইলে ম্যাসেজ এলো। হিমেলের ম্যাসেজ নিশ্চয়ই।
“পারলাম না রে সহ্য করতে। অনেক আগেই শুনেছি রবির সঙ্গে তোর সম্পর্ক আছে, তোকে জিজ্ঞেস করলাম, বললি ‘মিথ্যে কথা’। বিশ্বাস করলাম। আজকে এক বন্ধু জানাল, তোর সাথে নাকি ফরহাদের এবং আরো দুই-একজনের সম্পর্ক এবং তুই নাকি ভালো না, তোকে ছেড়ে দিতে বলল। আমি প্রতিবাদ করায়, ওর মোবাইলে রাখা তোর আর ফরহাদের একটা ছবি দেখাল, যেটা ফরহাদের রুমেই তোলা বোঝা যাচ্ছে। তোকে ছেড়ে দিতে পারতাম না, তাই চলে গেলাম।”
রেশমি বারবার ফোন দিচ্ছে হিমেলকে। কিন্তু অপারেটর বলছে, ‘এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’।
রাত ১ : ১৭
প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে অ্যাম্বুলেন্স চলছে হাসপাতালের দিকে। গলায় লাল ওড়না পেঁচানো, একটা নিথর শরীর পড়ে আছে পেছনের বেডে।
ইস! যদি, এইবারের মতো জ্ঞানটা ফিরে আসত…!