উপন্যাস পর্ব ৯
বাবা আছে, বাবা নেই
হঠাৎ এমন হচ্ছে কেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মাঝেমধ্যে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। চোখে সরষে ফুল দেখি। আগে অনেকবার কৃমির সমস্যা হয়েছে, ওষুধ খেয়েছি। সেরে গেছে। কিন্তু এবারের উপসর্গ কিছুটা ভিন্ন মনে হচ্ছে। আগে বমি ভাব হলেও মাথা ঘোরাত না। এবার কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে।
টিনা এবং খালাম্মার সম্মুখে বমি ভাবটা চেপে রাখার চেষ্টা করছি। এমনিতেই তাদের বোঝা হয়ে আছি। তার ওপর অসুস্থ হলে ওরা কত সামলাবে। ইদানীং তেমন খেতেও পারছি না। মুখে রুচি বলতে নেই।
আমার এ অবস্থা দেখে খালাম্মা বেশ কবার বকেছে। কী ব্যাপার খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছ নাকি? আমার অন্ন রক্ষা করছ?
কোনোটাই না খালাম্মা। এমনিতে খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমাকে কতবার বললাম, ডাক্তার দেখাও। কে শোনে কার কথা। অসুখ যখন শরীরে গেড়ে বসবে, তখন টের পাবে।
ডাক্তার দেখাব। এ কথা বলে এড়িয়ে গেছি।
মাকে খুব মনে পড়ছে। আমি অসুস্থ হলে মা বেশ অস্থির হয়ে পড়তেন। চিরতার জল, বাসক পাতার রস, কবিরাজি আরো কত কী খাওয়াতেন। তেতো ওষুধগুলো আমি খেতে চাইতাম না। নাক টিপে ধরেই মা খাইয়ে দিতেন।
বাকিউলের কাছ থেকে যে আমি পালিয়ে এসেছি, এ কথা নিশ্চয় মার কানে গেছে। মৌলানা শরাফত খান মাকে কিছু কটুকথা না শুনিয়ে থাকবেন না। হয়তো বলেছে, তোমার মেয়ে বংশের মান-ইজ্জত সব ধুয়ে-মুছে দিল। কত ভালো ঘরে বিয়ে দিলাম। ধৈর্য ধরে টিকতে পারল না। বাকিউলের সঙ্গে থাকলে সরকারি বাড়ি-গাড়ির মালিক হতো। তুমি যেমন বেশি বোঝ, তোমার মেয়েও বেশি বোঝে। মৌলানা শরাফত খানের এসব কথা শুনে মা কোনো রাগ করবেন না। নেপথ্যে হাসবেন। আর মনে মনে বলবেন, আমার মেয়ে যা করেছে, ভালোই করেছে।
কিন্তু আমি কোথায় থাকছি, কী খাচ্ছি। এ নিয়ে মায়ের টেনশন থেকেই যাবে। শিমুও মৌলানা শরাফত খানের সঙ্গে রাগ করবে।
শিমুর জন্য বেশ মন খারাপ হচ্ছে। আদরের ছোট বোন। একসঙ্গে থেকেছি। খেয়েছি। খুনসুটি, ঝগড়া কত কিছু করেছি। এই আড়ি দিয়েছি আর কিছুক্ষণ পর নিজে নিজেই ভাব করেছি।
হৈ-হুল্লোড় করে ঘর মাতিয়ে রাখতো শিমু। কোনো দিন মামার বাড়ি অথবা খালার বাড়ি বেড়াতে গেলে পুরো বাড়িটাই মৃতপুরীতে পরিণত হতো। ঘরে মানুষ আছে, তারপরও যেন কী নেই। হয়তো কিছুই নেই।
দু-চার দিনের জন্য শিমু কোথাও বেড়াতে গেলে পরদিন গিয়েই আমি নিয়ে আসতাম। কারণ, শিমুকে ছাড়া ঘরে একদম ভালো লাগত না।
আর এখন! শিমু আর মাকে ছেড়ে আমি কত দূরে। অজানা-অচেনা মানুষের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছি। আর ভাবতে পারছি না। বুক ভারি হয়ে আসছে। চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। ইচ্ছে করছে, মা মাগো বলে চিৎকার করে কান্না করি। পারছি না। জীবনের বাস্তবতা আমার ভেতরটা অনেক কঠিন করে দিয়েছে।
সামিয়া ও হৃদয়কে পড়াচ্ছি এক সপ্তাহ হয়ে গেল। এরই মধ্যে বেশ কবার সামিয়ার কাকার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেছে। সিঁড়িতে। দরজা খুলতে। ঢুকতে বোরোতে। এমনকি পড়ার টেবিলে। আমি এসেছি উনি টের পাননি। দিব্যি বই পড়াতে মগ্ন। পেছনে সোফায় বসে অপেক্ষা করেছি। পরে সামিয়ারা এসে উঠিয়েছে।
স্বভাবসুলভ সরি বলেই তিনি কেটে পড়েছেন।
কিন্তু আজ মনে হয় ব্যতিক্রম কিছু ঘটল। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলল সে। চোখাচোখি হলো। ঠোঁটে এক চিলতে মুচকি হাসি।
আসুন।
কী ব্যাপার, সামিয়ার মা নেই?
সামিয়ারা নেই? বললাম আমি।
হ্যাঁ আছে। আপনি পড়ার ঘরে বসুন।
তারপরও আমি ভরসা পাচ্ছিলাম না। আমার জন্মদাতা মৌলানা শরাফত খান আর বাকিউলকে দেখেই পুরুষ মানুষের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে গেছে। ওদের দেখলেই মনে হয় বাইরে এক, ভেতরে আরেক।
কী ব্যাপার আসুন।
দরজায় দাঁড়িয়েই এসব ভাবছি। সামিয়ার কাকার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম।
ও...।
সামিয়া ও হৃদয় ভেতর ঘর থেকে এলো।
এবার আশ্বস্ত হলাম।
ঢুকলাম পড়ার ঘরে।
সোজা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। তিনি বসলেন দরজার পাশের সোফায়।
কেমন আছেন?
পেছন ফিরলাম। সামিয়ার কাকা পেছন থেকেই জিজ্ঞেস করল।
জি ভালো।
আমি গায়ে পড়ে কথা বলছি দেখে বিরক্ত হচ্ছেন?
না।
শুধুই ‘না’ বলে কি সামাজিকতা রাখলেন।
ঈষৎ হেসে বললাম, না।
আপনি রাবেয়া, নামটা আমি জেনে নিয়েছি। আমার নাম নিশ্চয় জানা হয়নি?
জি না।
আপনার এই জি জি না উত্তরগুলো আমার কাছে বোরিং লাগছে।
সোজাসাপটা বলবেন, হ্যাঁ। না।
আচ্ছা।
আমি তুষার। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি। সামিয়ার কাকা। শেষেরটা আমি জানি।
আপনি কি পড়াশোনা করছেন।
হ্যাঁ। ক্লাস টেন-এ।
ও...।
আচ্ছা সামিয়ার আম্মু বাসায় নেই?
না। পাশের বাসায় গেছে। চলে আসবে।
থামলেন তুষার। পুনরায় শুরু করলেন আপনি কেমন ভয় পেয়ে গেছেন। তাই না—
না। মানে—
আমতা আমতা করার কোনো কারণ নেই। শুনুন, প্রথম দিন আপনাকে দেখেই মনে হয়েছে, আপনি ব্যতিক্রম। অন্য আর দশটি মেয়ের মতো নয়। তাই গায়ে পড়ে কথা বললাম। হয়তো আপনার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারব।
লজ্জা দিলেন? বললাম আমি।
রেখেঢেকে কথা আমি বলি না। তাই ভাবীরা আমাকে ঠোঁটকাটা ডাকে।
সামিয়া ও হৃদয় এসে বসেছে। হৃদয় পড়তে চায় না। সামিয়া ওকে টেনে নিয়ে এলো। বেচারা কাঁদছে।
আপনার পড়াশোনার প্রয়োজনে কোনো সহযোগিতা দরকার হলে বলবেন। তুষার বলল।
আচ্ছা। বললাম আমি।
তুষার বেরিয়ে গেল। সামিয়া ও হৃদয়কে পড়া দেখিয়ে দিয়ে আমি চুপটি মেরে বসে আছি। ভাবছি।
তুষার কী বলতে চাইল? কেনই বা সে গায়ে পড়ে এসব কথা বলে গেল। তাহলে কি আমাকে তার...। ছি! ছি!... এসব কী ভাবছি? তেমন নাও তো হতে পারে।
দরজা খোলার শব্দ হলো। মনে হয় সামিয়ার মা ফিরেছে।
বমির ভাবটা যাচ্ছে না; বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে।
মাথা চক্কর দেওয়াটাও কমেনি। খালাম্মা উঠেপড়ে লেগেছে ডাক্তার দেখানোর জন্য। বলেছি দেখিয়েছি। কিন্তু নিজের ভেতরও ভয় কাজ করছে।
আরো একটা বিষয় আমি লক্ষ করেছি। গত দুই মাস পিরিয়ড হয়নি। তাহলে কি আমি প্রেগন্যান্ট! এ কথা ভাবতেই কেঁপে উঠলাম। লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। যে রাতে আমার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল সে রাতের কথা স্পষ্ট মনে নেই।
মাথাব্যথা করছিল বলে বাকিউল কী একটা ওষুধ এনে আমাকে খাইয়েছিল।
ওষুধটা খাওয়ার পর আমি গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিলাম। চোখ মেলতে পারিনি। শরীরের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গিয়েছিল, তা টের পেলেও কিছুই করার ছিল না।
দেহটা নিস্তেজ পড়েছিল। প্রচণ্ড ব্যথা হয়েছিল। জ্ঞান হারিয়েছিলাম তক্ষুনি। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন টের পেলাম আমি হাসপাতালে।
সত্যিই কি আমি প্রেগন্যান্ট!
অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবতার কথা ভেবে চুপসে গেলাম। কয়েক দিন ধরেই লক্ষ করছিলাম, তলপেটটা কিছুটা ফেঁপে আছে। তা আমলে নিইনি। টেনশনে মাথা চক্কর দিচ্ছে। কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছি না। হারামি বাকিউলের সন্তান আমার পেটে? উফ। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গলাটিপে মেরে ফেলি।
সন্ধ্যায় টিনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম।
আমার ধারণাই ঠিক। প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার বলল সময় পেরিয়ে গেছে। এখন আর কিছুই করার নেই। ডেলিভারির আনুমানিক একটা ডেটও দিয়ে দিয়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ।
ইচ্ছে করল তলপেটে একটা কিল বসিয়ে দিই।
কিন্তু তাও পারা গেল না। অদৃশ্য একটা হাত বাধা দিল।
টিনাও নিষেধ করল। বলল, একটি সন্তানের জন্য কত হাহাকার করেছি। তিলে তিলে এ পেটে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর আলোর মুখ দেখতে পেল না। নয় মাস পেটে ধরে নাড়ির টান শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এ ব্যথা বোঝানোর কোনো ভাষা নেই।
টিনার সঙ্গে আর কথা বাড়াইনি।
বাসায় ফিরেই চুপচাপ। কোনো কাজে মন বসছে না। কারো সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। হঠাৎ করেই যেন ছন্দপতন হলো। সব স্বাদ-আহ্লাদ ধুলোয় মিশে গেল।
টিনা সোফায় বসে বই পড়ছে। আর আমি চেয়ারে পা তুলে চুপ মেরে আছি। সবকিছু অসহনীয় মনে হচ্ছে। আজ সামিয়াদের পড়াতে যাইনি।
আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে খালাম্মা এলো।
কী রে, তোরা এমন চুপ মেরে বসে আছিস কেন? রাবেয়া।
জি খালাম্মা।
সামিয়াদের পড়াতে যাওনি?
জি না খালাম্মা।
কেন? টিউশনি কামাই করা তো ঠিক না। একদিন কামাই করলে চার দিনের কথা হবে।
ভালো লাগছে না। তাই গেলাম না।
ডাক্তার কী বলেছে? খালাম্মা বলল।
আমি চুপ মেরে গেলাম। টিনা বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে খালাম্মার দিকে তাকাল।
আমার মুখে সাড়া নেই।
কী রাবেয়া? চুপ করে আছো কেন?
টিনা বইয়ের পাতা ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রাখল।
উঠে মার হাত ধরে রান্নাঘরের দিকেই নিয়ে গেল।
বুঝতে বাকি রইল না টিনা খালাম্মাকে কী বলবে। আমি আর ওদিকটায় গেলাম না।
ক্ষণিক পরেই খালাম্মা ফিরল। টিনা রান্নাঘরে।
আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। এ রকম একটা কিছু হতে পারে।
রাবেয়া।
জি খালাম্মা।
তুমি নাকি খুবই অসন্তুষ্ট? বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চাইছ?
খালাম্মা আপনি তো সবই জানেন। বাকিউল একটা হারামজাদা। ওর সন্তান...।
চুপ কর। তোমার পেটে ধরেছে। এটা তোমার সন্তান। ওকে পৃথিবীতে আসার হুকুম করেছে আল্লাহ। যদি তুমি আসতে না দাও, মেরে ফেলো তাহলে তুমি খুনি হিসেবেই আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবে।
খালাম্মা।
হু। বলো।
বাকি জীবন কি বাকিউলের চিহ্ন নিয়েই আমাকে কাটিয়ে দিতে হবে?
তোমার বাকি জীবন কীভাবে কাটবে, সেটা এখন তুমি আমি কেউই বলতে পারব না। সেটা সময়ই বলে দেবে।
কত আশা ছিল টিনার, একটা ফুটফুটে বাচ্চা হবে। আমরা নানা-নানি হয়ে ওর সঙ্গে খেলব। কিন্তু নিয়তি বড়ই নির্মম। কী ভেবেছিলাম আর কী হলো। দেখেছ টিনা এখনো বাচ্চার শোক কাটিয়ে উঠতে পারছে না। রাবেয়া।
জি খালাম্মা।
তুমি কি চাও না, তোমার সন্তানের মুখে আমরা নানা-নানি ডাক শুনি? ওকে নিয়ে খেলি, আদর সোহাগে বড় করি?
কোনো জবাব দিলাম না। বারবার বাকিউলের চেহারাটাই ভেসে উঠছে।
খালাম্মা।
হু।
সন্তানটি যখন বড় হয়ে বাবার পরিচয় খুঁজবে, তখন কী জবাব দেবো?
বলবে ওর বাবা মারা গেছে।
না খালাম্মা। আমি আমার সন্তানের সঙ্গে মিথ্যা বলতে পারব না।
তাহলে যা সত্যি তাই বলো। তারপরও তুমি সন্তানটিকে আলোর মুখ দেখতে দেবে, এ আমার দিব্যি।
খালাম্মার এ কথাটি মুহূর্তে আমার মাথায় রক্ত সঞ্চালিত করল। চোখ দুটি ঝিলিক দিল। হ্যাঁ। আমার পেটে ধরা সন্তানই বাকিউলের প্রতিশোধ নেবে। আর আমি প্রতিশোধ নেব মৌলানা শরাফত খানের।
দুদিন কামাই করে তৃতীয় দিনে সামিয়াদের বাসায় যাচ্ছি। দুর্বল শরীরটা টলছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে কলিংবেল টিপলাম। সামিয়াই দরজা খুলল।
হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।
সামিয়া...। ডাক দিয়েছি। বুঝতে পারছি আমি পড়ে যাচ্ছি। তুষার ভেতর থেকে দৌড়ে আসছে। তারপর কী হলো কিছুই মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখতে পেলাম আমি একটি বিছানায় শুয়ে আছি। চোখেমুখে জল ছিটালো। মাথার তালু ঈষৎ ভেজা।
ওরা সবাই আমার চারপাশে।
আপু, এখন কেমন লাগছে তোমার? সামিয়া বলল।
অসুস্থ শরীর নিয়ে কে আসতে বলল? ভাগ্যিস তুষার দৌড়ে গিয়েছিল। না হয় মাথাটাই ফেটে যেত। বলল সামিয়ার মা। হৃদয় চুপচাপ।
তুষার আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হলো। ফিরিয়ে নিলাম নিজেকে।
ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এমন হবে। বললাম আমি।
অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনার পড়াতে আসাটা ঠিক হয়নি। বলল তুষার।
কিঞ্চিৎ হাসলাম। চারদিকে দেখছি। ঘরটি গোছানো। সুন্দর। বিছানার পাশেই টেবিল। অনেকগুলো বই থরেথরে সাজানো। পেছন দিকে অন্য টেবিলে একটি কম্পিউটার। তাও কালো কাপড়ে ঢাকা। বুঝতে পারলাম, এটা তুষারের ঘর।
ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। পায়ে পায়ে পড়ার ঘরে এসে সোফায় হেলান দিয়ে বসতেই সামিয়ার মা ঢুকল।
আজ আর পড়াতে হবে না। তিনি বললেন।
সামিয়া ও হৃদয় আমার দুপাশে বসল। তুষারকে পর্দার ওপাশে পায়চারি করতে দেখলাম। বোঝা গেল, আমার প্রতি তুষার অনুভূতিশীল হয়ে পড়ছে।
ভাবী! তুষার সামিয়ার মাকে ডাকল।
হ্যাঁ, বল।
সামিয়ার টিচারকে তুমি দিয়ে এসো। একা যেতে দিও না।
আচ্ছা ঠিক আছে। সামিয়ার মা বলল।
পর্দার এপাশ থেকে আমরা শুনলাম। ক্ষণিক পর সামিয়ার মা এলো।
চলো রাবেয়া, তোমাকে পৌঁছে দি। সামিয়ার মা বলল।
লাগবে না। আমি একাই যেতে পারব।
বললেই হলো লাগবে না। ভাবী যাও, তুমি দিয়ে এসো। পর্দার ওপাশ থেকে তুষার যেন আদেশ করল।
আমার সঙ্গে সামিয়ার মাকে আসতে দেখে অবাক হলো খালাম্মা। শঙ্কিত মনে ভেতর ঘরে গেলাম। সামিয়ার মা সবকিছু জেনে যাবে। জেনে নিশ্চয় খুব অবাক হবেন। আমার সম্পর্কে তার ধারণাটাই পাল্টে যাবে।
টিনা চেয়ারেই বসা ছিল। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে চমকালো।
কী ব্যাপার? তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে? আজ সামিয়াদের পড়াওনি? বলল টিনা।
না।
কেন? ওরা বাসায় নেই?
বাসায় আছে।
তাহলে?
আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তাই সামিয়ার মা-ই বলল আজ আর পড়াতে হবে না। সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।
ব্যাপারটা কি উনি জানেন? বলল টিনা।
না। তবে বাসায় যখন এসেছেন, খালাম্মার কাছ থেকে জেনে যাবেন। খুবই বিশ্রী অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম।
তুমি নিজেকে অতটা ছোট মনে করছ কেন? তোমার এটুকু জীবনে যা কিছু ঘটল তার কোনোটার জন্যই তুমি দায়ী নও। বলল টিনা।
বসার ঘরে খালাম্মা আর সামিয়ার মা কথা বলছেন। আমি আর ওদিকটায় গেলাম না। খালাম্মা টিনাকে ডাকল। টিনা বেরিয়ে গেল।
বিছানায় শুলাম। মাথার ওপর পাখাটি ঘুরছে। নিয়তি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে, জানি না। তারপরও হাল টেনে ধরে জীবন নৌকা তীর খুঁজে পাচ্ছে না। মনে হয়, মাঝ দরিয়ায় দিক হারা নাবিকের মতো ঘুরপাক খাচ্ছি। কোথায় গিয়ে নোঙর করব, জানি না। তবে মৃত্যুকেই আমার শেষ নোঙর হিসেবে ধরে নিয়েছি।
টিনা ফিরেছে। সামিয়ার মা চলে গেছে। টিনা বলল।
কিছু খেতে দাওনি? বললাম আমি।
হ্যাঁ। মাই দিয়েছে। ও হ্যাঁ, বাবা ফিরেছে।
কাকা অদ্ভুত মানুষ। বললাম আমি।
কেন বলত? টিনা বলল।
কোনো ঝুট-ঝামেলাতে নেই। অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন না।
নিজের কাজ আর বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সংসার, সমাজ সবখানেই তিনি ভূমিকা রাখছেন। সত্যি, তুমি অনেক ভাগ্যবতী এমন একজন গুণী বাবা পেয়েছ। সুন্দর সংসার পেয়েছ। আর আমি পৃথিবীতে আমার সব থেকেও কেউ নেই। কিছু নেই।
রাবেয়া। টিনা বলল।
হুঁ।
তোমাকে নিষেধ করেছি এসব না বলতে। তারপরও তুমি বলে যাবে। টিনা পুনরায় বলা শুরু করে, আমার চেয়ে তোমার জীবনের অর্থ ব্যাপক। কারণ তুমি যুদ্ধ করে বেঁচে আছ। জীবন চলার পথে ঝড়ঝাপটা, দুঃখ-বেদনা, অনেক কিছুই তোমাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আর আমি তো বাবার সংসারে রেডিমেড গিলছি।
টিনার সঙ্গে আর কথা বাড়ালাম না। চোখ বুজে শুয়ে থাকলাম।
(চলবে)