নিবন্ধ
ঢাকায় কবি নজরুল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনের শীতল ছায়ায় কবি নজরুল ইসলাম অনন্তকালের জন্য নিজের স্থায়ী ঠিকানা নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবির শেষ পরিচয়টি সাথে নিয়ে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত ঢাকার মাটিতে। তবে কবির কাব্যপ্রতিভার উজ্জ্বল সময়ের বড় সময় কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রাজনীতি অঙ্গনের মানুষ। এই পরিচয়ের সূত্রেই প্রধানত তিনি কয়েকবার ঢাকায় আসেন।
নজরুলের ঢাকা আগমনের সথে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র বিশেষ ভূমিকা ছিল। ঢাকায় ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনটি প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশ ও মুক্তচিন্তার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রগতিশীল চিন্তা কবিকে আকৃষ্ট করে এবং এই সংগঠনের আমন্ত্রণে কবি ঢাকায় প্রথম পদার্পণ করেন ১৯২৬ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে। এ সময় কবি বর্তমান পুরান ঢাকার মোহিনীমোহন দাসের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। এই বাড়িতে কবির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেন কবি আবদুল কাদের, মোহাম্মদ কায়েস ও আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন।
কবি নজরুল ২৭ জুন মুসলিম সাহিত্য সমাজের চতুর্থ বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। বৈঠক হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। এই বৈঠকে কবি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেওয়ার পর তাঁর কয়েকটি জাগরণী গান গেয়ে শোনান। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘আমরা ছাত্রদল’, ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’, ‘কৃষাণের গান’ প্রভৃতি।
এই বছরেই অক্টোবর মাসের শেষ দিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কবি দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন। নজরুল ইসলাম ঢাকা বিভাগের মুসলমান কেন্দ্র থেকে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। তাই নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশ্যেই কবির ঢাকা আগমন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে। এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন কবি নজরুল। এ যাত্রায় কবি ঢাকায় মাত্র তিনদিন অবস্থান করেছিলেন। এ সময় কবির সাথে কাজী মোতাহার হোসেনের অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। এই অধিবেশনে কবি সংগীত পরিবেশন করেন। স্বল্পকালীন অবস্থানের কারণে এ পর্যায়ে কবির সাথে ঢাকার সুধীসমাজের ব্যাপক যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তবে এ সময় জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট রমেশচন্দ্র মজুমদার হলে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কবিকে আমন্ত্রণ জানান। এখানে বেশ কয়েকটি গান পরিবেশন করেন কবি।
কবি নজরুল ইসলাম ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে প্রথম তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক আবুল হুসেনের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেন। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর আরো কিছুদিন কবি ঢাকায় অবস্থান করেন। এ সময় তিনি বর্ধমান হাউসে (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় থাকেন। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন কবি। আবুল হুসেনের বাসায় অবস্থানকালে কবি তাঁর বিখ্যাত ‘নতুনের গান’ রচনা করেন। এই সম্মেলনে নতুনের গান গেয়ে শোনান কবি। ঢাকায় অবস্থানকালে কবির সাথে পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী ফজিলাতুননেসার। অল্পদিনেই কবির সাথে ফজিলাতুননেসার সখ্য গড়ে ওঠে। এই তরুণীর প্রতি কিছুটা অনুরক্ত হয়ে পড়েন কবি। এর অন্যতম প্রমাণ নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি ফজিলাতুননেসাকে উৎসর্গ করেছিলেন।
নজরুল ইসলাম ছিলেন খেয়ালী প্রকৃতির মানুষ। ১৯৩৫ সালে কলকাতার খেলার মাঠে বন্ধুদের সাথে আনন্দ করতে গিয়ে ঝোঁকের মাথায় কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে বসলেন। গোয়ালন্দ নেমে স্টিমারে করে চলে এলেন ঢাকায়। এবারও কবি কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় ওঠেন। এ সময় বুড়িগঙ্গার তীরে রূপলাল হাউসে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বুদ্ধদেব বসু কবির সম্মানে জগন্নাথ হলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
১৯৪০ সালে ঢাকা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য কবি একই বছর ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় এসেছিলেন। এ সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তিনি সংবর্ধিত হন। বলা যায়, সুস্থ অবস্থায় এটিই ছিল ঢাকায় কবির শেষ আগমন। এরপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে নজরুল ইসলাম ঢাকায় আসেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি লিট উপাধি দেয়। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এ দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন কবি। ২১শে পদকে ভূষিত করা হয় কবিকে। এ বছরেই কবি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়