‘অনেক টার্গেট নেওয়ার পর কুত্তার বাচ্চারে শেষ করতে পারছি’
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করার পরও মৃত্যু নিশ্চিত করতে নিষ্ঠুর আচরণ করেন কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী। মৃত্যুর আগে পানি চাইলে এ দুই কর্মকর্তার কেউ তাঁকে পানি দেননি। বরং প্রথম দফায় লিয়াকত আলী গালি দিয়ে বুকে লাথি মারেন। দ্বিতীয় দফায় মৃত্যু নিশ্চিত করতে ওসি প্রদীপ নিজের পায়ের জুতা দিয়ে গলা চেপে ধরেন। ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্র থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
অভিযোগপত্রের ১৪ পাতায় বলা হয়, রাত সাড়ে ৯টার দিকে পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে নিশ্চিত মৃত্যু হবে বুঝতে পেরে ওসি প্রদীপকে ফোন করেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে ১ মিনিটি ১৯ সেকেন্ড কথা হয়। লিয়াকত আলীর সফলতার ফোন পেয়ে ওসি প্রদীপ একটি সাদা মাইক্রোবাস এবং একটি পিকআপ ভ্যানে তাঁর সঙ্গীয় ফোর্সসহ দ্রুত গতিতে রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর প্রদীপ ও লিয়াকত আলী একান্তে কিছু সময় আলাপ করেন। তারপর প্রদীপ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা মেজর সিনহার কাছে যান। তখন প্রদীপ দম্ভোক্তি করে বলেন, অনেক টার্গেট নেওয়ার পর কুত্তার বাচ্চারে শেষ করতে পারছি। তারপর প্রদীপ প্রথমে মেজর সিনহাকে পা দিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখেন। সিনহা তখনও জীবিত ছিলেন এবং পানি চাচ্ছিলেন। প্রদীপ তখন তাঁর পায়ের জুতা দিয়ে মেজর সিনহার গলা চেপে ধরেন এবং এক পর্যায়ে সিনহার শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। তখনও প্রদীপ, লিয়াকত এবং সঙ্গীয় ফোর্সের কেউই সিনহার পড়ে থাকা দেহটিকে হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ না নিয়ে ঘটনাস্থলে ফেলে রাখেন। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে (৩১)। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে (৪৮) ২ নম্বর এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে (৩০) ৩ নম্বর আসামি করা হয়। বাকি ছয় আসামি হলেন—এসআই টুটুল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মো. মোস্তফা। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫-কে। ৭ আগস্ট মামলার সাত আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা হলেন—লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ, নন্দ দুলাল রক্ষিত, মো. লিটন মিয়া, ছাফানুর করিম, মো. কামাল হোসাইন ও মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা আত্মসমর্পণ করেননি।
র্যাব তদন্তে নেমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও আট জনের সংশ্লিষ্টতা পায়। তাঁরা হলেন—ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী (৪৭), বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)। তাঁদের মধ্যে সাগর দেব বাদে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত নয় আসামির মধ্য থেকে এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে বাদ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব ২০২১ সালের ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ১৫ আসামি গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আইনের আওতায় আসেন।
অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আদালত ৩১ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন। মামলার শুনানিতে আসামিদের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।