অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ ও ইসি পুনর্গঠনের দাবি বিএনপির
আইনের শাসন, মানবাধিকার ও ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার অভিযোগে অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করেছে বিএনপি। আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেটের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে বিএনপি নেতারা এসব দাবি জানান। একই সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, বিএনপি চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ সব নেতাকর্মীর মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি জানান তারা।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি আয়োজিত এই সমাবেশে যোগ দিতে দুপুর থেকেই বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে থাকে। তালতলা মার্কেটের সামনের পুরো রাস্তায় নেতাকর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের কড়া সমালোচনা করেন।
যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন তো আজ্ঞাবহ ক্রীতদাসের চেয়েও খারাপ। সরকারকে কিছু বলতে হয় না, তার আগে বলে দেয়, খুব ভালো নির্বাচন হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, এই যে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সব জয়লাভ করেছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই নির্বাচন কমিশনকে অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত। আজকে এই জনসভা থেকে আমরা ঘোষণা করতে চাই, অবিলম্বে এই নির্বাচন কমিশনকে পদত্যাগ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন নতুন করে যোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা গঠন করতে হবে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীদের কথা উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা কি ভোট দিতে গেলে ভোট দিতে পারি? এই যে আমাদের ছয়জন মেয়র প্রার্থী এখানে বসে আছেন, তারা কেউ ভোট করতে পারেননি। তাদের ভোটের দিন সবাইকে বের করে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে এবং সন্ধ্যা বেলা তাদের পছন্দমতো ফলাফল ঘোষণা করেছে।’
বিএনপির এ নেতা বলেন, এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নয়, সেই ২০১৮ সালের আগে থেকে ২০১৪ সালে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনেও আরেকটি নির্বাচন কমিশন তারাও ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঘোষিত করেছে। আমরা সেই নির্বাচনে অংশ নেইনি। আবার ২০১৮ সালে কৌশল পরিবর্তন করে আগের রাত্রে ভোট ডাকাতি করে নিয়েছে। লজ্জা হয়, চিফ ইলেকশন কমিশনার যখন বলেন যে, ভোট সুন্দর হয়েছে, সুষ্ঠু হয়েছে। অথচ তারই একজন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সাহেব তিনি খুব পরিষ্কার করে বলেছেন, এই নির্বাচন কমিশন ভোট গ্রহণ করার, ভোট পরিচালনা করার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার যোগ্য নয়।
নির্বাচনের প্রতিবাদ জানাতে বিভিন্ন মহানগরীতে সমাবেশ করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘কেন এতো ভয়? জনগণের যে কথা বলার অধিকার সেই অধিকার বন্ধ করে দেওয়া কেন? জনগণের ভোট দেওয়ার যে অধিকার সেই অধিকার বন্ধ করে দেওয়া কেন? কারণ আমরা জানি জনগণ যদি ভোট দেয়, ভোট দিতে পারে, তাহলে আপনারা কোনোদিনই আর ক্ষমতায় আসতে পারবেন না।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এই সরকার খুব দুর্বল সরকার। এতো দুর্বল যে তাদের নিজেদের রক্ষা করার জন্য নতুন নতুন আইন তৈরি করতে হয়। এই যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করেছে। এই যে আপনারা মোবাইল বলেন, ফেসবুক খোলেন-এগুলো ওরা নিয়ন্ত্রণ করে, মনিটর করে। কে কোথায় কী বলে না বলে ওইগুলো দেখে। তারা যন্ত্র নিয়ে এসেছে ইসরায়েল থেকে, যে দেশের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নাই। যেটা আবার আল জাজিরা টেলিভিশন প্রচার করে দিয়েছে। কী ভয়াবহ প্রচার। সেই প্রচারে আমরা বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম আমাদের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস বলেছেন, লেখালেখি করা ভালো কিন্তু রাষ্ট্রের ইমেজ নষ্ট হয়-এটা আমরা মেনে নেব না। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে যে, অবশ্যই আমাদের জানাতে হবে যে, কোন কাজে রাষ্ট্রের ইমেজ নষ্ট হয়। লেখালেখি করলে রাষ্ট্রের ইমেজ নষ্ট হয়। সেজন্য মুশতাক আহমেদকে কারাগারে মৃত্যুবরণ করতে হয়। আর সেজন্য কার্টুনিস্ট কিশোরের সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করা হয়, তার মাথার মধ্যে রক্তপাত হয়। সেখানে ইমেজ নষ্ট হয় না রাষ্ট্রের? আমরা যখন দেখি প্রায় ৭০০ লেখক, তারা লেখালেখি করার জন্য এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটকা পড়ে আছেন, তখন রাষ্ট্রের ইমেজ নষ্ট হয় না?
বিএনপির এ শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আমরা যখন দেখি যে, আমেরিকাতে ১০ জন সিনেটর তারা সিনেটে চিঠি দিচ্ছে বাংলাদেশে আইনের শাসন নেই, বাংলাদেশে বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড হয়, বাংলাদেশে বিনা বিচারে মানুষকে আটক রাখা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয় চরমভাবে, তখন ইমেজ নষ্ট হয় না? যখন সাত সাতটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বিবৃতি দেয়-বাংলাদেশে মানুষের মানবাধিকার নেই, লঙ্ঘিত হচ্ছে অন্যায়ভাবে, এখানে হয়রানি-নিপীড়ন করা হচ্ছে, তখন ইমেজ নষ্ট হয় না?
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের ঢাকা সফরকালে সীমান্ত হত্যা নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রতিবাদও জানান বিএনপির মহাসচিব। বলেন, সীমান্ত হত্যা নিয়ে এই সরকারের এতো দুর্বলতা কেনো? কেনো সে নিজের নাগরিকের কথা বলতে ভয় পায়। কেনো কানেকটিভি ওরা চায়? আমরা চাই যে, কানেকটিভি হোক। বাণিজ্য বাড়ুক, প্রসার ঘটুক। কিন্তু আমি কিছুই পাব না, আমি পোর্ট দিয়ে দেব, আমার এয়ারপোর্ট ব্যবহার করতে দেব, আমার রাস্তা ব্যবহার করতে দেব কিন্ত বিনিময়ে আমি ফেনী নদীর পানিরও হিস্যা পাব না, তিস্তা নদীর পানিরও হিস্যা পাব না। এটা হতে পারে না। সেখানে আমরা স্বাধীন কোথায়?
সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার পরিবেশ তৈরি করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানান ফখরুল।
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, এ এলাকা এক সময় আমার নির্বাচনী আসন ছিল। ঢাকা-৬ আসনের নির্বাচনী এলাকা ছিল। আমাকে ফেল করানোর জন্য এটার একটা অংশকে উত্তরের সঙ্গে, আরেকটা দিল দক্ষিণের সাথে। এটা এ সরকারের ষড়যন্ত্রের অংশ। এ সরকার ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই বুঝে না।
মির্জা আব্বাস বলেন, অবৈধ নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নৈশ ভোটের বৈধতা দিয়েছে। এ অবৈধ সরকার গুম, খুন শুরু করেছে অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। আমরা এ নির্বাচন কমিশনকে বলব, সরকারের গুম, খুনের ভাগ আপনাদেরও নিতে হবে। আওয়ামী লীগের আগে এ নির্বাচন কমিশনের ভোট বিচার হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আজ ভোট চোরদের তালিকা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমেরিকার ১০ জন সিনেটর ভোট চোরদের তালিকা করে তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতিসংঘের কাছে চিঠি লিখেছে।
আমীর খসরু বলেন, বিজিবিকে বলব, আপনারা সীমান্তে ফিরে যান, ভোট চুরির সহযোগী হবেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলব, আপনারা জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে ভোট চোরদের সহযোগিতা করবেন না আর। সব কিছুর এক্সপায়ার ডেট আছে, ভোট চোরদেরও সময় শেষ হয়ে গেছে।
বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশারাক হোসেন বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে আমি আপনাদের বলতে চাই, তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠেছে। আমরা এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মেনে নেব না। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, এই আন্দোলন-সংগ্রাম সফল করতে এই রক্ষী বাহিনীর পতন ঘটাতে প্রথম বুলেটটা নেওয়ার জন্য আমার বুক পেতে দেব। পেছনের দিক দিয়ে পালিয়ে যাব না।