করোনাকালে চোরা শিকারিদের কবলে সুন্দরবন
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/05/16/sundorban.jpg)
বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ ও সুন্দরী বৃক্ষ। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে সম্প্রতি সুন্দরবনের বাঘ ও হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। হ্রাসও পেয়েছিল সুন্দরী গাছ পাচার। কিন্তু চলমান করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবে নদ-নদী ও রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু ও চোরা শিকারিরা সুন্দরবনে মেতে উঠেছে হরিণ শিকার এবং গাছ পাচারে।
শুধু বন্যপ্রাণীই নয়, বনের সুন্দরি, পশুর গাছ নিধনসহ বিষ দিয়ে মাছ শিকারের মহোৎসব চলছে বনের ভেতরের নদী-খালে। সংঘবদ্ধ বৃক্ষচোর, বিষ প্রয়োগকারী দুর্বৃত্ত ও চোরা শিকারিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবনে রেড এলার্ট জারি করে টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
সুন্দরবনকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। বাগেরহাট জেলার শরণখোলা রেঞ্জ ও চাঁদপাই রেঞ্জ নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ। আর পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগে রয়েছে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকা। এর মধ্যে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে মাত্র ৩৬ দিনের ব্যবধানে পুলিশ ও বনরক্ষীরা অভিযানে চালিয়ে চোরা শিকারিদের কবল থেকে ২৪টি জীবিত হরিণ, ৭৯ কেজি হরিণের মাংস, নাইলনের দড়ির ছয় হাজার ৬০০ ফুট হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ করেছে। এ সময়ে সাতজন চোরা শিকারিকে আটকসহ তাদের কাজে ব্যবহৃত চারটি ট্রলার ও দুটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে।
সুন্দরবন বিভাগ জানায়, গত ৫ মে সুন্দরবনে পাথরঘাটার চরদোয়ানী এলাকার শীর্ষ তালিকাভুক্ত চোরা শিকারি মালেক গোমস্তা তাঁর দল নিয়ে অবৈধপথে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের শেলারচর-কোকিলমণি এলাকায় ঢুকেছে। এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বনবিভাগ অভিযান চালিয়ে টিয়ারচর থেকে ভোর রাতে হরিণ শিকারকালে তিন চোরা শিকারিকে আটক করে। এ সময় শিকারিদের বনের ভেতর পেতে রাখা ফাঁদে আটকে থাকা জীবিত ২২টি চিত্রল হরিণ উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা হয় ৩০ কেজি হরিণের মাংস, ৭০০ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ, তিনটি ট্রলার ও একটি নৌকা। পরে উদ্ধারকৃত ২২টি হরিণ সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়।
এই মালেক গোমস্তা বন বিভাগের হাতে আটক হয়ে মাত্র এক মাস আগে কারাগার থেকে ছাড়া পান।
গত ২ মে শরণখোলা রেঞ্জের ডিমেরচর থেকে দুপুরে হরিণ শিকারের প্রস্তুতিকালে দুই চোরা শিকারিকে আটক করে বন বিভাগ। এ সময় হরিণ শিকারের জন্য বনের ভেতর পেতে রাখা এক হাজার ৫০০ ফুট নাইলনের দড়ির ফাঁদ ও একটি ট্রলার জব্দ করা হয়।
গত ২৭ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারি স্টেশনের বনরক্ষীরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ঢাংমারি থেকে তিন কেজি হরিণের মাংসসহ এক চোরা শিকারিকে আটক করে। গত ২৫ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের বাদামতলা খাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুই হাজার ৭০০ ফুট নাইলনের দড়ির হরিণ ধরা ফাঁদ জব্দ করে বন বিভাগ।
গত ২৪ এপ্রিল ভোরে সুন্দরবন সংলগ্ন সোনাখালী গ্রামের বাদল মোল্লার পুকুরপাড় থেকে এলাকাবাসী একটি হরিণ ধরে মঠবাড়িয়া থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ বনবিভাগকে খবর দিলে তারা মাদী হরিণটি উদ্ধার করে ওই দিন বিকেলে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ সংলগ্ন বনে অবমুক্ত করে।
এদিকে গত ২৩ এপ্রিল দুপুরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শরণখোলা স্টেশন অফিসের বনরক্ষীরা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়ি সংলগ্ন মাঠে কর্কশিটে রাখা পাচারের অপেক্ষায় থাকা ১০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে। তবে কোনো পাচারকারীকে আটক করতে পারেনি।
গত ২২ এপ্রিল একই উপজেলার শাপল বাজার ইউনিয়নের বলেশ্বর নদের পার হয়ে লোকালয়ে আসার সময় সুন্দরবনের প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির বারকিং ডিয়ার (মায়া হরিণ) দুলাল নামের এক জেলে উদ্ধার করেন। বনবিভাগ ওই হরিণটি বিকেলে শরণখোলা রেঞ্জ সংলগ্ন বনে অবমুক্ত করে।
অপরদিকে, গত ১৭ এপ্রিল শরণখোলা রেঞ্জের চান্দেশ্বর এলাকায় বনরক্ষীরা অভিযান চালিয়ে ৭০০ ফুট, ১০ এপ্রিল কচিখালী এলাকায় ৫০০ ফুট এবং গত ২৮ মার্চ একই রেঞ্জের চরখালী এলাকা থেকে ৫০০ ফুট হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ কনরে। তবে কোনো চোরা শিকারিকে আটক করতে পারেননি।
৩০ মার্চ সুন্দরবন বিভাগ এবং পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে সুন্দরবন থেকে শিকার করে নৌকায় লোকালয়ে ফেরার সময় চাঁদপাই রেঞ্জের সুন্দরবন সংলগ্ন চটেরহাট এলাকার নিত্তিখালী খাল থেকে ৩৬ কেজি হরিণের মাংসসহ এক শিকারিকে আটক করে। এ সময় একটি নৌকা জব্দ করা হয়।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মৎস্যজীবী ও বনজীবীরা জানায়, চোরা শিকারির সংঘবদ্ধ চক্র সুন্দরবনের গভীরে হরিণের আবাসস্থল এলাকায় অবস্থান নেয়। কখনো ট্রলারে, কখনো নৌকায় আবার কখনো বনের গাছে মাচা বেঁধে হরিণের গতিবিধি লক্ষ করে। শিকারিরা রাতে বিশেষ করে কৃষ্ণপক্ষের রাতে জঙ্গলে বেশি হানা দেয়। সুন্দরবনে যে অঞ্চলে কেওড়া গাছ বেশি জন্মে, হরিণের আনাগোনা সেখানে সবচেয়ে বেশি থাকে। ভোরে অথবা পড়ন্ত বিকেলে কিংবা চাঁদনি রাতে হরিণ চরাঞ্চলে ঘাস খায়। শিকারিরা ও হরিণের এই স্বভাব বুঝে সুন্দরবনে অবস্থানের পরিকল্পনা আঁটে এবং জীবন বাজি রেখে রাতের আঁধারে গহীন অরণ্যে নামে। সুযোগ বুঝে তারা গুলি করে কিংবা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। পরে গোপন আস্তানায় বসে মাংস বানানো হয়। পরে তা বিক্রি করা হয় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে। এক কেজি হরিণের মাংস ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়।
সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা, দাকোপ, রায়েন্দা, তাফালবাড়িয়া, পাথরঘাটা, মঠবাড়িয়াসহ বনের আশপাশ এলাকায় হরিণের মাংস বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া শিকারিরা জ্বাল দেওয়া বা বরফ দেওয়া মাংস, জীবিত হরিণ ও হরিণের চামড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার করে থাকে। আবার কার্যসিদ্ধির জন্য টিপস হিসেবেও হরিণের মাংস বা চামড়ার রয়েছে বহুল ব্যবহার। অনেকে আবার ড্রইংরুমের শোভাবর্ধন করে হরিণের চামড়া দিয়ে। চোরাইপথে হরিণ শিকার এবং মাংস, চামড়া ও জীবন্ত হরিণ পাচারের নেপথ্যে যেসব রাঘববোয়াল জড়িত তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে না পারলে বিরল প্রজাতির এই হরিণ অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবন বিভাগসহ প্রশাসনের কঠোর নজরদারির কারণে এরই মধ্যে সুন্দরবন থেকে বেশ কিছু হরিণ ও হরিণ ধরার ফাঁদ, হরিণের মাংস জব্দ করা হয়েছে। উদ্ধারের ঘটনায় বন আইনে মামলাও করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শিকারিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবনে রেড এলার্ট জারি করে বন বিভাগের টহল জোরদার করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেও বনরক্ষীরা বনজ সম্পদ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।’