করোনা মহামারি থেকে রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর ৪ দফা প্রস্তাব
করোনাভাইরাস মহামারি থেকে রক্ষায় চার দফা প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে উন্নত বিশ্ব ও উন্নয়ন অংশীদারদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আজ সোমবার জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন-এসকেপ-এর ৭৭তম অধিবেশনে রেকর্ড করা ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে চলমান সংকট থেকে কিভাবে আরও ভালোভাবে উত্তরণ সম্ভব তার-ই উপায় খুঁজতে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে এসকেপের চার দিনের এ ভার্চুয়াল অধিবেশন।
প্রথম অধিবেশনে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে এসকেপের এ আয়োজনে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরেন করোনা মোকাবিলায় তাঁর সরকারের অবস্থান। বিশ্ববাসীকে তিনি জানান, অর্থনীতি সচল রেখে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। চলমান সংকট উত্তরণে চার দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি। কোভিড-১৯ মহামারি থেকে দ্রুত পুনরুদ্ধারে উন্নত বিশ্ব ও উন্নয়ন অংশীদারদের ভূমিকা জোরদারের আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পারস্পরিক সমৃদ্ধিতে আঞ্চলিক সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর টেকসই প্রত্যাসনের কার্যকর সমাধান বের করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এ সময় আহ্বান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম প্রস্তাবে বলেন, উন্নত বিশ্ব, উন্নয়ন অংশীদার এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইএফএস) কোভিড মহামারি থেকে দ্রুত পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসা উচিত।
দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন পদ্ধতি হওয়া উচিত যে কোনও সংকট থেকে আরও ভালোভাবে উত্তরণের জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিস্থাপক এবং পরিবেশবান্ধব।
শেখ হাসিনা তাঁর তৃতীয় প্রস্তাবে বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচিত একটি শক্তিশালী ও সার্বজনীন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য দক্ষ নীতি ও কৌশল গ্রহণ করা।
চতুর্থ ও চূড়ান্ত প্রস্তাবে বলেন, বাণিজ্য, পরিবহণ, জ্বালানি ও আইসিটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, মিয়ানমার থেকে ১১ লাখেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে টেকসই প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে একটি কার্যকর সমাধানের জন্য এই বিষয়ে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করেছে।
প্রায় দুই দশমিক ৯৫ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে এবং প্রতিদিন আরও হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহামারি অনেক মানুষকে আরও দরিদ্র করে তুলেছে এবং আরও অনেকে দারিদ্র্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
কোভিড-১৯-এর আক্রমণ মোকাবিলায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি, চাকরি ধরে রাখা এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের জিডিপির প্রায় চার দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রায় ১৪ দশমিক ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমাদের সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কোভিড-১৯ থেকে পুনরুদ্ধার এবং বাংলাদেশকে অবাধ ও টেকসই এলডিসি গ্রাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত করা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলার দিকে গতিপথ নির্ধারণের কৌশল অন্তর্ভুক্ত ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকার পরিবেশ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে অর্থায়নে পরিচালিত কর্মসূচিগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতাকে পারস্পরিক সমৃদ্ধি অর্জনে সর্বাধিক টেকসই উপায় বলে মনে করে। আমরা সার্ক (সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন), বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনোমিক কোঅপারেশন), বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল), বিসিআইএম-ইসি (বাংলাদেশ, চায়না, ইন্ডিয়া ও মিয়ানমার ইকোনোমিক কোরিডোর) এবং ট্রিলেটারেল হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত আছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সাউথ-সাউথ নেটওয়ার্ক ফর পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন’ বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে সহায়তা করছে। আমরা ক্রমবর্ধমান যোগাযোগ এবং এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের ইএসসিএপি-এর উদ্যোগের একনিষ্ঠ সমর্থক।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত কাগজ-বিহীন বাণিজ্য, এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্য চুক্তি, পিপিপি নেটওয়ার্কিং ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ ইউএন-ইএসসিএপি-এর অন্যান্য উদ্যোগের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে জড়িত আছে। আমরা গ্লোবাল কম্প্যাক্ট ফর সেফ, অর্ডারলি অ্যান্ড রেগুলার মাইগ্রেশন অর্জনে অঙ্গীকারাবন্ধ।
এসকেপ ইউনাইটেড নেশনস ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের এখতিয়ারভুক্ত পাঁচটি আঞ্চলিক কমিশনের অন্যতম। এই কমিশন ৫৩ সদস্য ও নয় সহযোগী সদস্য নিয়ে গঠিত। সদস্যদের অধিকাংশই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো ছাড়াও ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রও কমিশনের সদস্য রাষ্ট্র।
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ গনি, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো ইউদোদো, কিরিবাতির প্রেসিডেন্ট তানেতি মামুয়া, কির্গিজ রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারোভ, মার্শাল আইল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ডেভিড কাবুয়া, মঙ্গোলিয়ার প্রেসিডেন্ট বাতুলগা খালতমা, তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রাহমোন এবং তুভালুর প্রধানমন্ত্রী ও প্যাসিফিক আইল্যান্ড ফোরামের চেয়ার কাউসেয়া নাতানো অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রেখেছেন।
এর আগে উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য দেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতারেস, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল প্রায়উত চ্যান-উ-চা (অব.), জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ইএসসিএপির নির্বাহী সচিব আর্মিদা সালসিয়াহ আলিসজাহবানা, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনের সভাপতি ভলকান বোজকির, ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশাল কাউন্সিলের সভাপতি মুনির আকরাম।
উদ্বোধনী অধিবেশনে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী সামদেক আক্কা মহা সেনা পাদেই টেকো হুন সেন, ফিজির প্রধানমন্ত্রী জোসাইয়া ভোরেক বাইনিমারামারা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে এবং উজবেকস্তানের প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আরিপোভ ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন।