চট্টগ্রামে গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার, স্বামী কারাগারে
চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় বিয়ের সাত মাসের মধ্যে রহস্যজনকভাবে গৃহবধূ ফারজানা খানমের মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার বিকেলে নগরীর বায়েজিদ থানার চক্রেশো তিন নম্বর রোডে শ্বশুড়বাড়ির বাসা থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় ফারজানার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ফারজানার এ অস্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না তার পরিবারের সদস্যরা। তাদের দাবি, বিয়ের মেহেদির রং মুছে যাওয়ার আগে নানামুখী নির্যাতন ও নির্মমভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে পর্দানশীল ফারজানা খানমকে। মৃত্যু নিশ্চিত করে শ্বশুড়বাড়ির লোকজন ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছে তার লাশ।
বায়েজিদ থানা পুলিশ জানিয়েছে, নিহত ফারজার লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে এলে প্রকৃত ঘটনা নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে শ্বশুড়বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, সেটি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। লাশটি ফ্যানের সঙ্গে ঝুলানো অবস্থায় ছিল। ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলে যেসব আলামত থাকে সেসব কোনো প্রমাণ মেলেনি লাশে।
ঘটনার পর রৌফাবাদের পাহাড়িকা আবাসিক এলাকার নুরজাহান ম্যানসনটির চর্তুদিকে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ফারজানা খানমের জন্য শোকাহত মানুষগুলো তাকে কখনো দেখেনি। কারণ ছোট বেলা থেকে পর্দানশীল ফারজানার এলাকায় এক অন্যরকম পরিচিতি ছিল।
ভবনের এক বাসিন্দারা বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এ ভবনে ভাড়া থাকি। কোনো দিন সরাসরি দেখিনি তাকে। এমন ধার্মিক মেয়েকে নির্যাতন করে হত্যার পর তা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া কোনোভাবে কাম্য নয়।
নিহত ফায়জানার বাবা পাহাড়িকা আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির সভাপতি জেবল হোসেন বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কোনো আত্মীয়স্বজন এলে ছোট বাচ্চার মতো কেঁদে ফেলছেন। তিনি জানান, তার বড় মেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত। তার দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ও ছোট ছেলে কোরানের হাফেজ। বিয়ের সাত মাসের মাথায় নির্যাতন করে তার মেয়ের মৃত্যু হলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
চলতে বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ফারজানার বিয়ে হয়। তিনি মছদ্দিয়া মাদ্রাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার মেয়ে পরহেজগার ছিলেন। পর্দা করে চলাফেরা করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। বিয়ের দিন মানুষ দেখবে, এ জন্য তিনি ক্লাবে পর্যন্ত যাননি। বর পক্ষের লোকজন বাসা থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়েছে। ক্লাবে ফারজানার বাবা দুই হাজার মানুষ খাইছেন।
নিহত ফারজানার চাচা জমির উদ্দীন বলেন, ছোটবেলা থেকে আমি তাদের মাদ্রাসা ও হেফজখানায় গাড়িতে করে নিয়ে যেতাম। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা পর্দা করে চলাফেরা করত। সে কোনোভাবে আত্মহত্যা করতে পারে না। ধর্মীয় বিধিবিধান ও অনুশাসন মেনে চলা মানুষগুলো কখনো আত্মহত্যা করবে না। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ননদ পরিকল্পিতভাবে আমাদের মেয়েকে হত্যা করে নাটক সাজিয়েছে।
নিহত ফায়জার মা খুরশিদা বেগম শোকে পাথর হয়ে গেছেন। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, কত শখ করে মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। গত রোজার ঈদে মেয়ে জানায়, তাদের কাপড় না দিয়ে টাকা দিতে। তাই জামাইবাবুর হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছি। কোরবানির ঈদে মেয়েকে দেওয়ার জন্য গরু কিনেছি। পাঠানোর আগে গরু না দিতে জামাই অনুরোধ করেন। যেন টাকা পাঠিয়ে দেই। মূলত মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের দুটি ভবনসহ সম্পদ ও যৌতুকের জন্য মেয়েকে নির্যাতন করত। মেয়ে আমাদের কখনো বলেনি।
মেয়ের চাচাশ্বশুর মো. রফিক জানান, ছেলে শুক্রবার ছুটির দিনে কাপ্তাই যায়। এ নিয়ে বউয়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। পরে বেডরুম থেকে বৌমার লাশ উদ্ধার করি। তাদের মতে, বৌ আত্মহত্যা করেছেন। তবে তিনি আর তেমন কিছু জানেন না। পারিবারিক অশান্তি বা সমস্যা ছিল কি না, সে বিষয়ে তিনি অবগত নন।
বায়েজিদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খোরশেদ আলম জানান, প্রাথমিক তদন্তে ফারজানার রহস্যজনক মৃত্যুর প্রমাণ মিলেছে। তাই স্বামী ইকবাল কবির রকিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শ্বশুর, শাশুড়িসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা পলাতক। রকিকে রিমান্ডে আনার আবেদন করা হয়েছে। তাদের মোবাইল ফোনসহ প্রয়োজনীয় জিনিস সিজ করা হয়েছে। আগামীকাল আদালত রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান জানান, ঘটনার পর গৃহবধূ ফারজানার লাশ আমরা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এলে মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য বের হয়ে আসবে। আর স্বামী ইকবাল কবির রকিকে রিমান্ডে আনা গেলে প্রকৃত তথ্য জানা যাবে।