‘ছেলের লাশটা একটু দেখাও, লিস্টে নাম আছে’
কয়েকদিন আগে বিয়ে হয়েছিল চাঁদপুরের জজকোর্ট এলাকার বাসিন্দা মোস্তফা কামালের (৩৭)। নারায়ণগঞ্জে টিউশনি করে চলতেন তিনি। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে লকডাউনের সময় ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জ আসেন তিনি। গতকাল শুক্রবার রাতে ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুল সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন।
মসজিদে গ্যাসের লিকেজ থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের (এসি) বিস্ফোরণে কামাল এখন লাশ হয়ে পড়ে আছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। তাঁর দগ্ধ লাশ দেখার অপেক্ষায় আছেন বৃদ্ধ বাবা আবদুল করিম মিয়াজী (৭৫)। টেলিভিশনে নারায়ণগঞ্জের ঘটনা শুনে আজ সকালে তাঁর বড় ছেলে মোস্তফা কামালের (৩৭) মৃত্যুর সংবাদ শুনে মেজ ছেলেকে নিয়ে চাঁদপুর সদর থেকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ছুটে আসেন। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন হলো আমার ছেলে বিয়ে করেছিল। বিয়ের কয়েক দিনের মাথায় এই অবস্থা আল্লাহ কেন করল?’
আজ সকালে হাসপাতালের অভ্যর্থনা কক্ষে বসে মোস্তফা কামালের বাবা বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে টিউশনি করত আমার ছেলে। আমার ছেলের লাশটা একটু দেখাও, নিহতদের লিস্টে আমার ছেলের নাম আছে।’ এই বলে ভেঙে পড়েন এই বৃদ্ধ বাবা।
আবদুল করিম মিয়াজী বলেন, তাঁর তিন ছেলের মধ্যে মোস্তফা কামাল সবার বড়। লকডাউনের পুরো সময়টা মোস্তফা বাড়িতেই ছিল। ১৫ দিন আগে তিনি এসেছেন। সে নারায়ণগঞ্জে টিউশনি করতেন। ‘শুনছি ছেলে মারা গেছে। ছেলের লাশটা একটু আমাকে দেখান, তাও দেখায় না। আমি এখন কী করব? কোথায় যাব? কার কাছে যাব? কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বলছিলেন আবদুল করিম মিয়াজী।
নারায়ণগঞ্জে তুলা ও কাগজের ব্যবসা করতেন খুলনার ফুলবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেন (৫৫)। কাজ শেষ করেই বাসায় ফিরেন তিনি। গতকাল এশার আজানের পর বায়তুস সালাত জামে মসজিদে নামাজ পড়তে যান। নামাজ শেষ হওয়ার আগেই দগ্ধ হয় পুরো শরীর।
এক স্বজনের কাছে খোঁজ পেয়ে তাঁর স্ত্রী শেফালী বেগম ছুটে এসেছেন খুলনা থেকে। স্বামীর পোড়া শরীর দেখে ভেঙে পড়েন তিনি। বিলাপ করে কাঁদছেন আর বার বার মেঝেতে শুয়ে পড়ছেন। তাঁর চিৎকারে ভারি হয়ে উঠেছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট।
আজ বেলা ১১টার দিকে এনটিভি অনলাইনকে শেফালী বেগম বলেন, ‘ঈদের পর কিছুদিন আগেই মনির হোসেন নারায়ণগঞ্জে যান। পরিবারে তিনটি মেয়ে রয়েছে। উপার্জন করার মতো আর কেউ নেই। আমি কীভাবে বাঁচব? আল্লাহ আমার বাচ্চাদের কে দেখবে?’
পাশে থাকা এক স্বজন বার বার শেফালী বেগমকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। এভাবে শুধু শেফালী বেগম নন বার্ন ইনস্টিটিউটে স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহীম (৫০)। এশার নামাজ পড়তে তিনিও গতকাল রাতে মসজিদে যান। তাঁর বড় ছেলে ফয়সালও মসজিদে ছিলেন। ছেলে নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে ১০০ গজ দূরে যান। এর মধ্যে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। হঠাৎ তাঁর বাবার কথা মনে পড়ে। দৌড়ে মসজিদের সামনে যান।
ফয়সাল বলেন, ‘মসজিদের সামনে গিয়ে দেখলাম থাইগ্লাস ভেঙে আগুনের গোলা বের হচ্ছে। আগুনের গোলার সঙ্গে মানুষও বের হয়ে আসছে। দুইবার আগুনের গোলা বের হয়েছে। এরপর দেখি বাবাও রাস্তায় পড়ে আছে। দাড়ি, চুল, কাপড় সব পুড়ে গেছে, কিছু নেই। দ্রুত তাঁকে নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে আসি।’