ঢাকাবাসীকে মশা থেকে মুক্তি দিতে কাজ করছে দুই সিটি করপোরেশন, এক মন্ত্রণালয়
‘মশার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় মশারির ভেতরে বসে থাকতে বাধ্য হই,’ বলেন পুরান ঢাকায় বসবাসকারী ইসমাইল হোসেন নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী।
মশা তাড়ানোয় কয়েলও তেমন কাজ করে না। মশা নিধনে কয়েল ছাড়াও ইলেকট্রিক বিভিন্ন মেশিন ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, যা ব্যয়বহুল। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান ইসমাইল হোসেন।
মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ ঢাকার দুই সিটির (উত্তর ও দক্ষিণ) বাসিন্দারা। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার মশার উপদ্রব খুব বেড়েছে।
ঢাকার দুই সিটির বসবাসকারী বেশ কয়েকজন নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া যায়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পল্টন এলাকায় বসবাস করেন সরকারি কর্মচারী কামাল হোসেন। তিনি বলেন, আগে রাতে মশার উপদ্রব ছিল। এখন দিনে-রাতে সবসময় মশার যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে। তবে দিনের চেয়ে রাতে মশার উপদ্রব বেশি।
ঢাকা দক্ষিণে প্রচুর মশা বৃদ্ধি পেয়েছে। মশা নিধনে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, ‘আগামী দুই সপ্তাহ পর থেকে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা করছি।’
‘ঢাকাবাসীকে আমরা একটু ধৈর্য ধারণ করতে অনুরোধ করছি,’ বলেন মেয়র তাপস। ‘আমরা কৌশল পরিবর্তন করেছি। এখন আমরা যে কার্যক্রম নিচ্ছি, আমাদের সকালের কার্যক্রম চার ঘণ্টা চলছে, বিকেলের কার্যক্রম আমরা আরও বৃদ্ধি করেছি। সুতরাং আমরা আশাবাদী, আগামী দুই সপ্তাহ পর থেকে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে ডেঙ্গুর জন্য আমাদের কৌশল পরিবর্তন করে আবার এপ্রিল থেকে কার্যক্রম আরম্ভ করব।’
নতুন কৌশল ও কীটনাশক কেন আগে নেওয়া হয়নি জানতে চাইলে মেয়র তাপস বলেন, ‘আমি একটি বিষয়ে পরিষ্কার করতে চাই- আমাদের বিশেষজ্ঞ যাঁরা আছেন, তাঁরা ঘটনা ঘটে গেলে অনেক বড় বড় পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু ঘটনা ঘটার আগে আমাদের কী করণীয়, আমাদের কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে রকম পরামর্শ আমরা পাই না। আমাদের বলা হয়েছিল, ডেঙ্গুর প্রকোপটা যেহেতু আছে, তাই এই কার্যক্রম ডিসেম্বর পর্যন্ত চালিয়ে নিতে হবে। কিন্তু সেই কার্যক্রমটা ভুল ছিল। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধে কার্যক্রম নেওয়া উচিত ছিল। কারণ, বিভিন্ন স্থান জলাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।’
‘আমরা যদি খালগুলো আরও দুমাস আগে পেতাম, তাহলে হয়তো বা আমরা বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম আরও বেগবান করতে পারতাম,’ বলেন তাপস।
‘তাহলে ধীরে ধীরে কিউলেক্স মশার প্রভাব কমে যেত এবং আমরা কীটনাশক পরিবর্তন করলে ফলাফল পেতাম। গত জানুয়ারি থেকে আমরা খালগুলো হতে যে বর্জ্য অপসারণ ও চ্যানেল পরিষ্কারকরণ কার্যক্রম শুরু করেছি, সেই কার্যক্রমের মাধ্যমে এরই মধ্যে প্রায় ২০ কিলোমিটার খাল হতে বর্জ্য-পলি অপসারণ করা হয়েছে। এই সময়ে আমরা প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন বর্জ্য-পলি অপসারণ করেছি।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীনে বসুন্ধরায় বসবাসকারী ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, দিনে ঘুমালেও মশারি লাগে। রাতে তো মশা শরীর থেকে দুহাত দিয়ে সরাতে হয়।
সাইফুল ইসলাম পরিতাপ করে বলেন, ‘বসুন্ধরায় সিটি করপোরেশন থেকে মশা নিধনে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে চোখে পড়েনি। একটি সুন্দর আবাসিক এলাকা কিন্তু এখন বড় সমস্যা মশার উপদ্রব।’
বারিধারা জে ব্লকে বসবাসকারী ডা. আশেক বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় মশা অনেক বেশি। মশা এখন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েলসহ ইলেকট্রিক বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করলেও মশা তেমন নিধন হচ্ছে না।
এ বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জানান, ৮ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত (শুক্রবার ব্যতীত) ডিএনসিসি এলাকায় কিউলেক্স মশা নিধনে সমন্বিত অভিযান (ক্রাশ প্রোগ্রাম) শুরু হবে। এই ক্রাশ প্রোগ্রামে ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলের সকল মশকনিধন কর্মী এবং যান-যন্ত্রপাতি একটি অঞ্চলে নিয়ে একদিন করে মশকনিধন অভিযান পরিচালনা করা হবে।
‘কিউলেক্স মশা নিধনে আমরা ইনটেন্সিভলি কাজ করবো। মশক নিধনের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা অভিযানও পরিচালিত হবে। সমগ্র ঢাকা উত্তরকে আমরা সম্পূর্ণ সুইপিং করতে চাই,’ বলেন ডিএনসিসি মেয়র।
প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত লার্ভিসাইডিং এবং বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এডাল্টিসাইডিং করা হবে। পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা অভিযানও চলবে। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগের সমন্বয়ে এই অভিযান পরিচালিত হবে। মশকনিধন অভিযান চলাকালে মেয়রসহ কাউন্সিলরেরা মাঠে থাকবেন।
নগরজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ডিএনসিসি মেয়র প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে এই অভিযান পরিচালিত হবে। এ ছাড়া খালগুলো মশার প্রজননস্থল। ডিএনসিসির উদ্যোগে খালগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। ডিএনসিসি মেয়রের একটিই নির্দেশনা, যেকোনো মূল্যে মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া ডিএনসিসির বিশেষ মশকনিধন অভিযান গত রোববার শেষ হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ও শুক্রবার ব্যতীত মোট সাতদিন এই বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। এই সাতদিনের বিশেষ অভিযানে মোট ৪৪ হাজার ৯৬৮টি সড়ক, নর্দমা, জলাশয়, স্থাপনা ইত্যাদি পরিদর্শন করা হয়। এর মধ্যে ২১০টিতে মশার লার্ভা পাওয়া যায় এবং ৩০ হাজার ১২৯টিতে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। মশার লার্ভা ও বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পাওয়া এবং অন্যান্য অপরাধে ৮৯টি মামলায় মোট ১০ লাখ ৮২ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
মশা নিধনের সার্বিক বিষয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এখন অ্যানোফিলিস ও কিউলেক্স মশা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মশাগুলো খুব বিপজ্জনক নয়। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা সবাই মিলে এই সমস্যা থেকে নগরবাসীকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ঢাকা শহরের খাল-নালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে পারলে এসব মশার উপদ্রব থেকে নগরবাসীকে অনেকাংশে মুক্তি দেওয়া সম্ভব।
মো. তাজুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর খালগুলোর ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার পাশাপাশি খালের দুপাশ অবৈধভাবে দখল করে নির্মিত সব ধরনের অবকাঠামো উচ্ছেদ করা হবে। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে দুই মেয়রকে নিয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে অনেকগুলো সভা করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।