ঢাকার দুই সিটিতে মশা মারার বাজেট বাড়ে, মশাও বাড়ে
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে চলতি অর্থবছরে মশা মারার বাজেট ১৫৩ কোটি টাকা৷ আর মশা মারতে ড্রোনের ব্যবহারও করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন৷ তারা সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই নামের এক ধনের ব্যাকটেরিয়াও আমদানি করেছে৷ তারপরও মশার দাপট কমছে না৷ উল্টো গত চার মাসে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব দ্বিগুণ হয়েছে বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে৷
এডিস মশার পর এবার এই মার্চের শুরু থেকেই কিউলেক্স মশার কামড়ে নগরবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন৷ দিনে রাতে এখন সব সময়ই মশার কামড়৷
ঢাকার মুগদা এলাকার আতিকুর রহমান বলেন, ‘‘গত এক মাস ধরে দিনে রাতে সমান মশা৷ কামড় দিলে ফুলে ওঠে ও চুলকায়৷ বাচ্চাদের দিনেও মশারির মধ্যে রাখতে হয়৷ সিটি করপোরেশনের লোকজনকে ওষুধ ছিটাতে গত এক সপ্তাহে দেখিনি৷”
কলাবাগানের জসিম উদ্দিন জানান, ‘এখন বিকেল বেলা কোথাও দাঁড়ালে মাথার ওপর মশা ওড়ে৷ নাকে মুখে ঢুকে যায়৷’
ঢাকার অন্যান্য এলাকারও একই অবস্থা৷ তবে যেসব এলাকায় ডোবা, নালা বা খাল বেশি সেখানে মশাও বেশি৷
অবশ্য দুই সিটি করপোরেশনই দাবি করছে, তারা মশা নিধনে ব্যাপক কাজ করছে এবং মশা আগের চেয়ে কম৷
মশার ঘনত্ব দুই গুণ হয়েছে
গবেষণা বলছে, এখন ঢাকায় কিউলেক্স মশার ঘনত্ব ৯৯ ভাগ৷ এর মানে হলো ১০০টি মশার মধ্যে ৯৯টি কিউলেক্স মশা৷ আর গত চার মাসে এই ঘনত্ব বেড়েছে দ্বিগুণ৷ কিউলেক্স মশা ড্রেন, নর্দমা, ডোবা ও ময়লা পানিতে বংশ বিস্তার করে৷ এই মশার কামড়ে ফাইলেরিয়া রোগ হতে পারে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার৷
অধ্যাপক কবিরুল বাশারের নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ঢাকার ছয়টি স্পটে ১২টি ফাঁদের মাধ্যমে মশা সংগ্রহ করছে৷ নভেম্বরে গড়ে প্রতিটি ফাঁদে ২০০টি করে মশা ধরা পড়েছে৷ ডিসেম্বরেও গড় সংখ্যা মোটামুটি একই ছিল৷ তবে জানুয়ারি থেকে এ সংখ্যা ৩০০ হয়ে যায়৷ ফেব্রুয়ারিতে ৩৮৮ ও চলতি মার্চে এই সংখ্যা ৪২০টিতে ঠেকেছে৷ ঘরের ভেতর ও বাইরে আলাদা দুটি ফাঁদে সপ্তাহে একবার করে মাসে চারবার মশা সংগ্রহ করে হিসাব করে গড় বের করা হয়৷ গবেষণায় গড়ে প্রতি ফাঁদে মিলছে ৪২০টি মশা৷ সবচেয়ে বেশি উত্তরা ও দক্ষিণখান এলাকায় গড়ে ৫০০ মশা ধরা পড়েছে৷
কবিরুল বাশার বলেন, ‘‘গত বছরের তুলনায় এই সময়ে মশা বেড়েছে কী না তা তুলনা করার জন্য কোনো পরিসংখ্যান আমার কাছে নাই৷ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে ২০ ভাগ মশা বেড়েছে৷ আর সাধারণভাবে নাগরিকেরা মশা বাড়ার কথা বলছেন৷ ঢাকার ড্রেন ও নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার না করার ফলে মশা বেড়েছে৷ আর মশা ও মশার লার্ভা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না৷”
যা বলছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
অবশ্য এই গবেষণার সঙ্গে একমত নন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির৷ ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘‘গবেষণায় কী পাওয়া গেছে তা গবেষকের ব্যাপার৷ তার গবেষণার সাথে আমি একমত নই৷ মার্চ মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় মশক পরিস্থিতি যেকোনো বছরের তুলনায় ভালো এবং পরিস্থিতি আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে৷ বিচ্ছিন্নভাবে আমরা দুই-একটি এলাকা থেকে অভিযোগ পাচ্ছি৷ সেখানে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি৷ আর আমরা কিউলেক্স মশার প্রজনন ক্ষেত্র ড্রেন, নর্দমা, ডোবা, খাল নিয়মিত পরিষ্কার রাখছি৷ এছাড়া সকালে মশার লার্ভা নিধনের জন্য লার্ভিসাইট, বিকেল বেলা উড়ন্ত মশা নিধনের জন্য নিয়মিত ফগিং করছি৷”
আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, “কবিরুল বাশার ছাড়া আর কেউ তো মশা নিয়ে গবেষণা করেন না৷ ফলে তার গবেষণা তো আমাদের তুলনা করার সুযোগ নাই যে মশা বেড়েছে না কমেছে৷ তবে সাধারণভাবে দেখলে এটা তো অস্বীকার করার উপায় নাই যে মশা বেড়েছে৷”
ইমরুল কায়েস চৌধুরী আরও বলেন, “মশা নিধনে আমাদের নানা ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে৷ তবে এর সঙ্গে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ও খাল বিলের সম্পর্ক আছে৷ আমাদের উত্তর সিটি করপোরেশনে তিন হাজার বিঘার মতো জলাশয় আছে৷ এগুলোর অধিকাংশ রাজউক, পিডিবিসহ আরও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের৷ যেগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা তাদের দায়িত্ব৷”
খরচ বাড়ে, মশাও বাড়ে
ঢাকার দুই সিটির চলতি অর্থবছরে মশা মারার বাজেট ১৫২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা৷ এরমধ্যে উত্তরের ১২১ কোটি ৮৪ লাখ আর দক্ষিণের ৩১ কোটি এক লাখ টাকা৷ আর গত ১২ বছরে ঢাকার মশা মারার আয়োজনে খরচ হয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা৷ এই বাজেটের টাকা মশা নিবারণের নানা যন্ত্রপাতি, কীটনাশসহ আরও অনেক কাজে ব্যয় হয়৷
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ১০টি অঞ্চলে ৭৫টি ওয়ার্ড৷ মশানিধনে ১৫০ জন মশক সুপারভাইজারসহ এক হাজার ৫০ জনবল কাজ করছে৷ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০টি অঞ্চলে মোট ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে৷ এখানে ৭৫ জন মশক সুপারভাইজারসহ প্রায় ৬০০ জনবল আছে৷
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘‘কার্যকর মশা নিধনের দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের৷ তারা যদি যৌথ এবং সমন্বিতভাবে এই কাজটি করতো তাহলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যেত৷ তাদের কৌশলগত পরিকল্পনা দরকার৷ পাশাপাশি দরকার নগরবাসীকে সম্পৃক্ত করা৷”
ডা. মোজাহেরুল হক আরও বলেন, ‘‘ঢাকার জলশয়, খাল ময়লা দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে৷ ড্রেন, নর্দমা অপরিষ্কার৷ সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে৷ পানির চলাচল রাখতে হবে৷ আর মশা নিধনে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, তা ল্যাবরেটরিতে এবং ফিল্ড লেভেলে পরীক্ষা করে ব্যবহার করা দরকার৷”
অধ্যাপক কবিরুল বাশারের কথায়, “ড্রেন ও নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার না করার ফলে মশা বেড়েছে৷ অনেক জলাশয়ে প্রচুর কচুরিপানা৷ এসব কচুরিপানায় মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে৷ সিটি কপোরেশনের উচিত এখনই ড্রেন ও খালের লার্ভা ধ্বংস করতে গাপ্পি মাছ ছেড়ে দেওয়া৷ গাপ্পি মাছ ময়লা পানিতেও ভালো থাকে এবং মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে৷’’
দরকার আগাম প্রস্তুতি
মশার প্রাদুর্ভাব শুরু হলেই সিটি করপোরেশনের হাঁকডাক শুরু হয়ে যায়৷ তারা নানা কথা বলে, পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে৷ মশা মারতে ড্রোন, রোড শো, পরিচ্ছন্নতা ও মশককর্মীদের শরীরে অত্যাধুনিক বডি ক্যামেরার সংযোজন, হাঁস, পাখি, গাছ ও মাছের ব্যবহার করে চমক দেখায়, কিন্তু মশা কমে না৷ এখন কিউলেক্স-এর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে৷
কমিউনিটি মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, “মশার কারণে এখন সারা বছরই ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়৷ তাই মশা নিধনের কাজ সারা বছরই করতে হবে৷ আমরা কাজ ছাড়া আর কোনো কথা শুনতে চাই না৷”
ডা. লেনিন চৌধুরীর কথায়, ‘‘মশা নিধনের তিনটি উপায়৷ পরিবেশগত, রাসায়নিক ও বায়োলজিক্যাল৷ এই তিনটি প্রক্রিয়া সব সময় কাজে লাগাতে হবে৷ আমরা দেখছি মশা মারার ওষুধে মশা মরে না৷ তাই ল্যাবরেটরিতে যে রাসায়নিকে মশা মরছে সেটা বাস্তবে ব্যবহার করা হয় কী না তা দেখা দরকার৷’’
এই কিউলেক্স মৌসুম শেষ হলে আবার ডেঙ্গু মৌসুম শুরু হবে৷ গত বছর সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তিন লাখ ২১ হাজার৷ এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার৷ গত বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন এক হাজার ৭০৫ জন, যার মধ্যে ৯৮০ জনই ঢাকায় মারা গেছেন৷
ঢাকার দুই সিটির মধ্যে উত্তর সিটিতে সম্প্রতি একজন কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে৷ তিনি অবশ্য এখনও মশার ব্যাপারে কিছু জানেন না৷ সোমবার তার কাছে মশার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এ বিষয়ে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানেন৷” আর দক্ষিণে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই৷
কবিরুল বাশার মনে করেন, “তাদের কীটতত্ত্ববিদ থাকা দরকার এবং মশা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করা প্রয়োজন৷”
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নির্মল কুমার দত্ত বলেন, “সিটি করপোরেশন মাঝে মাঝে সহায়তা চায়৷ আমরা তখন আমাদের এক্সপার্টদের পাঠাই৷ তবে মশার ব্যাপারে আমাদের ভালো এক্সপার্ট নেই৷”