তিন ঘণ্টায় ‘উদঘাটন’ এইচএসসি পরীক্ষার্থী হত্যার লোমহর্ষক কাহিনি
চেম্বারের দরজা খুলেই আঁতকে ওঠেন চিকিৎসক মোহাম্মদ শাহাবুল হক। তাঁর ডেন্টাল চেম্বারের মেঝে ভেসে গেছে রক্তে। নিথর পড়ে রয়েছে তাঁর চেম্বারে সহকারী হিসেবে থাকা মাইনুল মীরের দেহ। সেই দরজা খোলার পর্ব থেকেই যেন ঝাঁপি খোলার মতো মাত্র তিন ঘণ্টার ব্যবধানে পুলিশ বের করেছে শ্বাসরুদ্ধকর-লোমহর্ষক এক হত্যাকাণ্ডের রহস্য।
নিহত মাইনুল মীর নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল শহরের দক্ষিণ চরপাড়া গ্রামের মৃত ফেলু মিয়ার ছেলে। স্থানীয় মুসা বিন কলেজ থেকে এবার দিয়েছিলেন এইচএসসি পরীক্ষা। যার ফল ঘোষণা করা হচ্ছে আজ রোববার।
হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে পুলিশ বলছে, মাত্র তিন ঘণ্টার ব্যবধানে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জাল ভেদ করে ঘাতক হিসেবে বেরিয়ে এসেছে নিহত মাইনুলের কথিত সাবেক প্রেমিকার নাম। এরই মধ্যে পুলিশ ইসরাত জাহান মীম (১৯) নামের ওই তরুণীকে আটক করেছে। প্রথমে ভাবলেশহীন থাকলেও পরে তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
মীম ঘোড়াশালের শীলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনিও মুসা বিন কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। একই স্কুল-কলেজে এক সঙ্গে লেখাপড়া করার সুবাদে মাইনুল ও মীমের মধ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ছিল বলে জানা গেছে।
এদিকে, অস্বচ্ছল পরিবারে বড় হওয়ায় এ বয়স থেকেই দুজন কাজে যোগ দেওয়া শুরু করেন। মাইনুল বাড়তি আয়ের জন্য ঘোড়াশাল বাজারে টুথ অফিস নামের একটি ডেন্টাল চেম্বারে সহকারী হিসেবে কাজ নিয়েছিলেন। অন্যদিকে, মীম মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ নেন স্থানীয় একটি ক্লিনিকে।
পুলিশ বলছে, এর আগে মীম এক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক থেকে বিয়েও করেছিলেন। পরে ওই ছেলের সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ হওয়ায় ধীরে ধীরে পুরোনো বন্ধু মাইনুলের সঙ্গে মীমের অন্তরঙ্গতা বাড়তে থাকে।
পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলছেন, ‘ভৈরব থেকে সপ্তাহে দুদিন প্র্যাকটিস করতে ঘোড়াশালে আসতেন ডেন্টাল চিকিৎসক শিহাবুল হক। বাকি সময়গুলোতে ওই চেম্বারের নিয়ন্ত্রণ থাকতো মাইনুলের হাতে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি, চেম্বারটি ছিল মূলত মীম ও মাইনুলের মেলামেশার নিরাপদ স্থান।’
এর মধ্যে গত ৬ ফেব্রুয়ারি মাইনুল প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গোপনে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। তিনিও এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। খবর পেয়ে ওই তরুণীর বাবা, খালু ও ভগ্নিপতি ছুটে যান মাইনুলের বাড়িতে। তাঁরা ওই তরুণীকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি যাননি। এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ডেন্টাল চেম্বারে যাওয়ার কথা বলে নিখোঁজ হন মাইনুল। এ ব্যাপারে তাঁর স্ত্রী থানায় গিয়ে স্বামীর নিখোঁজের বিষয়ে বাবা, খালু ও ভগ্নিপতির দিকে সন্দেহের আঙুল তুলে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর শুরু হয় তদন্ত। তবে এ পর্যায়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ক্লু না পেয়ে পুলিশ সহযোগিতা নেয় তথ্যপ্রযুক্তির। ফোনের বিস্তারিত ঘেঁটে পুলিশ জানতে পারে, নিখোঁজ হওয়ার আগে সর্বশেষ মাইনুলের সঙ্গে কথা হয় মীমের। ওই কথোপকথনের পর থেকেই বন্ধ হয় মাইনুলের মোবাইল ফোন।
তবে মাইনুল যে ডেন্টাল চেম্বারে সহকারী হিসেবে কাজ করতেন, সেটি বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকায় ধন্দে পড়ে যান তাঁর স্বজন এবং তদন্তকারীরা। এর মধ্যে গতকাল শনিবার বিকেল ৩টার দিকে ভৈরব থেকে নিজের চেম্বারে গিয়ে তালা খোলার পর চোখ কপালে ওঠে চিকিৎসক শাহাবুল হকের। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করলে ছুটে যায় পুলিশ। খোঁজ মেলে মাইনুলের।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী আশরাফুল আজিম জানান, তদন্তে থাকা পুলিশ সদস্যেরা ওই বাজারের আশপাশের সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারেন, মাইনুল নিখোঁজের আগে মীমের সঙ্গে ওই চেম্বারে ঢুকেছিলেন। এরপরই সন্দেহের আঙুল যায় মীমের দিকে। অভিযান চালিয়ে এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে আটক করা হয় মীমকে। তবে তাঁর বয়ানে আরেক দফা ধন্দে পড়ে যান তদন্তকারীরা। এরপর বেশ কিছু আলামত এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখানোর পর ধীরে ধীরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার ব্যাপারে স্বীকার করেন মীম।
পুলিশের দাবি, ‘জিজ্ঞাসাবাদে মীম বলেছেন, গোপনে বিয়ে এবং স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার পর ক্রমেই মাইনুলের প্রতি তাঁর নির্ভরতা বেড়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার সকালে দুজনের দেখা হয় ঘোড়াশাল বাজারে। মাইনুল মীমকে জানিয়ে দেন, তিনি সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। এখন আগের মতো আর মেলামেশা করা সম্ভব নয়। এর দলে ক্রোধে জ্বলে ওঠেন মীম। এরপর বিকেলে দেখা করার কথা বলেন। এর মধ্যে স্থানীয় একটি ফার্মেসি থেকে চেতনানাশক ইনজেকশন কিনে ব্যাগে নিয়ে চলে যান চেম্বারে। সেখানে মাইনুলের বিয়ের প্রসঙ্গটি তুলে শুরু হয় দুজনের ঝগড়া। একপর্যায়ে মাইনুল নীরবতা অবলম্বন করলে মীম পেছন থেকে তাঁর ঘাড়ে চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করে দেন। মাইনুল দ্রুত বাথরুমে ঢুকে মুখ ধুয়ে বের হতে না হতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
এরপর চেম্বারে থাকা ছুরি দিয়ে মাইনুলের ঘাড়ে একের পর এক আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করেন মীম। এক পর্যায়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে বেসিনে হাত মুখ ধোওয়ার পর মাইনুলের মোবাইল নিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যান মীম। ফেরার পথে চেম্বারের চাবি একটি ড্রেনে এবং মাইনুলের মোবাইলটি পেছনের শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেন তিনি।
নরসিংদীর এসপি কাজী আশরাফুল আলম বলছেন, মাত্র তিন ঘণ্টার ব্যবধানে পুলিশ মাইনুলের নিখোঁজ এবং হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে এবং প্রকৃত অপরাধীকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি জানান, এইচএসসির শিক্ষার্থীর এত নিপুণভাবে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া এবং জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে ভাবলেশহীনভাবে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করা হার মানিয়েছে পেশাদার খুনির আচরণকেও।
এসপি জানান, শনিবার রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের বেশ কিছু আলামত সংগ্রহের জন্য মীমকে নিয়ে অভিযান চালানো হয়েছে।